আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন পর্ব ৭

0
335
  • আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন
    .
    ৭ম পর্ব
    .
    এলাকায় পুলিশের যাতায়াত বেড়েছে।
    ইমরাজ চেয়ারম্যানের খুবই ব্যস্ত দিনকাল যাচ্ছে। পুলিশের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা তাকেই করতে হয়। কিছু সংখ্যক মানুষ আড়ালে-আবডালে নানান কথা রটাচ্ছে। অথচ চেয়ারম্যানকে পুলিশের সঙ্গে নারায়ণ মাস্টারের প্রশংসা করতে দেখা যায়।

    — ‘আহা, নারায়ণ মাস্টারের জন্য বড় কষ্ট হয় দারোগা সাহেব। লোকটি বড় ভালো ছিল। এলাকায় ফ্রী চিকিৎসা দিত। বাচ্চাদের বিনা টাকায় টিউশনি পড়াইত। কি যে হইল মাস্টার সাবের আল্লাহ পাক জানেন।’

    নারায়ণ মাস্টার এবং ইমাম সাহেব একই রাতে গুম হওয়ার কোনো যোগসুত্রই খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ। উঠোনে রক্ত দেখে প্রাথমিক ধারণা করা হচ্ছে মাস্টারকে হত্যা করে লাশ সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

    ক’দিন থেকে অন্তরার দম ফেলবার ফুরসত নেই। বাড়িতে নানান লোকজন আসা-যাওয়া করছে তাদেরকে নাস্তা দিতে হয়। রাতেও তাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হচ্ছে। বৈঠক খানায় চোরের মতো কিছু লোক এসে ফুসুরফাসুর করে তাদেরকেও চা দিতে হয়।

    সেদিনের পর থেকে সায়মা লজ্জায় আর স্যারের কাছে পড়তে যাচ্ছে না। বিকেলে বক্কর আলী বলেছিল,

    — ‘সায়মা মাস্টার সাব বলে দিছেন তুমি আজ সন্ধ্যায় পড়তে যেতে।’

    তাই সায়মা আজ যাচ্ছে। সে দরজা খুলে চেয়ারে গিয়ে চুপচাপ বসে রইল।

    জিসানের পুরোপুরি স্বাভাবিক আচরণ।

    — ‘হ্যাঁ বই বের করো, কেমন আছো?’

    — ‘ভালো আছি স্যার।’

    বেশকিছু সময় পাঠ্যপুস্তক নিয়েই কেটে যাওয়ার পর জিসান জিজ্ঞেস করল,

    — ‘মাস্টার আর ইমাম সাহেবের কি কোনো আপডেট খবর পাওয়া গেছে?’

    — ‘শুধু পুলিশ আসা-যাওয়া করে দেখি। আমি এগুলো বুঝি না স্যার। কিন্তু ভয় ভয় লাগে।’

    — ‘ভয় লাগারই কথা। গ্রামগঞ্জে মানুষ খুব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে যা ভয়ানক কান্ড করে দেখলাম। পরশু হাঁটতে বের হয়েছিলাম। বক্কর ভাই বলল কালাগঞ্জ না-কি কালা পীরের মাজার আছে। পীরের নামেই গ্রামের নামকরণ। ভাবলাম গিয়ে দেখে আসি। অথচ রাস্তা থেকে ফিরে আসতে হল৷ মেইন রাস্তার দুই পাশে রক্তারক্তি কান্ড হচ্ছে দুই গোষ্ঠীতে। সুপারি গাছের চোকানো ফলা দিয়ে আমার চোখের সামনে ঘাঁ মেরে দিল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোল। লোকটি পড়ে গেল রাস্তায়। তারপর সবাই মিলে এলোপাথাড়ি বাড়ি দিতে থাকল। আহত লোকটির গোষ্ঠীর মানুষ আসল ধেয়ে। আমার চোখের চোখের সামনেই শুরু হল সরাসরি সংঘর্ষ। একদল আরেকদলের মাথা ফাটাচ্ছে। আমার অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা। শরীরে কাঁপন শুরু হল। সেখান থেকেই বক্কর ভাইকে নিয়ে ফিরে আসলাম। বক্কর ভাই লোকজনকে জিজ্ঞেস করে যতদূর জানল এই মারামারির কারণ হচ্ছে একজনের গরু দড়ি ছিঁড়ে ধানক্ষেতে চলে গেছে। মালিক দৌড়ে এসে আচ্ছা মাইর দিল গরুকে। গরুর মালিক এসে বলল,
    –‘তোর বাপের খমতা থাখলে আমার সামনে আরখবার গিয়া মার গরুরে।’

    দ্বিতীয় লোকটি গরুকে না মেরে মালিকের মাথা ফাটিয়ে দিল। পর্যায়ক্রমে দুই গোষ্ঠীর রক্তারক্তি সংঘর্ষ। যারা সালিশ করতে গিয়েছিল তারাও না-কি মাইর খেয়ে আহত। এসব এলাকায় মাইর হলে পুলিশও না-কি কোনোদিন আসে না। কি ভয়ংকর ব্যাপার।’

    — ‘হ্যাঁ স্যার, দাদিমার কাছে গল্প শুনেছিলাম আগে আরও বেশি মারামারি হতো।’

    — ‘হ্যাঁ বক্কর ভাইয়ের কাছে সব শুনেছি৷ গ্রামের মানুষ না-কি ছেলে সন্তান জন্ম দিয়ে বলে একটা লাঠি বাড়লো। গোষ্ঠীর মানুষ দেখতে এসে অবুঝ শিশুকে কোলে নিয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে,

    -‘অমুকের মতো বেটা অইবা, মাইরে গেলে পিছপা হওয়া যাইত নায়। মাইর দিয়ে আসবা খেয়ে আসবা না। ফরে যা অয় আমরা দেখমু।’

    যতদূর বুঝলাম মাইরে জেতা তাদের একটা বংশীয় ঐতিহ্য, গৌরবের ব্যাপার। প্রতিটি বাড়িতে না-কি হস্ত তৈরী নানান অস্র থাকে। তুচ্ছ ব্যাপারে গোষ্ঠীর ছেলে বুড়ো মিলে মারামারির শলাপরামর্শ হয়।
    যেসব শিক্ষিত ছেলেরা মারামারি বিমুখ। এসব ব্যাপারে খানিকটা উদাসীন। তাদেরকে পুরুষই মনে করা হয় না। মানে ব্যাপারগুলো মানুষ নানাভাবে মহিমান্বিত করে ফেলেছে।’

    — ‘হ্যাঁ স্যার।’

    — ‘সবাই ক্ষমতা দেখাতে ব্যস্ত৷ কবজির জোরে সবকিছু চালাতে চায়। এগুলোকে তুমি কীভাবে দেখ?’

    — ‘খারাপভাবে দেখি স্যার।’

    — ‘কেমন অসভ্য জংলী জানোয়ার লাগে এসব মানুষদের তাই না?’

    — ‘হ্যাঁ স্যার, এসব পরিবারের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে আমি মিশিও না।’

    — ‘ওরা খারাপ বলে যে মিশছ না তা কিন্তু না। হতে পারে তুমি বড়লোকের মেয়ে তাই অহংকার থেকে মিশ না।’

    সায়মা মুচকি হেঁসে বলল,

    –‘এহ, আমার এতো অহংকার নাই।’

    জিসান খানিক গম্ভীরভাবে বলল,

    –‘কোথাও পড়েছিলাম, ‘আমি পৃথিবীর সব খারাপ মানুষকে ত্যাগ করতে পারি কিন্ত নিজেকে পারি না।’

    — ‘বুঝি নি স্যার।’

    — ‘মানে আমরা অনেক খারাপ মানুষকে এড়িয়ে চলি কিংবা ত্যাগ করি কিন্তু নিজের ভেতরের খারাপকে ত্যাগ করি না এড়িয়ে চলি না। যেমন তুমি।’

    ধুপ করে নিভে গেল সায়মার হাস্যজ্বল চেহারা।

    — ‘মানে?’

    — ‘মানে গ্রামের অই জংলী জানোয়ার মূর্খদের আপডেট ভার্সন তুমি নিজেও। তুমি পড়ালেখা করেও নিজের আপন চাচাতো বোনকে কাজের মেয়ে বল। বড় বোন হওয়ার পরও অসহায় একটি মেয়ের গায়ে হাত তুলতে বুক কাপে না। গ্রামের অই লোকদের যেমন তোমার কাছে জঘন্য জংলী জানোয়ার লাগে। আমার কাছে তোমাকে লেগেছে সেদিন।’

    সায়মা লজ্জায় অপমানে মাথা দুই হাতে মুখ ঢেকে মাথা নুইয়ে ফেলল। শরীর কেঁপে কেঁপে উঠল কান্নায়। এই মুহূর্তে তার মরে যেতে ইচ্ছা করছে।

    — ‘এসব কথা বলার আমার কোনো অধিকার নেই সায়মা। তবুও তুমি ছাত্রী হিসেবে বলছি। শোন, তুমি যদি সত্যিই স্রষ্টায় বিশ্বাস করো। যদি বিশ্বাস করো উপরে একজন সবার জীবনের পান্ডুলিপি লিখে রেখেছেন। তাহলে একবার ভেবে দেখ তোমার জীবনটা যদি অন্যভাবে লিখে ফেলতেন? সুতরাং অধীনস্থদের প্রতি আমাদের সকলের সংবেদনশীল হওয়া অত্যন্ত জরুরী সায়মা।’

    — ‘সরি স্যার।’ কাঁপা গলায় বলল সায়মা। সে মুখ ঢেকে টেবিলে মাথা রেখে কেঁপে কেঁপে উঠছে। মাটি ফাঁক হয় না কেন? চুপচাপ ঢুকে পড়তে ইচ্ছে করছে।

    — ‘আমাকে সরি বলে লাভ নাই। তবে তুমি একটা সাহায্য করলে খুশি হব।’

    মাথা তুলে তাকাল সায়মা। চোখ মুছে বলল,

    –‘কি?’

    আমি চাই অন্তরাকে পড়াতে। মানে কমপক্ষে অক্ষর জ্ঞান দিতে। বাংলা ইংলিশ কেবল রিডিং পড়া এবং লেখা শিখুক। তোমার সঙ্গেই আসতে পারে অথবা ফজরের বাদে।

    — ‘আমি জানি না স্যার। আব্বা জানেন এসব।’

    — ‘আমার ধারণা তুমি ভালোভাবে চাইলেই তোমার আব্বুও মানবেন। তুমি যদি আমার কাছে এসে পড়তে পারো অন্তরাকে বাঁধা দেওয়ার কোনো কারণ দেখছি না। ফজরের পর প্রতি শুক্রবারে সে কোরআন তেলাওয়াত করে। তারমানে তখন তার কাজ থাকে না। শুক্রবার ছাড়া বাকী ছয়দিন আমার কাছে আসবে। আমি আহমদপুর বাজার থেকে চক-স্লেট আনব।’

    — ‘আমাকে কি করতে হবে?’

    — ‘তোমার আব্বুকে বলবে, ‘কাল থেকে ফজরের বাদে অন্তরাকে পড়তে পাঠাব।’

    — ‘আমার কথা বলব কেন?’

    — ‘এমনিই বলবে। মানুষ হুদাই কত কিছু করে।’

    — ‘হুদাই মানুষ কি করে?’

    — ‘অই ধরো এখন তুমি হুদাই কলম কামড়াচ্ছ৷ হুদাই মানুষ রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় আনমনে ড্রিংকসের বোতলকে লাত্থি মারে। অনেকে হুদাই কোথাও বসে ধ্যান ধরে একস্থানে অনেক্ক্ষণ তাকিয়ে থাকে। প্রতিদিন আমরা এরকম অসংখ্য হুদাহুদি কাজ করি।’

    সায়মা মুখ থেকে কলম সরিয়ে ফিক করে হেঁসে ফেলল, তারপর বলল,
    — ‘যেমন আপনি প্রতিদিন হুদাই ছাদের এমাথা থেকে ওমাথায় পায়চারী করেন।’

    সায়মার কথা শুনে জিসান হেঁসে বলল

    — ‘আমি হুদাই পায়চারী করি না। তোমাদের এখানে কারেন্ট নাই। যা গরম লাগে। তাই ছাদে হাঁটাহাঁটি করি।’

    — ‘ওমা হাতপাখা আছে না।’

    — ‘ওবাবা হাতপাখা কিছুক্ষণ ঘুরালে হাত ব্যথা করে।’

    ‘ওবাবা’ শুনে সায়মা প্রথমে ফিক করে হেঁসে ফেলল। খানিক বাদেই বুকটা বেদনায় হু হু করে উঠলো।
    ইশ মানুষটার কত কষ্ট হচ্ছে৷ দিনে না হয় সে বাতাস করতে পারবে। রাতে কি হবে? রাতে এই গরমে ঘুমাতে না জানি কত কষ্ট হয় মানুষটার।
    …চলবে..
    লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here