আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন
( ১ম পর্ব )
.
গলায় শাণিত ছুরি দিয়ে আলতো টান দিতেই গলগল করে গরম রক্ত বেরুলো।
ঠিক তখনই কুশিয়ারা নদী থেকে ভেসে এলো লঞ্চের আগমনী ডাক। পাশ থেকে বক্কর আলী তাড়া দিয়ে বলল,
– ‘সকাল করো লঞ্চ আইচ্ছে।’
লোকটি দ্রুত দু’টা ট্যাং কেটে ব্যাগে ভরে বক্কর আলীর হাতে দিল।
– ‘হাটইন মাস্টার সাব।’
জিসান নাক চেপে ধরে হাঁটছে। অসহ্যকর গন্ধ। এমনিতেই তার মাথা ব্যথা এলে জগৎ-সংসারের সর্ববিষয়ে বিরক্তি চলে আসে। এই জঘন্য গন্ধকে কি নামে ডাকা যায়? ভোঁটকা গন্ধ? অবশ্যই না, সে ঠিক ধরতে পারছে না। ক’দিন থেকে নিজের অজানা বিষয়গুলো পদে পদে চিহ্নিত করার খেলায় মেতেছে সে। অসংখ্য বিষয়ে নিজেকে আনাড়ি আবিষ্কার করে এখন হতাশ। গলির দু’পাশে পোল্ট্রি মুরগি আর শুঁটকির দোকান। রাস্তার যেখানে-সেখানে জমে আছে নোংরা জল।
বক্কর আলী আরেকটা গলির দিকে মোড় নিয়ে বলল,
— ‘চলোক্কা মাস্টার সাব। মাছের আরদও ঝাইমু।’
মাছের আরদ থেকে গিজগিজ করা মানুষের হাঁক-ডাক ভেসে আসছে। চারদিকে মাছি ভনভন করছে। জিসানের মেজাজ বিগড়ে যাবার জোগাড়। লোকটি আর বাজার করার সময় পেল না বুঝি! তাকে সঙ্গে নিয়েই কি করতে হবে? আসমান থেকে তো ওহী নাযিল করে বলা হয়নি বক্কর তুমি এই মাথা ব্যথায় কাহিল লোকটিকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে বাজারের সমস্ত কার্য সম্পাদন করিতে হইবে। নচেৎ রোজ কেয়ামতে পুলসিরাতের পুল তুমি পাড়ি দিতে পারিবে না।
– ‘গোয়া খাইবায়নি মাস্টার সাব?’
জিসান ভুরু কুঁচকে বলল,
-‘হোয়াট! গোয়া খাব মানে?’
– ‘ও আপনে মনে হয় ইতা খাইন না। শিক্ষিত মাইনষে হুনছি গোয়া খায় না।’
বক্কর আলী খানিক এগিয়ে পাশের টং দোকানটিতে বলল,
— ‘গোয়া দেওবা।’
পান মুখে পুরে তর্জনীর আগায় অল্প চুন নিয়ে বক্কর আলী হাঁটা শুরু করে। কিছুক্ষণ পর পর সে আয়েশ করে জিভের আগায় অল্প করে চুন নিচ্ছে৷ ‘ফুরুত’ করে পাশের ড্রেইনে পানের রস ফেলছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে পানের চেয়ে মজাদার খাদ্য এই সংসারে দ্বিতীয়টি আর নেই।
জিসান এবার বুঝতে পারে লোকটি সুপারিকে বলেছিল ‘গোয়া’। কিন্তু বক্কর আলীর পরিচয় এখনও জিজ্ঞেস করা হয়নি। পরনে লুঙ্গির সঙ্গে ছাঁই রঙের পাঞ্জাবি। মাথার মাঝখানে টুপি৷ হাতে কালো ইদ্রিস ছাতা। লজিং বাড়ির গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি কি-না ঠিক বুঝতে পারছে না জিসান। তাকে কেবল বলা হয়েছে শেরপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে লজিং বাড়ির কেউ তাকে রিসিভ করতে আসবে। গ্রামের একটি নতুন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি শিক্ষক প্রয়োজন। সে গেলেই চাকুরিতে জয়েন করতে পারবে।
জিসান টং দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
–‘বক্কর সাহেব, আপনি আরদ থেকে কাজ সেরে আসুন আমি এখানেই আছি।’
— ‘আচ্ছা থাকইন আপনে। আমি গিয়া ছপ্পারি আইরাম।’
কাজ শেষে দু’জন লঞ্চঘাটের দিকে হাঁটে। পাশের চা’র হোটেল থেকে ভেসে আসছে নায়ক মান্নার ডায়লগের সঙ্গে মারামারির ‘ডিসুম ডিসুম’ আওয়াজ। ছেলে-বুড়োরা মাথা তুলে তাকিয়ে আছে টিভির পর্দায়।
বামদিকের সেলুনের দোকানে চলছে, -‘খায়রুন লো তোর লাম্বা মাথার কেশ,
চিরল দাঁতে হাসি দিয়া
পাগল করলি দেশ খায়রুন লো।’
লঞ্চ কাউন্টারের গায়ে ভাড়ার তালিকা সাঁটা।
লাইনে অপেক্ষা করে টিকিট কেটে বক্কর আলী আর জিসান লঞ্চমুখো। সেখানেও লাইন। লঞ্চ থেকে দু’টা কাঠের সিঁড়ি নেমেছে। একটি দিয়ে লোকজন নামছে আরেকটি দিয়ে উঠছে।
জিসানের প্রথম লঞ্চ জার্নি তাই সবকিছু বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখছে সে। নানান বর্ণের নানান পেশার মানুষে লঞ্চঘাট একাকার। তার সামনে ছাত্র গোছের একজন সাইকেল ঠেলে ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। সাধারণ মানুষজন শহর থেকে মাস খানেকের বাজার-সদাই নিয়ে যাচ্ছে। ভাটি অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা যাচ্ছে তাদের ব্যবসার মালামাল নিয়ে।
ঘণ্টি বাজাতেই নীচে ড্রাইভার ইঞ্জিন চালু করলেন। নদীর বুকে কাঁপন ধরিয়ে চালু হল ইঞ্জিন। টেনে তোলা হল কাঠের দু’টা পাটাতন। নিষ্ঠুর লঞ্চ কুশিয়ারার বুক ছিঁড়ে ফালাফালা করে এগুতে থাকে।
এক কোণে খাবারের দোকান। রয়েছে পান সিগারেটের বন্দোবস্তও। ইতোমধ্যে ভ্রাম্যমাণ দোকানীরাও ভদ্রলোকদের ধার ঘুরে নাকিসুরে টেনে টেনে বলতে শুরু করেছে,
-‘এই বরিশালী আমরা লাগবেএএএ, বরিশালী আমরাআআ।’
কেউ বলছে,
-‘এই বরই আচার লাগবেএএএএ, বরই আচারআয়ায়ার।’
জিসান সবকিছু মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছে।
লঞ্চের উপরে কেবিন সিস্টেম। সেখানে ভদ্রমহিলা এবং সাহেব গোছের লোকজন গম্ভীর মুখে বসে আছেন।
লঞ্চের দু’পাশে কাঠের রেলিং। মাঝখানে যাত্রীরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে।
চাচী-খালারা ইতোমধ্যে পরিচয় বিধির বই খুলে বসেছেন। পরিচয় পর্ব শেষ হলেই আরাম করে পা তুলে বসবেন। তারপর বাটার পান ভাগাভাগি করে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিবেন।
জিসান এক সঙ্গে মুগ্ধ এবং বিস্মিত। দুই হাজার এগারো সালে এসেও লঞ্চে যাতায়াত কিংবা এমন মানুষ এমন পরিবেশ তার ধারণাতেই ছিল না।
এদিকে বক্কর আলী সাহেব একঝাঁক মানুষের সঙ্গে হাঁটা-চলার ময়লা জায়গাতেই বসে পড়েছেন। তাদের মধ্যমণি সেজে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভঙ্গিতে কথাও বলছেন৷
জিসান একা সিঁড়ি বেয়ে উপরে এসে দাঁড়ায়। নিমিষেই ফুরফুরে বিশুদ্ধ শীতল বাতাসে তার দেহ-মন ভিজিয়ে দিয়ে গেল। দূরের গ্রামগুলি যেন সবুজ অরণ্যে ঘেরা। নদীর পাড়ের খোলা মাঠে রাখালরা গরু রাখছে। অন্যদিকে কৃষকরা গরুর পাছায় চোকা লাঠির গুঁতো দিয়ে অদ্ভুত শব্দে ‘থেতেত থেতেত, টুরুরু টুরুরু’ করে জমি হাল দিচ্ছেন। সামনে একটি ঘাটে লঞ্চ থামাল। পাটাতন নামিয়ে দিয়েছে। একদল নামছে আরেকদল উঠছে। একজন চা বিক্রেতাকেও দেখা যাচ্ছে। সে ছাদ থেকে চুটকি বাজিয়ে হাঁক ছাড়ে। চা ওয়ালা উপরে এসে তাকে চা দেয়। লঞ্চের মাথায় বসা বক্কর আলীর দলকেও চা দিতে দেখিয়ে দিল জিসান। মনটা কেমন যেন হালকা, কোমল, পবিত্র হয়ে গেছে। চায়ে চুমুক দিয়ে তাকাল নদীর দিকে। এদিক-সেদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছোপ ছোপ পানায় সাদা ধবধবে বগ বসে আছে পুঁটিমাছের অপেক্ষায়৷ পানির সামান্য উপর দিয়ে একঝাঁক পাখিও উড়ে গেল।
সন্ধ্যা নামার আগমনী ঘণ্টি বাজতেই যেন সূর্য তার অপূর্ব রঙের খেলা মানুষকে দেখিয়ে অমর থাকার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একের পর এক রূপ পাল্টাচ্ছে সে।
পশ্চিম আকাশে সূর্যের
লাল আভায় অপূর্ব রক্তিম রঙ। বিচ্ছুরিত লাল আভা নদীর টলটলে পানিতে পিছলে পড়ে মোহনীয় সৌন্দর্যে পরিণত হয়েছে। সবকিছু যেন অপার্থিব। এ যেন ভিন্ন এক জগত। দেহ মন পবিত্র করার জগত।
আচমকা ফোনটি বেজে উঠলো। রিসিভ করার পর ওপাশ থেকে বলল,
– ‘আশেপাশে কেউ আছে?’
– ‘না, বল।’
– ‘এখন আছিস কোথায়?’
– ‘লঞ্চে।’
-‘আচ্ছা শোন। তোকে আগে ইচ্ছে করেই বলিনি। তুই একটি মাদ্রাসায় ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে যাচ্ছিস। জানি মানিয়ে নিতে কষ্ট হবে। তবুও অসম্ভব কিছু না।’
– ‘হোয়াট! মাদ্রাসার শিক্ষক মানে? আমি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করাব? তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে?’
– ‘আরে গরু। নিজের পরিচয় গোপন রেখে থাকবি। তোর নাম তো সার্টিফিকেটে মোহাম্মদ জিসান আহমেদ। সুতরাং সমস্যা হবে না। তাছাড়া তোর জন্য শহরে এখন জীবনের ঝুঁকি আছে৷ কুপিয়ে মারার জন্য ওঁৎ পাতা লোকের অভাব নাই। অজপাড়া গাঁয়ে থাকা উত্তম। আচ্ছা রাখছি এখন।’
– ‘হ্যালো, হ্যালো…।
ফোনটি কেটে গেল। চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। আকাশেও বোধহয় মেঘ জমেছে। বৃষ্টি আসতে পারে। লঞ্চের বাতি জ্বেলে দিয়েছে। একটা সিগারেট খেয়ে নিচে চলে যেতে হবে। কিন্তু সিগারেট ধরাতে গিয়ে পড়লো বিড়ম্বনায়। শা শা করে প্রবল বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টির ফোঁটা পড়া শুরু হয়েছে। সিগারেট প্যাকেটে রেখে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগল। ওমনি কাছাকাছি শুনতে পেল আরেকটি লঞ্চের ডাক। ঢেউয়ে পুরো লঞ্চ কেঁপে উঠল। সঙ্গে কেঁপে উঠল জিসানের বুক।
-চলবে– ( সিলেটি ভাষা কেবল প্রথম কয়েকটি পর্বে আছে, ধৈর্য নিয়ে পড়তে থাকুন)
লেখা: MD Jobrul Islam