আলোছায়া পর্ব-১৬

0
1712

#আলোছায়া
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১৬

জুনায়েদ তাড়াতাড়ি নীলুকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটলো। গাড়ি চলছে মেয়েটা অচেতন হয়ে আছে।জুনায়েদের ওকে এক হাতে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রেখে ড্রাইভ করছে। রাস্তা যেনো আজ কিছুতেই ফুরাতে চাইছে না। জুনায়েদের ওকে নিয়ে নাজেহাল অবস্থা। নীলুর চুলগুলো এলোমেলো হয়ে মুখের উপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দীর্ঘ রাস্তা, শেষপর্যন্ত সমাপ্তি ঘটিয়ে ওরা হাসপাতালে পৌঁছে গেলো। জুনায়েদ একটা প্রাইভেট ক্লিনিকের সামনে এসে গাড়ি থামিয়ে নীলুকে কোলে তুলে নিলো। আশেপাশের লোকজন ওর দিকে তাকিয়ে আছে।। ও সেগুলোকে ইগনোর করে ভেতরে যেতেই কয়েকজন এগিয়ে এসে একে সাহায্য করলো। নীলুকে কেবিনে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন অল্প বয়সী ডাক্তার ভেতরে আসলেন। জুনায়েদ ছেলেটাকে চিনে না। এই মূহুর্ত্তে চেনার দরকারও নেই ওর। আগে মেয়েটা সুস্থ হোক তারপর দেখা যাবে। ছেলেটা এসে নীলুরকে চেক করে বলল,

> আপনি একটু বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করুণ। চিন্তা করবেন না আমি দেখছি।

জুনায়েদের এক মূহুর্ত্তের জন‍্যও নীলুর হাত ছাড়তে মন চাইছে না তবুও মলিন মুখে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো। জুনায়েদ দরজার ওপাশে পায়চারি করছে। নীলুর এই হঠাৎ হঠাৎ অসুস্থতা নিয়ে ওকে খুব ভাবাচ্ছে। দশ মিনিটের মাথায় ভেতর থেকে ওকে ডেকে উঠলো। জুনায়েদ হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে গিয়ে দেখলো নীলু বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছে। শুকনো মুখ তবুও ঠোঁটে হাসির ঝিলিক। জুনায়েদ একবার ওর দিকে তাঁকিয়ে এবার ডাক্তারের দিকে নজর দিলো। ডাক্তার ছেলেটা কেমন বিমোহিত ভাবে নীলুকে দেখছে। বিষয়টা ওর কাছে বেশ দৃষ্টিকটু লাগলো তবুও সৌজন্যতার খাতিরে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,

> হাই আমি জুনায়েদ সাইদ, আর রোগী আমার স্ত্রী নীলু।

> আমি ডাক্তার তীব্র মেহেরাজ। এখানে নতুন এসেছি।

> নীলুকে কেমন দেখলেন? কোনো অসুবিধা হবে নাতো?

> চিন্তা করবেন না। শরীর দুর্বল তাই এমন হচ্ছে।
রেস্ট আর টাইম মতো দাওয়া দাওয়া দরকার। আমি কিছু ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি খাওয়াবেন ঠিক হয়ে যাবে।

> অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।

জুনায়েদ লোকটাকে ধন্যবাদ দিয়ে নীলুর পাশে গিয়ে বসলো। ডাক্তার তীব্র এখনো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। জুনায়েদ ভেবে পাচ্ছে না ছেলেটা নীলুকে এভাবে কেনো দেখছে। রোগী দেখার পরেও কি ডাক্তার তার কেবিনে অপেক্ষা করে? ওর জানা মনে তো না তাহলে? ওর ভাবনার অবসান হলো নীলুর কথা শুনে।

> ঘুম পাচ্ছে খুব। বাড়িতে ফিরতে হবে তো?

> শরীর খারাপ ছিল তবুও ক্লাসে যাওয়া কি খুব দরকার? আজ থেকে বাড়িতেই থাকবে। নোট লাগলে আমি আনিয়ে দিবো।

নীলু ওর কথায় উত্তর করলো না। বারবার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। ওকে এভাবে ঢুলতে দেখে পাশ থেকে তীব্র বলল,

> জুনায়েদ সাহেব আমার মনে হচ্ছে মেয়েটা এখানে কিছু সময় থাক। একটু ঘুমিয়ে নিলে শরীর ঠিক লাগবে।

তীব্রর প্রস্তাব ওর পছন্দ হলো না। নীলুকে এখানে রাখা ঠিক হবে না ভেবে তাড়াতাড়ি ওকে আবারও কোলে তুলে নিয়ে বলল,

> বাড়িতে সবাই চিন্তা করবে। আমরা এখন যায় ইনশাআল্লাহ পরে দেখা হবে।

জুনায়েদ তীব্রর উত্তরের অপেক্ষা করলো না। কথা বলতে বলতে বাইরে চলে গেলো। তীব্র সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল।সারা রাস্তা নীলু ঘুমিয়ে থাকল। ওকে পেছনে ছিটে রেখে জুনায়েদ গাড়ি ড্রাইভ করছে আর বারবার পেছন ফিরে দেখছে। ভেবেছিল সামনেই রাখবে কিন্তু মেয়েটা ঠিকঠাক বসতে পারছে না। বসতে অসুবিধা হবে ভেবে পেছনে রাখা। বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে জুনায়েদ ওকে কোলে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। পারভীন বেগম মনোযোগ দিয়ে চায়ের কাপে মুখ ডুবাচ্ছিলেন হঠাৎ ছেলেকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন। চোখেমুখে আতঙ্ক বিরাজ করছে। উনি হন্তদন্ত হয়ে জুনায়েদের পথ আগলে বললেন,

> ওর সঙ্গে তুই কি করেছিস? মেরেছিস তাই না? ওর কিছু হলে কিন্তু তোকে আমি মেরেই ফেলবো। বেয়াদব ছেলে একটা। বল কি করেছিস?

জুনায়েদ এবার খেপে গেলো। মানুষের ভালো করলেও দোষ কথাটা ভেবে ও ধমকে উঠে বলল,

> অনেক কিছুই করেছি সেসব এখন বলতে ইচ্ছে করছে না। সামনে থেকে সরবে নাকি ওকে ফ্লরে ফেলে দিবো?

পারভীন বেগম ভয়ে চুপসে গেলো। ছেলের মেজাজ খারাপ হলে যা বলেছে সত্যিই তাই করে বসবে। মাঝখানে মেয়েটা কষ্ট পাবে। জুনায়েদ উনার দিকে একবার তাঁকিয়ে গটগট করে উপরে চলে আসলো। শুভ্র রুমে ছিল কিছুক্ষণ আগেই ফিরেছে। হঠাৎ বাইরে এমন চেচামেচি শুনে বেরিয়ে আসলো। ওকে দেখে পারভীন বেগম জ্বলে উঠলেন। বড় ছেলেটাকে বলেছিল নীলুকে নিয়ে আসতে কি তেমন কিছুই হয়নি। এই ছেলের কপালে যে বউ টিকবে না এটা উনি বেশ ভালো বুঝেছেন। সারাদিন কাজ কাজ করে পৃথিবী ভূলে যাওয়া ছেলেদের কপালে বউ টিকে না আর যদি টিকেও সেগুলো এলিয়েন টাইপ বউ হয়। উনি রেগেমেগে জুনায়েদর পিছু ধরলেন। শুভ্র কিছু জিঞ্জাসা করতে চাইলো কিন্তু তার আগেই ডলি সব ঘটনা বলে দিলো।

রাতে নীলুর খাওয়া হয়নি। অনেকবার ডাকা হয়েছিল কিন্তু মেয়েটা উঠেনি তাই আর জোর করা হয়নি। জুনায়েদ নিজের রুমে পায়চারি করছে এই মূহুর্তে নীলুকে দেখতে প্রচণ্ড ইচ্ছে করছে। মেয়েটার শরীর বিশেষ ভালো নেই চিন্তা হচ্ছে। কথাগুলো ভেবে ও নীলুর রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। পারভীন বেগম নিজের রুমে ছিলেন হঠাৎ উনার দরজার সামনে দিয়ে জুনায়েদকে এগিয়ে যেতে দেখে উনি দ্রুতগতিতে ওর সামনে গিয়ে বললেন,

> নীলুর সঙ্গে আমি ঘুমাবো তুই রুমে যা।

জুনায়েদ ভ্রু কুচকে ফেলল মায়ের কথা শুনে। তাছাড়া এইসব ওর একটু বেশিই বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে। ওকে এভাবে ভাবতে দেখে উনি আবারও বললেন,

> কি হলো যা।

জুনায়েদের কথা বলতে ইচ্ছে হলো না। ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাকে পাশ কাটিয়ে নীলুর রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। পারভীন বেগম বাকরুদ্ধ ছেলের এমন কাজকর্ম দেখে। শুভ্র কফির মগ হাতে যাওয়া সময় মাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন করলো,

> এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? কোনো সমস্যা?

উনি সবটা বলে হতাশ গলাই বললেন,

> এইটা আমার ছেলে হতেই পারেনা। জন্মের সময় হাসপাতালে চেঞ্জ হয়ে গিয়েছিল কি খোঁজ নিতে হবে।

শুভ্র মায়ের কথার শব্দ করে হেসে ফেলল। ওর হাসি দেখে পারভীন বেগম ধমক দিলেন তবুও ও শুনলো না। বহুকষ্টে হাসি থামিয়ে বলল,

> এসব কেনো করছো? নীলুকে ও ভালো রাখবে। ভূল করে একটা কাজ করে ফেলেছে সেসব ধরে বসে থাকলে চলবে? ওদেরকে ভালো থাকতে দাও আর নিজেরাও ভালো থাকো। ওদের সঙ্গে ঝামেলা করবে না ওরা যেমন ইচ্ছে থাক।

পারভীন বেগম ছেলের কথায় কোনো উত্তর করলেন না। রুমে চলে গেলেন।

নীলু সদ‍্য ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। চোখমুখ ফুলে গেছে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে জানা নেই। ও চোখ খুলে বসতেই জুনায়েদের মুখটা দেখতে পেলো। ছেলেটা সোফায় চোখ বন্ধ করে আছে। ওকে এভাবে দেখে ওর খারাপ লাগলো।এতবড় একটা মানুষের সোফায় ধরছে না দেখে কোনো রকম টলতে টলতে উঠে গিয়ে জুনায়েদের সামনে দাঁড়ালো। হঠাৎ উঠার জন্য মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে। নীলু ওকে ডাকতে গিয়ে নিচু হতেই ঝুল সামলাতে না পেরে হুড়মুড় করে জুনায়েদের উপরে পড়ে গেলো। ছেলেটা চমকে উঠে বসতে চাইলো কিন্তু পারলো না কারণ বুকের উপরে আরেক জনের অস্তিত্ব বিরাজ করছে। জুনায়েদ ভ্রু কুচকে ভালো করে দেখলো নীলু ওর বুকের উপরে। জুনায়েদ বুঝতে পারলো না নীলু বিছানা ছেড়ে এখানে কি করছে। ও ভ্রু কুচকে বলল,

> তুমি এখানে কি করছো?

নীলু হন্তদন্ত হয়ে উঠতে গেলো কিন্তু পারলো না মুখ থুবড়ে আবারও পড়লো। জুনায়েদ ব‍্যাথা পেলো কিন্তু বিষয়টা কি জানার জন্য ওকে থামিয়ে নিজেই ওকে উঠতে সাহায্য করলো। নীলু চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে। জুনায়েদ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। নীলু আস্তে করে বলল,

> সরি আমি আপনাকে ডাকতে গিয়ে পড়ে গেছি। হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে মাথাটা ঘুরছিল।

জুনায়েদ বিষয়টা বুঝতে পেরে বলল,

> ও আচ্ছা। আমি ভেবেছিলাম তোমার হয়তো বিছানায় ঘুম আসছে না। যাইহোক চলো খেতে বসবে। আমার ক্ষুধা পেয়েছে।

নীলু অবাক হয়ে বলল,

> আপনি না খেয়ে আছেন কেনো?

জুনায়েদের সরল স্বীকারোক্তি,

> তোমার জন্য। এক সঙ্গে খেতে চাই।

নীলু আর প্রশ্ন করলো না। উঠে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,

> চলুন।

দুজনে খাবার খেয়ে নিলো।খাওয়া শেষে জুনায়েদ ওকে রেখে নিজের রুমে চলে আসলো। নীলু ওকে আটকালো না।তবে যাওয়া আগে জুনায়েদ ওকে একটা ফোন হাতে ধরিয়ে দিলো। কোনো অসুবিধা হলে ওকে ফোন করতে।

এভাবেই রাত পার হলো। সকালে নীলু ফ্রেস হয়ে ক্লাসের জন্য তৈরী হলো। সবাই ওকে নিষেধ করলো কিন্তু ও শুনলো না। আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে যেতেই হবে। না গেলে হবে না। তবে কথা দিয়েছে আগামীকাল থেকে বাড়িতে থাকবে। জুনায়েদ ওকে চুপচাপ ক্লাসের সামনে নামিয়ে দিয়ে অফিসে চলে গেলো। সারা রাস্তা ওদের কথা হয়নি। অফিসের ঝামেলা মিটিয়ে জুনায়েদ দুপুর পরে ওকে আনতে গেলো কিন্তু রাস্তায় পেলো না। জুনায়েদ ভেতরে গিয়ে খোজখবর নিলো পরিচিত সবাই বলল নীলু ক্লাস শেষ করে বেরিয়েছে। জুনায়েদ বাড়িতে ফোন দিয়ে শুনলো ও বাড়িতে যায়নি। ওর কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো। মেয়েটা গেলো কোথায় কে জানে। ও গেটের আশেপাশের লোকদের জিঞ্জাসা করেও তেমন কিছুই জানতে পারলো না। হঠাৎ একটা আইসক্রিমের দোকানের দিকে ওর নজর গেলো। গেটের সোজাসুজি লোকটা আইসক্রিম বিক্রি করছে। জুনায়েদ লোকটার কাছে এগিয়ে গিয়ে নীলুর ছবি দেখিয়ে জানতে চাইলে লোকটা বলল কিছুক্ষণ আগে একটা মাইক্রেবাসে কিছু লোক ওকে জোর করে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। কথাটা শুনে জুনায়েদের পাগল পাগল অবস্থা। মেয়েটাকে হঠাৎ কে তুলে নিলো? ওকে কোথায় পাওয়া যাবে?

(চলবে)

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।

আসুন নামাজ ও কোরআন পড়ি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here