আষাঢ়ে_প্রেমের_গল্প
নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১৫
— তুমি হচ্ছো একটা তিঁতা করল্লা মেহুলিকা। একটু মিষ্টি করে কথা ও তো বলতে পারো।
— আমার মুখ দিয়ে এত মিষ্টি কথা আসে না। আপনার এত মিষ্টি কথা শুনতে মন চাইলে মিষ্টির দোকানে চলে যান।
— হুহ! তোমাকে বলে আর লাভ নেই মেহুলিকা। চলো, একটা ভালো রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি।
— হুম, কিন্তু বেশি দূরে কোথাও যাবো না।
— আরে, বেশি দূরে না তো;এই সামনেই।
— হুম, তাহলে চলুন।
এরপর একটু হেঁটে আমরা দুজন রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকলাম। বর্ণ রেস্টুরেন্টে ঢুকেই আমাকে; বললেন মেনুকার্ড দেখে অর্ডার দিতে। আমি এবার পড়লাম বিপদে। বর্ণ কী খেতে পছন্দ করেন তাও তো জানি না। আন্দাজে কীই বা অর্ডার দিবো? এইদিকে বর্ন গিয়েছেন হাত ধুঁতে। আমি একটা পাস্তা অর্ডার দিলাম আর বর্ণের জন্য বার্গারের অর্ডার দিলাম।
বর্ণ হাত ধুয়ে এসে আমার সামনে চেয়ার টেনে বসলেন। আমাকে বর্ণ কিছু একটা বলতে নেবেন আর তখনই আমার ফোন বেজে উঠলো। ব্যাগ থেকে ফোন বের দেখি, মনিরা কল দিয়েছে। আমি কল রিসিভ করে বললাম,
— হ্যালো।
— এই এখন কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে মেহুলিকা। বেশি দেরি করিস না আর। তাড়াতাড়ি আমাদের বাসায় চলে আয়। আংকেল কিন্তু আবার তোকে নিতে আসবে আমাদের বাসায়।
— আচ্ছা, আমার আর বেশিক্ষন লাগবে না। আমি আসছি জলদি তুই চিন্তা করিস না।
— হুম জলদি আয়।
এরপর মনিরা কলটা কেটে দিলো। বর্ণের সাথে সময় কাটাতে কাটাতে আমার বাড়ি ফেরার কথা একটু মনে ছিল না। ভাগ্যিস এখন মনিরা মনে করিয়ে দিল। এখন তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে আবার মনিরাদের বাসায় যেতে হবে।
এরপর বর্ণ আর আমি খাওয়া দাওয়া করে বেরিয়ে পড়লাম রেস্টুরেন্ট থেকে। বর্ণ আমাকে মনিরাদের বাসার নিচে নামিয়ে দিলো। এরপর আমি একাই মনিরাদের বাসায় চলে আসলাম। কলিংবেল বাজাতেই মনিরা এসে দরজা খুলে দিলো।
— যাক বাবা তুই এসেছিস তাহলে। আমি যে-ই ভয় পাচ্ছিলাম। কেউ যদি কিছু টের পেতো তাহলে তুই ও শেষ আমিও শেষ।
— হুম এবার ঘরে ঢুকতে দে। সর সামনে থেকে।
— তোর হাতে এটা কীসের প্যাকেট রে দোস্ত?
— এগুলো তোর জন্য। বর্ণ কিনে দিয়েছে তোর জন্য।
— এই হলো দুলাভাইয়ের মতো কাজ। যোগ্য শালীকার যোগ্য দুলাভাই।
— হয়েছে হয়েছে আর দুলাভাইয়ের গুনগান গাইতে হবে না।
— আচ্ছা, দোস্ত তোরা আজকে কী কী করলি রে?
— তোকে বলবো কেন রে?
— আমাকে বলবি না দোস্ত? তুই না কত ভালো একটা মেয়ে?
— পামের শেষ নেই! তেমন কিছুই করিনি আমরা। শুধু ঘোরাঘুরি আর হালকা খাওয়া দাওয়া;ব্যস এটুকুই।
— তুই না আসলেই একটা রসকষহীন মহিলা।
— হুম তাই ভালো। আমার এত রসকষ যুক্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই।
এরপর আব্বা এসে মনিরাদের বাসা থেকে আমাকে নিয়ে গেলেন। সেদিন আর তেমন কিছু হয়নি। শুধু বাসায় আসার পর বর্ণ কল দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে বাসায় ঠিকঠাক এসে পৌঁছতে পেরেছি কি না৷
তিন-চারদিন পরে আমি বেলা বারোটায় রান্নাঘরে এসে দেখি;আজকে কোনো রান্নাবান্না হচ্ছে না রান্নাঘরে। আমি এসেছিলাম কী রান্না করছে আম্মা সেটা দেখতে। আজকে শুক্রবার কলেজে ক্লাস ও নেই আমার। শুক্রবার আমি আর আব্বা দু’জনেই দুপুরে বাসায় থাকি। তাই আম্মা একটু ভালমন্দ রান্না করেন। কিন্তু, আজকে দেখি কোনো রান্নাবান্না হচ্ছেই না। আমার সন্দেহ হলো, আম্মার হয়ত শরীর ভালো না তাই হয়ত;আম্মা আজকে রান্না করেননি। আম্মার রুমে গিয়ে দেখি আব্বা পেপার পড়ছেন। আম্মা বসে বসে টিভি দেখছেন৷ আমি রুমে ঢুকেই আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম,
— আম্মা আজকে রান্না করবে না?
— আজকে আবার দুপুরে রান্না করবো কেন? রাতে রান্না করবো। আজকে তো আমাদের এলাকার কমিউনিটি সেন্টারে; আমাদের একটা বিয়ের দাওয়াত আছে। মনে নেই তোর?
— আম্মা তুমি তো আমাকে কিছু বলোনি।
— বললাম না ওইদিন রাতে? তোর মনে নেই না কি?
— খেয়াল নেই হয়ত। আচ্ছা কার বিয়ের দাওয়াত আম্মা?
— তোর ঘরের বারান্দা দিয়ে যে একটা বাড়ি দেখা যায় না? এর পরের বাড়িটার বাড়ি ওয়ালার ছেলের বিয়ে।
— ওহ,
— হুম, তুই রেডি হয়ে নে জলদি।
— যাচ্ছি আম্মা।
আমি আমার রুমে গিয়ে বারান্দায় গিয়ে খেয়াল করলাম, আমার বারান্দা মুখোমুখি বাড়িটা বর্ণদের। বর্ণদের পাশের বাড়িটাই না কি যাঁর বিয়ে তাদের বাড়ি। আমি যতদূর জানি বর্ণদের পাশের বাড়িটা ওর আংকেলের বাড়ি। তাহলে আজকে যাঁর বিয়ে সে বর্ণের কাজিন। তাহলে এই বিয়েতে তো বর্ণ ও আসবে!
আমি আর আম্মা রেডি হয়ে বসে রইলাম৷ আব্বা নামাজ পড়তে গিয়েছেন। আব্বা নামাজ পড়ে আসলেই আমরা সবাই একসাথে যাবো।
আব্বা বাসার নিচে এসে আম্মাকে ফোন দিয়ে বললেন, আমাকে নিয়ে বাসার নিচে নামতে। এরপর আমি আর আম্মা বাসার গেটে তালা দিয়ে বাসার নিচে চলে গেলাম। আমাদের বাসা থেকে কমিউনিটি সেন্টার বেশি দূরে না। হেঁটে হেঁটেই যাওয়া যায়।
আমরা যখন কমিউনিটি সেন্টারে ঢুকলাম তখন;আব্বাকে ওনার এক পরিচিত লোক ডাক দিলো। আব্বা গিয়ে ওনার সাথে বসলেন। আমি আর আম্মা গিয়ে একটা টেবিলে বসার সাথে সাথেই; আম্মার পরিচিত এক আন্টি এসে আম্মার সাথে গল্প জুড়ে দিলেন। এরপর আস্তে আস্তে খাবার টেবিলে দেওয়া শুরু হলো। আমি আশেপাশে তাকিয়ে শুধু দেখছিলাম যে, বর্ণ আসলে কোথায়?
এরপর আমাদের টেবিলে এসে একজন ওয়েটার সালাদের প্লেট রেখে গেল। এরপর দেখি একটা লোক মাংসের টিকার প্লেট নিয়ে;এলো সবাইকে টিকা সার্ভ করার জন্য। পাশেই তাকিয়ে দেখি বর্ণ! ব্ল্যাক একটা প্যান্ট পড়া। ওয়াইট শার্ট আর একটা কালো রঙের ব্লেজার পড়া। শুধু বর্ণ না আরও অনেকেই বর্ণের মতো সেম ড্রেস পড়া। দেখে মনে হলো এগুলো বর্ণের কাজিনরা। শুধু ড্রেসে না চেহারায় ও হালকা মিল।
আমি বর্ণকে দেখে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। বর্ণ এসে ওয়েটারের থেকে মাংসের টিকার প্লেটটা নিয়ে বললেন,
–আপনি রোস্টের প্লেট নিয়ে আসুন আমি এটা সবাইকে সার্ভ করে দিচ্ছি।
এরপর বর্ণ ঘুরে ঘুরে আমাদের টেবিলে যাঁরা বসা ছিলেন তাদের প্লেটে মাংসের টিকা সার্ভ করলেন। সবার প্লেটে এক পিস করে মাংসের টিকা দিলেও আমার প্লেটে বর্ণ দুই পিস টিকা দিলেন। আম্মা হয়ত খেয়াল করেননি। যদি খেয়াল করতো অবশ্যই এটা নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করতো।
আমি এত লোকজনের সামনে বর্ণকে আর কিছু বলিনি। এরপর অন্যান্য খাবার সার্ভ করার সময় আমার সাথে সেম কাজ করা হলো। আমি প্লেটে অল্প একটু পোলাও নিয়ে মাত্র খাওয়া শুরু করেছি। আর, বর্ণ এসে আরও ৫-৬ চামচ পোলাও আমার প্লেটে দিয়ে দিলেন। শুধু এই টুকুতেই ক্ষান্ত হননি। আম্মার কাছে গিয়েও পোলাওয়ের বাটি নিয়ে বলতে লাগলেন,
— আন্টি আরেকটু পোলাও দেই? আন্টি আর কিছু লাগবে?
মোট কথা আমি খেতে বসে বর্ণের জ্বালাতনে মোটেও শান্তি পাইনি। কখনো মাংস দিচ্ছেন আমার প্লেটে কখনো পোলাও দিচ্ছেন। আবার জর্দা থেকে বেছে বেছে মিষ্টি দিচ্ছেন আমার প্লেটে। আম্মা যদি একবার বুঝে ফেলতো তাহলে আমার খবর হয়ে যেতো। আমি এমনিতেও বেশি খেতে পারি না। তাঁরমধ্যে আবার বিয়ে বাড়ি। এমন অত্যাচার কী সহ্য করা যায়?
আমি কোনো রকমে খেয়ে আম্মাকে বললাম
— আম্মা আমার খাওয়া শেষ হাতটা ধুয়ে আসি?
— একটু দাঁড়া আমিও যাবো এখন। একসাথে যাই দুজনে।
— আম্মা তাহলে তুমি বসো। আমি গেলাম;আমার হাত দেখো ঝোলে ভর্তি। পরে আমার এত সুন্দর জামাটা ঝোল লেগে নষ্ট হয়ে যাবে আম্মা।
— আচ্ছা, তাহলে যা তুই।
আমি হাত ধুতে চলে গেলাম। হাত ধুতে এসেও শান্তি নেই। বর্ণ সেখানেও হাজির। আমার দেখাদেখি উনিও হাতে সাবান মেখে হাত ধুচ্ছেন। এমনিতেও খাবার টেবিলে আমাকে সেই জালিয়েছেন। এখন আবার এসেছেন বিরক্ত করতে।
— তুমি দেখি কিছুই খেতে পারো না। এত এত খাবার দিলাম আর তুমি কত অল্প খেলে।
— আমাকে কী আপনার রাক্ষস মনে হয়?
— আমি সেটা বলিনি।
— যাই বলেন না কেন। আপনার ফ্যামিলি এত কিপ্টা কেন?
— কেন খাবার শর্ট পড়েছে না কি? আমি তো সব ঠিকঠাক রেখে এলাম।
— আপনার ঠিকঠাকের মাথায় আগুন। একটা কোক ফান্টা টাইপ কিছুই পেলাম না। খাবার আমার গলা অবধি উঠে আছে।
— বোরহানি ছিল তো।
— আমি বোরহানি খাই না।
— তো সেটা বললেই তো হয়। আমি তো দিতাম ব্যবস্থা করে।
— তো এখন বসে আছেন কেন?
— যাচ্ছি, পাঁচ মিনিট ওয়েট করো। নিয়ে আসছি এক্ষুনি।
বর্ণ এটা বলে চলে গেল। আমিও হাত ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বর্ণ যখন আসলো আমাকে ইশারা দিলো। আমি তাকিয়ে দেখি আব্বা কার সাথে যেন গল্প করছেন। আর আম্মা পান আনতে গিয়েছেন।
আমি সেই সুযোগে বারান্দার ওদিকে চলে এলাম। বর্ণ ওখানেই আছেন। বারান্দায় যাওয়ার পর বর্ণ আমাকে একটা গ্লাসে কোক ঢেলে দিলেন। উনিও গ্লাসে কোক ঢেলে নিজেও নিলেন। আমি সেই আরামে কোকের গ্লাসে চুমুক দিলাম।
— তো কেমন খেলে তোমার ভাসুরের বিয়ে?
— ভাসুর?
— বরের বড় ভাইকে যে ভাসুর বলে জানো না তুমি?
— শুরু হয়ে গেল আবার?
— হুহ! তোমার শশুর বাড়ির লোকগুলোকে দেখেছো? চিনে নাও চিনে নাও। এক এক করে সবাইকে চিনে নাও। না চিনলে বলো আমি চিনিয়ে দেবো কে কোনটা।
— উফ বাদ দিন তো আপনার ফালতু কথা।
চলবে….