আষাঢ়ে_প্রেমের_গল্প
নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১৬
— উফ বাদ দিন তো আপনার ফালতু কথা।
— হুম, ভালো কথার দাম নেই আজকাল।
— কত ভালো কথা বলে উল্টে দিচ্ছেন আপনি!
— হুহ!
— থাকুন আপনি আমি গেলাম।
— থাকো না আরেকটু?
— আপনি থাকুন। আম্মা হয়ত খুঁজছে আমাকে; আমি যাচ্ছি।
আমি এরপর কোকের গ্লাসটা ওখানে রেখে চলে এলাম। গিয়ে দেখি আম্মা কার সাথে যেন কথা বলছে।
— কীরে কোথায় ছিলি মেহুল? আম্মা তোমার পিছনের চেয়ারে এই যে।
— হুম, আমার সাথে বস এবার।
এরপর আর কিছুক্ষন ওখানে থেকে আমরা বাসায় চলে আসলাম। বর্ণের সাথে ওইদিনকার মতো আর দেখা কিংবা কথা হয়নি।
এরপর আসলো সেই নির্ধারিত ২৮ তারিখ। আজকে অবশ্য ২৭ তারিখ। কালকে রাত ১১টায় বর্ণের ফ্লাইট। আমার মনটা আজ খুবই খারাপ। আবার কবে না কবে দেখা হয় বর্ণের সাথে! হয়ত আমি বর্ণের মতো নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারি না। তাই বলে এমন না যে বর্ণকে আমি ভালোবাসি না।
আজকে রাতে বর্ণকে আমি নিজেই বলেছি রাতের বেলা বারান্দায় আসতে। যাওয়ার আগে অন্তত একবার একটু আলাদা ভাবে সময় কাটাতে চাই।
তখন ঘড়িতে রাত ১ঃ৩০ বাজছে। রাস্তায় শুধু কুকুরগুলো ঘেউঘেউ করে ডাকছে। আমি বারান্দায় গিয়ে দেখি বর্ণ বারান্দায় বসে। একধ্যানে কী যেন দেখছেন উনি। আমি যে ওনার সামনে উনি এতটুকুও খেয়াল করেননি। তখন ওনার বারান্দায় হালকা একটা ড্রিমলাইট জ্বলছে। আমি এবার হালকা করে একটা কাশির আওয়াজ করলাম। বর্ণ তখন নড়েচড়ে উঠে আমার দিকে তাকালেন। উনি কিছু বলার আগেই আমি বললাম,
— মন খারাপ না কি?
— নাহ।
— মিথ্যা কথা বলছেন? তাও আবার আমার সাথে?
— হুম মন খারাপ কিন্তু হালকা।
— কেন মন খারাপ? আংকেল আন্টি বকেছে না কি?
— নাহ, কে বকবে আমাকে? আমি কী ছোট্ট না কি যে এখনও বকা খাবো?
— তাহলে কী হয়েছে?
–চলে যাবো কালকে। সবার জন্য খুব মন খারাপ।
— হুম, এরকম হবে প্রথম প্রথম। ওখানে গেলে কত বন্ধু-বান্ধব হবে। তখন এত খারাপ লাগবে না।
— তোমার খারাপ লাগছে না মেহুলিকা?
— লাগছে তবে কী আর করার? যা হবার তা হবেই আমার কিংবা আপনার খারাপ লাগাতে সেটা কী থেমে থাকবে?
— হুম, এখন তোমার কথা বলো। এসব নিয়ে আলোচনা করতে আর ভালো লাগছে না আমার। একটু শান্তি চাই শান্তি।
— আমার কথা আর কী বলবো? আপনি তো সব কিছু জানেনই।
–জানো মেহুলিকা তোমার কোন জিনিসটা আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছিল?
— কী?
— তুমি কারো দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে কথা বলতে পারো না। আমি এই জিনিসটা দেখে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। মাথা নিচু করে কী সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে। আমার পাগল পাগল মনে তো নিজেকে।
— এসব জিনিস আবার কারো ভালো লাগে না কি? ধুর, আপনার পছন্দই খারাপ।
— আমার পছন্দ খারাপ না কি ভালো তা জানি না। শুধু এতটুকুই জানি আমি তোমাকে পেয়েছি। এরচেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে?
— হুম,
— আজকে আম্মুকে বলেছি যে, আমার জন্য কোনো মেয়ে দেখবে না। আমার পছন্দ আছে আমি তাঁকেই বিয়ে করবো।
— আল্লাহ্ বলেন কী! তারপর!
— আম্মু বলেছে তাহলে তো ভালোই। আমার অর্ধেক কাজ হয়ে গেল। আমার আর বেশি পরিশ্রম করতে হবে না।
— আপনার আম্মা দেখি আপনার মতোই। আমার আম্মা হলে মেরে মাটি চাপা দিয়ে দিতো।
— তোমার আম্মুকে মানানোর দায়িত্ব আমার। উনি যদি নাও দেন তাহলে ওনার মেয়েকে দরকার হলে তুলে নিয়ে বিয়ে করবো।
— হুহ্ এসেছে তুলে নিয়ে বিয়ে করতে। সরুন এখান থেকে।
— আমি মিথ্যা কথা বলি না। তোমার আম্মু না দিলে তুলে নিয়ে যাবো তোমাকে।
— বাজে কথা বন্ধ করুন।
— আমি একটা কথা চিন্তা করেছিলাম জানো?
— কী?
— একবার ভেবেছিলাম কোর্ট ম্যারেজ করে রাখবো আমরা। কিন্তু তোমার কথা চিন্তা করে আর আমি এই বিষয়ে আর এগুতে পারিনি। বাট একবার ভেবে দেখো কোর্ট ম্যারেজ করে রাখলে কেমন হয় বলোতো?
— আমি এখন এইসব করতে চাচ্ছি না। আপনি তো জানেনই সবকিছু। আমি আব্বা আম্মার অনুমতি ছাড়া বিয়ে করতে পারবো না।
— হুম, আমি শুধু তোমাকে বললাম। কালকে সকাল অবধি সময় আছে। যদি চাও আমাকে বলো। আমি রাজি আছি।
— নাহ, সম্ভব না এখন। আপনি এরপরের বার দেশে আসুন তারপর যা হবার হবে কিন্তু এখন না প্লিজ।
–হুম, তোমার ইচ্ছা সব।
— রাতে খাওয়া দাওয়া করেছেন?
— হুম, তুমি?
— হুম, আমিও করেছি।
— তোমাকে খুব মিস করবো মেহুলিকা। কতদিন তোমাকে দেখতে পাবো না। কেমন একটা অস্থিরতা কাজ করছে জানো?
— সব ঠিক হয়ে যাবে। এত চিন্তা করবেন না।
— আজকে আমার বড় আপু এসেছিল। এসেই আপু আমাকে জড়িয়ে ধরে কী কান্না। আমার এত মায়া লেগেছে জানো।
— হুম, আপনি তো আপুর বাসায়ই ছিলেন এতদিন তাই খারাপ লেগেছে এত।
— আয়রা এসেছিল জানো? অবশ্য আপু এখনও আমাদের বাসায়। কালকে তোমাকে আয়রাকে দেখাবো। আজকে এসে আমার রুমের অবস্থা বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে আয়রা। কিছু বলতেও পারি না। কিছু বললেই আপুর কাছে গিয়ে বলে ” আম্মু মামা বতা দেয়”।
— হাহাহা, আপনার ভাগ্নী একেবারে আপনার মতোই চালাক। সবকিছু বুঝে দেখি।
— হুম, শুধু কী এটা না কি? ওদের বাসায় যখন ছিলাম তখন সকালে উঠে গেট খুলে দেখি সে হাজির। আমার বই খাতা খুলে কলম দিয়ে দাগিয়ে কিছু রাখতো না। আপুর কাছে যখন বলতাম আপু আমার বইয়ে কলম দিয়ে কে দাগ দিয়েছে? তখন ও দৌড় দিয়ে এসে বলতো মামা আম্মু আম্মু। আমি আর আপু কী বলবো? আমাদের কাজ ছিল শুধু হাসা। আবার আমার ইরেজার কামড়ে ছিঁড়ে কিছু রাখতো না। আমি যখন পড়তে বসতাম তখন দেখতাম টেবিলে ইরেজার নেই। কিছুদিন পরপর শুধু ইরেজার গায়েব। পরে দেখি আমার ইরেজারকে কামড় দিয়ে ছোট ছোট টুকটা করে;ওগুলো দিয়ে সে হাঁড়ি-পাতিল খেলে।
— হায় হায়! ইরেজার বেচারাকে ও বাদ দিলো না। হাহাহাহা।
— হুম, বুড়ি খুব দুষ্ট। আবার তুমি যদি একটা হালকা করে ধমক দাও তাহলে; তোমার দিকে তাকিয়ে এমন একটা হাসি দিবে। তুমি আর ওকে কোলে না নিয়ে থাকতে পারবে না।
— ওরে বাবা।
— কালকে সকালে বারান্দায় আসবে দেখো। আবার ছাঁদে গিয়ে আমার পায়রাগুলোকে খাবার দেয়। সব কাজ পারে সে।
— হুম এটাই ভালো। মামার মতো অকর্ম না হলেই হলো।
— ইস্ এসেছে আমাকে অকর্ম বলতে। আমি তোমার মতো না আমি সব কাজ পারি।
–হুম, পেরে একেবারে উল্টে ফেলেছেন আপনি।
— আমাকে এতকিছু বলো। কিন্তু তুমি কী পারো?
— আমি খুব ভাল রান্না করতে পারি। হুহ্ একবার খাবেন তো বারবার চাবেন।
— কয়দিন আগে এটা বললে না কেন বলো তো? আমিও একটু টেস্ট করতাম তোমার হাতের রান্না।
— পরেরবার যখন আসবেন তখন অবশ্যই খাওয়াবো। এখন যান ঘুমান। রাত চারটা বেজে গিয়েছে। পরে আবার সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারবেন না।
— হুম, কালকে আবার সকালে উঠে শপিংয়ে যেতে হবে। কিছু কেনাকাটা করা বাকি আছে।
— আচ্ছা, গুড নাইট।
— ভালো থেকো মেহুলিকা। ফোনে কিন্তু তোমার সাথে কথা হবে।
— আচ্ছা, আপনিও ভালো থাকবেন। সাবধানে যাবেন।
আমি এরপর চলে এলাম রুমে। বর্ণের সাথে পরেরদিন সকালে ছাঁদে দেখা হয়েছিল কিন্তু কথা হয়নি। বর্ণ আর আয়রা ছাঁদে এসেছিল। পায়রা নিয়ে দুষ্টুমি করছিল ওরা। আমি বেশি কাছে যাইনি। দূর থেকে বর্ণ আর আয়রাকে দেখে চলে এসেছি। বর্ণ আমাকে দেখেনি দেখলে কথা বলতো অবশ্যই। আমি অবশ্য বর্ণকে দেখা দিতে চাইনি। কারণ সকালে কেউ এভাবে কথা বলতে দেখে ফেললে সমস্যা হতে পারে।
ওইদিন সারাদিন আর বর্ণের সাথে দেখা হয়নি। রাতের সাড়ে দশটা বাজে বর্ণ আমাকে ভিডিও কল দিলো। আমি তখন খেয়েদেয়ে মাত্র রুমে এসে বসেছি। পরে কল রিসিভ করে দেখি বর্ণ এয়ারপোর্টে।
— একটু পরে ফ্লাইটে উঠবো মেহুলিকা। তোমার কথা খুব মনে পড়ছে। দোয়া করি আল্লাহর কাছে পরেরবার যেন তোমার সাথে এভাবেই ফ্লাইটে উঠতে পারি।
— আমিন, সাবধানে যাবেন আপনি। খেয়াল রাখবেন নিজের। আর আমাকে মনে রাখবেন।
— তোমাকে কীভাবে ভুলি বলো? তোমাকে অনেক বেশি মিস করবো। তুমি মিস করবে না আমাকে?
— মিথ্যা বললে একটুও করবো না। আর সত্যি বললে অনেক মিস করবো।
— বারান্দায় বসে তোমার সাথে কতদিন গল্প করা হবে না মেহুলিকা। বারান্দাটাকেও মিস করবো খুব।
— হুম, আমিও। এখন কল রাখুন একটু পরে আপনার ফ্লাইট। দোয়া করুন বেশি করে যাতে কোনো বিপদ-আপদ না হয়।
— কী বিপদ হবে আমার? মরে যাবো এইতো?
— যাওয়ার সময় এগুলো বলবেন না। আমাকে টেনশনে ফেলে দিচ্ছেন আপনি।
— আচ্ছা, আর বলবো না যাও। রাখছি এখন বায়।
— আল্লাহ হাফেজ। ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন এবং নিজের খেয়াল রাখবেন।
— হুম, তুমিও রেখো;আল্লাহ হাফেজ।
চলবে…