আষাঢ়ে_প্রেমের_গল্প
নুজহাত_আদিবা
পর্ব ২২
বর্ণদের বাসা থেকে আজ অনেক ডালা এসেছে। সব আমাদের বিয়ের ডালা। বিয়ের যাবতীয় পোশাক, গহনা, সব বর্ণ নিজে কিনেছে। আমাকে বলা হয়েছিল একবার বর্ণের সাথে যেতে। কিন্তু আমি যাইনি। আমারও অবশ্য এটাই ইচ্ছে ছিল যে, বর্ণ সবকিছু নিজের হাতে পছন্দ করে কিনবে। তাই বর্ণ, আন্টি এবং বর্ণের বোনেরা মিলেই সবকিছু কেনাকাটা করে পাঠিয়েছে। তবে আমার জিনিসপত্র কেনার সময় বর্ণ নিজে পছন্দ করে কিনেছে। বর্ণের পছন্দ এমনিতেও খুব সুন্দর। বর্ণ কানাডা থেকে আসার সময় আমার জন্য বিদেশি চকলেট থেকে শুরু করে যা পেয়েছে সব কিনেছে আমার জন্য। বর্ণকে মুখে আমি যাই বলি না কেন ওনার এই গুনটা খুব ভালো। আমার জন্য মনে করে করে জিনিসপত্র কিনেছে। আমি আমার জন্য কিছুই আনতে বলিনি। কিন্তু উনি খেয়াল করে দেখেছেন আমার আসলে কী প্রয়োজন।
— মেহুলিকা।
— হুম বলুন বর্ণ, বিয়ের ডালা গুলো খুলে দেখেছিলে?
— হ্যাঁ, খুব সুন্দর হয়েছে জিনিস গুলো।
— সুন্দরের কথা বাদ দাও। তোমার পছন্দ হয়ে কি না সেটা জানতে চেয়েছি।
— আপনি পছন্দ করে কিনেছেন সেটা আবার ভালো কীভাবে না লাগবে।
— হুম, বাসার নিচে কী সুন্দর লাইটিং করা হয়েছে দেখেছো? এখান থেকে একেবারে মেইন রোড অবধি পুরো লাইটিং করেছি আমরা
— হুম দেখেছি, সুন্দর লাগছে দেখতে খুব।
— একবার আমাদের বাসায় এসেও তো ঘুরে যেতে পারো। আসলে না একদিন ও।
— বিয়েটা হোক তারপর যাবো। বিয়ের আগে এত ঘোরাঘুরি কীসের?
— হুহ, তোমাকে এখন ফোনে কথা বলতে দেখলে কেউ কিছু বলে না?
— কী বলবে? কথা আপনার সাথেই বলি। সবাই জানে এটা তাই কিছু বলে না।
— না বললেই ভালো। নিষেধ করলেও আমি অবশ্য শুনতাম না। কিন্তু একটা কথা জানো মেহুলিকা? আমার না মনে হচ্ছে আমি স্বপ্ন দেখছি। কালকে আমাদের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। পরশুদিন না কি আবার বিয়ে। সময় কত তাড়াতাড়ি কেটে যায় তাই না? সেদিন একটা মেয়ের হাতে আমি গল্পের বই তুলে দিলাম। আর তাঁর সাথেই কি না আমার বিয়ে। কী অদ্ভুত না?
— হুম আসলেই, আমরা আমাদের মতোই ছিলাম শুধু মাঝখানে এত সুন্দর দিনগুলো কেটে গেছে।সেই দিনগুলো মারাত্মক রকমের সুন্দর ছিল। কিন্তু আমরা ভাবতে পারিনি সেই দিনগুলো এত জলদি কেটে যাবে।
— হুম, তোমাদের বাসায় লোকজন নেই? মানে তোমার কাজিন-টাজিন, আত্নীয় স্বজন কেউ আসেনি?
— হুম, এসেছে তো। আপনাদের বাসায় আসেনি?
— তা আর বলতে।
— আচ্ছা, আমাদের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান কী একসাথে হবে না? না কি আলাদা আলাদা?
— আলাদা কেন হবে? একসঙ্গেই হবে।
— হুম।
— মেহুলিকা আপু তোমাকে আজকে সুন্দর লাগছে খুব।
— থ্যাংক ইউ সোনা।
আমার আর বর্ণের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। আমাদের ফ্যামিলির মোটামুটি সবাই হাজির। বর্ণরা এখনও আসেনি। আমি বুঝি না সব সময় ছেলেরা বিয়ের দিনে এত দেরি কেন করে? মেয়েদের সাজতে ২-৩ ঘন্টা লাগে। তবুও মেয়েরাই আগে এসে পৌঁছায়। কিন্তু, ছেলেরা আসবে দেরি করে।
বর্ণদের আসতে দেরি হচ্ছে দেখে আম্মু মেহেদীর আর্টিস্টকে আমার হাতে মেহেদী পরিয়ে দিতে বললেন। আমাকে মেহেদী পরিয়ে দিতে কয়েকটা আপু এসেছে। একটা আপু আমাকে মেহেদী পরিয়ে দিবে। আর বাকি আপু গুলো অন্যদেরকে মেহেদী পরিয়ে দিবে।
হাতের খানিকটা অংশে মেহেদীর ছোঁয়া লাগতে না লাগতেই দেখি;হলুদ পাঞ্জাবি পরিহিত এক তরুন হাজির। আমি দিকে এগিয়ে এসে মুচকি এক হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকালো সে। আমি উঠে গিয়ে আমার পাশে বসার জন্য তাঁকে জায়গা করে দিলাম। আমার পাশে বসেই সে আলতো ভাবে আমার কানে চুপিসারে বললো,
— এক শ্রাবনের উন্মাদ বর্ষনের মতো তোমার উপর ঝড়ে পড়তে চাই। আমার এলোমেলো আষাঢ়ে গল্পে আবার ও তোমার নাম লিপিবদ্ধ করতে চাই।
আমি চমকে উঠে তাঁর দিকে তাকালাম। তাঁর ঠোঁটে এখনও মুচকি হাসি বিদ্যমান। আমাকে এমন অবাক দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে সেও অবাক হয়ে বলল,
— কী দেখছো এভাবে?
— কী আর দেখবো? সামনে আপনি ছাড়া আর কে আছে বর্ণ?
— আমার সামনে অবশ্য অনেক মেয়েই আছে। কিন্তু আমি তো শুধু আমার মেহুলিকা-কেই দেখি।
— মেহুলিকা-কেই দেখা উচিত। অন্য মেয়েদের দিকে তাকালে আপনার চোখ এতক্ষন অবধি আর আস্ত থাকতো না। আলএই আঙুল গুলো দিয়ে গেলে দিতাম চোখটা।
বর্ণ হাসতে হাসতে বললেন,
— ওমা তাই না কি?
— হুম।
— মেহুলিকা,
— হুহ্।
— চলো না আমরাও সবার সাথে গিয়ে ডান্স করি।
— আপনার এত ডান্স করার ইচ্ছে থাকলে আপনি যান। আমি এখন হাতে মেহেদী পরছি। দেখছেন না আপনি?
— হুম দেখছি তো।
বর্ণ এবার যে-ই আপুটা আমার হাতে মেহেদী পরিয়ে দিচ্ছিলেন ওনার কাছে গিয়ে বললেন,
— আপু এখানে ছোট্ট করে বর্ণ লিখে দেবেন।
আপুটাও বললো,
— হুম ভাইয়া লিখে দেবো।
আমি বিরক্ত হয়ে বর্ণের দিকে তাকালাম। হাতেও আবার ওনার নাম লিখতে হবে? মনের মধ্যে যে এত সুন্দর করে নাম লিখেছি সেটা চোখে দেখেন না উনি। এখন আমার হাতে ওনার নাম লিখলেই ওনার শান্তি। হুহ্!
মেহেদী দেওয়া শেষ হতে না হতেই বর্ণ আমাকে টেনে ধরে ডান্স করতে নিয়ে গেলো। আমার কাজিন, বর্ণের কাজিনরা এবং বর্ণের বন্ধুরা ডান্স করছিল ওখানে। বর্ন আমার হাত ধরে ওদের সামনে গিয়ে বলল,
— এক্স কিউজ মি, আমাকে আর আমার বউকে আপনাদের সবার সাথে একটু ডান্স করতে দেওয়া যাবে?
বর্ণের কথা শুনে কেউ হাততালি দিলো কেউ শিষ বাজালো জোরেসোরে। আমি তো লজ্জায় শেষ। এভাবে সবার সামনে এসব কেউ বলে? বর্ণ আসলেই পাগল।
বর্ণ সবার মাঝখানেই ডান্স করছিল। আমার খুব লজ্জা লাগছিল তাই আমি শুধু হাত তালি দিচ্ছিলাম। বর্ণ হুট করে আমার আঙুলটা নিজের হাতে ধরে আমাকে ঘোরাতে আরম্ভ করলেন। আমি এমনিতেই আজকে লেহেঙ্গা পরেছিলাম। তারপর এত জোরে ঘোরাতে আমার লেহেঙ্গা ঘুম সুন্দর করে ঘুরে উঠলো। লেহেঙ্গা-টা খুব ঘের ওয়ালা ছিল। তাই লেহেঙ্গা-টা যখন ঘুরে উঠলো তখন খুব সুন্দর লাগলো। আমাদের এত সুন্দর দৃশ্যটা বর্ণের ক্যামেরাম্যান তাঁর ক্যামেরায় ধারণ করলেন। আর বললেন পরে তিনি ভিডিওটা এডিট করে বর্ণের ল্যাপটপে দিয়ে দেবেন।
এরপর শুরু হলো গ্রুপ ডান্স। রিহা আর বর্ণের ফ্রেন্ড নাজিফ একসাথে ডান্স করছিল। ওরা আগে থেকে প্র্যাকটিস করেছে কি না তা আমি জানি না। কিন্তু বর্ণের ফ্রেন্ড ছেলে হলেও অসম্ভব সুন্দর ডান্স করতে পারেন। রিহাও খুব সুন্দর ডান্স করে। নাজিফ আর রিহা এতক্ষন জুটি বেঁধে ডান্স করছিল। ওদের জুটিটা অবশ্য মানিয়েছিল ভালো। বর্ণ ওদের দুজনের ডান্স দেখে কানে কানে আমাকে বললেন,
— উফ, এদের মধ্যে কী কিছু হতে পারে না? তাহলে পরেরবার এসে বিয়েটা খেতে পারতাম।
আমি হেসে দিলাম বর্ণের কথায়। আসলেই জীবনের এই সুদীর্ঘ পথচলায় একটা সাথী হলে মন্দ হয় না।
আজকে আমাদের হলুদের অনুষ্ঠানে মনিরাও এসেছিল। কিন্তু, ওর গা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসেছে। তাই, বেশিক্ষন ছিল না। কিছুক্ষন থেকেই বাড়ি চলে গেছে। আমিই অবশ্য ওকে বলেছিলাম বাড়ি চলে যাওয়ার কথা। কারণ,ওর শরীরের অবস্থা বেশি ভালো না। পরে যদি আবার অসুস্থতা বেড়ে যায়? এই ভেবেই আমি ওকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি।
আমার কয়েকটা মেয়ে কাজিন বর্ণের কাছে এসে বর্ণকে জ্বালাতে আরম্ভ করলো। তাঁদের কথা তারা এতক্ষন অনেক ডান্স করেছে। বর্ণকে এখন তাদেরকে বকশিস দিতে হবে। বর্ণ ওদেরকে ক্ষ্যাপানোর জন্য বললো বর্ণের জন্য পান বানিয়ে নিয়ে আসতে। আমার কাজিনরাও দুলাভাইয়ের ভদ্র শালির মতো বর্ণের জন্য পান বানিয়ে নিয়ে আসলো। শুধু বর্ণ না আমার জন্যও পান বানিয়েছে তারা। আমি পান খাই না কিন্তু ওরা এত কষ্ট করে বানিয়েছে ভেবে মুখে পুরে দিলাম।
পান মুখে দেওয়ার কিছুক্ষন পর বর্ণ গালের একপাশে পান চিবুতে চিবুতে আমাকে বললেন,
— তোমার কী মাথা ঘুরাচ্ছে মেহুলিকা?
আমি অবাক হয়ে বললাম,
— কই না তো। অনেকদিন পরে পান খাচ্ছেন আপনি। তাই বোধহয় এমনটা হচ্ছে।
— হতে পারে।
কিছুক্ষন পরেই বর্ণ আমার বাহুতে হাত রেখে বললেন,
— আমার শালীদের ভালোবাসায় ভেজাল আছে ভেজাল।
আমি চমকে বললাম,
— কেন? কী হয়েছে আবার?
— তোমার কাজিনরা পানের ভেতরে ঠুষে ঠুষে জর্দা দিয়েছে। আমি এখন বসতে পারছি না ঠিকমত। মাথা ঘুরছে খুব; মনে হচ্ছে আশেপাশের সবকিছু গোল হয়ে আমার চারপাশে ঘুরছে।
বর্ণ টলমলে শরীরে আমার কাঁধে মাথা দিলেন। মাথায় ঘোরানোর জন্য ঠিকমতো বসতেও পারছে না। আমি এবার আমার কাজিনদের দিকে তাকিয়ে দেখি ওরা মুচকি মুচকি হাসছে। আমি ওদের এত হাসাহাসি দেখে চোখ রাঙিয়ে ওদের দিকে তাকালাম।
চলবে…