আষাঢ়ে_প্রেমের_গল্প নুজহাত_আদিবা পর্ব ২৩

আষাঢ়ে_প্রেমের_গল্প
নুজহাত_আদিবা
পর্ব ২৩

লাল টকটকে লেহেঙ্গা আর ভারী গহনায় নিজেকে রাঙিয়েছি আমি। এগুলো সব-ই বর্ণের পছন্দে কেনা। আজকে আমাকে বর্ণ যদি আমাকে দেখে তাহলে আমি কী করবো? লজ্জা পাবো? নাহ, লজ্জা কেন পাবো? ওটা তো আমারই বর্ণ। ওনার সামনে আবার লজ্জা কীসের?

আজকে আমার আগে বর্ণ চলে এসেছে। আমি-ই বোধ হয় একটা দেরি করে ফেলেছি। অবশ্য আমার কী দোষ? পার্লার থেকে আমাকে দেরি করে সাজালে আমি কী করতে পারি?

আমি যখন স্টেজে উঠতে নিলাম বর্ণ দৌড়ে এসে, আমার হাত ধরে আমাকে স্টেজে উঠতে সাহায্য করলেন। লেহেঙ্গা-টা খুব ভারী তাই হাঁটতে একটু কষ্ট হচ্ছিল।

স্টেজে উঠে আমি আর বর্ণ পাশাপাশি বসলাম।বর্ণ আমার হাতটা টেনে নিয়ে ওনার হাতের উপরে রাখলেন। আমি যখন বিরক্ত হয়ে ওনার দিকে তাকালাম। তখন বর্ণ বললেন,

— এদিকে না ওদিকে তাকাও।

আমি বর্ণের কথামতো সামনে তাকিয়ে দেখি ক্যামেরাম্যান আমাদের ছবি তুলছে। আজকের ক্যামেরাম্যান অবশ্য বর্ণের ফ্রেন্ড। ভাইয়া কালকের হলুদের অনুষ্ঠানেও আমাদের ছবি তুলে দিয়েছিলেন। আজকেও তাই ভাইয়া-ই ছবি তুলে দিচ্ছেন। ভাইয়ার সাথে আগে পরিচয় হয়নি আমার কালকেই যা কথা হলো। তবে যতটুকু বুঝলাম উনি বর্ণের বেশ ক্লোজ ফ্রেন্ড।

বর্ণের ফ্রেন্ডদের যন্ত্রণায় একটু শান্তি নেই। ভাবী ভাবী করে আমার মাথা খেয়ে ফেলছে ওনারা। কিছুক্ষন পরপর নানা রকম ছবির পোজ বের করবেন। আবার সবাই স্টেজে উঠে আমাকে-সহ দল বেধেঁ ছবি তুলবেন। আমি বিরক্ত এদের এই কাজকর্ম দেখে।

এরপর স্টেজে অমালিকা আপা আর দুলাভাই আমাদের সাথে ছবি তুলতে এলেন। ছবি তোলা শেষে অমালিকা আপা যখন স্টেজ থেকে নেমে গেলেন।তখন, দুলাভাই আমাকে আর বর্ণকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

— আমি কিন্তু এখনও ট্রিট-টা পেলাম না।

বর্ণ হেসে দুলাভাইকে বললেন,

— আপনি তো আমাদের স্পেশাল গেস্ট। আপনার জন্য সব খাওয়া দাওয়া ডবল ডবল।

আমি এবার শব্দ করে হেসে উঠলাম। এই বর্ণটা না পারেন ও বটে। কখন কোন কথা বলতে হবে সব তাঁর জানা।

এরপর স্টেজে উঠে এলো মনিরা। মনিরা-কে দেখে বর্ণ বললেন,

— কী হে শালিকা। কোথায় থাকো তুমি? দেখি-ই তো না তোমাকে। তোমার ফ্রেন্ড তো আমাকে দাম-ই দেয় না। এবার যদি তুমিও আমার সাথে এমন করো তাহলে আমার কী করে চলবে বলো? তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে বলো?

মনিরা লজ্জা পেয়ে বলল,

— আমার শরীরটা ভালো না দুলাভাই। নাহলে আপনার থেকে শুধু শুধু দূরে কেন থাকবে বলুন?

আমি এবার আর না পেরে ওদের দু’জনকেই ধমক দিলাম। কী যে শুরু করেছে এরা। একেকটা পাগলের দল।নাহলে এমন কেউ করে? আর সব পাগলদের বড় পাগল এই বর্ণ। সব কিছুতেই পাগলামি করাই লাগবে ওনার। কী যে করি ওনাকে নিয়ে।

বিদায়বেলায় যখন আমি আব্বা আম্মাকে জরিয়ে ধরে কাঁদছিলাম। তখন,বর্ণ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। গাড়িতে উঠেও আমি যখন কাঁদছিলাম তখন বর্ণের কাছে খেলাম এক ঝারি। ধমক দিয়ে আমাকে বলেছিলেন,

— বিড়ালের বাচ্চার মতো মিউমিউ করে কাঁদছো কেন? এই তো কয়েকটা দিন। এরপর আমি আবার চলে যাবো। তখন তো আবার ওনাদের কাছেই ফিরে যাবে। আমার কাছে তো অল্প কয়টা দিন থাকবে। তবুও এত কান্নাকাটি?

আমি এরপর বর্ণের যুক্তির কাছে পরাজিত হয়ে কান্নাকাটি বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইলাম।

বিয়ের পর বর্ণকে খুব একটা পাইনি আমি। নিজেদের মতো খুব একটা সময়ও কাটানোর সুযোগ হয়নি আমাদের। আমাদের বৌভাতের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর বর্ণকে আমি মাত্র সাতদিন কাছে পেয়েছি। এই সাতটাদিন আমার জন্য খুব স্পেশাল ছিল।বর্ণ আবার কানাডা ব্যাক করার আগে;বর্ণের সাথে লাস্ট ঘুরতে গেলাম। বর্ণের বড় খালামনির বাড়িতে।আমার আর বর্ণের দাওয়াত ছিল ওনাদের বাসায়।

বর্ণের নিজের পছন্দ করা একটা শাড়ি পরে গিয়েছিলাম ওনাদের বাড়িতে। বিয়ের পরে বর্ণ আমার জন্য ওইবারই প্রথম; জামাকাপড়, জুতাসহ আরও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে দিয়েছিল। একটা নতুন মোবাইল ফোন ও কিনে দিয়েছিল। আনন্দে আমার চোখে পানি এসে পড়েছিল। বর্ণের এসব জিনিস দেওয়ার পেছনে কতটা ভালোবাসা লুকিয়ে ছিল সেটা শুধু আমি জানতাম। কিন্তু, নতুন বিয়ের পর মেয়েদের যেমন অনুভূতি হয়। আমার ক্ষেত্রে সেই অনুভূতির সময় ছিল খুব স্বল্প। বিয়ের আটদিন পরেই তো বর্ণ কানাডা চলে গেল। আমার সেই অনুভূতি গুলোর সেখানেই সমাপ্তি ঘটলো। ফোনে কথা হতে নিয়মিত কিন্তু তবুও বর্ণের অনুপস্থিতি আমাকে কষ্ট দিতো।

যেদিন বর্ণ চলে গেল সেদিন আমি কতটা কষ্ট পেয়েছিলাম সেটা শুধু আমি জানি। বর্ণকে জরিয়ে ধরে কেঁদে ছিলাম আমি। এয়ারপোর্টে যখন বর্ণ চলে যাচ্ছিল আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। এই কষ্ট আমি কাকে বোঝাবো? বর্ণের ও খুব কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু, আমাদের কিছুই করার ছিল না। এটা তো হওয়ারই ছিল। আমরা আর কী করতে পারতাম?

বর্ণের যাওয়ার পর আমি আবার আগের মতো একাকী জীবন যাপন করতে শুরু করলাম। বর্ণদের বাসা যেহেতু আমাদের বাসা থেকে বেশি দূরে নয়। তাই, কখনো আমাদের বাড়িতে থাকতাম কখনে বর্ণদের বাড়িতে। যখন যেখানে ইচ্ছে তখন সেখানে থাকতাম আরকি।

বর্ণের কাছে মানে আমার কানাডা যেতে যেতে তেরো মাস সময় লেগেছিল। এই তেরোটা মাস বর্ণ আমার জন্য প্রচন্ড ছটফট করেছিল। বর্ণ মুখ ফুটে বলতো না কিছু। কিন্তু, আমি বুঝতে পারতাম।

বাংলাদেশ থেকে কানাডা গেলাম আমি একা একা। প্রচুর ভয় লেগেছিল। আব্বা, আম্মা এবং আপা, দুলাভাই বোঝাচ্ছিল বারবার যে কিছু হবে না। তবুও অজানা আশংকায় বারবার কেঁপে উঠছিলাম আমি। এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে যখন আমি রওনা দেবো। তখন, বর্ণ ফোন করে কীভাবে কী করতে হবে সব বুঝিয়ে দিলেন। বর্ণের সাথে কথা বলার পর ভয়টা খানিকটা হলেও কমেছিল আমার।

কানাডায় পৌঁছে যখন এয়ারপোর্টে বর্ণকে দেখতে পেলাম। তখন,আমার কতটা ভালো লেগেছিল আমি বলে বোঝাতে পারবো না। বর্ণ এসেই আমাকে দেখতে পেয়েই দৌড়ে এসে জরিয়ে ধরলেন। হাতে ফুলের তোড়া ছিল ওনার। ফুলের নামটা ঠিক জানি না আমি। বিদেশি কোনো ফুল ছিল হয়তো।

বর্ণের সাথে এরপর বর্ণের গাড়ি দিয়ে বাড়িতে চলে আসলাম আমরা। বাড়িটা আমি শুধু ভিডিও কলেই দেখেছি। সামনাসামনি এবার-ই প্রথম দেখলাম। খুব সুন্দর বাড়িটা। আর বাড়ির সাথেই সেই বিখ্যাত কমলা গাছ। শুধু কমলা গাছ না অন্যান্য গাছও ছিল। কিন্তু, আফসোস আমি কোনো গাছেরই নাম জানি না।

বাড়ি পৌঁছানোর পরেই আমি জামাকাপড় চেঞ্জ করে ফ্রেস হয়ে নিলাম। বর্ণ আমাকে বললেন উনি না কি রান্নাবান্না সব করেছেন। খাবার দাবার সব রেডি। শুধু এবার খেয়েদেয়ে আমাকে একটা ঘুম দিতপ বললেন। আমি ভেবেছিলাম বর্ণ ছেলেমানুষ কী-ই বা রান্না করতে পারবে। কিন্তু, রান্না খেয়ে আমি অবাক। এত ভালো রান্না আমিও করতে পারবো না কখনো। পরে কথা প্রসঙ্গে জানলাম এখানে আসার পর থেকেই না কি বর্ণের রান্না উনি নিজেই করেন।

খাওয়া শেষ করে আমি বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলাম। ক্লান্তিতে আমার চোখ জুড়িয়ে এলো। মুর্হুতেই ঘুমের তলদেশে তলিয়ে গেলাম আমি। ঘুম থেকে যখন উঠলাম দেখি বর্ণ আমার পাশে নেই। আমি বেড থেকে উঠে একটু খুঁজতেই দেখি বর্ণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি বারান্দার দরজা খুলে বারান্দায় ঢুকে পড়লাম। বর্ণ আমাকে দেখে বললেন,

— ঘুম ভেঙে গেল এত জলদি?

— হুম,

— শরীর খারাপ লাগছে না কি?

— হ্যাঁ হালকা কিন্তু মনটা খুব ভালো লাগছে।

— তাই না কি?

— হুম কিন্তু, আব্বা আম্মার কথা খুব মনে পরছে।

— চিন্তা করো না। তোমাকে যখন একবার নিয়ে এসেছি এখানে। তখন ওনাদেরকেও এখানে নিয়ে আসতে খুব বেশি সময় লাগবে না।

হুম বলেই আমি এবার বর্ণকে জরিয়ে ধরে বর্ণের বুকে মাথা রাখলাম। বর্ণ ও আমাকে জরিয়ে ধরে বললেন,

— তোমাকে একটা প্রশ্ন করি মেহুলিকা?

— হুম অবশ্যই।

— আমাদের প্রেমের এত সুন্দর গল্পটা কে লিখলো মেহুলিকা?

— আমি কীভাবে জানবো? আপনি বলুন এটা।

— ছদ্মনামে লিখা যেই গল্প!
ভেবে নিও সেটা ওই আষাঢ়ে প্রেমের গল্প!

সমাপ্ত।

( দেখতে দেখতে গল্পটা শেষ হয়ে গেল। আমি খুব মিস করবে বর্ণ আর মেহুলিকা-কে। যাই হোক, সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি কিছুদিন একটু গ্যাপ নিচ্ছি। তাই,আমাকে ভুলে যাবেন বা প্লিজ। এরপর আবার নতুন কোনো বড় গল্প নিয়ে হাজির হবো। ততদিন অবধি সবাই একটা অপেক্ষা করবেন আশাকরি। আল্লাহ হাফেজ সবাইকে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here