ইচ্ছের উল্টোপিঠ পর্ব-০৬

0
2288

#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_৬
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

জুভান অবাক চোখে পিছন ফিরলো। ঐশী ভয়ে প্রায় কেঁদে দেওয়ার মতো অবস্থা। জুভান ভাবছে , হঠাৎ করে কি হলো এই মেয়ের ? ঐশী জুভানকে এরূপ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে মরিচ স্প্রে টা জুভানের সামনে বের করে আবারও জোরালো গলায় বললো,

” কি হলো ? গাড়ি থামাতে বললাম না। থামাচ্ছেন না কেনো ? ”

জুভান ঐশীর পাগলামি দেখে ফুস করে এক নিঃশ্বাস ফেলে আবারও ঐশীর দিকে তাকালো। ঐশী বারবার ঢোক গিলছে আর ভয়ার্ত চোখে জুভানের দিকে তাকিয়ে আছে। জুভান এতে কোনো ভাবান্তর না করে ভ্রু আঁকাবাঁকা করে ফট করে ঐশীর হাত থেকে মরিচ স্প্রে টা নিজের হাতে নিয়ে নিল। ঐশী হঠাৎ এমন ব্যাবহার দেখে থমকে গেলো ? এখন কি হবে ? ওর একমাত্র সম্বল তো ওই মির্জা হাতিয়ে নিল। ঐশী মুখের লালা দিয়ে গলা একটু ভিজিয়ে সিটের একটুখানি পিছিয়ে গেল। জুভান স্প্রের বোতল একটু নেড়েচেড়ে আবারও ঐশীর দিকে তাকালো। ভ্রুকুটি করে বললো,

” লাল মরিচ শুধু ? নাকি আর কোনো মরিচ আছে এতে ? ”

ঐশী নাক ফুলিয়ে রাগ দেখিয়ে বললো,

” তাতে আপনার কি ? এক্ষুনি গাড়ি থামান। আমি নেমে যাবো। ”

জুভান প্রতিউত্তর না করে স্প্রে টা নিজের কাঁধ ব্যাগে রেখে দিল। এসব দেখে ঐশীর মন চাইলো এই মির্জা কে জাস্ট মেরে ফেলতে। কত সাহস ! ওর স্পেশাল থেরাপি টা নিয়ে নিল ? ঐশী মুখ ভরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু লাভ বিশেষ হলো না। ঐশী রাগ দমন করতে না পেরে আবারও বললো,

” আপনার কি কান নেই ? কখন থেকে বলছি গাড়ি থামান। অথচ আপনি কানেই নিচ্ছেন না। আর আমার স্প্রে দিন। দিন বলছি। আমি নেমে যাবো। ”

জুভান ফোন স্ক্রল করছিল। ঐশীর কথা শুনে ফোনটা আবারও নিজের পকেটে রেখে দিল। ঐশীর দিকে ফিরে অতীব রাগী কণ্ঠে বললো,

” আর ইউ ম্যাড ? এই মধ্যরাতে, মাঝরাস্তায় তুমি গাড়ি থেকে নেমে যাবে ? চিনো কিছু ? জানো এই শহর সম্বন্ধে ? কোথ থেকে যে আসে এসব ডাফার । ডিসগাস্টিং । ”

বলেই জুভান বিরক্তি হেসে আবারও সামনে তাকালো। ঐশীর মনোভাব নিতান্তই তুচ্ছ করে আবারও ফোন স্ক্রল করতে মনোযোগ দিল। ঐশীর মাথা এবার আগুন হলো। জ্বলন্ত লাভা ফুটলো তার মগজে। সেই লাভার উত্তাপে এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড করে বসলো ও । অত্যধিক ক্ষোভে চলন্ত গাড়ির দরজা খুলে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু জুভান সতর্ক হয়ে সাথেসাথে ঐশীর হাত ধরে হেচকা টান দিয়ে আবারও সিটে বসিয়ে দিল। চটজলদি এক হাত দিয়ে তাড়াতাড়ি করে দরজা আটকে দিল।

” ইউ মেড ” বলে ঐশীর এমন অবিশ্বাস্য ব্যবহারে ক্ষিপ্ত হয়ে জুভান রেগে থাপ্পড় লাগাতে হাত অগ্রসর করতেই ঐশী চোখ খিচে বন্ধ করে দিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। কাদতে কাদতে বললো,

” আমি যাবো না আপনার সাথে। যা করার করে নিন। ”

ঐশীর কান্নার শব্দ খুব অসহায় হয়ে ভেসে আসলো জুভানের কানে। জুভান থমকে গিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো ঐশীর দিকে। রাগ এখনো কমে নি। কিন্তু এই মেয়ের বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পাওয়ায় সেও হিতাহিত বিবেক কে প্রশ্রয় না দিয়ে ড্রাইভারকে বলে মাঝরাস্তায় গাড়ি থামিয়ে দিল। গাড়ি থামানোর প্রায় সঙ্গেসঙ্গে ঐশী দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা ধরে। আর একবারও পিছন ফিরে তাকায় নি সে। ভয়ে এখনো বুকের ভিতর-টা তবলা বাজাচ্ছে। কপাল বেয়ে ঘাম চুঁইয়ে পড়ছে। মুখ লালাভ রং ধারণ করেছে। কিন্তু মনটা এখন শান্তি। ওই মির্জা থেকে তো নিজেকে বাঁচাতে পেরেছে। ভেবেই জয়ের হাসি হাসলো ঐশী। একটু পর পাশ দিয়ে জুভানের গাড়ি শো আওয়াজ করে সামনে এগিয়ে গেলো। ঐশী সেদিকে তাকিয়ে আবারও জিভ ঠোঁট ভেজালো। বাঁচা গেছে।

রাত কয়টা বেজে ঐশীর জানা নেই । একটা অতীব সত্যি বিষয় হলো , মানুষ মাত্রই অলস। সবসময় তার শুধু একটাই চাওয়া ” ইসস ! আরো সহজ উপায়ে যদি কাজটা করা যেত। ” কিন্তু সে এটা জানে না সেই তথাকথিত সহজ উপায় অবলম্বন করতে করতে সে নিজের ভাগ্যটাকেই সংকুচিত করে ফেলে । তেমনটাই করেছে ঐশী। সহজ উপায় স্বরূপ নিজের হাতঘড়ি- টায় একবার চোখ বুলালো। তিনটা দশ বাজে। ঐশী সময় দেখে এক ঢোক গিললো। কিন্ত তাতে কাজের কাজ কিছুই হলো না। গলা তবুও শুকনোই আছে। ঐশী চারপাশটায় একটু চোখ বুলালো। দুপাশে সারি সারি গাছ। অদূরে কয়েকটা মাটির ঘর দেখা যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে ঝি ঝি পোকার পরিচিত শব্দ কানে আসছে। নিঃসন্দেহে এটা এক ভয়ঙ্কর পরিবেশ। আর ঐশী ভয়ও পাচ্ছে। ঐশী ভয়কে পাশ কাটিয়ে বিসমিল্লাহ বলে সাইড ব্যাগটা শক্ত করে ধরে হাঁটা শুরু করলো। ঢাকা খুব দূরে নয়। সেই আন্দাজ করে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো ঐশী।

তিনটা ছেলে হেলেদুলে হাঁটছিলো রাস্তা ধরে। আজ জুয়া খেলে নেশাটা ভালই হয়েছে। মাথা চক্কর দিচ্ছে। কুচকুচে কালো রঙের ছেলে আকাশ দুলতে দুলতে বললো,

” মামা , আইজ খেললামও। আর গিললামও। এখন একটা মাইয়া পাইয়া গেলে তো রাতটাই ফুরফুরে হইয়া যাইবো। কি কস। ”

সজীব নামের ছেলেটা কোনো উত্তর না দিয়ে মাতাল গলায় গান ধরলো,

” মাই নাম ইজ শীলা , শীলা কি জাবানি।
বাহ। কিয়া জাবানি ! এমন জাবানি ওয়ালা মেয়ে মিলে গেলে তো মামা আমি বড়লোক হইয়া যাইতাম।ভাবতেই শরীর এখনই আনচান করতাছে। ”

দুজন যখন এক পৃথিবীতে মত্ত তখন হঠাৎ লিমন নামের ছেলেটা আঙ্গুল দিয়ে চাঁদের আবছা আলোয় ঐশীকে দেখিয়ে চমক গলায় বললো,

” মামা, ঐটা একটা মাইয়া না ? দেখতো।”

সজীব পিটপিট করে তাকালো। হেলে দুলে বললো,

” দূর বেটা। এহন এত রাইত্রে এহানে মাল আইবো কেমনে ? ”

মুখ দিয়ে বিষয়টাকে তাচ্ছিল্য করলেও আবারও সেদিকে তাকালো সজীব । কি হলো এটা ? সেকি ঠিক দেখলো ? একটা মেয়েই তো !

” হ মামা। মালই ত । ভালো করে চাইয়া দেখ। ”

আকাশের কথায় সজীব আর লিমন একটু নড়েচড়ে দাড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে তাকাল।না। একটা মেয়েই। তারা অবাক হলো। বিস্মিতও হলো। তারা একবারও কল্পনাও করেনি এত রাতে এই যুবতী চাঁদ পেয়ে যাবে।

তিনজন একে ওপরের দিকে তাকিয়ে হেলেদুলে জোরে হাঁটতে লাগলো ঐশীর দিকে।

” এই আফা। আফা গো। ও আফা। দাড়ান একটু। ”

পিছন থেকে বিশ্রী কণ্ঠ শুনে সেদিকে ফিরে তাকালো ঐশী। ছেলে তিনটাকে দেখে থমকে গেলো। এই মাতাল ছেলেপুলে দেখে যা বুঝার বুঝে গেলো ঐশী। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে আবারও সমানে তাকিয়ে জোরে হাঁটা ধরলো। আল্লাহ ! আজ যে আর কত কিছু মোকাবেলা করতে হবে। একদিনে ঐশীর অনেক অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে।

” আফা। ও আফা। আইজ যাইবেন আমাগো লগে ? টাকা দিমু। অনেক টাকা। ”

বলে ছেলেগুলো দৌড়ে ঐশীর পিছন পিছন আসতে আসতে লাগলো। ঐশী এবার দৌড় লাগালো। রাগে , ভয়ে রীতিমত কান্না করছে সে। স্পেশাল থেরাপি-টাও নাই। ওই শয়তান মির্জা-টা নিয়ে গেছে। এখন কি হবে ? ঐশী প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। ঐশীর চাওয়া , একবার শেষ রক্ষা হোক। এইবার ঐশী নিজের সম্মান রাখতে সক্ষম হোক।

কিন্তু বিধাতা মনে হয় ঐশীর চাওয়া রক্ষা করতে ইচ্ছুক নন। তাইতো ওই মাতাল ছেলেগুলো ঐশীকে খুব জলদি ধরে ফেললো। সজীব এগিয়ে এসে চোখ বুজে ঐশীর শরীরের ঘ্রাণ নিল। সঙ্গেসঙ্গে ঘৃণায় ঐশীর শরীর রি রি করে উঠলো। ছাড়া পাওয়ার জন্যে ছটফট করতে লাগলো ও । ছেলেগুলো একে একে ঐশীর দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। ঐশী ওদের এগুতে দেখে চোখ বন্ধ করে আল্লাহর নাম জপছে আর বারবার বাঁচার জন্যে ছটফট করছে।

” এই ধানিলঙ্কা মেয়েকে তোদের সাথে নিয়ে যা। যা টাকা লাগে আমি তোদের দিব। ”

হঠাৎ পুরুষালি কন্ঠ শুনে ছেলেগুলো ঐশীর থেকে মনোযোগ ছিন্ন করে পিছন ফিরল। আর ঐশী ? সে তো সেই দুর্বিষহ বাক্য শুনে ভয়ে ক্ষয়। আজই কি তার জীবনের সময়সীমা শেষ ? মজবুত ঐশী আজকের পরই কি দুর্বল হয়ে যাবে ?

#চলবে

{

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here