ইচ্ছের উল্টোপিঠ পর্ব-২৬

0
1933

#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_২৬
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

অন্ধকার এক রুম। কাঠের জানালা থেকে একটু আলো ছিটকে পড়ছিলো রুমের ভেতরে। কিন্তু সচেতনতার জন্যে ছেলেগুলো জানালাটা আটকে দিলো। ঐশী রুমের এক কর্নারে বসে আছে হাঁটু গেরে। পরনের সাদা লেহেঙ্গায় ধুলো বালি জমে আঁটসাঁট হয়ে আছে। ঐশীর অনেক ঘুম পাচ্ছে। ঘুমের কারণে চোখ মেলে রাখা দায়। তাও ঐশী চোখ পিটপিট করে বললো,
–” আমি ড্রিঙ্কস খাবো না। বাসায় যাবো আমি। বাসায় যা..”

বিড়বিড় করে আর কি যেন বললো বুঝতে পারলো না কেউ। ছেলেগুলো সব দিক আটকে দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো ঐশীর দিকে। মাতাল ঐশী নিজের মধ্যে নেই। তাও হাত দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করলো ওদের। তবে সক্ষম হলো না। ছেলেগুলো ঐশীর পাশে দাড়িয়ে জোড় করে ওকে দাড় করালো। দাড়িয়ে থাকা ঐশী হেলেদুলে আবারও পড়ে যেতে নিলে ছেলেগুলো খুব বিশ্রী হাতে ওকে আটকে নেয়। কোমরে রাখা হাত ঐশী জোর করে ছাড়াতে ছাড়াতে বিড়বিড় করলো,
–” খ্.খবরদার, অস.অসভ্যতামি করবে ন.না। ”

ছেলেগুলো হাসলো। সেই বিশ্রী হাসির শব্দ ঐশীর কানে যেতেই শিউরে উঠলো সে। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বললো,
–” বাসায় যা-যাবো আমি। বাসা-সায় যাবো। ছাড়ো আমায়।”
ছেলেগুলো ঐশীকে নিজের দিকে টেনে বললো,
–” যাবে তো বাসায়। আজ সারারাত আমাদের সাথে থেকে কালকে সকালে বাসায় চলে যাবে তুমি। এখন আসো। আমাদের কাছে আসো। ”
ক্লান্ত ঐশী চোখ বেটে নিয়ে বললো,
–” ছা-ছাড়ো আমায়। ছাড়ো। ”
ছেলেগুলোর ঐশীর এসব কাকুতি শুনার ইচ্ছে নেই। তারা
নিজ কাজ হাসিল করতে ব্যস্ত। দস্তাদস্তির এক পর্যায়ে একটা ছেলে ঐশীর লেহেঙ্গার টপসের পিছনের ফিতে ছিঁড়ে ফেললো। ঐশী যেনো ঝটকা খেলো। বাম হাত দিয়ে পিছন দিকটা ঢাকতে ঢাকতে বললো,.
–” আ-আমার ড্রেস। এই , এই কি করছো তোমরা। ছা-ছাড়ো। ”
ছেলেগুলো এবার যেনো আরো হিংস্র হয়ে উঠলো। ঐশীর লেহেঙ্গার হাত টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেললো। ঐশী নিজেকে বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। কিন্তু জোয়ান ছেলেগুলোর সাথে সে মাতাল এক মেয়ে পেরে উঠছে না।

_____________________

জুভান প্রায় অনেকক্ষণ হলো ঐশীকে খুঁজে যাচ্ছে। পার্টিতে আসার পর ব্যস্ত থাকায় ঐশীর খবর নিতে পারেনি ও। কিন্ত ফ্রি হবার পর প্রায় এক ঘন্টা যাবত ঐশীকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। সম্পূর্ণ রিসোর্ট উত্তাল পাত্তাল করে ফেলেছে। কিন্তু কোথাও ওর দেখা নেই। জুভান একজায়গায় দাড়িয়ে পড়লো। কোমরে ডান হাত দিয়ে, বাম হাত দিয়ে কপাল চুলকালো। বুকের ভিতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে ওর। এমন একটা অচেনা জায়গায় ঐশী নিখোঁজ! এর থেকে ভয়ংকর খবর আর কি হতে পারে। জুভানের পাশ দিয়ে একটা ওয়েটার গেলে জুভান জলদি ওকে থামিয়ে নেয়। ব্যাকুল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
–” হেই, একটু আগে এখানে একটা মেয়ে ছিল। সাদা লেহেঙ্গা পড়া। দেখেছো তাকে? ”

ওয়েটার ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর জুভানকে চিন্তায় ফেলে দিয়ে ” না বোধক” উত্তর দিলো। জুভান অসহায় ভাবে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আবারও দৌড় লাগালো। এত রাতে কোথাও গেলো এই মেয়ে! জুভান দৌড়াচ্ছে আর চারপাশে তাকাচ্ছে। কিন্তু কোথাও নেই ও। জুভানের কপাল ধরধর করে ঘামছে।
সে নিজেকে সামলে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলো। ওয়াশরুমের দরজা খুলতেই একটা পুরনো ঘর থেকে মৃদু চিৎকার ওর কানে আসলো। জুভান থমকে গেলো। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বুঝার চেষ্টা করলো সেই আওয়াজ। কিন্তু এবার কোনো আওয়াজ আসলো না। কিন্তু জুভান থেমে গেলো না। জলদি পা বাড়ালো সেই পুরনো রুমের দিকে।

দরজা ভিতর থেকে আটকানো। জুভান ভয়ে রীতিমত ঘামছে। মনে মনে একটাই প্রার্থনা করছে ” তার মেঘবালিকা যেখানেই থাকুক, সেফ থাকুক। ”
জুভান দরজা ধাক্কা দিতে গেলেও থেমে গেলো। কোনো
বাচ-বিচার না করে এক ধাক্কা দিয়ে দরজা ভেঙে ফেললো সে।
কিন্তু তারপর যা দেখলো তাতে ও সম্পূর্ণ থমকে গেলো। ঐশীর সাথে দুজন ছেলে রীতিমত জোর-জবরদস্তি করছে। তারা নিজেদের কামনা মেটাতে এতটা ব্যস্ত ছিল যে দরজা ভাঙার শব্দ তাদের কানে যায়নি।এসব দেখে জুভানের দাত কিরমির করে উঠলো। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রক্তলাল চোখে এগিয়ে গেলো ওদের দিকে। সঙ্গেসঙ্গে দুজন ছেলেকে নাক বরাবর পরপর তিনটি ঘুষি দিয়ে মাটিতে শুইয়ে দিলো তাদের। নাক থেকে গড়গড় করে রক্ত ঝরছে ওদের। জুভানের এসব দেখেও মায়া লাগলো না। সে আর নিজের মাঝে নেই। ক্রমাগত লাথি দিতে লাগলো ওদের শরীরে। ছেলেগুলোর আর উঠে দাড়ানোর শক্তি নেই। মাটিতে শুয়ে কাতরাতে লাগলো ওর। জুভান পাগলের মত এদের মারতে লাগলো আর চিৎকার করে বললো,
–” শালা, জানো** বাচ্চা।তোদের সাহস কি করে হয় আমার জিনিসের দিকে হাত বাড়ানোর। শি ইজ ম্যাই গার্ল। বুঝেছিস? আজ তোদের দুনো হাত আমি ভেঙেই ফেলবো মাদা***।”

জুভান রাগে এক পা দিয়ে আটকে ধরলো ছেলের হাত। ছেলেগুলো ছটফট করতে লাগলো। বারবার মাফ চাইতে লাগলো জুভানের কাছে। জুভান এদের মারতে মারতে চোখ গেলো ঐশীর দিকে। ঐশী একপাশে অনুভূতিশূন্য ভাবে দাড়িয়ে আছে। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে অবিরাম। জুভানের বুক ধক করে উঠলো। ছেলেগুলোর হাত ছেড়ে দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো ঐশীর দিকে। ঐশীর সামনে দাড়িয়ে ওর গাল আলতো হাতে ছুঁয়ে বললো,
–” ভয় পেও না। আমি আছি না? কিছু হবে না তোমার। কিছু না। ”

ঐশী কান্নাভেজা চোখে জুভানের দিকে তাকালো। ঐশীর চোখের দিকে তাকিয়ে জুভান আশ্বাস দিলো। হঠাৎ ওর চোখ গেলো ঐশীর জামার দিকে। জায়গায় জায়গায় ছেড়া ওর লেহেঙ্গা। জুভানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো এসব দেখে। সঙ্গেসঙ্গে নিজের চোখ সরিয়ে নিলো ও। নিজের গায়ের জ্যাকেট খুলে ঐশীর দিকে এগিয়ে বললো,
–” পড়ে নাও। ”

ঐশী যেনো নিজের মাঝে নেই। তার নেশা এখনো কাটে নি। সে শরীর ছেড়ে দিয়ে স্থির ভাবে দাড়িয়ে আছে নিজ জায়গায়। জুভান এসব দেখে নিজেই জ্যাকেট-টা পড়িয়ে দিলো ঐশীকে।
ঐশীর হাত ধরে বেরিয়ে গেলো সে ঘর থেকে। ওরা বেরোনোর সময় পার্টির সবাই অবাক হয়ে দেখলো ওদেরকে। কেউ কেউ ভিডিও করতে চেয়েছিল। কিন্তু জুভান তখন একঝাঁক লোকের সামনে চিৎকার করে বলেছে,
–” আজকের ঘটনা যদি কোথাও লিক হয়, তাহলে আই সোইয়ার,আমি সেই চ্যানেল চিরকালের জন্যে বন্ধ করে দিবো। ( আঙুল উচিয়ে) অ্যান্ড আই মিন ইট। ”

___________________
” নিস্তব্ধ কুঠির”। সুবিশাল বাড়ির গেটের সামনে নেমপ্লেটে জ্বলজ্বল করছে এই নাম। জুভান ঐশীকে নিয়ে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলো। লেবু পানি খাইয়ে ঐশীর নেশা বেশ খানিক কাটিয়ে দিয়েছে জুভান। ঐশী এখন ক্লান্ত শরীরে মাথা নুইয়ে বিছানায় বসে আছে। শরীর এখনো মৃদুমন্দ কাপছে। একটু আগের দেখা ভয়ংকর দৃশ্য চোখের সামনে যেনো জ্বলজ্বল করে ভাসছে ওর। জুভান সার্ভেন্টকে বেসিন পরিষ্কার করতে বলে ঐশীর পাশে এসে বসলো। ঐশীর ওর দিকে একটা শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বললো,
–” তোমার ড্রেস। ”

ঐশী কিছু না ভেবেই ব্যাগটা নিজের হাতে নিলো। জুভান ঐশীর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো। ঠোঁট ফেটে চৌচির হয়ে আছে ওর। জুভান মিহি আওয়াজে বললো,
–” পানি খাবে? ”

ঐশী ডানে মাথা নাডলো। যার অর্থ” পানি খাবে সে”। জুভান এগিয়ে গেলো টি টেবিলের দিকে। গ্লাসের উপর থেকে প্রটেক্টর সরিয়ে গ্লাসটা এগিয়ে দিলো ঐশীর দিকে। ঐশী জুভানের হাত থেকে ছু” মেরে গ্লাস নিয়ে একদমে পুরো পানি সাবার করে দিলো। জুভান ঐশীর এমন অবস্থা দেখে ভ্রু কুচকে বললো,
–” আরো ? ”
ঐশী সম্মতি দিলো। জুভান মুচকি হেসে ঐশীর দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিলো। ঐশী বোতল হাতে নিয়ে তিন ঢোকে অর্ধেক পানি শেষ করে ফেললো। জুভানের দিকে বোতলে এগিয়ে দিয়ে হাত দিয়ে ঠোঁট মুছলো। জুভান কিছুটা অবাক হলেও মুখে প্রকাশ করলো না। বোতলটা জায়গায় রেখে দিয়ে বললো,
–” শাওয়ার নিয়ে আসো। আমি ডিনার রেডি করছি। ”

ঐশী ” হা,না ” কিছু না বলে ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। জুভান ফুস করে এক নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
–” স্ট্রেঞ্জ! ”

_________________________
জুভান নিচে গিয়ে সকল সার্ভেন্টকে ডাক দিলো। সবাই এক জায়গায় জড়ো হলে জুভান পায়চারি করতে করতে বললো,
–” আজকে সকল আনহেলথি ফুড বানানো হবে। লাইক , মাটন, কাবাব, পোলাও, কোরমা। অ্যান্ড ফাইনালি চিকেন। ইজ দেট ক্লিয়ার? ”

সার্ভেন্ট সবাই মাথা নিচু করে সম্মতি দিলো। জুভান নিজের রুমে চলে যেতে নিলে আবারও ফিরে তাকালো। ওদের দিকে একঝলক চোখ বুলিয়ে বললো,
–” আজ কোনো ফিমেল সার্ভেন্ট আসে নি? ”
একজন বয়স্ক লোক মাথা নেড়ে না বোধক উত্তর দিলো। জুভান ভ্রু কুচকে তাকিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো।

ঐশীর রুম ক্রস করতেই জুভান থেমে গেলো। মাথা ঘুরিয়ে ঐশীর রুমের দিকে তাকালো। ঐশী আয়নায় দাড়িয়ে জামার পিছনের ফিতা লাগানোর চেষ্টা করছে। চোখে মুখে বিরক্তি তার। বিড়বিড় করে বলছে,
–” এই সুতোর জামা ছাড়া আর কোনো জামা ছিল না মার্কেটে?”

ঐশী হাত দিয়ে যথাসম্ভব চেষ্টা করছে ফিতে লাগানোর। জুভান এসব দেখে হাসলো। পাগল মেয়ে! জুভান দরজায় হাল্কা করে ঠোকা দিলো। ঐশী হুড়মুড়িয়ে ফিরে তাকালো। জুভানকে দেখে জলদি ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ওড়না নিয়ে গায়ে জড়ালো। জুভানের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে মিনমিনিয়ে বললো,
–” আপনি? ”

জুভান জিন্সের পকেটে দুনো হাত ঢুকিয়ে রুমে প্রবেশ করলো। মৃদু হেসে বললো,
–” এই ড্রেস আমি না, শাহাদাত চাচা এনেছেন। বয়স্ক মানুষ এতসব বুঝেন না। তাই তোমার ভাষ্যমতে এই সুতোর জামা নিয়ে এসেছেন। ”

বলেই জুভান ফিক করে হেসে উঠলো। ঐশী এসব শুনে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো নিজের জায়গায়। জুভান ঐশীর দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললো,
–” আজ কোনো ফিমেল সার্ভেন্ট আসেনি। সো, তুমি যদি চাও ফিতে লাগাতে আমি হেল্প করতে পারি। বাট ডোন্ট ওয়ারি, আমার চোখ কাপড় দিয়ে বাধা থাকবে। ”

ঐশী হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো জুভানের দিকে। ঠোঁট কামড়ে চিন্তা করলো কিছুক্ষণ।

#চলবে…
শব্দসংখ্যা – ১৩০০+
আগামী পর্ব পরশু দেওয়া হবে।

আগের পর্ব
https://www.facebook.com/105343271510242/posts/196170669094168/?app=fbl

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here