ইচ্ছে_দুপুর পর্বঃ১
দিজা আরুশি আরু
মেডিকেলে চান্স পাবার পর সাধারনত সবার বাড়িতে মেয়েকে নিয়ে মাতামাতি লেগে থাকে।কিন্তু আমার বেলা হলো তার উল্টো।মেডিকেলে চাঞ্চ পেয়েছি শুনে বাবা তড়িঘড়ি কোনো এক মাস্টার মশাইয়ের সঙ্গে আমার বিয়ের দিন তারিখ পাকা করে ফেললেন।যেখানে সবার আমাকে নিয়ে মেতে থাকার কথা সেখানে সবাই আমার বিয়ে নিয়ে মেতে উঠলো।
আমি ইচ্ছেবিলাসী রহমান।পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী মানুষের একজন।যার এতোবছর কষ্ট করে পড়ার মূল্য তার পরিবার দিলো না।ছোট থেকে খুলনায় বড় হয়েছি।দরকার ছাড়া বাড়ির বাইরে অবধি পা রাখি নি।আসলে অনুমতি পাই নি।আর আমি তো বাবা মায়ের বাধ্য মেয়ে।তাই তাদের অমতে কক্ষণো কিছু করি নি।তবে আমার উপর এবার তাদের করা অন্যায়টা মেনে নিতে পারলাম না।তাই ভেবে নিলাম পালাবো।
যেই ভাবা সেই কাজ।মাঝরাতে ব্যাগপত্র নিয়ে যেই পালাবো ঠিক সে সময় বাবার কাছে ধরা খেয়ে গেলাম।বাবা সে রাতেই আমার বিয়ে দিয়ে দিলেন।আকদ যাকে বলে আরকি।আমাকে কাজী এসে কবুল পড়িয়ে গেলো তারপর বরের বাড়িতে চলে গেলো।রাগে শোকে আমি তখন পাগলপ্রায়।কিসের ডাক্তারী পড়া,কিসের শহরে যাওয়া,আমি তখন এই শোকে মরছি যে আমাকে সবাই ডাক্তার ইচ্ছেবিলাসী না ডেকে মাস্টারের বউ ডাকবে।
আমার এই অতি শোকের মাঝে বাবা বললেন,
—এখন থেকে তুমি ইচ্ছেবিলাসী রহমান নয় ইচ্ছেবিলাসী মাহবুব লিখবে।
আমি তখন নাক টেনে টেনে কাঁদছি।বাবার কথায় মাথা দুলালাম মাত্র।তারপর সোফা থেকে উঠে নিজের ঘরে চলে এলাম।
ভেবে অবাক হচ্ছি আমার জীবনটা হঠাত এমন বদলে গেলো কি করে!যেখানে আমার এখন মেডিকেলে ভর্তি,হোস্টেলে রুম ঠিক করা এসবে ব্যস্ত থাকার কথা সেখানে আমি এখন কারো বিবাহিতা স্ত্রী।তার উপর আমার এমন চাঁদ কপাল যে নিজের বরকে দেখা তো দূরের কথা তার নামটা অবধি জানি না।অথচ তার নামের একটা অংশ এখন থেকে আমায় বয়ে বেড়াতে হবে।সত্যিই জীবনটাকে বড্ড বেশি অদ্ভুত লাগতে লাগলো।
সেদিনের পর বাড়ির কারো সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলি নি।ছোটভাই তুর্জ কয়েকবার এসে কথা বলতে চেয়েছিলো,আমি তার কথায় সায় দিচ্ছি না দেখে মুখ গোমরা করে চলে গেলো।আসলে বেচারার দোষ নেই তবে মন খারাপ থাকলে সবাইকেই অসহ্য লাগে।তা সে দোষী হোক বা না হোক।
এভাবে কেটে গেলো সাতটা দিন।এ সাতদিনে কারও সঙ্গে কথা না বললেও নিজের কাগজপত্র ঠিক গুছিয়ে নিয়েছিলাম।সকাল দশটার বাসে বাবার সঙ্গে আমি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।ভেবে অবাক হচ্ছিলাম যে,আমার নামমাত্র বর এখন পর্যন্ত আমায় দেখতে আসে নি কেনো?তাকেও কি আমার মতো জোর করে বিয়ে করানো হয়েছিলো?আবার মনে হলো,আচ্ছা বর বেটা কি টেকো ভুড়িওয়ালা মাস্টারমশাই!নতুবা নিজের বিয়ে করা বউয়ের সামনে আসবে না কেনো।
নানা রকম অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে অবশেষে আমার মেডিকেলে ভর্তিকার্য সম্পাদন হলো।হোস্টেলে একটা সিঙ্গেল রুমও পেয়ে গেলাম।ভাবতেও অবাক লাগছিলো যে,প্রথম বর্ষের হয়েও আমি হোস্টেলে সিঙ্গেল রুম পেলাম কি করে!
কৌতুহল ধরে রাখতে না পেরে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম,
—বাবা,সাধারনত প্রথম বর্ষের স্টুডেন্টরা হোস্টেলে রুম পেতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়।তাহলে আমাকে এতো সহজে একটা গোটা সিঙ্গেল রুম দিয়ে দিলো কি করে?তোমার কাছে অদ্ভুত লাগছে না ব্যাপারটা?
বাবা মুচকি হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
—অবাক হবার কিছুই নেই ইচ্ছে।তোর শ্বশুরের বন্ধু তোর মেডিকেল কলেজের উপর মহলে দায়িত্বরত আছেন।উনিই কথা বলে তোকে রুমটা পাইয়ে দিয়েছেন।তাছাড়া তোর ভর্তি,থাকা খাওয়া সব খরচ তো জামাই বাবা’ই দিচ্ছে।
তখন আমার ভেতর ভেতর বড্ড রাগ হতে লাগলো।যে মানুষটাকে চিনি না,জানি না কেবল একটা শব্দের জোরে তার এবং তার পরিবারের সবার থেকে সুবিধা গ্রহন করতে হবে আমায়!আমি মুখ বেঁকিয়ে বললাম,
—জামাই বাবা!হুহ…রাগে গা পিত্তি জ্বলে যায়।এতো আদিখ্যেতা কোথা থেকে আসে বুঝি না বাবা।
ভেবেছিলাম বাবা আমার বিড়বিড় করে বলা কথাগুলো শোনেন নি।কিন্তু বাবা ঠিকই শুনলেন।শুনেই হুঙ্কার দিয়ে উঠে বললেন,
—জামাই আমার সোনার টুকরো ছেলে।তাকে নিয়ে যা তা বললে আমি ভুলে যাবো তুই আমার মেয়ে।তোর সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করতেও সময় নেবো না।তোর তখন জামাই বাবার কাছে যাওয়া ছাড়া কোনো পথ থাকবে না।
আমি কেবল মাথা নিচু করে বাবার কথাগুলো গলাধঃকরণ করলাম।সত্যি বলতে তখন বাবার জামাইকে সামনে পেলে আমি নিঃশ্চিত তাকে গরম তেলে ভাজতাম।আরে যার নামটা অবধি জানি না তার সম্পর্কে এতো সুনাম কার সহ্য হয়!তার উপর আমার বাবাকে সে কিনে নিয়েছে।আমার বাবা তার আদরের ইচ্ছেবিলাসীকে বকছে তাও কি না ওই বজ্জাত মাস্টারের জন্য।ভাবা যায়…!
কিছুক্ষণ পর বাবা আবার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
—ইচ্ছে মা,সংসার জীবন ছেলেখেলা নয়।এ জীবনে অনেক দায়িত্ব।ছেলেটা অকপটে সব দায়িত্ব পালন করছে তার মানে এই না যে তুই তাকে অবহেলা করবি।তুই তাকে ভালো না বাসলে সে তোর কাছে ধরা দেবে কেনো?
—আমি সংসার জীবনের মারপ্যাঁচ বুঝি না বাবা।কি করে বুঝবো,তোমরা তো সারাজীবন আমার জীবনটাকে বইখাতা আর বাসার চার দেয়ালের মাঝেই সীমাবদ্ধ রেখেছো।তবে এখন কেনো চাইছো হঠাৎ করে আমি বড় হয়ে যাই,সব ধরনের দায়িত্ব বুঝে নেই?বড় হওয়া এতো সোজা?এতো সহজে কি বাচ্চা বাচ্চা স্বভাবের ইচ্ছেবিলাসী চাইলেই বড় হতে পারবে?দায়িত্বের বোঝা সামলাতে পারবে?
—মেয়ে হয়ে জন্মালে দায়িত্ব কখনো না কখনো তো নিতেই হবে মা।
—সে কখনো না কখনো আর যাই হোক এখন না।এতো পড়ে মেডিকেলে চাঞ্চ পেলাম আর তুমি আমাকে সেই প্রাপ্তিটার আনন্দ ভোগ করতে দিলে না।জোর করে বিয়ে দিয়ে দিলে।দিলে তো দিলে তার উপর এখন বলছো মানিয়ে নিতে!বিয়ে দেয়ার আগে তোমার ভাবা উচিত ছিলো আমার আধো মানিয়ে নেয়ার বয়স হয়েছে কিনা।তখন যখন ভাবো নি তাহলে এখন আর ভাবতে এসো না।আমার জীবন আমি যা বুঝবো তাই হবে।তাছাড়া আমি এখন বিবাহিত।আমাকে কিছু বলার অধিকার এখন তোমাদের বাড়ির কারও নেই।
কথাটা বলেই হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে হোস্টেলের ভেতর চলে গেলাম।আমার ঘরটা তিনতলায়।দৌতলার সিঁড়িঘরে দাড়িয়ে আড়াল থেকে দেখলাম বাবা এখনো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছেন।বাবার সঙ্গে আমি কখনো জোর গলায় কথা অবধি বলি নি, সেখানে আজ আমি বাবাকে কতো কথা শুনালাম।আসলেই সম্পর্কগুলো রং পাল্টায়।তার সঙ্গে সঙ্গে আমি স্বত্বাটাও একসময় পরিবর্তিত হয়।যেমন আমি নিজেকে আজ নতুন করে আবিষ্কার করলাম।
হোস্টেলে আমার দিনগুলো বেশ কষ্টে কাটতে লাগলো।কাটবে না’ই বা কেনো, আমি তো রান্নার র-টাও জানি না।কিনে খাওয়ার সামর্থ্য আমার নেই।আমার বরের আছে কি না জানি না।তবে অহেতুক অর্থ ব্যয় করা আমার পছন্দ না।তাই এক সিনিয়র আপুর কাছে টুকটাক রান্না শিখতে লাগলাম।মিতালি আপু ছিলো বড্ড রাগী,রান্না শিখতে গিয়ে দু-একটা থাপ্পড়ও খেয়েছি।
যেই আমি বাস্তবতা থেকে কয়েক ক্রোশ দূরে ছিলাম সেই আমাকে গোটা পনেরো বিশদিনের দিনের মাঝে কতো কতো বাস্তবতার সম্মুখীন হলো!
হোস্টেলে স্যাটেল হবার পঁচিশ দিনের মাথায় ক্লাস শুরু হলো।প্রথম দিন ক্লাসে গিয়ে আমি রিতীমতো ধাক্কা খেলাম।এতোসব টেকো,ভুড়িওয়ালা স্যারদের মাঝে দু’জন জুনিয়র স্যারও আছেন।দুজনেই এখানে পরিক্ষা দিয়ে প্রথম হওয়ায় এখানেই চাকরি পেয়েছে।ওনাদের দেখে আমি হাওয়ায় ভাসতে লাগলাম।স্বপ্ন দেখতে লাগলাম যে,আমিও একসময় মেডিকেল কলেজে টপ করবো।তারপর আমিও আমার স্যারদের কলিগ হয়ে স্টুডেন্টদের পড়াবো।
কথাগুলো ভাবছিলাম,হঠাৎ কারো ডাকে ঘোর কাটলো আমার।সামনে তাকিয়ে দেখি রুদ্র স্যার আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছেন।কি বলবো খুঁজে না পেয়ে স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা শুকনো হাসি দিলাম।স্যার কি বুঝলো কে জানে,আমাকে ধমকে উঠে বললেন,
—এই মেয়ে,আমাকে কি জোকার মনে হয় তোমার?
- চলবে…