জলে_ভাসা_পদ্ম ০২ শেষ পর্ব

#জলে_ভাসা_পদ্ম
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ০২ (শেষ পর্ব)
__________________

ফিরোজা খাতুন বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে চ্যাঁচামেচি করছেন। চ্যাঁচামেচির বিষয় হচ্ছে, পদ্ম ইদানিং কাজ-বাজ করছে না তেমন। পদ্ম ঘরের ভিতর বসে শুনছে শাশুড়ির ধারালো একেকটা কথা। কিছু বলছে না, সব সহ্য করে নিচ্ছে। কী-ই বা বলার আছে তার? হৃদয়ই যেখানে এখন মৃতপ্রায় সেখানে কাজের প্রতি কার মন থাকে? মানুষগুলো তাকে একটুও বোঝার চেষ্টা করছে না। একটুও না! এই বিশ্ব ভূখণ্ডে পদ্ম নিজেকে ভীষণ একলা এবং অবহেলিত অনুভব করছে! ঘরের দরজা বন্ধ করে রেখেছে সে। জানালায় দাঁড়িয়ে উঠোনে দৃষ্টি রেখেছিল এতক্ষণ। সম্মুখ জানাল ছেড়ে পিছন জানালার দিকে অগ্রসর হলো। তাহেরের কথা ভাবছে সে। মানুষটার কাছে আসলেই সে অবহেলার পাত্রী হয়ে গেছে! কই, তাহের তো কিছু বললো না নিজের মাকে! সে তো উঠোনেই উপস্থিত ছিল। মায়ের কথার প্রতিবাদ কি করা উচিত ছিল না তার? ছিল তো। কিন্তু করলো না। পদ্মর হৃদয়ে অভিমান স্তূপীকৃত হয়ে গেড়ে বসলো। চোখের তারায় চিকচিক করে উঠলো অশ্রু। মনে মনে তাহেরের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো,
“আপনার কাছে এতটাই অনীহার পাত্রী হয়ে গেছি তাহের সাহেব?”

প্রশ্নটা করতে হৃদয়ে খুব ব্যথার উপলব্ধি হলো। হৃদয় যেন ক্ষয় হতে শুরু করেছে। পদ্ম ‘তাহের সাহেব’ শব্দ দুটো নিয়ে ভাবতে লাগলো। বিয়ের এত বছরেও সে কখনও তাহেরকে কোনো কিছু বলে সম্মোধন করেনি। ‘তাহের’ অথবা ‘তাহের সাহেব’ ডাকতে তার কেমন যেন লাগতো। তাই কখনও ডাকেনি।
একবার তাহেরকেই জিজ্ঞেস করেছিল,
“আপনাকে কী বলে ডাকবো আমি?”

তাহের উত্তর দিয়েছিল,
“পদ্ম বিবির স্বামী বলে ডেকো।”

তাহেরের উত্তরে পদ্ম লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। মানুষটা এমন ত্যাড়া-বাঁকা কথা না বলে যেন সোজা-সাপ্টা কথা বলতে পারে না।
তাহের পদ্মর লজ্জামাখা মুখখানি দেখে হাসে। সে বসে আছে খাটে, আর পদ্ম দাঁড়িয়ে। সে বসা থেকে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে পদ্মর মাথাটা নিজের বুকে টেনে নিলো। কিশোরী পদ্ম স্বামীর প্রশস্ত বুকে ঠাঁই পেয়ে জড়ো-সড়ো হয়ে গেল একেবারে। তাহের বললো,
“এত লজ্জা কেন পাও তুমি পদ্ম? এরকম লজ্জা পেলে তোমার নাম তো পদ্ম বিবি বাদ দিয়ে লজ্জাবতী রাখতে হবে। আমাকে নাম ধরে ডেকো। ‘তাহের’ অথবা ‘তাহের সাহেব’!”

তাহের বলে দেওয়ার পরও পদ্ম তাকে নাম ধরে ডাকতে পারেনি। মনে মনে অজস্রবার নাম ধরে ডাকার অনুশীলনী করলেও মুখে ‘তাহের’ শব্দটি কখনও ফুঁটাতে পারেনি। পদ্মর ঠোঁটের কোণে সহসা একটা সরল হাসির রেখাপাত ঘটলো। বিষাদমাখা সরল হাসিটা যেন একটু বেশিই নয়নাভিরাম মনে হলো। মানুষের আনন্দের হাসির থেকে বিষাদ জড়িত হাসিই বোধহয় প্রকৃত অর্থে বেশি সুন্দর এবং মর্মঘাতিক হয়। পদ্মর হাসি থেকে এই বিষয়টা উপলব্ধি করা গেল সহজেই।

বিকেলে পদ্ম শাশুড়ির ঘর ঝাড় দিতে এসেছিল। স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহের জন্য ঠিক করা মেয়েটিকে সে এর আগে দেখেনি। দেখার ইচ্ছা জাগেনি মনে। কিন্তু আজ যেন তার মন কেমন করলো। খুব ইচ্ছা হলো মেয়েটিকে দেখতে। সে জানতো শাশুড়ির ঘরে টেবিলের ড্রয়ারের ভিতর মেয়েটির ছবি পাওয়া যাবে। সে ড্রয়ার খুলে ছবিটা খুঁজে বের করলো। খুব গভীরভাবে দেখতে লাগলো মেয়েটার ছবি। মেয়েটা তার মতো সুন্দর নয় দেখতে। চেহারার ধরণও তেমন আকর্ষণীয় নয়। পদ্ম নিবিড় দৃষ্টি বুলিয়ে চললো অনেকক্ষণ ধরে। মেয়েটার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকাকালীন কষ্টের একটা সূক্ষ্ম রেখাংশ তিরতির করে একটা বিশ্রী শব্দ তুলে তার হৃদপিণ্ড ছিদ্র করে দিলো। একরাশ হাহাকার জেগে উঠলো বুকে। মেয়েটার ছবির উপর হাত বুলিয়ে গভীর গলায় বললো,
“কী ভাগ্যবতী গো তুমি!”
আরও হয়তো কিছু বলতো সে। হয়তো হৃদয়ের জমা কষ্টের ক্ষুদ্র একটা অংশ এই ছবির ভিতরে থাকা মেয়েটার কাছে সে এভাবেই প্রকাশ করতো। কিন্তু তার আগেই তার শাশুড়ি এসে পড়লো। পদ্ম ব্যস্ত হয়ে ছবিটা ঢুকিয়ে রাখলো ড্রয়ারে।

ফিরোজা খাতুন ঘরে ঢুকে পদ্মকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কটু স্বরে কয়েকটা কথা শোনালেন। পদ্ম চুপচাপ হজম করে নিলো। তবে আননে কান্না কান্না একটা ছাপ ফুঁটে উঠতে চাইছিল থেকে থেকে। পদ্ম কান্না চেপে বেরিয়ে এলো সেখান থেকে।

______________

ক্রন্দনের চাপা করুণ সুর ছড়িয়ে পড়েছে পদ্মর পুরো ঘরময়। হৃদয়ে চলছে অসহ্যনীয় জ্বালাপোড়ন! এত কেন কষ্ট হচ্ছে? এত কাঁদছে কেন সে? কাঁদতে তো সে চায়নি। একদমই চায়নি কাঁদতে। চেয়েছিল এক ফোঁটা চোখের জল ঝরাবে না। তবুও অবাধ্য হয়ে চোখের জল এত অনর্গল কেন ঝরছে? কেন ঝরছে?

বাইরে চলছে বিয়ে উপলক্ষ্যে উৎসব উৎসব আমেজ। ওই আমেজের কাছে তার এই কষ্ট, কান্না কতই না তুচ্ছ! সেও অতি তুচ্ছ একটা প্রাণ এখন এই পৃথিবীর বুকে। পদ্ম দুই হাত দিয়ে বালিশটা আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। বালিশে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। এই মুহূর্তে শ্বশুর আব্বার কথা খুব করে মনে পড়ছে। শ্বশুর আব্বা বেঁচে থাকলে এই বিয়ে কখনও হতো না, কখনও না। কিছুতেই সে হতে দিতো না এই বিয়ে।
পদ্ম আজ দেখেছে, তার স্বামীর পাশে লাল বেনারসি পরে একটা মেয়ে প্রবেশ করেছে বাড়িতে! ওটা তার দেখা জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক দৃশ্য ছিল! নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিচ্ছিল তার। স্বামীর পাশের ওই স্থানটা কোনো স্ত্রী কি অন্য কাউকে দিতে পারে? পারে না। পদ্মও পারছে না। কিন্তু তার সহ্য করতে হচ্ছে সব। সে সহ্য করতে বাধ্য। তার বার বার একটা কথা মনে হচ্ছে, তাহের তাকে ভালোবাসেনি! সত্যিই ভালোবাসেনি। যদি ভালোবাসতো তাহলে শুধুমাত্র একটা সন্তানের জন্য আরেকটা বিয়ে করতে পারতো না! যদি মানুষটা সত্যিকারের ভালো না-ই বেসে থাকে তাহলে কেন এত ভালোবাসা দেখিয়েছিল? কেন করলো মানুষটা এমন? পরিবর্তন হয়ে গেছে ‘প্রিয় স্বামী’ নামক ব্যক্তিটা! খুব পরিবর্তন হয়ে গেছে!
ধীরে ধীরে বাইরের উৎসব আমেজ কমে গিয়ে পরিবেশ নীরব হয়ে এলো। কিন্তু ঘরের ভিতর পদ্মর কান্নার ধ্বনি নীরব হলো না।
ঘরের ভেজানো দরজাটা হাট করে খুলে গেল। ওই শব্দ পদ্মর কর্ণকুহরে প্রবেশ করে তাকে সচকিত করতে পারলো না। পরিচিত আলতো এক কণ্ঠস্বরে তার জাগতিক চেতনা ফিরলো,
“পদ্ম…”

চিরচেনা ডাকে পদ্মর কান্নার করুণ ধ্বনি থমকে গেল। বালিশে গুঁজে রাখা মুখটা হালকাভাবে উঁচু করলো সে। তাহের!
অক্ষির কোল ডিঙিয়ে কষ্টের ধারা বহমান হতে শুরু করলো আবার। কেঁদে উঠলো অন্তরাত্মা। হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলো বালিশ। নিজেকে যথাসম্ভব সংযত করে নামলো বিছানা থেকে। অশ্রু মুছলো না। এটা গোপন করার কিছু নেই। তাহেরের উদ্দেশ্যে বললো,
“আপনি এখানে এসেছেন কেন?”

তাহের এক পা এগিয়ে এলো। আবারও কোমল কণ্ঠে ডাকলো,
“পদ্ম!”

দুজনের মাঝে দূরত্ব অনেক। ঘরে লাইট জ্বলছে না। চারপাশের আলো প্রবেশ করে ঘর মোটামুটি উজ্জ্বল করেছে। পদ্ম স্বামীর আঁখি জোড়া লক্ষ্য করলো। মানুষটার চোখ কি ছলছল করছে? না করছে না।
হৃদয় ভাঙনের সাথে সাথে মুখ বেঁকেও কান্না এলো পদ্মর। কিন্তু সামলে নিলো নিজেকে। চোখের অশ্রু শব্দহীন বিসর্জন হচ্ছে। এমনই থাকুক। বললো,
“ওদিকে আপনার নতুন স্ত্রী আপনার জন্য অপেক্ষা করছে, আপনি নতুন স্ত্রী রেখে পুরোনো স্ত্রীর সাথে কেন দেখা করতে এসেছেন? চলে যান। আমার সাথে দেখা করার কিছু নেই। আমি তো এখন পুরোনো, মূল্যহীন আপনার কাছে! চলে যান।”

তাহের কাছে এগিয়ে এলো। পদ্মর কুসুমকোমল মুখটি দুই হাতে আলতো করে ধরে বললো,
“কে বললো তুমি পুরোনো, মূল্যহীন আমার কাছে?”

পদ্ম তাহেরের হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,
“মিথ্যা ভালোবাসা আমাকে আর দেখাবেন না তাহের সাহেব। আমি দেখতে চাই না আপনার এমন ভালোবাসা।”

তাহের ভর্ৎসনার সুরে বললো,
“মিথ্যা?”

পদ্ম ‘মিথ্যা’ শব্দটার ব্যাখ্যা দিতে পারলো না। কান্না ভেজা কণ্ঠে বললো,
“চলে যান, উনি অপেক্ষা করছেন।”

তাহের স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। এটা নিয়ে কথা বাড়ালো না আর।পদ্মর কাছ থেকে আবারও একই কথা ভেসে এলো,
“চলে যান।”

পদ্ম এই মুহূর্তে বুঝতে পারলো না তাহেরের মৌন অবস্থা। শুধু দেখলো, মানুষটা ক্ষণকাল তাকিয়ে রইল তার দিকে। তারপর দৃষ্টি হতে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে একটা ঢোক গিলে আবার তাকালো। তারপর হালকা মাথা দুলিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বললো,
“হুম, যাচ্ছি।”

বলে চলে গেল তাহের। সে চলে যাওয়ার পর আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লো পদ্ম। আজ অনেকদিন পর তাহেরের সাথে কথা হয়েছে তার। এতদিনে একটা কথাও হয়নি। কান্না চললো কিছুক্ষণ। ধীরে ধীরে সে নিজেকে সামলে নিলো। জল ল্যাপ্টানো চোখে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো পিছন জানালায়। এখান থেকে বাড়ির পিছন দিকটা দেখা যায়। দেখা যায় পদ্মপুকুরও। কয়েক মুহূর্ত পদ্মপুকুরের দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি দিলো আকাশ পানে। আকাশে উজ্জ্বল চাঁদ! আবারও তাকালো পুকুরে। পুকুরে লাল পদ্ম! রাতটা একেবারে তার আর তাহেরের বাসর রাতের মতো মনে হচ্ছে না? ওই পদ্মপুকুর ঘাটে কত স্মৃতি আছে তার আর তাহেরের। সুপ্ত মুখর স্মৃতি সব। অনেক কিছু মনে আছে পদ্মর। কেন যেন ভুলতে পারে না স্মৃতিগুলো!

সময়টা বিয়ের প্রথম দিকের ছিল। বিয়ে হওয়ার কারণে পদ্মর স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শ্বশুর আব্বা চেয়েছিলেন পদ্মকে পড়ালেখা করাতে। তিনি একজন গৃহ শিক্ষক রাখলেন পদ্মর জন্য। এক মাস পড়েছিল সেই গৃহ শিক্ষকের কাছে। গৃহ শিক্ষকের স্বভাব চরিত্র ভালো ছিল না। কেমনই যেন একটা দৃষ্টি ছিল তার পদ্মর উপর। যা পদ্মর একদম ভালো লাগতো না। পদ্ম ঘটনাটা একদিন তাহেরের কাছে বললো। তাহের শুনে তো ক্ষেপে গেল। পরের দিন যখন গৃহ শিক্ষক পড়াতে এলো তখন তাহের বকা-ঝকা করে বিতাড়িত করে দিলো লোকটাকে। তাহের যে এত রাগারাগি করবে তা পদ্মর ধারণায় ছিল না। গৃহ শিক্ষককে তো ভাগিয়ে দিলো তাহের, এখন পদ্ম পড়বে কার কাছে? একজন মহিলা গৃহশিক্ষিকার সন্ধান করা হলো, কিন্তু পাওয়া গেল না। পরে সিদ্ধান্ত হলো, তাহের পড়াবে পদ্মকে। প্রস্তাবটা তাহের নিজেই রেখেছিল। সন্ধ্যার পর তার কোনো কাজ থাকে না, সুতরাং পড়াতে সমস্যা হবে না। সাতটা থেকে নয়টা পর্যন্ত পড়াবে। বেশ, যা কথা হলো, তেমনই কাজ শুরু। রোজ সন্ধ্যা সাতটায় পড়াতে বসে সে পদ্মকে। কিন্তু সমস্যা হলো পড়াতে বসলেই তার আচরণ হয়ে ওঠে রাগী শিক্ষকের মতো। কোথাও একটু ভুল হলেই রেগে যায়। বকা-ঝকা শুরু করে। পড়ানোর সময় আবার একটা বেতও সাথে নিয়ে বসে। যেন আসলেই সে একজন শিক্ষক এমন ভাব করে। তার এমন আচরণের জন্য পদ্ম আর তার কাছে পড়বে না বলে শুনতে পায়। সেই থেকে একটু সংযত হয় তাহের। পড়াতে বসার আগে পণ করে বসে একদমই মাথা গরম করবে না। কিন্তু পড়াতে বসলেই ওই যে, সে রাগী শিক্ষক হয়ে যায়। মাথা গরম না করে একদমই পারে না। দেখা যাবে বেত দিয়ে টেবিলে জোরে আঘাত করছে, সেই সাথে বকছে ছাত্রী রূপে থাকা নিজ স্ত্রীকে। এমনই একদিন পড়াতে বসে খুব বকা ঝকা করলো পদ্মকে। অংক ভুল করেছে পদ্ম। এত বকা ঝকা এর আগে কখনো করেনি।
যে সময় তাহের বকছিল, সে সময়ই পদ্ম রাগ করে বের হয়ে এসেছে ঘর থেকে। মানুষটা একটু বেশি বেশিই করে সব সময়। পদ্ম ওই দিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো আর পড়বে না তাহেরের কাছে। রাগ করে এসে পদ্মপুকুর ঘাটে বসেছিল সে। অনেকক্ষণ পর তাহের এসেছিল তাকে মানাতে। এসে পদ্মর থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে বসলো ঘাটের উপর। বললো,
“এখানে এসে বসে রয়েছো কেন? ঘরে চলো।”

পদ্ম তার কথা কানেও তুললো না। তাহের বুঝলো মেয়েটা তার সাথে ভালোই রাগ করেছে।

“আমি কী করবো? আমি কি তোমার সাথে রাগারাগি করতে চাই? আমি তো পড়াতে বসে খুব সুন্দর আচরণই করতে চাই, কিন্তু আমার মাথা তো নিজ থেকেই গরম হয়ে যায়। দোষটা কি এখন আমার? দোষটা তো আমার মাথার। আমার মাথার কাছেই জিজ্ঞাস করো এখন, কেন সে এমন করে?”

এসব কথা পদ্মর মন গলাতে সক্ষম হলো না। তাহের ব্যর্থতা অনুভব করলো। আদুরে কণ্ঠে ডাকলো,
“পদ্ম…”

পদ্ম অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো একেবারে। তাহের নিকটে এগিয়ে এলো। আসতেই পদ্ম ওদিকে সরে বসলো। তাহের এবার কঠিন গলায় বললো,
“কী ব্যাপার? ওদিকে সরে যাচ্ছ কেন তুমি?”

পদ্ম উত্তর দিলো না। তাহের আবারও কাছে এগিয়ে এসে বসলো। পদ্ম দূরে সরে গেল। তাহের রাগ অনুভব করে বললো,
“বাচ্চা মেয়ে বিয়ে করলে এই এক সমস্যা। এদের রাগ আসমান ছোঁয়া হয়। এখন কি বাচ্চাদের মতো করে বোঝাতে হবে তোমাকে? যে, সোনামণি রাগ করো না?”

তাহেরের এই কথাটা একটু বেশিই গায়ে লাগলো পদ্মর। তাহেরের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনি এমন কেন?”

তাহের একটু হোঁচট খেলো,
“কেমন আমি?”

“আপনার কাছে পড়বো না আমি।”

তাহেরের সম্মানে আঘাত লাগলো। বললো,
“কেন পড়বে না? কী খুঁত আছে আমার মাঝে? আমি কি একজন শিক্ষক হিসেবে অযোগ্য?”

“অযোগ্য কি না জানি না, তবে যোগ্য নন। আমি পড়বো না। আপনি একজন শিক্ষিকা খোঁজার ব্যবস্থা করুন।”

“ব্যবস্থা কি মুখের কথা? জানোই তো, এর আগে শত খুঁজেও পাইনি।”

“খুঁজে না পেলে নেই, তারপরও আমি আপনার কাছে পড়বো না।”

“তুমি কি মূর্খ থাকতে চাও?”

“আপনার কাছে পড়ার থেকে মূর্খ থাকাও ভালো।”

সম্মানে লাগা আঘাতটা এবার নিজের বিস্তৃতি ঘটালো। তাহের বলে উঠলো,
“বেয়াদব মেয়ে! স্বামীর মুখের উপর কথা বলছে।”

পদ্ম কিছু বললো না। তাহের আবারও কাছে এগিয়ে এলেই পদ্ম দূরে সরে যাচ্ছিল, তাহের অমনি ওর এক হাত ধরে টান দিয়ে কাছে এনে ফেললো।

“কোথায় যাচ্ছ? হুহ? কোথায় যাচ্ছ? সাথে সাথে থাকো। এখানে জ্বীনের অভাব নেই। রাত হলেই হাজার কয়েক জ্বীন ঘুরে বেড়ায় এখানে। সুন্দরী কোনো মেয়ে বসে আছে দেখলেই একেবারে তুলে নিয়ে যাবে।”

পদ্মর মনে হঠাৎই একটু ভয় ঢুকে পড়লো। গলা নিচু করে বললো,
“এখানে জ্বীন আছে?”

“হুম। আর তুমি জ্বীনের সর্দারের কাছে বসে আছো এখন।”

পদ্মর মনে ভয় কামড় দিলো,
“মানে?”

তাহের পদ্মর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“আমি একটা জ্বীন পদ্ম, তোমার স্বামী না। তোমার স্বামী তো ঘরে। আমি হলাম একটা বদ জ্বীন।”

পদ্মর চোখের তারায় ভয় ছেয়ে গেল। ভয়ার্ত চোখ জোড়া মেলে তাকালো তাহেরের দিকে। মনে প্রশ্ন জাগলো, এটা আসলেই তার স্বামী তো? প্রশ্নটা মনে জাগতেই পদ্ম লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে দৌঁড়ে চলে গেল বাড়ির ভিতর। আসতে আসতে পিছনে শুনতে পেয়েছিল,
“আরে আমিই তোমার স্বামী। জ্বীন নই।”

তাহেরের এই কথাটা মনে পড়তেই হেসে উঠলো পদ্ম। চোখের পানি শুকিয়ে গিয়েছিল, আবারও ভিজে উঠলো চোখ। ঝরেও পড়লো টুপ করে। আসলে মানুষটার ভালোবাসা মিথ্যা ছিল না। মানুষটা পরিবর্তন হয়ে গেছে এখন, সাথে ভালোবাসাও!
আকাশের দিকে তাকালো পদ্ম। আজ তার ইচ্ছা হচ্ছে ওই আকাশের সাথে মিলিয়ে যেতে। কীভাবে মিলিয়ে যাওয়া যায় আকাশের সাথে? পদ্ম চোখের জল মুছে নিয়ে সরে এলো জানালার কাছ থেকে। এসে আলমারি খুললো। আলমারি খুঁজে পদ্ম রঙা শাড়িটা বের করলো। শাড়িটার গায়ে যেন লাল পদ্মরই রং। সাদা, লাল, গোলাপির সংমিশ্রণ। শাড়িটা তাহের দিয়েছিল। বছর খানেক আগে। দেওয়ার আগে বলেছিল,
“পদ্মর জন্য পদ্ম শাড়ি নিয়ে এসেছি।”

কথাটা শুনে অবাক হয়েছিল পদ্ম। কিন্তু তাহের যখন শাড়িটা দেখালো, তখন তার নিজেরই মনে হলো আসলেই যেন এটা একটা পদ্ম শাড়ি। আজ এই পদ্ম শাড়িটা পরবে। পদ্ম পরনের কাপড় পাল্টে শাড়িটা পরলো। আয়নার সামনে এসে বসলো। মুখে পাউডার মাখলো, চোখে কাজল দিলো, ঠোঁটে লিপস্টিক। হাতে পরলো গোলাপি রঙের চুড়ি। হুম, সাজলো সে। সাজতে সাজতে নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভাবছিল। তাহের তো তাকে আর আগের মতো ভালোবাসে না। মানুষ বুঝ দিতে দিতে মানুষটাকে তার কাছ থেকে অনেক দূর করে দিয়েছে! যাও একটু ভালোবাসা আছে মনে, তাও নিঃশেষ হয়ে যাবে! কদিন থাকবে তাহেরের মনে তার জন্য এই ঠুকনো ভালোবাসা? বড়ো জোড় কিছুদিন। এর বেশি নয়। একটা বাচ্চা হলে তো তাহের ভুলেই যাবে সে কে! পদ্ম নামের মেয়েটাকে একদমই চিনতে পারবে না তখন! হয়তো বলা যেতে পারে তাহের তাকে ভুলবে না, ভালোবাসবে। কিন্তু আসলে বাস্তবতা এমন নয়। বাস্তবতা হলো, সে ধীরে ধীরে তাহেরের মন থেকে খসে পড়বে! বাস্তবতা খুব কঠিন জিনিস। পদ্ম ইতোমধ্যে উপলব্ধি করতে শিখেছে এটা। সে হাতের চুড়িগুলো নাড়িয়ে মৃদু ঝুনঝুন একটা শব্দ করতে করতে বললো,
“আপনি ভালোবাসেন না আমায়। আপনি ভালোবাসেন না তাহের!”

পদ্ম ঘর ছেড়ে বের হলো। আজ অনেক শখ করে সেজেছে সে। মাথায় টিকলি দিতেও ভুলেনি। পায়েও খুব যত্ন করে আলতা পরেছে। আলতাটা পাঁচ ছয়-মাস আগে কিনেছিল। দেওয়া হয়নি। আজ দিলো। খুব যত্ন সহকারে দিয়েছে।
পদ্মপুকুর ঘাটে এসে থামলো সে। জোৎস্নার আলোয় কী অপূর্ব লাগছে পুকুরটা! ইচ্ছা করছে পদ্মফুলের মতো তারও জলে ভাসতে। সাঁতার জানে না বলে কখনও নামা হয়নি পুকুরে। তাহের অনেক বার বলেছিল সাঁতার শেখাবে। কিন্তু পদ্ম সাহস পায়নি পানিতে নামতে। ছোট বেলা থেকেই তার পানিতে নামতে ভয় হয়। পদ্ম আশেপাশে তাকিয়ে রাতের প্রকৃতিকে দু চোখ ভরে দেখলো। প্রকৃতি আজকে এত সুন্দর লাগছে কেন? খুব সুন্দর না এই প্রকৃতি? এত গভীরভাবে তো এর আগে কখনও প্রকৃতি দেখা হয়নি। আজ দেখলো। কিন্তু এই দেখায় তেষ্টা মিটলো না। পদ্ম পিছন ফিরে বাড়ির দিকে তাকালো। বাড়ির মানুষগুলো কী করছে এখন? না, সকলকে নিয়ে তার মাথা ব্যথা নয় আসলে। তার ভাবনায় তো শুধু তাহের। সে তীব্র অভিমান জড়ানো কণ্ঠে বললো,
“দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন তাহের সাহেব, আপনি তো ভুলে যাবেন আমায়। একদম ভুলে যাবেন। আমার মুখটা দেখতেও একসময় খুব বিরক্ত লাগবে আপনার! কী লাগবে না? আমি জানি তো লাগবে। আপনি কিন্তু আমাকে ভালোবাসেননি। না ভুল বললাম। অস্বীকার করবো না, আপনি আমাকে ভালোবেসেছেন। কিন্তু এখন বাসেন না। যদি ভালোবাসতেন তাহলে দ্বিতীয় বিয়ে তো করতেন না। করতেন? উহু, কিছুতেই করতে পারতেন না। যদি এখন ভালো না-ই বাসবেন তাহলে আগে অত কেন ভালোবাসা দেখিয়ে ছিলেন? অত ভালোবাসা দেখানো উচিত হয়নি আপনার। খুব কষ্ট পেলাম আপনার আচরণে। যে মানুষটা ভালোবাসতে শেখায়, সেই মানুষটা যখন কষ্ট পাওয়াও শেখায় তখন সেটা খুব কষ্টের হয়। এই কষ্টের গভীরতা অনেক, পরিমাপ করা যায় না। এই কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। আপনার দেওয়া কষ্ট আমি হজম করতে পারলাম না। ক্ষমা করবেন। আপনাকে খুব ভালোবাসি আমি, খুব। আর ভালোবাসি বলেই তো আপনার মনে অন্য নারীর জন্য ভালোবাসা একদম মানতে পারবো না। আমার খুব হিংসা হবে। এতটা হিংসা আমি কাউকে করতে চাই না। ওই মেয়েটারও তো আপনার কাছ থেকে ভালোবাসা প্রাপ্য। এটা তার ন্যায্য পাওনা। ন্যায্য কোনো কিছুতে হিংসা ব্যাপারটা একদম বেমামান। একদম। আমি শুধু বলবো, আপনি এখন ভালোবাসেন না আমায়, ভবিষ্যতেও বাসবেন না। কিন্তু আমি আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আপনাকে ভালোবাসবো।”

পদ্ম নিষ্পলক তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ বাড়িটার দিকে। তারপর চোখ ফিরিয়ে আনলো। এক ধাপ এক ধাপ করে সিঁড়ি অতিক্রম করে নামতে লাগলো। এক সময় পানির নিচে চলে যাওয়া সিঁড়িতেও পদচারণ ফেললো সে। কী শীতল পানির স্পর্শ! আবার অনেক শান্তিময়ও।

____________________

দিনের আলো ফুঁটতে শুরু করেছে। পূবের আকাশে সূর্য আগমনী লাল বার্তা আভা। পাখি ডাকছে। শীত শীত সমীরণ বইছে। অনেকের সালাত আদায় করা শেষ। অনেকে হয়তো আলসেমি করে এখনও বিছানায় পড়ে আছে ঘুমন্ত অবস্থায়। ফিরোজা খাতুনের বোন শেফালী খাতুন পুকুর থেকে পানি নেওয়ার জন্য বাড়ির পিছনের পুকুরে এলেন। তার হাতে বালতি। সিঁড়ি ভেঙে নামছিলেন। হঠাৎই চোখ পড়লো পুকুরের ওই প্রান্তে। যে দৃশ্য দেখলেন তাতে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে কাঁপন ধরলো সারা শরীরে। হাতের বালতি পড়ে গেল। দু চোখে আতঙ্ক, গলায় গগন বিদারী চিৎকার করলেন,
“আল্লাহ গো…”

শেফালী খাতুন ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেলেন সিঁড়িতে। ওনার চিৎকারের শব্দ এত জোরে ছিল যে বাড়ির সকলের কর্ণকুহরে সেই চিৎকারের শব্দ প্রবেশ করলো। এমনকি যারা ঘুমিয়ে ছিল তাদেরও ঘুম ভাঙলো। ভোরের নিস্তব্ধ পরিবেশের মাঝে পর পর কয়েকটা দরজা খোলার শব্দ হলো। সেই সাথে কয়েক জনের উৎকণ্ঠা গলার স্বর। সবাই-ই চিৎকার অনুসরণ করে পুকুর ঘাটে আসছে। সবার প্রথমে দৌঁড়ে এলেন তাহেরের ভাই। এরপরই উপস্থিত হলেন ফিরোজা খাতুন। তাহেরও ব্যস্ত হয়ে ছুটে এসে উপস্থিত হতে পারলো তৃতীয় স্থানে। ধীরে ধীরে সবাই-ই উপস্থিত হলো পুকুর পাড়ে। সকলের দৃষ্টিই পুকুরের জলে। ভয়ে থমথম মুখ। চোখেও এত ভয় যেন, কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। তাহেরের হৃদয়ে ধারালো কিছুর আঘাত লাগলো। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো তার। হাঁসফাঁস অনুভব হতে লাগলো। মনে মনে একটা শব্দই প্রতিধ্বনিত হলো শুধু, ‘না’।

পুকুরের লাল পদ্মর মাঝে আজ অন্যরকম একটা পদ্ম ফুঁটে আছে। ওই পদ্ম তাহেরের সবচেয়ে দামি। এই মুহূর্তে এসে তার সংশয়ে পড়তে হলো, ওই দামী পদ্মর থেকে কি একটা সন্তান বেশি মূল্যবান ছিল তার কাছে? তাহেরের হৃদয় ভাঙতে লাগলো। জলে ভেসে আছে তার পদ্ম! স্থির চক্ষু জোড়া জলে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো। কণ্ঠ ক্ষীণভাবে ডেকে উঠলো,
“পদ্ম!”

(সমাপ্ত)

_____________

কেউই হয়তো ভাবতে পারেননি এটা একটা ছোট গল্প, মাত্র দুই পর্বে শেষ হয়ে যাবে। আসলে ভাবনা ছিল এই প্লটে একটা অনুগল্প লিখবো। একটু বড়ো হলো বিধায় দুই পর্বের লিখতে হলো। যখন ‘বিবর্ণ জলধর’ গল্পটা লিখছিলাম তখন এই প্লটটা মাথায় আসে। তখন ওই গল্পটা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় এটায় মনোযোগ দিতে পারিনি। চেয়েছিলাম ওটা শেষ হওয়ার পর এটা লিখবো। ওই গল্পটা শেষ হওয়ার পরে দেখি এই গল্পটা লেখার আর কোনো আগ্রহ নেই আমার মাঝে। চাইছিলাম লিখবো না এটা। পরে আবার কী ভেবেই যেন লিখে ফেললাম। তবে ওই সময়ের ভাবনার মতো এখনকার ভাবনা গভীর ছিল না। ওই সময়ে লিখলে হয়তো গল্পটা আর একটু ভালো হতো। যাই হোক, ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
আর দুই পর্বের এই গল্পটা কেমন লেগেছে কষ্ট করে হলেও একটু জানাবেন।

আর হ্যাঁ, এটা আমার গ্রুপ লিংক―
https://facebook.com/groups/3087162301558677/

যদি কেউ এড হতে চান, তাহলে হতে পারেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here