ইচ্ছে_দুপুর পর্বঃ৪
খাদিজা আরুশি আরু
ওনার বলা কথাগুলো শুনে আমি নিঃশব্দে কাঁদছিলাম।অথচ ওনার চোখে একফোঁটা জল ছিলো না।সেদিন বুঝেছিলাম অতি শোকে পাথর কাকে বলে…ওনার চোখে মুখে আমি সেদিন কাঠিন্য দেখেছিলাম।মানুষ একদিনে রাগী বা কঠোর হয় না।বাস্তবতা মানুষকে কঠোর থেকে কঠোরতর বানিয়ে দেয়।এটাই প্রকৃতির নিয়ম আর আমরা সে নিয়মের ধারক।আমাকে কাঁদতে দেখে উনি মুচকি হাসলেন।তারপর কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে বললেন,
—এটুকুতেই কাঁদছো ইচ্ছে?এখনোতো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্টটা তোমায় বলিই নি।
আমি অবাক হয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
—এখনো আরও বাকি আছে?এটুকু কষ্ট কি একটা মানুষের জন্য যথেষ্ট নয়?
—কারও কারও জন্য নিঃশ্চই যথেষ্ট।কিন্তু আমার জন্য নয়।কারন সৃষ্টিকর্তার মর্জি তো অন্য কিছু ছিলো।
—কি?
—এতো অশান্ত হয়ো না।আমি তো বলছি’ই…
—জ্বী।
—বিন্দির জানাজার পর যখন কবর দিয়ে বাসায় আসলাম তখন মনে হচ্ছিলো আমার ঘরের প্রতিটি কোনায় বিন্দি আছে।সে এক ধম বন্ধকর অবস্থা।তারপর সিদ্বান্ত নিলাম ও বাড়িতে আর থাকবো না।আমি বরাবরই ক্ষেপা।দু’দিনের বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে বাড়ি ছাড়লাম।তারপর কাজ আর বাচ্চা নিয়ে হিমসীম খেতে লাগলাম।অযত্নে বাচ্চাটার নিউমোনিয়া বাজিয়ে বসলাম।সে এক বিভীষিকাময় রাত।মরণাপন্ন বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে মাঝরাতে হাসপাতালে ছুটলাম।আমি এমন হতচ্ছাড়া বাবা যে তখন পর্যন্ত নিজের বাচ্চার কোনো নাম দেই নি।
আমি উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
—বাচ্চাটা কি মারা গেলো?
—না,সে যাত্রায় বাচ্চাটা আমার বেঁচে গিয়েছিলো।কিন্তু আমি ওকে নিয়ে ঝুঁকি নিতে চাইছিলাম না আর।হাসপাতাল থেকে আমার বাড়ির লোক খবর পায়।তারাও আমার কাছে বারংবার অনুরোধ করছিলো।শেষে আর না করতে পারলাম না।বাড়ি ছাড়ার তিন মাসের মাথায় আবার বাড়ি ফিরে গেলাম।বাড়িতে সবাই ওকে অনেক যত্ন করতো।তাই আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।বাচ্চাটার প্রতি নিজের পরিবারের যত্ন-আত্তি দেখে আমার সব রাগ অভিমান পড়ে গেলে।আমি অকপটে সবাইকে তাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা করে দিলাম।
—ক্ষমা করতে পারলেন?
—আসলে কি বলোতো ইচ্ছে,” দূরের মানুষের সঙ্গে রাগ করা যায়,অভিমান করা যায়,তাদের ঘৃণাও করা যায়।আর সে রাগ বা অভিমানের স্থায়িত্বও সর্বকালের জন্য হয়।কিন্তু পরিবারের ক্ষেত্রে তার ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।পরিবারের সঙ্গে অভিমান করা চলে রাগ না,তাদের শান্তিমতো ঘৃণাও করা যায় না।।স্থান,কাল পাত্র বিবেচনায় কখনো না কখনো সে রাগের জের কমে যাবে,সম্পর্কে স্বাভাবিকত্ব ফিরে আসবে।ব্যাস দেরি না হলেই চলে।যেসব রক্তের সম্পর্ক ভাঙ্গার পর কখনো জুড়ে না ধরে নেবে সে সম্পর্কগুলো জন্ম থেকেই নড়বড়ে”।
—সম্ভবত।তারপর কি হলো?
—আমার মেয়ের নাম দিলাম ময়ূরী।ময়ূরী আগুনরূপী ছিলো জানো!যে কেউ একবার দেখলে না চাইতেও বারবার তাকাবে।তুমিও কিন্তু ভারী সুন্দর।তোমার চেহারার সঙ্গে ময়ূরীর চেহারার কিছুটা মিল আছে।তবে তুমি স্নিগ্ধ।তোমাকে আগুনরূপী বলা চলে না।
—আমার রূপের বর্ণনা পরে শুনবো।আগে আপনার কষ্টগুলো শুনে নেই।তারপর কি হলো বলুন তো।তর সইছে না আমার একদম।
—ময়ূরীর এস.এস.সি পাশ করার পরপর আমি ক্যালিফোর্নিয়া গেলাম একটা ডিগ্রীর জন্য।পরিবারের সবার চোখের মনি ছিলো ময়ূরী।সুতরাং আমি নিশ্চিন্তে ওকে বাড়িতে রেখে দেশ ছাড়লাম।আমার যাবার দিন আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁফিয়ো ফুঁফিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা বলেছিলো,”প্লিজ ডোন্ট গো পাপা।আই নিড ইউ।আই রিয়েলি নিড ইউ”!আমি ওর কান্নার ভাষা বুঝতে পারি নি।ওর অন্তরের ডাককে উপেক্ষা করে,সব মায়া কাটিয়ে দেশান্তর হয়েছিলাম।আমি সে দেশে যাবার পর ফোনে মাঝে মাঝে কথা হতো ময়ূরীর সাথে,তবে ময়ূরী কেনো যেনো আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইতো না।আমিও জোর করতাম না।ভেবেছিলাম রাগ কমলে ঠিক হয়ে যাবে।
—তারপর?ময়ূরীর রাগ কমে নি?
—রাগ হলে হয়তো কমতো।তবে ওর আহ্বানে রাগ নয় আকুতি ছিলো।যা আমি বুঝতে পারি নি অথবা বুঝার চেষ্টাই করি নি।
—মানে?
—বলছি…একটু ধৈর্য্য ধরে বসো তো মেয়ে।
—আমি ধৈর্য্য ধরতে পারছি না।ইতোমধ্যে আমার হাত পা কাঁপছে।
—শান্ত হও ইচ্ছে।ওহ,দুঃখিত।তোমার অনুমতি ছাড়াই তখন থেকে ইচ্ছে ডাকছি আসলে তোমার নামটা বেশ বড় তো।
—আরে সেটা ব্যপার না।আমাকে সবাই ইচ্ছেই ডাকে।আপনি তারপর বলুন প্লিজ।
—আমার ক্যালিফোর্নিয়া যাবার দু-তিন মাস পার হয়ে গিয়েছিলো তখন।ততোদিনে ময়ূরী আমার সঙ্গে কথা বলা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিলো।আমি ফোন করে ওকে চাইলে নানা কাজের বাহানা দিয়ে এড়িয়ে যেতো।আমিও বেশি জোর করি নি।ভেবেছিলাম বাড়ন্ত বয়স,তাই হয়তো মুড সুইং হচ্ছে।আসলে ওর কোনো ব্যাপারেই কখনো ততোটা গুরুত্ব দেই নি আমি।ওই যে ছন্নছাড়া পুরুষমানুষ যাকে বলে আমি ছিলাম সেই।আমি ক্যালিফোর্নিয়া যাবার সাড়ে নয় মাসের মাথায় একটা চিঠি এলো আমার কাছে।বেশ অবাক হচ্ছিলাম চিঠি দেখে।প্রেরকের কোনো নাম ছিলো না খামের উপরে।চিঠি খুলে বুঝলাম চিঠিটা ময়ূরীর।মুচকি হেসে চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম।মনে মনে ভাবছিলাম মেয়ের আমার রাগ পড়েছে কিন্তু চিঠিটা কিছুদূর পড়ার পর আমার পুলকিত চেহারা ভয় নামক কালো মেঘে ঢেকে গেলো।চিঠিতে কি লেখা ছিলো জানো?
আমি ভয় আর কুণ্ঠামিশ্রিত স্বরে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
—কি?
—চিঠিতে লেখা ছিলো,
প্রিয় পাপা,
কেমন আছো জিজ্ঞেস করবো না।কারন এ চিঠি পড়ার পর তুমি ভালো থাকতে পারবে না আমি জানি।তুমি হয়তো ভাবছো আমার রাগ পড়ে গেছে তাই চিঠি দিয়েছি তোমায়।কিন্তু তা নয়।আসলে বরাবরই তুমি আমাকে বুঝতে ভুল করো।এবারও তাই করছো।আমি কোনোদিন তোমার উপর রাগ বা অভিমান করি নি পাপা।আসলে আমি তোমার সঙ্গে রাগ করতে পারি না।তবে একটা চাপা অভিমান জন্মেছিলো, সেটাও সময়ের সাথে সাথে নিঃশেষ হয়ে গেছে।সেদিন আমি সত্যি বলেছিলাম পাপা।আমি পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভরসা তোমাকে করি পাপা।আমার সত্যিই সে সময় তোমাকে ভীষণ প্রয়োজন ছিলো।জানো পাপা,আমি যখন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরি তখন গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু ছেলে নানা আকার ইঙ্গিতে আমার দিকে বাজে মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়।আমি জেঠিমাকে বলেছিলাম।জেঠিমা আমাকে কি বলেছে জানো?বলেছে,”মেয়েদের জন্মই হয় সহ্য করার জন্য।তুই এসবে এতো গুরুত্ব দিস না”।পাপা,আমি একটা মেয়ে,আমার আত্নসম্মানের কোনো দাম নেই?যে যা বলবে আমার মুখবুজে সহ্য করতে হবে?সেদিনের পর আমি আমার কোনো সমস্যা বাড়ির কাওকে বলি নি।নিজের মতো করে আমার সমস্যাগুলোর প্রতিকার করার চেষ্টা করে গেছি।চুপ করে না থেকে প্রতিবাদ করেছি।তাতে আমার উপকারের বদলে অপকার হয়েছে জানো পাপা?আমাকে ওই বাজে ছেলেগুলো আপত্তিজনকভাবে স্পর্শ করেছে।রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো তামাশা দেখেছে।একটাবারের জন্য সাহায্যের হাত বাড়ায় নি।এমনকি একজন মহিলাও আমাকে সাহায্য করতে ওই বাজে ছেলেদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে নি।অপমানে জর্জরিত হয়ে আমি বাড়ি ফিরেছিলাম।আস্তে আস্তে নিজের মাঝে থাকতে শুরু করলাম।তুমি বরাবরই বলো,আমাকে নাকি এ বাড়ির সবাই খুব ভালোবাসে,তবে আমার বদলে যাওয়া কারো চোখে পড়লো না কেনো পাপা?তুমি ব্যস্ত মানুষ,তোমাকে নিজের সমস্যাগুলো বলতে গিয়েও বলতে পারতাম না।এর মাঝে ওই ছেলেগুলো আরো কয়দিন আমার সঙ্গে অসভ্যতা করেছিলো।ভেতর ভেতর আমি ভেঙ্গে পড়েছিলাম।আজ আমার মা বেঁচে থাকলে আমাকে এতো ভুগতে হতো না।তোমার ক্যালিফোর্নিয়া যাবার খবর পেয়ে আমার ভয়টা তীব্র থেকে তীব্রতর হলো।তাই সাহস করে তোমাকে সবটা বলতে গেলাম।কেঁদে কেঁদে বললাম,”আই নিড ইউ”।কিন্তু তুমি আমায় বুঝলে না,ঘুমাতে যেতো বললে।তারপরও আমি হারি নি।একাই নিজেকে সামলাতে লাগলাম।কিন্তু পাপা,আমি আর নিজেকে সামলাতে পারছি না।গত তিনমাস আগে সকালে কলেজ যাবার সময় ওরা আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো।ওরা আমার শরীরে আঁছড় দিচ্ছিলো কিন্তু সে আঁছড় আমার শরীর ভেদ করে আত্নায় গিয়ে লাগছিলো।আজ টেস্ট করে জানতে পারলাম আমি অন্তঃসত্ত্বা।আমার জীবনীশক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে পাপা।আমি আর বাঁচতে চাই না।
তুমি ভালো থেকো পাপা।আমার জন্য একটুও কেঁদো না।আমি বেঁচে থাকলে আমাকে আরো অনেক নোংরা কথা শুনতে হতো।তার থেকে বরং আমি পরপারেই পাড়ি জমাই।
ইতি,
ময়ূরী।
চলবে…
গত পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1294858047695886/