ইতি মাধবীলতা – ১০(ক)

0
854

ইতি মাধবীলতা – ১০(ক)
আভা ইসলাম রাত্রি

আগামীকাল নিলাংসু জমিদার বাড়ি ছেড়ে শহরের পথে রওনা হবে। নিলাংসুর মঙ্গলের উদ্দেশ্যে জমিদার বাড়িতে পূঁজোর আয়োজন করা হয়েছে। সে কারণেই সক্কাল সক্কাল বাড়ি যেনো আলোয় আলোয় পূর্ণ হয়েছে। জমিদার বাড়ীর পূঁজো ঘরটায় শ্রী কৃষ্ণের মূর্তির সামনে সাজানো হয়েছে ফুলের ঢালা, পূঁজোর লাড্ডু আর কতকি! এ যেনো এক
এলাহী কাণ্ড!
জমিদার বাড়ীর পূজো গ্রামে বেশ সমাদৃত! তাই তো ভোর হতেই পূঁজোর উদ্দেশ্যে এ বাড়িতে বহু লোকের আনাগোনা লেগেই আছে। মাধবী নিজ কক্ষে বসে গীতা পাঠ করছিল। সেসময় রেখা দেবী প্রবেশ করলেন সে কক্ষে। তার হাতে বেতের এক সুন্দর ঢালা। মাধবী রেখা দেবীর আগমন উপলব্ধি করতে পেরে গীতা পাঠ বন্ধ করলো। সসম্মানের সহিত পবিত্র গীতাকে যথাস্থানে রেখে রেখা দেবীর মুখোমুখি হলো সে। নম্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— কিছু বলবেন?
রেখা দেবী মুখশ্রী কঠিন করে হাতের ঢালা মাধবীর দিকে এগিয়ে দিলেন। বললেন,
— এখানে আজ’গের পূঁজোর জন্যে শাড়ি আর কিছু গহনা আছে। তৈরি হয়ে নাও। আমি চাইনা, গ্রামের কেউ জমিদার বাড়ীর পুত্রবধূকে দেখে নাক কুঁচকাক।

মাধবী কিঞ্চিৎ হাসলো। অদ্ভুত ভাবে তার ঠোঁটের কোণে ভেসে উঠলো তাচ্ছিল্যের হাস! মনে মনে কয়েকবার আউড়ে নিল সে ‘মহিলাটা ভীষণ স্বার্থপর’ ..মাধবী হাত বাড়িয়ে ঢালা নিজের কাছে নিল। মৃদু হেসে বললো,
— মানুষের আর কি দোষ! নিজ বাড়ীর মানুষ যেমন, গ্রামের মানুষদের তেমনই হওয়া বাঞ্ছনীয়। বরং তারা তেমন না হলে তা বেশ সন্দেহজনক বটে।

রেখা দেবী মাধবীর নম্র কণ্ঠে বলা বজ্রধ্বনিতে বেশ অপমানিত হলেন। তিনি বেজায় রেগে বললেন,
— তোমার স্পর্ধা আমায় ক্রমশ অবাক করছে! ভুলে যেও না, তুমি এক সামান্য বেদের মেয়ে। এত অহংকার তোমার কণ্ঠে শোভা পায়না।
— আমি সত্য বলতে কুন্ঠিত হইনা! একে যদি আপনি অহংকার বলে আখ্যায়িত করতে চান, তবে আমার কোনো আফসোস নেই।

রেখা দেবী বড়ই আশ্চর্য্য হলেন। অপমানে তার গা রি রি করে উঠলো। মাথার রক্ত টগবগ-টগবগ করে ফুটতে লাগলো ক্রমাগত। সামান্য দু পয়সার মেয়ের মুখে এরূপ কঠিন কথা তার সহ্য হলো না। তিনি পড়ে যাওয়া আঁচল কাঁধে তুলে হনহনিয়ে মাধবীর কক্ষ পরিত্যাগ করলেন। মাধবী সেদিকে চেয়ে কুটিল হাসলো। জাত পাতের গর্ব এ বাড়ীর সবাইকে অন্ধ করে রেখেছে। চোখ থাকতেও চোখের কি নিদারুণ অপচয়, আফসোস!
___________________________
লাল পাড়ের সাদা শাড়ি! এ যেনো সাক্ষাৎ দেবী দূর্গার অন্য রূপ! কানে ঝুমকো, নাকে নথ! হাত-পায়ের লাল টকটকে আলতা! নখে লাল রঙের মেহেদী! এ এক অপরুপা নারী! মাধবীর এ রূপ আজ যেনো ঝলসে দেবে এ ভুবন। মাধবী এই রূপ দেখে জমিদার বাড়িতে আগত সবাই বিস্মিত! চোখে অপার মুগ্ধতা নিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখছে ধরণীতে নেমে আসা দূর্গা’মাকে! মাধবী জমিদার বাড়িতে আগত সব মহিলাদের সাথে খোশ গল্পে মেতে উঠলো। সবার মুখে একটাই বাক্য, ‘এ কি নারী নাকি সাক্ষাৎ মা?’

— বড় কত্তি, বড় কত্তা ডাক’চেন আপনারে।
দাসীর কথা শুনে মাধবী বেশ বিরক্ত হলো। তবে মুখে হাসি স্থাপন করে বললো,
— আসছি আমি।
দাসী নতমুখে স্থান প্রস্থান করলো। মাধবী সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাকে বিদায় দিয়ে নিলাংসুর কক্ষের পানে পা বাড়ালো।

নিলাংসু কক্ষে থাকা বিশালাকার দর্পণের সামনে দাঁড়িয়ে চুলে চিরুনি চালাচ্ছিল। গায়ে তার জড়ানো ধবধবে সাদা রঙের পাঞ্জাবি! ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত এ পুরুষকে দেখে মাধবীর সুপ্ত মনে বাদ্যযন্ত্র বেজে উঠলো। বিধাতার নিজ হাতে গড়া যেনো এ পুরুষ! কিছুক্ষণ আগ অব্দি মাধবীর মেজাজ বিশ্রী থাকলেও নিলাংসুর এহেন সুদর্শন দেহখানা দেখে তার মন প্রসন্ন হলো। সে ধীর পায়ে নিলাংসুর পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— ডেকেছিলেন?

এতদিন পর নিজ বধূর মুখে নরম কণ্ঠ শুনে একপ্রকার স্তব্ধই হলো নিলাংসু। সে চকিতে পেছন ফিরল। চক্ষু দ্বারা মাধবীকে আগাগোড়া নিরক্ষণ করতেই মাধবী অস্বস্তিতে জমে উঠলো। নিলাংসু কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করলো,
— আজ আমার বাঘিনী এরূপ শীতল কেনো?

মাধবী বেশ অপ্রস্তুত হলো। নিলাংসুর বাক্য শুনে সে নিজেও বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। আসলেই কি সে আজ বাঘিনী থেকে শীতল রূপ ধারণ করেছে? কই, সে তো তা বুঝতে পারছে না! মাধবী কাঁধের আঁচল অদক্ষ হস্তে ঠিকঠাক করতে করতে উত্তর করলো,
— যে জন্যে ডেকেছিলেন তাই বলুন। অযথা কথা বাড়িয়ে আমার সময় অপচয় করবেন না।

নিলাংসুর দীর্ঘশ্বাসের শব্দে ভারী হলো কক্ষের শীতল বায়ু। নিলাংসু স্বাভাবিক হয়ে বললো,
— আমরা কাল শহরে যাচ্ছি। তাই বলছিলাম, তুমি চাইলে তোমার বাবাকে দেখতে পারো। আমি তাকে খবর পাঠাবো আসার জন্যে।

মাধবীর সুন্দর মুখশ্রী এবার খানিকটা কঠিন হলো। সে বললো,
— তার কোনো প্রয়োজন নেই। এ বাড়িতে আমার বাবার দ্বিতীয়বার অপমান আমি সইতে পারবো না।

নিলাংসু মাধবীর পানে এগিয়ে এলো। মাধবীর কাঁধে দুহাত রেখে আশ্বস্ত করে বললো,
— চিন্তা নেই। আমি আছি তো। আমি থাকতে তোমার বাবার পুনরায় অপমান হবে না। ভরসা রাখো।

মাধবী চোখ তুলে তাকালো নিলাংসুর পানে। মন চাইছে, একটিবার মানুষটার উপর ভরসা রাখতে। মানুষটা কি তার ভরসার মূল্য রাখবে? মাধবী মুখ ফুলিয়ে শ্বাস টানলো। অতঃপর মাথা নাড়িয়ে সম্মতি প্রদান করলো। নিলাংসুর ঠোঁট যেন আপনা আপনি হেসে উঠলো। ‘এক সংসার জয় করার খুশি সে পেয়ে গেছে’ তার হাসি যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে এ কথাই বলছে।

#চলবে

লেখিকার পাঠকমহল,
আভার পাঠকঘর📚-stories of Ava Islam Ratri

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here