ইতি মাধবীলতা – ১১

0
769

ইতি মাধবীলতা – ১১
আভা ইসলাম রাত্রি

শহরে আসার কদিনের মাথায়ই মাধবী অসুস্থ হয়ে গেলো। সারা গায়ে গুটিগুটি বসন্ত! সে কি জ্বালা তাদের। চুলকায় খুব, কিন্তু চুলকানোর অবকাশ না থাকায় মাধবী খুব কান্না পায়। দাত খিচিয়ে বসে রয় অবিচল! এ কদিন নিলাংসু একটিবারও ঘর ছাড়া হয়নি। রাজনীতির দায়িত্ত্ব বিশ্বস্ত একজনকে সপে দিয়ে সারাক্ষণ মাধবীর পাশটায় বসে ছিল ঠায়।
ওই তো সেদিনের কথা!
রাত প্রায় দুটো। শহরটা ঢেকে আছে ঘোর অন্ধকারে। ঘুমের ঘোরে মাধবী পুনরায় যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠলো। ছটফট করতে লাগলো অবিরত। সে কি কষ্ট মেয়ের! মাধবীর এমন কষ্ট দেখে শক্ত প্রাণের অধিকারী নিলাংসুর চোখ অব্দি ভিজে এলো। বসন্তরোগে আক্রান্ত প্রিয়তমাকে চেপে ধরলো নিজের বুকের সাথে। প্রিয়তমার নরম দেহখানা বুকের সাথে পিষে ফেলতে চাইলো। যন্ত্রনায় কাতর মাধবীও বিড়াল ছানার ন্যায় গুটিয়ে গেল নিলাংসুর বুকের আড়ালে। মাধবী ক্লান্ত কণ্ঠে বললো,
— আমাকে ছুবেন না। আমি নোংরা হয়ে গেছি।

নিলাংসু কথা বললো না। নিজের ঠোঁট চেপে ধরলো মাধবীর ললাটে। বিড়বিড় করে বললো,
— তুমি আমার কাছে পবিত্রতার প্রতীক, মাধবীলতা! তোমার একটুখানি ছোঁয়ায় আমার মত পাপীরাও পবিত্র হতে বাধ্য।

নিলাংসুর কণ্ঠে ‘পাপী’ শব্দটার অর্থ মাধবীর একটুও বোধগম্য হলো না। সে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে ঘুমিয়ে পড়ল নিলাংসুর বুকের মধ্যিখানে। সেদিন সারা রাত নিলাংসুর চোখে ঘুম ধরা দিল না। সারাটা রাত মাধবীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো সে। ভগবানের কাছে অসংখ্যবার প্রিয়তমার সুস্থতার প্রার্থনা করলো।

প্রায় পনেরো দিন পর সুস্থ হলো মাধবী। এ কদিন নিলাংসুর মাধবীর প্রতি যত্ন মাধবীকে ক্রমশ অবাক হতে বাধ্য করেছে। মন বলে, নিলাংসুর প্রেম নিখুঁত বটে! অথচ, স্বার্থপর মস্তিষ্ক তা যেনো মানতেই নারাজ। মন-মস্তিষ্কের এই দ্বন্ধ যুদ্ধে মাধবী ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত!

দরজায় কড়া নাড়ানোর শব্দে মাধবীর ধ্যান ভঙ্গ হলো। শাড়ির আঁচলটুকু ঠিকঠাক করে সরদর দরজা খুললো। ব্যগ্র মুখে নিলাংসুকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আপনা আপনি ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হলো মাধবীর। নিলাংসু পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে কপালের ঘামটুকু মুছে নিয়ে বললো,
— জলদি তৈরি হয়ে নাও, মাধবীলতা। আমরা হাসপাতাল যাবো।

মাধবী বেশ অবাক হলো বটে। চোখ তার কপাল স্পর্শ করলো। ব্যস্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— হাসপাতালে? কেনো, কার ব্যামু হয়েছে?

নিলাংসু নিম্নস্বরে উত্তর দিলো,
— তোমার বাবার!
______________________
হাসপাতালের কেবিনের পড়ে আছে মাধবীর বাবা রামানাথ। হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ। হাতের উল্টোপিঠে সেলাইনের নল। সে কি বিদঘুটে দৃশ্য! মাধবী বাবার এহেন করুন অবস্থা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লো। নিলাংসু পাশে দাঁড়িয়ে মাধবীর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করতে চাইলো তাকে। তবে লাভ বিশেষ হলো না। মাধবী বাবার হাতখানা আকড়ে বিলাপ করতে লাগলো,
— এটা কেমন করে হলো, বাবা? তুমি এতটা ব্যামার কি করে হয়ে পড়লে? সেদিনই তো ঠিকঠাক ছিলে। আজ এসব কি হয়ে গেল?

রামনাথের হাত প্রায় অবশ হয়ে আছে। তবুও তিনি বেশ কষ্টে হাত উঁচু করে মাধবীর মাথায় রাখলেন। বললেন,
— শান্ত হ, মেরি বাচ্চা! মে বিলকুল ঠিক আছি। ইয়ে এক ছোটাসা চুট হে, বাচ্চা। ঠিক হয়ে যাবে! যদি তেরা পতি আমারে হাসপাতাল নেহি লেকে আতা, তো হাম রাস্তায়ই মার যাতা।

মাধবী বেশ অবাক হলো। ক্রন্দন থামলো নিমিষেই। স্থির চোখে চেয়ে রইলো বাবার পানে। মানুষটা এত ভালো কেনো? মাধবী এই মানুষকে মনে প্রাণে ঘৃনা করতে চায়, তবে বারবার ব্যর্থ হয়ে সে। মানুষটা তার উপকারের ঝুলি এত ভারী করছে কেনো? সে কি করে এই উপকারের শোধবোধ করবে?
সেদিন সম্পূর্ণ রাত বাবার পাশটায় ঠাট মেরে রইলো মাধবী। নিলাংসুকে সাফসাফ বলে দিলো,বাবাকে এই অবস্থায় রেখে আজ সে বাড়ি যাবে না। কিছুতেই না।
মাধবীর জেদ দেখে না চাওয়া সত্ত্বেও নিলাংসু রাজি হলো। অসুস্থ বাবার পাশে মাধবীর থাকাটা দরকার এই মুহূর্তে!
________________________
— আপা, আপনি কি জানেন আপনার স্বামী একজন অপরাধী?
এলাকার এক মহিলার কথা শুনে মাধবী স্তব্দ হয়ে পড়ল। পরক্ষণেই মহিলার স্পর্ধা দেখে মাধবী রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো মহিলাটার পানে। কি স্পর্ধা! আমার বাড়ি বয়ে এসে আমার স্বামী নিয়ে কুকথা? মাধবী বেশ তেজ নিয়ে বললো,
— আমার স্বামী নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না, আপা। উনাকে নিয়ে চিন্তা করার জন্যে আমি এখনো মরে যাইনি।

মহিলাটা তবুও দমে গেলো না। গলা উচিয়ে বললো,
— আপনি তো বলবেনই। স্বামীর উপর অন্ধ বিশ্বাস মোটেও ভালো না, বুঝলেন? সেদিন আমার স্বামী আপনার বিশ্বস্ত স্বামীকে একটা নির্জন রাস্তায় খুন করতে দেখেছে, খুন!

আচমকা ‘খুন’ শব্দটা শুনে মাধবী হতবাক হয়ে গেলো। শিরদাঁড়া অব্দি কেপে উঠলো তার। অতি বিস্ময়ে সে হতবিহ্বল হয়ে পড়ল। মাথা যেনো হুট করে দুবার চক্কর দিয়ে উঠলো। চোখে মুখে অন্ধকার পরিলক্ষিত হতেই মাধবী বললো,
— দয়া করে মুখ সামলে কথা বলুন, আপা। আমি আর সইতে পারছি না এসব।
মহিলার বোধহয় এবার খানিকটা দয়া হলো। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। মাথায় কাপড় তুলে মাধবীর দিকে চেয়ে বললো,
— চোখ কান একটু খোলা রাখুন, আপা। কে কখন কি হয়ে বের হয় তার কোনো ইয়াত্তা নেই। ভগবান কার মতিগতি কখন পাল্টে দেয়, কেউ বলতে পারে না।

সেদিন সম্পূর্ণ সময় মাধবীর ছটফট করেই কাটলো। ঘুমুতে পারলো না, দাড়াতে পারলো না, রান্নায় মন বসলো না। বারবার একটা কথাই ঘুরছে, নিলাংসু কি সত্যিই এতটা জঘন্য? তার মন মানছে না এ কথা! একটুও না।

সেদিন প্রায় মধ্যরাতে বাড়ি ফিরলো নিলাংসু। মাধবীকে বিছানায় ঘুমিয়ে থাকতে দেখে নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। পায়ের রক্তে মাখা জুতোটা নিয়ে আড়ালে স্নানাগারে চলে এলো। নিলাংসু চলে যেতেই মাধবী চট করে উঠে বসলো। নিলাংসুর পিছু পিছু স্নানাগার অব্দি এলো সে।
সেসময় যা তার চোখ দেখলো, তার তার নরম মন বিশ্বাস করতে চাইলো না। মাধবী মুখে দুহাত চেপে ধরলো। মাথাটা ভনভন করে উঠতেই পাশে থাকা পিলার চেপে ধরলো সে। নিলাংসুর জুতোয় তাজা তাজা রক্ত! নিলাংসু একটা গামছা দিয়ে সে রক্ত পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। তার গায়ের পাঞ্জাবির বুকের দিকটায় রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। মাধবী ভয়ের চোটে যেনো জ্ঞান হারাবে! মনে মনে চিৎকার করে বলতে লাগলো এ নারী, হ্যাঁ ভগবান, এ দৃশ্য যেনো মিথ্যে হয়। তার এতদিন পর জন্মানো বিশ্বাস যেনো এভাবে চূর্ণ বিচূর্ণ না হয়ে যায়। তবে আপসোস, মাধবীর প্রার্থনা ভগবান শুনলেন না। নিলাংসুর আসল রূপ শেষ পর্যন্ত মাধবীর সামনে চলেই এলো। তবে না! বিষয়টা আরো যাচাই করতে হকবে। তবেই মাধবী এ দৃশ্য বিচার করবে। কখনো কখনো চোখের দেখায়ও ভুল থাকতে পারে। কারণ যে মানুষটা সম্পূর্ণ ধরনীর কাছে ভগবানতুল্য, সেই মানুষটা এরূপ জঘন্য কাজ করতে পারে না! কিছুতেই না।
____________________________
নিলাংসু ঠোঁট চেপে ধরলো মাধবীর ললাটে। ক্ষুদ্র চুমু খেয়ে কিঞ্চিৎ হেসে বলল,
— আজ তো যুথিও বাড়ি নেই । তাই বলছি, সাবধানে থেকো। আজ আমার ফিরতে বেশ দেরি হবে।

এ কদিন নিলাংসুর ছোট বোন মাধবীদের সাথে ছিল। তার পড়শোনা শেষ হয়ে যাওয়ায় সে গ্রামে চলে গেছে। যুথির জন্যে নাকি পাত্র দেখা হচ্ছে। সুযোগ্য পাত্র পেলে তারা বিবাহ সম্পন্ন করতেই বিলম্ব করবেন না। এ কদিন যুথি বাসায় থাকায় মাধবী নিলাংসুর সেই রাতের বিষয়টা যাচাই করতে পারেনি। আজ সুযোগ এসেছে! আর মাধবী জানে সুযোগের সদ্ব্যবহার কেমন করে করতে হয়?

নিলাংসু বাড়ি ছেড়ে চলে যেতেই মাধবী ব্যস্ত হয়ে উঠলো। কদিন আগে আনা মুসলিম সেলাই ঘর থেকে একটা বোরকা এনেছিল মাধবী। দ্রুত সেই বোরকা দ্বারা নিজের আপদমস্তক ঢেকে নিল সে। নিলাংসুর পিছু পিছু একটা রিকশা নিয়ে তাকে অনুসরণ করতে লাগলো মাধবী।

তবে বিপত্তি ঘটলো একটু পরেই। নিলাংসুর নিজস্ব রিকশা কোনো গলির পথে যায়নি। বরং একটা বিশাল দালানের সামনে এসে তার রিকশা থেমে গেলো। মাধবী কিছুটা অবাক হয়ে রিকশা ছেড়ে নেমে দাড়ালো। এ বাড়িতে নিলাংসুর কিসের কাজ?

অতঃপর খুব সন্তর্পনে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো নিলাংসু। মাধবী তার পিছু পিছু বাড়িতে প্রবেশ করলে হুট করে সদর দরজা আটকে যায়! মাধবী চকিতে পেছন ফেরে।

— মাধবীলতা! আমার মাধবীলতা!
পেছন থেকে নিলাংসুর কণ্ঠ শুনে আত্মারাম কেপে উঠলো মাধবীর। বুকের ধরফরানি বেড়ে গেলো মুহূর্তেই। মাধবী স্থির পায়ে দাঁড়িয়ে রইলো নিজ স্থানে! নিলাংসু মাধবীর কানের কাছে মুখ রাখল। মাধবী যেনো জমে গেলো সে স্পর্শে! নিলাংসু বিড়বিড় করে বললো,
— আমি যাকে ধরা দেইনা সে আমায় ছুঁতে পারে না, মাধবীলতা! এমনকি তুমিও না! আমা অব্দি পৌঁছানো এ ভুবনের কারো সাধ্য নেই।

#চলবে

লেখিকার পাঠকমহল,

আভার পাঠকঘর📚-stories of Ava Islam Ratri

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here