ইতি মাধবীলতা – ৮
আভা ইসলাম রাত্রি
সময়টা তখন সকাল ছ’টা। জমিদার বাড়ির সবাই তখন কাজে ব্যস্ত। সবার নাশতা খাওয়া শেষ হলেও বাকি রয়ে গেলো মাধবী। মূলত, কেউ তাকে জল খাবার খাওয়ার জন্যে ডাকে নি। মাধবীও যেচে একটি বারও খাবার কথা তুলে নি। আত্মসম্মানবোধ যেনো এ নারীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে মেশানো।
নিলাংসুও আজ বাড়ি নেই। সকাল সকাল কোথায় উধাও হয়েছে কেউ জানে না। যখন সে বাড়ি ফিরলো তখন প্রায় মধ্য দুপুর। নিলাংসুর গা বেয়ে ঘাম ঝরছে। গায়ের সাদা রঙের মনে পাঞ্জাবিটাও ঘামে জবথুবু হয়ে শরীরের সাথে লেপ্টে গেছে। তাই সে আর বিলম্ব করলো না। বাড়ি ফিরেই স্নানাগারে প্রবেশ করলো।
নিজ কক্ষে মাধবীকে দেখতে না পেয়ে নিলাংসু ভিজে শরীর নিয়েই রান্নাঘরে পা রাখে। রেখা দেবী তখন উনুনের সামনে বসে পদ্মা নদী থেকে আনা ইলিশ দিয়ে সরষে রাঁধছেন। ইলিশ মাছের সুস্বাদু গন্ধ রান্নাঘর ছাড়িয়ে সম্পূর্ণ জমিদার বাড়িতে ছড়িয়ে গেছে। নিলাংসুর খুব পছন্দের খাবার হচ্ছে এই পদ্মা নদীর ইলিশ! তাই তো তার মা নিজ হাতে বেশ শখ করে ছেলের পছন্দের খাবার রান্না করছেন।
— মা, মাধবীলতা কোথায়?
রান্নাঘরের দরজার পাশে থেকে প্রশ্ন করলো নিলাংসু। মাধবীর নাম শুনেই রেখা দেবীর মাথায় যেনো আগুন চাপলো। তিনি খচখচ কণ্ঠে জানালেন,
— সে আমি জানিনা বাপু! দেখ, কোন নাগরের সাথে পালিয়েছে!
মায়ের মুখে এহেন বিশ্রী কথা শুনে নিলাংসুর রক্ত উষ্ণ হয়ে গেলো। সে দাঁত খিঁচিয়ে মায়ের দিকে তাকালো। ছেলের রাগ সম্বন্ধে পূর্বে থেকেই ধারণা থাকায় রেখা দেবী থতমত হয়ে গেলেন। মনে পড়ে গেলো, মাধবীকে নিয়ে বেশ ভারী কথাই তিনি বলে ফেলেছেন। নিলাংসু নিজেকে সামলে নেওয়ার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা চালালো। অতঃপর বেশ শান্তসুরে বললো,
— মাধবী আমার স্ত্রী, মা। পরবর্তীতে তাকে নিয়ে আমি কারোর একটিও বাজে কথা সহ্য করবো না।
নিলাংসু ক্ষেপা কণ্ঠ শুনে রেখা দেবী মনে মনে বেশ আহত হলেন। সামান্য বেদের মেয়ের জন্যে নিজের ছেলে তার মুখের উপর কথা বলছে। হায় ভগবান, এ দিনও তাকে দেখতে হলো? নিলাংসু সেথায় আর একটি মুহূর্তও দাঁড়ালো না। হনহনিয়ে বাগানের দিকে পা বাড়ালো সে।
মাধবী বাগানের একটি পার্শ্বে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। তার খোলা কেশ বাগানের মিষ্টি বাতাসে এলোমেলো দুলছে। লাল-সাদা শাড়ির আঁচল মেঘের ন্যায় চারপাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। মাধবীকে সচক্ষে দেখতে পেরে নিলাংসুর চোখ শীতল হলো। সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো প্রিয়তমার পানে।
— মাধবীলতা?
কানের কাছে নিলাংসুর ভরাট কণ্ঠ শুনে মাধবী কিছুটা চমকে উঠলো। পাশ ফিরে নিজের অতি সন্নিকটে নিলাংসুকে লক্ষ্য করতেই মাধবী সরে দাঁড়ালো। নিলাংসু সোজা হয়ে দাঁড়ালো। শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— এখানে কি করছিলে?
মাধবী সামনে দৃষ্টিপাত করলো। দূরের আকাশে চোখ রেখে বললো,
— আকাশ দেখছিলাম।
— তা, আকাশে কি দেখলে?
— একটা বিশাল ভরসাপূর্ণ বুক। যেখানে মাথা রাখলে ধরণীর কোনো পাপ আমায় ছুঁতে পারবে না। যেথায় নিজের মন খারাপ জমা করে রাখা যায় অবলীলায়। আমি কাঁদলে, সেও কাঁদে। তার বুক থেকেও বৃষ্টি ঝড়ে। আকাশ হলো এ সংসারের সবচেয়ে বিশুদ্ধ প্রেমিক!
নিলাংসু ঠোঁট টেনে হাসলো। নিজেও আকাশের পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মিহি কণ্ঠে সুধালো,
— যদি আমায় একটুখানি ভালোবাসতে, তবে দেখতে আমিও এ ভুবনের সবচেয়ে বিশুদ্ধ প্রেমিক হতাম। সংসারের সকল প্রেমকে তুচ্ছ করে একচ্ছত্র জয়ী হত আমার প্রেম। কিন্তু আফসোস! তুমি আমায় ভালোবাসলে না!
মাধবী কিছু বললো না। চুপচাপ চেয়ে রইলো আকাশের দিকে। নিলাংসু হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো,
— সকালের জল খাবার খাও নি কেনো?
মাধবী কিছুটা অবাক হলো। সে খায়নি, তা নিলাংসু জানলো কেমন করে? সে কি মাধবীর মন অব্দি পৌঁছে গেছে? মাধবী ছোট করে বললো,
— এ বাড়িতে আমার আপন কেউ নেই! তাই আমি না খেলেও কারো কিছু যায় আসবে না।
নিলাংদু কিঞ্চিৎ হাসলো। মাধবীর চোখে চোখ রেখে বললো,
— আমার তো যায় আসে। তবে কি আমি তোমার আপন কেউ?
মাধবী নীরব হয়ে গেলো। এ প্রশ্নের উত্তর সে দেবে না, একটুও না। নিলাংসু আর দেরি করলো না। মাধবীকে টেনে নিয়ে গেল কক্ষের দিকে।
__________________________
— নাও, মুখ খুলো!
মাধবীর সামনে খাবারের থালা নিয়ে বসে আছে নিলাংসু। মুখের সামনে রুটি দিয়ে মাংসের এক টুকরো তুলে ধরলো। মাধবী প্রথমে কয়েকবার রুক্ষ কণ্ঠে বারণ করেছে। তবে তেজী নিলাংসুর কথার তালে হেরে গেছে সে। এবার মাধবীর বেশ অস্বস্তি অনুভব করতে লাগলো। মা ব্যতীত আর কারো হাতে খায় নি সে। তবে আজ নিলাংসুর হাতে খেতে তার সর্বাঙ্গ যেনো তুমুল অস্বস্তিতে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
— কি হলো? খুলো মুখ!
নিলাংসুর বারবার তাগিদে মাধবী আর দেরি করার অবকাশ পেলো না। হা করলো সে। অতঃপর, নিলাংসু মাধবীকে নাশতা খাইয়ে দিয়েই নিস্তার দিলো।
— বড় কত্তা, দুজন কৃষক এসেছে আপনার সাথে দেখা কত্তে।
দরজার পাশ থেকে দাসীর কণ্ঠ শুনে নিলাংসু বললো,
— অপেক্ষা করতে বলো। আমি আসছি।
— আজ্ঞে, কত্তা!
দাসী নতমুখে জায়গা প্রস্থান করলো। নিলাংসু সম্পূর্ণ নাশতা শেষ করে তবেই স্থান ত্যাগ করলো। মাধবীর চুপচাপ বসে থাকার নির্দেশ দিয়ে কক্ষ থেকে চলে গেলো সে।
#চলবে
আজ আর একটুও বড় করতে পারিনি। ম্যাম চলে এসেছেন। আগামী পর্ব বড় করে দেবো, পাক্কা প্রমিজ!
লেখিকার পাঠকমহল,
আভার পাঠকঘর📚-stories of Ava Islam Ratri