ইফতারি লেখা: সেলিনা রহমান শেলী ১.

0
229

ছোটগল্প: ইফতারি
লেখা: সেলিনা রহমান শেলী
১.
নুরু আজও ইফতারির আগে আগে বড় বাজারে এসেছে। এখানে সারি সারি দোকানে ইফতারি বানানো হয় রোজ। ব্যস্ত দোকানিদের হাঁক-ডাক, সাথে ক্রেতাদের দামদামি দেখতে বেশ লাগে নুরুর। লোভাতুর চোখে ইফতারির দিকে তাকিয়ে থাকতেও কেমন এক তৃপ্তি লাগে। নয়, দশ বছরের নুরুর অপুষ্ট শরীর, তাকে সাত আট বছরের ছেলে মনে হয়। কৃষ্ণ বর্ণের, গলার হাড় বেড়িয়ে থাকা ছেলেটি বোতামহীন, রোদ ঝলসানো শার্ট, মাথা ভর্তি ধুলোবালি মাখা কোকড়ানো চুল, হাতে টিফিন বাটি নিয়ে মুগ্ধ চোখে ইফতারির বেঁচাকেনা দেখে।

দোকানি বসির মিয়া নুরুর দিকে তাকিয়ে খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠে, ” ঐ বান্দির বাচ্চারা রোজ ইফতারির টাইমে এখানে কি? যা ভাগ। ভীড় বাড়ায় শুধু। ”

নুরু দোকানদারদের এসব গালাগালি, বকাবকিতে কিছু মনে করে না। কারণ সে তো একা না। আরও পাঁচ ছয় জন পোলাপান তার মত ইফতারির সময় এই দোকানগুলোয় ঘুরে বেড়ায়। তারা নুরু মত শুধু বেঁচাকেনা দেখে তা না। এরা সারাক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করতেই থাকে দোকানি আর ক্রেতাদের সাথে। কখনো শার্ট, পাঞ্জাবির কোনা ধরে বলে,” একটা পিয়াজু দেন স্যার, একটা বেগুনি,ও স্যার মায়ে রোজা রাখছে একটু জিলাপি দেন না।”

কত কত মিথ্যা কথা যে এরা বলতে পারে। নুরু এদের খুব ভালো করে চেনে। এরা ইফতারি চেয়ে যা পায় কখনোই বাড়ি নিয়ে যায় না। নিজেরা খায়, আবার খেতে না পারলে ফেলেও দেয়। ইফতারি চাওয়াটাই এদের মজা। এমন চেয়ে খেতে খুব লজ্জা লাগে নুরুর । তার দেখাতেই শান্তি। কাস্টমার, দোকানির হৈচৈ, রিকশার টিনটিন বেল,অটোর হর্ণ সব মিলিয়ে নুরুকে ঘোরের এক রাজ্য নিয়ে যায়। নুরু মুগ্ধ হয়ে ভীড় দেখে, কোলাহলে ব্যস্ত মানুষ দেখে।

এক সময় কেনাকাটার ভীড় কমে আসে। পড়ন্ত বিকেলের ম্লান আলোয় নিয়ন বাতিগুলো জ্বলে ওঠে। ইফতারির সময় হয়ে আসে। যে যার বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।

নুরুও দৌড় দেয় বাস স্ট্যন্ডের দিকে। তার বাপের গাড়ি মাগরিব ওয়াক্ত বাস স্ট্যান্ডে থামবে। নুরু টিফিন বাটিতে বাপের জন্য ভাত তরকারি নিয়ে এসেছে। এই ভাত তরকারিই নুরুর বাবার ইফতারি। বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছতে দেরি হইলে বাপে গালি দেয়। নুরু এতেও মন খারাপ করে না। রোজা রেখে সারাদিন বড় গাড়ির হেল্পারি করা সহজ কাজ না।

নুরু বাপের কাছে ইফতারি দিয়ে গ্যারেজে চলে যাবে। কিছু দিন হচ্ছে নুরু গ্যারেজের কাজ শিখছে। সন্ধ্যায় গ্যারেজে তেমন কাজ না থাকলেও মালিক বকাবকি করে এদিও ওদিক ঘুরতে গেলে। নুরু দ্রুত পা চালায়। আজ আযান পইড়া যাইব মনে হয় বাস স্ট্যান্ডে যাবার আগেই।

” নাহ্, আর ইফতারির বাজারে যাওয়া যাইব না। শুধু শুধু সময় নষ্ট। ” নিজেকেই শাসন করে নুরু। যদিও জানে আগামীকাল আবার সে যাবে ইফতারির বাজারে।
২.
নুরুর মা আছিয়া বাসা বাড়িতে কাজ করে। কাজ শেষে রাত আটটা, নয়টায় বাসায় আসে। সাহেব ম্যামদের ইফতারি খাওয়াইয়া, থালাবাসন ধুইঁয়া, রাতের রান্না করে দিয়ে এরপর তার ছুটি। পুরো রোজার মাস নুরুর মা একদিনও বাড়িতে ইফতারি করতে পারে না।

রাতে মায়ে যখন আসে কাপড়ের মধ্যে ইফতারি নিয়ে আসে। নুরু জানে এগুলো স্যার ম্যামদের না খাওয়া, বেঁচে যাওয়া অংশ মায়ে নিয়ে আসে। প্রায়ই সেই ইফতারির মধ্যে অর্ধেক খাওয়া পেয়াজু,বেগুনি থাকে। নুরু মাকে জিগ্যেস করে না এগুলো খাওয়া ক্যান?পাছে অন্যরাও জেনে যায় যদি। নুরু মাকে লজ্জায় ফেলতে চায় না।

নুরুর ছোট দুই ভাই বোন, অন্ধ দাদি পরম মমতায় সেই ইফতারি খায়। নুরুও মাঝে মাঝে খায়। কিন্তু রোজ খায় না। নুরু ভাবে, “এটুকু ইফতারি একজন কম খাইলে অন্য জন তো একটু বেশি পায়।”

নুরুর মা আদর করে ডাকে,” নুরু, বাপ আলুর চপটা নাও।”

নুরু ইফতারির পরিমাণ এক ঝলক দেখে বলে,” আইজ গ্যারেজে স্যার ইফতারি দিছিল মা। পেট ভর্তি। ওদের দাও।”

মা আগ্রহ নিয়ে জানতে চায়,” কি খাওয়াইছে বাপ?” নুরু বেশ আয়োজন করে বলে,” এক প্যাকেট বিরিয়ানি আর কোক। সাথে তরমুজও আছিল মা। বিরিয়ানির মধ্য বড় মুরগীর রান। ”

নুরুর ছোট ভাই রতন অভিমান করে বলে,” একলা খাইলা তুমি? একটু আনতা। আমরাও খাইতাম।”

নুরু হতচকিয়ে যায়। এত বড় মিথ্যা কথা বলা ঠিক হয় নাই। একটা মিথ্যা বললে সাথে আরও দশটা মিথ্যা বলতে হয়। মসজিদের হুজুর এক দিন বলছে। মিথ্যা সকল পাপের গুরু। নুরু মিথ্যা বলতে চায় না। কিন্তু মুখ ফসকে বলে ফেলছে আজ।

নুরু কিছু বলার আগে মায়ে ধমক দেয় ছোট ভাইকে।
” কইলেই আনোন যায়? যারা দেয়, হেরা সামনে বসে খাইতে কয়। চাইলেই আনোন যায় না। বুজছস। ”

অন্ধ দাদি বলে,” খাওনের সময় কথা কম কওন লাগে। এত কথা কি?” সবাই খাওয়ায় মন দেয়।

নুরুর ছোট বোন পরী রাতে ঘুমানোর আগে এক ফাঁকে নুরুর কানে কানে বলে,” এরপর বিরিয়ানি দিলে আমার জন্য একটু আইনো দাদা ভাই। ”

নুরু অসহায় ভাবে মাথা নাড়ে। সে আনবে। কিন্তু দিলে তো আনবে। নিজের কাছেই কেমন অপরাধী মনে হচ্ছে তার। যেনো সত্যি সত্যি সে একা বিরিয়ানি খেয়ে এসেছে।

চলবে…

(আগামীকাল রাত ৯.৩০ এ শেষ অংশ পোস্ট করা হবে। যারা কমেন্ট করে রাখবেন তাদের ম্যানশন দেওয়া হবে। ধন্যবাদ।)

#coyright_reserved

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here