#উপন্যাস_প্রপর্ণ(১৪)
#কুরআতুল_আয়েন
দুইদিন পর থেকে বেলীর পরীক্ষা শুরু।কিন্তু,বিপত্তি হয়েছে বেলীর পড়ায় কোনো মনোযোগ নেই।বেলী মনের সাথে অনেক যুদ্ধ করছে পড়ায় মন বসানোর জন্য কিন্তু বারবার হিতে বিপরীত হচ্ছে।তাই রাগে টেবিলের উপর থাকা বই টা বন্ধ করে দেয়।দুই হাত দিয়ে মাথা টা চেপে ধরে বসে আছে।
বুরাগ বিছানায় হেলান দিয়ে আছে।বুরাগ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে বেলীর পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত থাকবে।পরীক্ষা শেষ করেই একদম তার সাথে করে নিয়ে যাবে।বেলীর উপর ভরসা পাচ্ছে না বুরাগ।বেলীর বিগড়াতে বেশি সময় লাগবে না।বুরাগ পা দুটো নাড়াচ্ছে আর হাতে ফোন নিয়ে বসে আছে।অবশ্য,হাতে ফোন রাখাটা হলো একটা অভিনয় সে তো ক্ষণে ক্ষণে বেলীর দিকে তাকাচ্ছে।বেলীর মুখ দেখতে না পারলেও পিঠ দেখতে পারছে।একা একা বসে খুবই বিরক্তি লাগছে বুরাগের।ইচ্ছা করছে ইশারা দিয়ে ডাকতে বেলীকে।কিন্তু,এখন ডাক দেয়া মানে বেলীর রণচণ্ডী রূপ ধারণ করা।তার উপর কাল রাতে বুরাগ দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে একটা ডোজ দিয়েছে।তাই চুপ থাকাটাই শ্রেয়তর মনে হচ্ছে।হাতে থাকা ফোনটা নিয়ে শুধু উলোটপালোট করছে।এরিমধ্যে রায়ানের ফোন এসেছে।বুরাগ কতক্ষণ ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে তাকিয়ে রইলো ফোনটার দিকে।পরমুহূর্তেই বেলীকে জ্বালানোর একটা বুদ্ধি বের করে ফোনটা কানে চেপে ধরলো।ফোনের অপাশে রায়ান কথা বলার আগেই বুরাগ বেলীকে শুনিয়ে বলতে লাগলো,
–“হ্যালো!দ্বিতীয় হবু বউ কেমন আছো?আরে চিন্তা করো না এখন প্রথম বউ এর কাছে থাকলে কি হবে মন তো শুধু তোমার কাছেই পড়ে আছে।”
রায়ান ফুটপাত দিয়ে হাটছিলো।গন্তব্য ছিলো সামনের চা স্টল টা।ওই দোকানের চা একদিন না খাওয়া মানে অমৃত মিস করা।বুরাগের কথা কর্ণপাত করেই সটান করে ফুটপাতের উপর বসে পড়লো।
–“ভাই তুই ঠিক আছোস।তুই কি আবার বিয়া করবি?এবার বিয়া করলে আমারে করাইস,তোর তো বউ আছে আমার তো নাই।”
–“কান্না করে না হবু বউ আমার।খুব তাড়াতাড়িই আমরা কাছাকাছি হবো।আর বেশি দিন নেই।এইবার ফিরেই তোমাকে বিয়ে করে আমাদের চারহাত দুইহাত করে ফেলবো।”
–“ইসস্!শালারপুত গাঞ্জা খাইছোস তুই।তোর থেকে দূরে দূরে থাকতে হবে।তোর নজর খারাপ।আমার ইজ্জত লুটেপুটে নিবি।”
বেলী রাগে ফোসফাস করছে।এক তো পড়া হচ্ছে না তার উপর বুরাগের এইসব কথাবার্তা বেলীর হৃদয়ের গহীনে আঘাত হানছে।পিছনে ফিরে বুরাগের দিকে একবার কটমট চোখে তাকিয়ে নিলো।বুরাগ কথা বলছে আর বেলীর কটমটানি চোখ দেখে মনে মনে অনেক আনন্দে পাচ্ছে।বুরাগ কথার রস আর একটু বাড়িয়ে দিলো।বিছানায় হেলানো থেকে এখন সে শুয়ে পড়েছে।একবার বিছানার এপাশ হয়ে কথা বলে তো আরেকবার ওপাশ হয়ে।
অন্যদিকে,রায়ানের মাথা একপ্রকার আউলা-ঝাউলা হয়ে যাচ্ছে।বুরাগের কথার আগামাথা কিছুই ভাবান্তর হচ্ছে না।ফুটপাতের পাশের মেইন রোড টা দিয়ে গাড়িঘোড়া শো শো করে চলে যাচ্ছে।এতে ধুলোবালি গুলো রায়ানের মুখে এসে পড়ছে।বেচারা এবার অনেকটাই রেগে গেছে।চেঁচিয়ে বলতে শুরু করলো,
–“ভাই!আপনি রং নাম্বারে ফোন দিয়েছেন।আর যদি আপনি আমার বন্ধু বুরাগ হন তাহলে শুনোন!ওই হারামি আমি তো বন্ধু রায়ান।কোন বেডিরে ফোন দিতে গিয়ে আমারে ফোন দিয়ে বউ বউ ডাকা শুরু করছিস।মানুষ হইলি না তুই।”
বুরাগ অনেক কষ্টে হাসি চাপিয়ে রেখেছে।বেলীর কটমটানি চোখ আর রায়ানের কথাবার্তার ধরণ দেখে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে রাখছে।রায়ানের কথার উত্তরে বললো,
–“রাগ করে না।আমি আসবো খুব শীঘ্রই তোমার কাছে।একটু অপেক্ষা করো।অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়।”
বেলী চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লো।চোখে পানির অশ্রু বাঁধা মানছে না।রাগে আলমারির কাছে এগিয়ে গিয়ে বুরাগের ব্যাগ টা টেনে বের করলো।ঢিল মেরে বুরাগের শরীরের উপর ফেলে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“দরকার নেই এইখানে থাকার আপনার।বেরিয়ে যান আপনি।আপনার দ্বিতীয় হবু বউয়ের কাছে বসে থাকেন এইখানে থাকতে গেলে এতো পটরপটর করতে পারবেন না”
বুরাগ ফোনটা কান থেকে নামিয়ে বুকে চেপে ধরেছে।বেলীর চোখে পানি দেখেও না দেখার ভান করে বললো,
–“একটু ভদ্র ভাবে কথা বলো।কি ভাববে বলো তো!ভাববে তোমার মতো এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করেছি যার কথা বলার ধরণ এইরকম।বেশি দিন তো থাকছো না আমার কাছে,কয়েকদিন পর তোমাকে মুক্ত করে দিবো।”
অপমানে বেলী মাথা টা নিচু করে ফেললো।বেলীর মন জুড়ে তো বুরাগের প্রতি ভালোবাসার অসংখ্য গল্প,কবিতা,শিল্পের টুকরো ছিলো।যেগুলো আজকেও ভেঙে গিয়েছে।বেলীর মন এখন শূন্যতায় ভরপুর।ভালোবাসার এই যন্ত্রণা একটু কাটিয়ে উঠতে পারবে কিনা তা বেলীর অজানা।তবে,এই বেদনা টাকে বেলী নিজের সঙ্গী করে নেয়ার চেষ্টা করছে।
আর কিছু না বলে এলোমেলো পা’য়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো।বুরাগ ফোন টা কেটে দিয়ে বেলীর যাওয়ার পানে তাকিয়ে প্রাণহীন হাসি টেনে বললো,
‘তুমিও যে বেদনা অনুভব করছো তোমার সাথে সাথে আমিও সেই বেদনা অনুভব করছি।এখন তোমার মনে ঘন কালো মেঘেরা ভর করেছে,ঠিক আমিই তোমার উদাস মনের কালো মেঘদের দূর করতে তাদের সাথে মিষ্টকথন জুড়ে দিবো।তার আগে,আর একটু বেদনা সয়ে নাও।’
————————–
আফিয়া সবেমাত্র রুম গুছিয়ে বিছানায় একটু বসেছেন।শরীর টা ইদানীং ম্যাচম্যাচ করে উনার।বুরাগ আসলে ডক্টর দেখাবেন ভেবে নিয়েছেন।দুপুরের সময়।বাসা নিস্তব্ধ।বাসায় উনি আর উনার ননদ পারভীন ছাড়া আর কেউ নেই।পারভীন নিজের রুমে ঘুমিয়ে আছেন।নড়তে চড়তে অনেকটাই কষ্ট হয়।কোহিনূর হাসি খুশিকে নিয়ে প্রাইভেট,কোচিং এ দৌড়াদৌড়ি করছেন।আফিয়া শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।দরজাটা খোলায় রেখেছেন।মনে করার চেষ্টা করছেন মেইন দরজা লাগানো কি না।মনে করার চেষ্টা করেও মনে করতে পারেন নি।তাই বাধ্য হয়েই উঠে দাঁড়ালেন।দরজার কাছে যাবেন এই মুহুর্তে আজাদ রহমান কে দেখে কিছুটা হকচকিয়ে উঠলেন।এই অবেলায় উনার স্বামীকে একদমই আশা করেন নি।তাই কিছু না বলে চুপ করে বিছানায় বসে পড়লেন।আজাদ রহমান গরম চোখে নিজের সহধর্মিণী আফিয়ার দিকে তাকালেন।হুট করেই আজাদ রহমান আফিয়ার চুলের মুঠি ধরে দু’গালে দুটো থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন।এতে প্রথমে আফিয়ে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেও পরক্ষণেই নিজেকে ঠিক করে নিলেন।
–“তোর কথায় বুরাগ ওই মেয়েকে আনতে গেছে তাই না।তুই শিখিয়ে দিয়েছিস ওকে এই বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য।না হলে,যে ছেলে বিয়ে টাই মানতো না সে কেনো ওই মেয়েকে আনার জন্য পাগল হয়ে যাবে।বুরাগকে এখন আমার অনেক দরকার।ওর সাথে আমি আমার পার্টনার রাখেশের মেয়ের বিয়ে দিয়ে ব্যবসা টাকে আরো দূরে নিতে চাচ্ছি এখন মাঝখান দিয়ে বুরাগ এইরকম পাল্টে গেলে কিছুতেই হবে না।সব তুই ওকে শিখিয়ে দিয়েছিস।”
আফিয়া আজাদ রহমানের হাত টা ছিটকে সরিয়ে দিলেন।নিত্যদিন উনার উপর অত্যাচার গুলো আফিয়া আর নিতে পারছেন না।আজাদ রহমানের কথার পিঠে চেঁচিয়ে বললেন,
–“বুরাগ শিশু নয় যে আমি তাকে শিখিয়ে দিবো।সে নিজের ইচ্ছাতেই বেলীকে আনতে গিয়েছে।নিজের ব্যবসার জন্য বুরাগকে হাতিয়ার বানিয়ে কী লাভ হবে?বুরাগ বিবাহিত জেনেও কীভাবে তুমি ওর আরেকটা বিয়ে দিতে চাইছো?”
–“আমার দিকে একদম প্রশ্ন ছুড়ে মারবি না।আমার টাকা দিয়ে চলে আবার আমার উপরেই কথা বলছিস তুই।তোকে তো কবেই বিদায় করে দিতাম কিন্তু বুরাগের জন্য পারলাম না।এখন,ছেলেকেও তুই হাত করে নিচ্ছিস।”
–“ছেলে যদি তোমার মতো লম্পট হতো তাহলে ঠিকই হাত করে নিতাম।আমার মতো কষ্ট করতে দিতাম না বেলীকে।কিন্তু,বুরাগ ঠিক তোমার উল্টো।তোমার মতো রাতের পর রাত অফিসের কলিগদের সাথে বসে থাকে না।”
আফিয়ার গালে আরো একটা চড় পড়লো।আজাদ রহমানের হাত রাগে কাঁপছে।আগের মতো আবারও বলতে লাগলেন,
–“তো আছিস কেন আমার মতো লম্পটের সাথে।বেরিয়ে যাচ্ছিস না কেন?তোর মুখ দেখলেও আমার কষ্ট হয়।”
আফিয়ার নিজেকে সামলানোটা খুবই দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে।কথায় কথা বাড়বে বলে আর কিছু বলেন নি।চার দেয়ালের মাঝে তাঁদের সম্পর্ক টা ঠিক এইরকম।যে সংসারে আফিয়া কোনোদিন সুখের দেখা পান নি।শুধুমাত্র বুরাগের দিকে তাকিয়ে ধৈর্য ধরে আছেন।নিজেদের এই ব্যবহার গুলো বুরাগের সামনে বহিঃপ্রকাশ করতে চান না।তাই তো ঘোড়ার খাটনি করে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন এই সংসার টাকে।
————————–
সামনের পুকুর টা থেকে বুরাগ আর তামিম মিলে দুজনে গোসল করে নিয়েছে।পুকুরের পানি কম হওয়ায় তা বুরাগের কোমর অবধি হয়েছে।তাই মগ দিয়েই গোসল করে এসেছে।তামিমের জোড়াজুড়িতে বুরাগ বাধ্য হয়ে লুঙ্গি পড়েছে।তামিমের এক কথা লুঙ্গি পড়ার মতো শান্তি এই দুনিয়াতে আর নেই।শান্তির আরেক নামেই লুঙ্গি।গোসল শেষ করেই দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর্বও শেষ হয়েছে।জাবেদা সব টাটকা জিনিসেই রান্না করেছেন।বাড়ির আশেপাশের জায়গা গুলোতে প্রায় মোটামুটির সব সবজিরই বাগান করেছিলেন।
বুরাগও তৃপ্তিসহকারে খেয়ে ঘরে ঢুকে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো।চোখ দুটো ঘুমে নিয়ে যাচ্ছে।আশেপাশের কোনো কিছু না ভেবেই ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিয়ে নিলো।
বেলী গোসল করে বাহিরে বের হয়েছে মাত্রই।বুরাগকে লুঙ্গি পড়া অবস্থায় দেখে কতক্ষণ সঙের মতো দাঁড়িয়ে রইলো।বুরাগকে ঘুমিয়ে পড়তে দেখে আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে নি।চুপচাপ সেও বের হয়ে গেলো ঘর থেকে।
সবাই বের হওয়ার পর শিউলি স্কুল থেকে বের হয়েছে প্রতিদিনের মতোই মিনিট পাঁচ-দশের মধ্যেই স্কুল টা ফাঁকা হয়ে গিয়েছে।সামনের মাঠটায় কয়েকজন মিলে খেলছে।শিউলি করিমের সাথে দেখা করে স্কুলের লাস্টের দেয়ালটার আড়ালে।সেখানে মানুষের আনাগোনা বলতে গেলে একদমই নেই।তাদের কথা বলার জন্য তেমন একটা জায়গা বরাদ্দ করেছে করিম।শিউলি আশপাশ টা খেয়াল করে দৌড়ে চলে গেলো স্কুলের দেয়াল টার আড়ালে।
করিম তখন দেয়ালে ঠেস দিয়ে বিড়ি খাওয়ায় ব্যস্ত।শিউলি করিমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো কিন্তু,করিমকে বিড়ি টানতে দেখেই মুখটা ছোট করে ফেললো।করিম পাশে শিউলির উপস্থিতি পেতেই বিড়িটা ছিটকে দূরে ফেলে দিলো।নিজেকে ঠিক করে শিউলির দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলো।
–“করিম ভাই!আপনাকে কতোবার বলেছি এইসব ছাইপাঁশ খাবেন না।এইসব আমার একদমই পছন্দ না।
করিম শিউলির হাত টা টেনে এনে নিজের পাশে দাঁড় করালো।শিউলির মসৃণ কোমর টা নিজের সাথে চেপে ধরে রেখেছে।প্রথম প্রথম করিমের এই স্পর্শ গুলো শিউলির কাছে অস্বস্তি লাগলেও এখন ঠিকই ভালো লাগে।এমনকি করিমের এই স্পর্শ গুলো বারবার পেতে যায় শিউলি।করিম একবার আড়চোখে তাকালো শিউলির দিকে।শিউলি লজ্জায় মাথাটা নিচু করে মিটিমিটি হাসছে।করিম জোরে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
–“আইচ্ছা!ছাইড়া দিমু এইসব খাওয়া।তোমার যেহেতু পছন্দ না তাহলে বাদ দিলাম।”
শিউলি ইচ্ছাকৃত ভাবে করিমের সাথে আর একটু চেপে দাঁড়ালো।করিমও শিউলির মতিগতি বুঝতে পেরে তার ঠোঁটে একটা কামুক হাসি ফুটে উঠলো।শিউলি করিমের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“করিম ভাই!আপনি কাল কেনো আমাদের বাড়ি গিয়েছিলেন?আম্মার সাথে কী কথা বলেছেন?”
করিম গলাটা পরিষ্কার করতে লাগলো।তার ভাবনার বাহিরে ছিলো শিউলি তাকে দেখে ফেলবে।সে তো খবর নিয়েই গিয়েছিলো রোকসানার কাছ থেকে।তখন তো রোকসানা বলে ছিলো শিউলি বাড়ি নেই।এখন,করিম কী বলবে তাই ভেবেই তার কপাল থেকে ঘাম ঝড়ছে।শিউলিকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমতাআমতা করে বললো,
–“তোমার আর আমার বিয়ার কথা কইতে গেছিলাম।”
করিমের কথা কানে পৌঁছতেই শিউলি এক লাফে করিমের হাত দুটো জড়িয়ে ধরলো।উত্তেজিত গলায় বললো,
–“সত্যি করিম ভাই!আমি আজকেই আম্মাকে এই কথাটা জিজ্ঞেস করবো।”
–“আরে!শিউলি এখনোই এইসব বইলো না।আমি যেদিন বলতে কমু সেদিনেই কইবা।”
–“ঠিকাছে!কিন্তু করিম ভাই আম্মা কি বলেছে আপনাকে?রাজি হয়েছে?আসলে,বুনি আপার বিয়ের দিনের ওই ঘটনা টা হওয়ার পর থেকে তো আম্মা আপনাকে সহ্য করতে পারতো না”
–“ইয়ে মানে!আমি চাচির কাছ থাইকা ক্ষমা চাইয়া নিছি।চাচি আমারে ক্ষমা কইরা দিছে।আর কইছে,তোমারে যেনো এহন এইসব না কই।কইলে তুমি আর পড়াশোনা করবা না।এইলাইজ্ঞা কইতাছি তুমি এহন এইতা নিয়া চাচিরে কিছু কইও না।কইলে পরে সব কিছু উলোটপালোট হইয়া যাইবো।”
শিউলি খুশি হয়ে করিমকে জড়িয়ে ধরলো।করিমও শিউলিকে নিজের সাথে চেপে ধরে আছে আর ভাবছে,’শিউলি তুমি কত্তো বোকা।’
কিছুক্ষণ পর শিউলি নিজেকে করিমের থেকে ছাড়িয়ে নিলো।করিম শিউলির দিকে জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।শিউলি মুচকি হেসে বললো,
–“আমাকে যেতে হবে।আর থাকা যাবে না।দুলাভাই এসেছে কাল রাতে।”
করিম চমকে উঠলো।মুখটা তার গম্ভীর হয়ে গিয়েছে।এমতাবস্থায় বললো,
–“আইচ্ছা যাও।আর হুনো!চাচিরে কিন্তু তুমি কিছুই বলবা না।”
শিউলি মাথা দুলিয়ে জায়গায় পরিত্যাগ করলো।করিম রাগে বিরবির করছে,’ধুর!বেলীরে এহন আর রাস্তার মধ্যে কিছুই করতে পারমু না।’
————————–
গোধূলির সময়।গ্রামের সরু রাস্তা টা দিয়ে বেলী আর বুরাগ হাঁটছে।বেলীকে জোর করেই পাঠিয়েছেন জাবেদা।গ্রামের চারপাশ টা বুরাগকে দেখিয়ে আনার জন্য আর দু’জনে যেনো একটু আলাদা সময় কাটাতে পারে তার জন্য।বেলী বুকে হাত গুজে হাঁটছে।পাশে থাকা বুরাগের দিকে একবারও তাকাচ্ছে না।বুরাগ গোধূলির এই মৃদু বাতাস টা বেশ উপভোগ করছে।চেকের লুঙ্গি টা মৃদু বাতাসে তাল মিলিয়ে দুলছে।রঙচটা বিকেল টা যেনো অন্ধকারের বাষ্পে একটু একটু করে মিহিয়ে যাচ্ছে।বাতাসের তালে কচি ধান ক্ষেতের ধান গাছ গুলো সমান তালে নুয়ে পড়ছে।বুরাগের মনে হচ্ছে একটা অলস দুপুর পেরিয়ে সূর্যের শেষ আলো টা আবিরের মতো ছড়িয়ে একটা বিকেল এসেছে।সূর্যের হালকা হালকা রোদের টুকরো গুলো ফুরিয়ে যাচ্ছে।গোধূলির পায়ের ধূলো দিয়ে গরু গুলো সমান তালে নিজেদের আস্তানায় ফিরছে।দূর পুকুরে ভেসে থাকা হাঁস গুলো দৌড়ে পুকুর পাড়ে উঠছে।প্যাঁকপ্যাঁক করে ডেকে লাইন বেয়ে বাড়ির দিকে ফিরছে তারা।সকাল,দুপুরের ফেলে আসা স্মৃতি,ক্লান্তির অবকাশ ঘটিয়ে বিকেল নেমে এলো।বেলী হাঁটা থামিয়ে দিয়েছে।একপাশে দাঁড়িয়ে আছে আগের ন্যায় বুকে হাত গুজে।বুরাগ কিছুটা সামনে এগিয়ে গিয়েছিলো,বেলীকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে নিজেও বেলীর পাশে এসে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে পড়লো।গলাটা পরিষ্কার করে বললো,
–“ভাবছি!দ্বিতীয় বিয়েটা করে তোমাদের বাড়িতেই হানিমুন করতে আসবো।বউকে নিয়ে লুঙ্গি পড়ে এইভাবে সময় কাটাবো।অবশ্য,তোমার জায়গায় তখন অন্যকেউ থাকবে।”
বেলী চটে গিয়েছে।এতো সুন্দর একটা মনোমুগ্ধকর পরিবেশে এইরকম অযৌক্তিক কথাবার্তা একদমই বেমানান।তাও আবার,জামাইয়ের দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে।বেলী বুরাগের কথায় উত্তর দিলো না।নাক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।বুরাগ বেলীর উত্তর না পেয়ে কিছুটা ঠেস দিয়ে বললো,
–“কি গো!কিছু বলো।আমি আর আমার দ্বিতীয় বউ কে নিয়ে সময় পেলেই এইখানে ঘুরতে চলে আসবো,আর তুমি আমাদের কে আশপাশ টা ঘুরিয়ে দেখাবে।”
বেলী কাটকাট উত্তর দিলো,
–“ঠিকাছে আমি আপনাদের ঘুরিয়ে দেখাবো।আপাতত আমার এইখানে থাকতে ভালো লাগছে না।আমি বাড়ি গেলাম।আপনার আশপাশ টা দেখা হয়ে গেলে আপনি নিজ দায়িত্বে চলে আসবেন।”
–“যদি এক পা-ও নড়ো তাহলে চড়াই-উতরাই একদম সোজা বানাইয়া দিবো।চুপচাপ তুমি আমার সাথে থাকবে।কালকে কি বলেছিলাম যতোদিন না দ্বিতীয় বউ আনছি ততদিন এইভাবেই আমাকে সঙ্গ দিয়ে চলবে।”
বেলীর এখন ভিষণ কান্না আসছে।মনে মনে বুরাগের নাম দিয়েছে’পাষাণ জামাই’।বেলী নাছোড়বান্দা হয়েই জবাবে বললো,
–“আমি এখনোই বাড়ি যাবো।আপনার সাথে থাকতে আমার কিছুতেই ভালো লাগছে না।”
বুরাগ রাগ দেখিয়ে রাস্তার পাশের ঘাসগুলোর উপরে বসে পড়লো।বেলীর হাত টা টেনেও বসিয়ে দিলো।বেলী বাধ্য হয়েই নিজেকে ঠিক করে বসে পড়লো।বুরাগ সামনের প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে কোমল কন্ঠে বললো,
–“চুপ করে এইখানে বসে থাকো।জায়গা টা বেশ ভালো লাগছে আমার।শহরে থাকতে থাকতে একদম তেঁতো হয়ে গিয়েছি।এইরকম প্রকৃতি উপভোগ করা অনেকটা ভাগ্যের ব্যাপার।”
–“আপনার প্রকৃতির উপভোগ আপনি একাই করেন।আমাকে কেন বসতে বলছেন আপনি।”
–“ওই যে তুমি আমার স্বল্প কালের বউ তাই।তোমার সাথে বসেও এমন প্রকৃতি একটু উপভোগ করে নেই।পরে তো আর পারবো না বলো।তখন আমার হৃদয় জুড়ে শুধু তোমার সতীনের বসবাস থাকবে।সেও আমাকে তোমার কাছে আসতে দিবে না আর আমিও তোমার কাছে আসবো না।তাই সুযোগ বুঝে এখন তোমাকে নিয়েই চার মারছি পরে না হয় দ্বিতীয় বউ নিয়ে ছক্কা মারবো।”
বেলীকে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারছে না।বুরাগের কথায় অনেকটাই ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে।নিজের কষ্ট টা ভিতরে চাপিয়ে রাখা খুবই কষ্টকর হচ্ছে।তাই আর না পেরে,জোর গলায় কেঁদে উঠলো বেলী।মুখে হাত দিয়ে শব্দ করে কেঁদে যাচ্ছে।
বুরাগ প্রথমে চমকে উঠেছিলো।বেলীর কান্না সেও সহ্য করতে পারছে না।কিন্তু,বেলীকে একটু কষ্ট না দিয়ে সে শান্তি পাবে না।বেলীর চলে আসায় তো সেও এইভাবে কষ্ট পেয়েছে,ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে।শুধু তফাৎ একটাই বেলী কান্না করে নিজের কষ্ট টাকে বাহিরে ঝেড়ে ফেলছে কিন্তু,বুরাগ নিজের কষ্ট টা মনের ভিতরেই চেপে ধরে রেখেছিলো।কথায় আছে,ছেলে মানুষদের কান্না করতে নেই।হয়তোবা সেই প্রথা ঠিক রাখতেই বুরাগ নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করেছিলো।
বেলীর কান্নার বেগ আরো বাড়ছে।বুরাগ আশপাশ টায় একবার তাকিয়ে দেখে নিলো।আশপাশে লোকজনের কোনো চিহ্ন নেই।বুরাগ বেলীর কিছুটা কাছে এগিয়ে গেলো।বেলীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর অসহায় মুখ করে বলছে,
‘আহারে!কান্না কইরো না আমার স্বল্প কালের বউ।’
চলবে..