উপন্যাস প্রপর্ণ, পর্ব-১৩

0
3630

#উপন্যাস_প্রপর্ণ(১৩)
#কুরআতুল_আয়েন

–“তোর অফিস দেখানোর জন্য আমারে এইখানে বসাইয়া রাখছোস?”

বুরাগ চেয়ার নিয়ে হেলছে আর দুলছে।রায়ানের দিকে একবার তাকিয়ে নিলো।ফোনে চোখ গুজে রেখেই বুরাগের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে মেরেছে।রায়ানের মতিগতি দেখে বুরাগের যেনো পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

–“বাহির হ!আমার কেবিন থেকে।শালা!ফোন টার দিকে চোখ দিয়ে রাখছোস।আমার দিকে একটু দেখ,আমি কি একটা অবস্থার মধ্যে আছি।”

রায়ান এবার একটু নড়েচড়ে বসলো।ফোন টা পকেটে গুজে রেখে দিলো।চেয়ার টায় হেলান দিয়ে পেটের কাছে হাত দুটো ভাজ করে রেখে দিয়েছে।কিছুটা আমোদিত গলায় বললো,

–“সেই এক ঘন্টা ধরে তোরে দেখতেছি।কই তুই তো ঠিকই আছোস।কোনো পরিবর্তন হলে না বুঝতাম তোর অবস্থা টা।যেমন ধর এই এক ঘন্টার মধ্যে যদি তুই ছেলে থেকে মেয়ে হইতি তাহলে তোর অবস্থার ব্যাখ্যা দিতে পারতাম।কিন্তু তুই তো আগের মতোই আছোস।”

বুরাগ সরু চোখে তাকালো রায়ানের দিকে।কিছুটা কর্কশ গলায় বললো,

–“তোরে আমার আশেপাশে সহ্য হচ্ছে না।তুই বিদায় হ!অন্তত আমার সামনে এক সপ্তাহ আসবি না।”

–“এমন করতাছোস কেন?আচ্ছা!এখন সিরিয়াস মুড নিয়েই কথা বলবো।”

বুরাগ কিছু বলে না চুপ করে বসে আছে।এসির বাতাসেও যেনো তার মনের প্রশান্তি মিলছে না।এসির বাতাস টা ঠান্ডা থেকে কেমন একটা গরমে পরিণত হচ্ছে।জোরে শ্বাস নিলে এসির বাতাস টা ঠান্ডা অনুভব হয় আবার ছেড়ে দিলে যেই লাউ সেই কদু।
রায়ান নিজেকে ঠিক করে আরো একটু আয়েসি ভঙ্গিতে বসে পড়লো।একটা হাই তোলে বুরাগের দিকে তাকালো।দুপুরের এই সময়টাতে রায়ানের চোখে ঘুমেরা সবসময় উঁকিঝুঁকি দেয়।পাশে রাখা সোফাটা যদি আর একটু লম্বা হতো তাহলে কখন গিয়ে শুয়ে পড়তো।কিন্তু,এইটা এখন কিছুতেই সম্ভব না।ছোট সোফা তো আর টেনে লম্বা করা যাবে না।বলতে গেলে এখন কল্পনা ছাড়া আর কিছুই করার উপায় নেই।রায়ান বুরাগের দিকে নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে আবারও বললো,

–“তোর প্রতিদিনের এইসব প্যাঁচাল ক্যাঁচাল আমার ভালো লাগে না বুঝছোস।একবার মাঝরাতে ফোন দিয়ে ঘুম ভাঙাস,আবার এক ঘন্টার মতো অফিসে বসাইয়া রাখোস।তার থেকে ভালো তুই তোর রাগ টাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে ভাবিরে আনতে যা।দেখবি তুইও ভালো থাকবি সাথে আমিও একটু মানসিক ভাবে সুস্থ থাকবো।”

বুরাগ দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে বললো,

–“আমিও তাই ভাবছি।বেলীকে নিয়েই আসবো।ওকে ছাড়া থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে।আর বেশিদিন থাকা পসিবল না।তাই ভাবছি আজকে রাতেই রওনা দিবো।”

রায়ানের ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো।বুরাগের কথার তালে বলতে শুরু করলো,

–“যাক বুঝলি তাহলে তুই ভাবিকে ভালোবাসিস।আহারে!বন্ধু আমার পিরিতের জ্বালায় থাকতে পারতাছে না।”

–“বেলীকে ভালোবাসার অনুভূতি গুলো তোর দ্বারাই বুঝেছি।না হলে এইভাবেই থাকতে হতো।ভালোবাসা আর বাহিরে প্রকাশ হতো না আকাশ ভাঙা ঝুম বৃষ্টির মতো।”

–“ভাবিরে বলবি কবে তোর মনের কথা?”

বুরাগ ফোসফাস করে বললো,

–“তোর ভাবিরে আর একটু কষ্ট দিবো আর সাথে শাস্তিও বরাদ্দ করা আছে।আমাকে এই কয়েকদিনে কম কষ্ট দেয় নি।যেগুলো কড়ায় গন্ডায় বুঝে নিবো।তার কাজের প্রাপ্য হিসাব টা তাকে পেতেই হবে।”

বুরাগের কথায় রায়ান দাঁত কেলিয়ে হেসে উঠলো।কিছুটস রস মিশিয়ে বলতে শুরু করলো,

–“বন্ধুর তো দেখি পিরিতের আগুনে জ্বলতাছে।কতোটুকু জ্বলতাছো দেখি তো!দ্বিগুণ নাকি তিনগুণ?”

–“তোরে দেখাবো কেন?যার জন্য জ্বলতাছি তারেই দেখাবো এবং,তারেও পোড়াবো।তবে আমার ভিতরের জ্বলন দ্বিগুন বা তিনগুণ ও না এক লাফে দশগুণে চলে গিয়েছে।”

রায়ান চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বুরাগের কথায় মুচকি মুচকি হাসছে।বুরাগ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।সামনের জানালা টার দিকে এগিয়ে গেলো।সাদা-গোলাপি মিশ্রিত পর্দা টা ঠেলে দু’পাশে এক করে দিয়ে জানালার থাইগ্লাস টা খুলে দিলো।খুলে দিতেই বাহির থেকে আসা ঠান্ডা,শীতল বাতাস টা বুরাগের চোখেমুখে এসে ধাক্কা খেয়ে তা এসি যুক্ত কেবিনটায় গিয়ে পড়ছে।বুরাগ জানালাটার পাশের দেয়ালটায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের পানে চেয়ে রইলো।মাঝেমধ্যে দূরের বিল্ডিং যুক্ত আবছা আবছা গাছপালা গুলোর দিকেও তাকালো।বুরাগ প্রকৃতির একটা সুর পাচ্ছে।যা বাতাসের দাপটে নিয়ে আসছে বুরাগের কান অবধি।বুরাগ প্রকৃতির লীলাখেলা উপভোগ করছে সেই সাথে বিরবির করে বলতে লাগলো,’আমি আসছি বেলী রাণী!খুব ভুগিয়েছো
আমাকে।এবার না হয় আমার জন্য তুমিও একটু ভুগবে।’
————————–
বেলী নিজের ঘরের টেবিলের সামনে বিদ্যমান কাঠের চেয়ার টায় বসে আছে।একপ্রকার মনমরা হয়েই আছে।কয়েকদিন পর তার কলেজে পরীক্ষা আছে।কয়েক সপ্তাহের মতো কেটে গিয়েছে।বেলীর পড়ায় কোনো মন বসছে না।ভেবেছিলো,সে চলে আসার পর বুরাগ তার খোঁজ নিবে।পরক্ষণেই তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে মনে মনে বলতে লাগলো,আমার কেনো খোঁজ নিতে যাবেন উনি!উনার মনে তো আমার কোনো অস্তিত্বই নেই।বেলীর কাছে তার জীবনটা খুবই কঠিন লাগছে।সাথে ভাগ্য টাকেও নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে।বুরাগকে ভালোবেসে একদম ভুল করে ফেলেছে সে!আর কিছু না ভেবেই তপ্ত একটা শ্বাস ফেলে পড়ায় মনোনিবেশ করলো।আর সিদ্ধান্ত নিলো নিজেকে যতোটা সম্ভব ঠিক রাখবে।

জাবেদা দিনদিন অনেকটাই চিন্তিত হয়ে পড়ছেন।কখনো ছোট মেয়ের আচরণে তো আবার কখনো বড় মেয়ের মতিগতি পর্যবেক্ষণ করে।জাবেদা ইদানীং লক্ষ্য করছেন বেলীকে।বেলীর মনমরা হয়ে বসে থাকাতে যেনো উনি আরো কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলেন।জাবেদা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন,কি হয়েছে তা বেলীর কাছে খোলসা করে জানবেন।উঠোন পেরিয়ে যখন ঘরের দিকে রওনা দিবেন তখনি বাড়ির রাস্তা টার পাশে করিমকে দেখে কিছুটা চমকে উঠলেন।করিমের সাহস দেখলে জাবেদা ভয় পেয়ে যান।তার উপর বুনির বিয়ের দিনের ঘটনা টার পর থেকেই উনি আরো ভয় পান করিমকে।জাবেদা খুব বিচক্ষণ মানুষ হলেও অপবাদ জিনিস টা উনার কাছে জমের মতো মনে হয়।অপবাদ জিনিস টা ঠিক নিতে পারেন না।তাও যদি এইগুলো উনার ফুটফুটে দুটোর মেয়ের নামে হয়।

করিম কিছুটা হিরো স্টাইলে এসে দাঁড়ালো জাবেদার সামনে।জাবেদাকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত কতক্ষণ চোখ দিয়ে দেখে নিলো।পরমুহূর্তেই লম্বা একটা সালাম জানালো।জোর গলায় বললো,

–“কেমন আছেন চাচি?বাড়ির সবাই ভালা নি।হুনলাম বেলী আইছে।”

জাবেদা যেটার ভয় পাচ্ছিলেন সেটাই হলো।করিমকে এই সময় উনাদের বাড়িতে দেখেই বুঝে নিয়েছেন বেলীর আসার সংবাদ করিমের কানে গিয়েছে।অবশ্য,এইটা তো আর লুকিয়ে রাখা যায় না।কারোর না কারোর মুখ থেকে তো জানবেই।কিন্তু তাই বলে যে একদম বাড়িতে চলে আসবে তা নিতান্তই ভাবনার বাহিরে ছিলো।জাবেদা শাড়ির আঁচল টা ভালো করে টেনেটুনে নিয়ে ঠিক করে নিলেন।করিমের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে জবাবে বললেন,

–“এইখানে কেন এসেছো তুমি।কি মনে করো তুমি নিজেকে?চেয়ারম্যানের ছেলে হয়েছো বলে যা খুশি তাই করবে,এইটা ভেবে থাকলে একদম ভুল ভেবেছো।চলে যাও এইখান থেকে।”

–“যাহ্ শালা!মা আর মাইয়া দুই জনেই আমারে ভুল বুঝে।ওইদিন যখন বেলীর ওড়না ধইরা টান দিলাম তহনও আপনার মাইয়া আমার লগে সাহস দেহাইলো।থাপ্পড় মাপ্পড় মাইরা ওড়না টাইনা লইয়া গেলো।এহন আপনার লগে একটু দেহা করতে আইলাম আর আপনেও এইরাম আচরণ করতাছেন চাচি।”

জাবেদা আঁতকে উঠলেন করিমের কথা শুনে।এমনকি খুব রাগও হলো উনার বেলী এই কথাটা সম্পূর্ণ লুকিয়ে গেছে তাই।উনি গরম চোখে করিমের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন,

–“এখনই বের হ এইখান থেকে।এই বাড়ির আশেপাশে যেনো তোকে আর না দেখি।”

জাবেদা তড়িঘড়ি করে ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন।জাবেদার যাওয়ার দিকে করিম কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে শিস বাজিয়ে জায়গায় পরিত্যাগ করলো।

জাবেদা ঘরে ঢুকেই বেলীকে জোর গলায় ডাকলেন।বেলী তখন টেবিলে বসে পড়ায় মনোনয়ন করতে ব্যস্ত।আম্মার জোর গলার আওয়াজ পেয়ে বেলী দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।দরজার কাছে যাওয়ার আগেই জাবেদা ঘরে ঢুকে দরজা টা একটু চাপিয়ে রাখলেন।বেলীকে কিছু বলতে না দিয়েই উনি বেলীর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে মারলেন,

–“করিম রাস্তায় তোর ওড়না ধরে কবে আটকিয়ে রেখেছিলো ছিলো রে?”

বেলী শুকনো একটা ঢোক গিললো।এই কথাটা ইচ্ছা করেই আম্মার থেকে এড়িয়ে গিয়েছিলো সে।আম্মাকে মূলত আর তার জন্য চিন্তায় রাখতে চায় না,তাই তো ওই দিনের রাস্তার ঘটনা টা চাপিয়ে গিয়েছে।কিন্তু আজকে আম্মার মুখে এমন একটা প্রশ্ন শুনে কিছুটা হকচকিয়ে গিয়েছে।জাবেদা বেলীর উত্তর না পেয়ে আবারও বলতে শুরু করলেন,

–“কি হলো বল?কবে তোর সাথে এমন করেছে করিম।তোকে তো তোর আব্বা দিয়ে আসেন আর নিয়ে আসেন।তাহলে করিম কীভাবে সুযোগ পেলো তোর ওড়না ধরার।”

বেলী অবাক চাহনি নিয়ে তাকালো আম্মার দিকে।আম্মার কথার মোড় অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছে।আম্মার কথায় রয়েছে সম্পূর্ণ সন্দেহ।নিজের একটা ভুলের জন্য এখন তাকে তার আম্মাও সন্দেহ করছে।ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো,

–“আম্মা তুমি আমাকে সন্দেহ করছো!”

জাবেদার বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো।রাগের মাথায় কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেলেছেন তা ভেবেই উনি এখন নিজেকেই বকাবকি শুরু করে দিয়েছেন।উনি তো বেলীকে কোনোমতেই সন্দেহ করতে পারেন না।বেলীর উপর সম্পূর্ণ ভরসা আছেন উনার।বেলীকে ধরে নিজের বুকে টেনে নিলেন।বেলীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে লাগলেন,

–“আমাকে ভুল বুঝিস না মা!আমি রাগের মাথায় এমন একটা কথা বলে ফেলবো তা একমুহূর্তের জন্যও ভাবিনি।তোকে আমি বিশ্বাস করি বেলী।আমার খুব ভয় হয় তোকে আর শিউলিকে নিয়ে।তোদের কিছু হলে আমি কিছুতেই ঠিক থাকতে পারবো না।”

বেলী আম্মার বুকে মাথা রেখে কেঁদে উঠলো।আম্মার কথার কর্ণপাত করেই আম্মার উপর থেকে অভিমান সরে গিয়েছে।কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

–“যেদিন আব্বা আমাকে বাড়ি নিয়ে আসে নি ওইদিনই করিম আমার সাথে এই আচরণ টা করে।ঝোপঝাড়ের সরু রাস্তাটা দিয়ে আমি আসছিলাম তার কিছুক্ষণ পরেই করিম আমার ওড়না টা টেনে ধরে।ওড়না টা ছাড়াতে নিতেই অনেক আজেবাজে কথা বলে যেগুলো আমার সহ্য হচ্ছিলো না তাই আমি থাপ্পড় মেরে দেই।”

জাবেদা বেলীকে আর একটু আগলে নিলেন।মুখটা তোলে কপালে একটা চুমু খেয়ে বললেন,

–“যা করেছিস একদম ঠিক করেছিস।ওর সাথে এটাই করা উচিত।তবে,যা হবে সব তুই আমাকে বলবি।যতোদিন তুই এইখানে আছিস ততদিন তুই কিছুতেই শান্তি পাবি না।তার উপর তুই ওকে থাপ্পড় মেরেছিস।তার ভিতরে তো আরো জ্বলতে শুরু করেছে।”

বেলী ভয় পেয়ে যায়।রাগের মাথায় থাপ্পড় মেরেছে ঠিকই কিন্তু এইসব ভাবনা একদমই ভুলে গিয়েছে।এখন তো করিম ওকে ছেড়ে কথা বলবে না।আবার যদি খারাপ কিছু করে ফেলে ওর সাথে।ভাবতেই বেলীর শরীরের ভাজে ঘামের রেখা জন্ম নিতে শুরু করলো।

শিউলি অনেক উশখুশ করছে।ঘরের জানালা দিয়ে করিমকে আম্মার সাথে কথা বলতে দেখেছে।কিন্তু,দূর থেকে তাদের কথোপকথনের আগামাথা কিছুই বুঝে নি।শিউলির খুব ইচ্ছা করছে আম্মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে করিমের সাথে কি কথা হয়েছে।কিন্তু সাহসে কুলিয়ে উঠছে না।কয়েকবার ঘর থেকে বের হয় তো আবার ঘরের ভিতর গিয়ে চুপ করে বিছানায় ঠেস দিয়ে বসে থাকে।অস্থির মন এতে কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না।তাই সাহস করে এগিয়েই গেলো উঠোনের দিকে।
উঠোনের পাশেই জাবেদা মাঠির চুলোয় ভাত বসিয়েছেন।বাড়ি আনন্দে গমগম করছে।বাড়িতে নতুন কোনো অতিথি আসলে তো গমগম করবেই।রেশমি দু’মাসের অন্তঃসত্ত্বা।কয়েকদিন ধরেই বমি হচ্ছিলো আর সেই সাথে মাথা ঘুরানি।কালকে সকালেই শহরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন রেহানা আর সুমনা।রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে।রেহানা তো আনন্দে আত্নহারা।দাদি হবেন উনি।কাল থেকেই রেশমির খেয়াল রাখা শুরু করে দিয়েছেন।উনাকে দেখলে মনেই হবে না উনি রেশমিকে দেখতে পারতেন না।তামিমও বাবা হওয়ার খবর শুনে আজকেই রওনা দিয়েছে বাড়ি আসার জন্য।সুমনা গিয়েছেন একটু বাপের বাড়ি।সবুজ থাকতে চেয়েছিলো কিন্তু সুমনা অনেক জোর করে নিয়ে গিয়েছেন।প্রায় অনেকদিন হলো বাপের বাড়ি যাচ্ছেন তাই সবুজকেও নিয়ে গেলেন।তাই সব কাজ জাবেদা একা হাতেই সামলাচ্ছেন।অবশ্য,এতে উনার কোনো সমস্যা নেই।

শিউলি গুটিগুটি পায়ে জাবেদার পাশে গিয়ে বনের আড়ালে থাকা পিঁড়িটা টেনে গিয়ে বসে পড়লো।সামনে আসা চুল গুলো কানের পিছনে গুজে নিয়ে আমতাআমতা করে বললো,

–“আম্মা একটা কথা বলি তোমাকে?”

জাবেদা চুলোতে লাকড়ি ঠেলে দিলেন।মাথাটা নিচু করে চুলোর আগুনটা দেখে নিলেন।শিউলির দিকে একবার তাকিয়ে পুনরায় চুলোতে মন বসালেন।কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

–“বল।অনুমতি নিচ্ছিস কেন।আমি শুনছি।”

–“আম্মা করিম ভাই কেনো এসেছিলো আমাদের বাড়িতে।না মানে হঠাৎ করেই আসলেন তো তাই আর কি।”

জাবেদা এতো কথা বাড়ালেন না।তবুও উনার মনে একটু খটকা লাগছে শিউলির কথা শুনে।তাও বাহিরে প্রকাশ না করে গম্ভীর গলায় বললেন,

–“তা তোর না জানলেও চলবে।ছোট আছিস ছোটর মতোই থাক।এইসব চিন্তা মাথায় না এনে পড়াশোনায় মন দে।”

শিউলি রাগে পিঁড়ি ছেড়ে উঠে পড়লো।ধপাধপ্ পায়ে উঠোন পেরিয়ে চলে গেলো।জাবেদা শিউলির যাওয়ার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন।শিউলির এইভাবে রেগে যাওয়া টায় কিছুতেই কোনো কিছু আঁচ করতে পারছেন না।
————————–
রাতের খাবার খেয়ে সবাই শুয়ে পড়েছে।বেলী নিজের ঘরে বসে বসে পড়ছে।জাবেদাও ঘরের সব কিছু দেখে নিচ্ছেন।দরজা,জানালার ছিটকিনি ঠিকভাবে লাগানো আছে কিনা তা দেখে নিলেন।এতোক্ষণ বেলীর কাছেই বসে ছিলেন।বেলীর পরীক্ষার সামনের দিনগুলি থেকে শেষ পর্যন্ত জাবেদা বেলীর সাথেই থাকেন।সব কিছু ঠিক রেখে আবারও বেলীর ঘরের দিকে রওনা দিবেন কিন্তু তার আগেই দরজার কড়া আঘাতের জন্য উনি কিছুটা ভয় পেয়ে যান।আচমকা এমন একটা ঠান্ডা পরিবেশে এইভাবে কড়া আঘাত টা যেনো প্রচন্ড ভয়ের হয়ে দাঁড়িয়েছে।বেলীর ঘর টা কোণার দিকে হওয়াতে বেলীর ঘর পর্যন্ত আওয়াজ টা পৌঁছায়নি।সিমেন্টের দেয়াল টায় টাঙানো পুরোনো ঘড়ি টার দিকে তাকিয়ে সময় টা দেখে নিলেন।এগারোটার উপরে বাজে।গ্রামে এই সময় টা মানে মাঝরাতের কাছাকাছি।দরজায় আবারও কড়া আঘাত হচ্ছে।জাবেদা এবার অনেকটাই ভয় পেয়ে পিছিয়ে যান।কপালে,নাকে মুখে ঘামের যেনো আস্তরণ তৈরি হচ্ছে।শাড়ির আঁচল টা দিয়ে ঘাম গুলো মুছে নিলেন।ঘরের লাইট টা জ্বালিয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন।কিছুটা সাহস টেনে বললেন,”কে এতো রাতে”।
দরজার অপাশ থেকে কারোর কন্ঠের আওয়াজ আসে নি তবে দরজার কড়া আঘাত শব্দ টা আবারও আসছে।হয়তোবা দরজার আওয়াজে জাবেদার গলা শুনতে পায় নি দরজার অপাশে থাকা ব্যক্তিটি।জাবেদা সাহস জুগিয়ে দরজাটা অর্ধেক খুললেন।দরজার হালকা ফাঁকা দিয়ে দরজার বাহিরে বুরাগকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা বিস্মিত হয়ে গেলেন।এতোরাতে বুরাগকে এইখানে একদমই আশা করেন নি।তাড়াতাড়ি করে দরজা খোলে দিলেন।
বুরাগ এতোক্ষণ খুবই বিরক্ত হচ্ছিলো।এক তো দরজা খুলতে দেরি হচ্ছিলো তার উপর মশার কামড়।ভেবেছিলো রাতে রওনা দিবে কিন্তু বেলীকে দেখার জন্য সন্ধ্যায় রওনা দিয়ে দিয়েছে।দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে সামনে শ্বাশুড়ি কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সালাম জানালো বুরাগ।
জাবেদা খুব লজ্জা পাচ্ছেন।উনি বুঝতে পেরেছেন এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকায় বুরাগকে মশা কামড়িয়েছে।দরজা থেকে দূরে সরে দাঁড়িয়ে বুরাগকে ভিতরে আসতে বললেন।

টানা কয়েক ঘন্টা বসে থাকতে থাকতে বেলীর কোমর ধরে গিয়েছে।তাই চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘর জুড়ে হাঁটতে লাগলো।হাত গুলো মোচড়ামুচড়ি করে ব্যথা সরানোর চেষ্টা করছে।দরজার ক্যাটক্যাট আওয়াজ পেয়ে বেলী তেমন একটা পাত্তা দিলো না।ভেবে নিয়েছে আম্মা এসেছে।

বুরাগ দরজা ঠেলে রুমে ঢুকেছে।বুরাগ ভেবেছিলো বেলী এখন ঘুমিয়ে আছে।সে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেলীকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়বে।এতোদিনের কষ্ট গুলো কমাবে বেলীকে কাছে পেয়ে।কিন্তু টেবিলের উপর বেলীর বই দেখে বুঝে নিয়েছে বেলী এখনো ঘুমায়নি।মুখটা কিছুটা গম্ভীর করে দরজা টা শব্দ করে লাগিয়ে দিলো।

দরজা লাগানোর শব্দে বেলী চট করে পিছনে ফিরে তাকালো।পিছনে ফিরে বুরাগকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো।বুরাগকে এখন এই সময় দেখবে তা কখনোই ভাবতে পারে নি বেলী।বুরাগের চোখের দিকে তাকালো।কেমন একটা গম্ভীর চোখ দেখে নিজেকে গুটিয়ে নিলো বেলী।

বুরাগ চেয়ার টা বেলীর দিকে ফিরিয়ে বসে পড়লো।জুতা,মোজা খুলছে আর বেলীর দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে।কালো একটা জামা পড়ে আছে বেলী।ফর্সা শরীর টাতে কালো জামাটা একদম ফুটে উঠেছে।বেলীকে সদ্য এক কালো গোলাপ মনে হচ্ছে বুরাগের কাছে।তার উপর আবার গলায় ওড়না নেই।বিছানার এক কোণায় পড়ে আছে।গোল গলা হওয়ায় বেলীকে যেনো আরো আকর্ষণীয় লাগছে।জুতা,মোজা খোলে ব্যাগ থেকে ট্রাউজার আর টি-শার্ট নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।যাওয়ার আগে রাগ দেখিয়ে নিজের ব্যাগ টা বিছানার উপর ঢিল মেরে রেখে গিয়েছে।

বেলী মুখ ভেঙচি মেরে বিছানার উপর থেকে ব্যাগ টা সরিয়ে আলমারির ভিতর রেখে দিলো।বিছানাটা গুছিয়ে দিয়ে টেবিলে বসে পড়লো।সামনে বই খোলে রেখেছে কিন্তু মন পড়ে আছে বুরাগের উপর।

বুরাগ কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে এসে লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়লো।বেলী মাথা ঘুরিয়ে পিছনে আহাম্মকের মতো তাকিয়ে আছে।অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।বাহির থেকে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ আসছে।বেলী উঠে গিয়ে এলোমেলো পায়ে লাইটের কাছে এগিয়ে গেলেই বুরাগ কঠিন গলায় বললো,

–“অনেক কষ্ট করে এসেছি একটু ঘুম দরকার।লাইট যেনো না জ্বালানো হয়।”

বেলী বিরবির করে বলতে লাগলো,’কে বা আসতে বলেছিলো।’

ঘর অন্ধকার হওয়ায় বেলী আস্তে পায়ে এগিয়ে গেলো বিছানার দিকে।বুরাগের দেখে একটু দূরত্ব রেখে শুয়ে পড়লো।
বুরাগ একপাশ হয়ে শুয়ে আছে আর বেলী অন্যপাশ হয়ে শুয়ে আছে।দুজনেই পিঠ মুখোমুখি করে রেখেছে।বুরাগ রাগে ফেটে যাচ্ছে।একটুও বেলীকে কাছে পাচ্ছে না।খুব উশখুশ করছে বেলীকে জড়িয়ে ধরার জন্য।কিন্তু,কেন জানি পারছে না।অনেকক্ষণ এইভাবে থাকার পর আর না পেরে ঘাড় ঘুরিয়ে বেলীর দিকে এগিয়ে গেলো।বেলীকে নিজের দিকে ফিরিয়ে জড়িয়ে ধরলো।বেলীর গলায় মুখ ডুবিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো।

এমন হওয়ায় বেলীর শরীর টা আপনাআপনি শক্ত হয়ে যায়।অনেকদিন পর বুরাগের স্পর্শ পেয়েছে।হুট করেই বুরাগের উপর অভিমান যেনো অনেক বেড়ে গিয়েছে তাই বেলী নিজেকে ছাড়ার জন্য অনেকটা নড়াচড়া করা শুরু করে দিলো।নিজেকে বুরাগের থেকে ছাড়ানোর জন্য অনেক চেষ্টা করছে।কিন্তু বারবার ব্যর্থ হচ্ছে।বুরাগ বেলীর নড়াচড়া দেখে মুখ টা তোলে কিছুটা ধমক দিয়ে বললো,

–“এইভাবে শুয়ে থাকবে একদম নড়চড় করবে না।যখন আমি আরেকটা বিয়ে করবো তখন তুমি মুক্তি পাবে।নতুন বউ আনার আগ পর্যন্ত ঠিক এইভাবেই আমার সাথে থাকবে।”

বেলী বুরাগের দিকে করুণ চোখে তাকালো।অন্ধকার হলেও আবছা আবছা আলো আসছে খোলা জানালা টা দিয়ে।এই আলোতেই দুজন দুজনের মুখ দেখতে সক্ষম।বুরাগ কিছুক্ষণ বেলীর চাহনিটার দিকে তাকিয়ে পুনরায় বেলীর গলার ভাজে মুখ গুজে দিলো।

বুরাগের কথা শুনেই বেলীর চোখ দুটো ভরে আসলো।বুরাগের মুখে দ্বিতীয় বিয়ে করার কথা শুনে বেলী নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না।গলা ছেড়ে কান্না করতে ইচ্ছা করছে।কিন্তু,বুরাগের সামনে কিছুতেই কান্না করতে পারছে না।ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা যাকে বলে বৃথা চেষ্টা।

বুরাগ চোখ দুটো বন্ধ করে রাখলেও বেলীর নাক টানার শব্দ টা ঠিকই শুনতে পাচ্ছে।মিটিমিটি হাসছে আর মনে মনে আওড়াচ্ছে,’কাঁদো বউ আমার একটু কাঁদো।আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছো তুমি।এবার তুমি একটু কষ্ট পাও।’

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here