উপন্যাস প্রপর্ণ, পর্ব-১২

0
3608

#উপন্যাস_প্রপর্ণ(১২)
#কুরআতুল_আয়েন

আনমনে শিউলি ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলো।ছুটির ঘন্টা দিয়েছে প্রায় মিনিট দশেক হবে।স্কুলে আসার আগে আম্মাকে কথা দিয়ে এসেছে এখন থেকে তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরবে।স্কুল ছুটি হওয়ার পর আর দেরি করবে না।এই শর্ত টা মেনেই শিউলি স্কুলে এসেছে।শিউলির ভিতরে জ্বলন থাকলেও কষ্ট করে হলেও আম্মার দেওয়া এই শর্ত টা মেনে নিয়েছে।না হলে তো করিমকে একপলকও দেখার সুযোগ মিলবে না।মিনিট দশেকের মধ্যেই মনে হয় স্কুল টা কেমন ফাঁকা হয়ে গিয়েছে।শিউলি সামনের মাঠটায় চোখ বুলিয়ে করিমের খোঁজ লাগালো।কিন্তু করিমের দেখা না পেয়ে মন গভীর রাতের মতো অন্ধকার ছেয়ে গেলো।অন্ধকার মন নিয়েই বাড়ির পথে হাঁটা ধরলো।শিউলির পা’দুটো মনে হয় চলছে না।তাও কষ্ট করে বাড়ির পথের দিকে কদমে কদমে অগ্রসর হচ্ছে।তবে,বিপত্তি বাজলো!স্কুলের মাঝারি সাইজের মাঠ টা পেরিয়ে যাওয়ার আগেই করিমের কন্ঠস্বর ভেসে আসলো।যা শুনে পিছনে ফিরতে বাধ্য হলো শিউলি।একরাশ চমকপ্রদের মতো শিউলি পিছনে ফিরে করিমকে স্কুলের লাস্টের দিকের দেয়ালটায় আবিষ্কার করলো।সেখানের চারপাশটা জঙ্গলে ভর্তি।এমনকি ক্লাস গুলো ভাঙাচোরা হওয়ায় সেদিকটায় ক্লাস করানো হয় না।করিমকে দেখে শিউলির কিশোরী মনটা যেনো আনন্দে নেচে উঠলো।যে মনে আছে করিমের জন্য এক সীমাহীন অনুভূতি।করিম ইশারায় শিউলিকে ডাকছে।করিমের ইশারা পেয়ে শিউলি এক দৌড়েই চলে গেলো তার ভালোবাসার মানুষটির কাছে।সবুজ আজকে স্কুলে না আসায় শিউলি যেনো আর একটু সাহস পেয়ে গেছে।মনে মনে ভেবে নিলো একটু দেরি হলে আম্মা তাকে কিছু বলবে না!আর যদিও কিছু বলে তাহলে বলে দিবে মেয়েরা তাকে জোর করে খেলায় নিয়েছে।সে অনেক না করেছিলো কিন্তু তারা তার কথা শোনে নি!

শিউলি করিমের কাছে যেতেই করিম শিউলি কে হেঁচকা টান দিয়ে স্কুলের দেয়াল টার সাথে চেপে ধরলো।শিউলি এমন একটা কাজের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।কতক্ষণ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো করিমের দিকে।সাথে বার কয়েক চোখের পলকও ফেললো।বুক তার অসম্ভব রকমের দুরুদুরু করে কাঁপছে।করিম কিছুক্ষণ শিউলির দিকে লালসাযুক্ত চাহনি নিয়ে তাকিয়ে রইলো।শিউলির অবস্থা দেখে করিম মুখে একটা কামুক হাসি টেনে শিউলির কোমর টা নিজের শক্ত হাত দুটো দিয়ে চেপে ধরলো।এতে যেনো শিউলির শরীরটা কিছুটা কেঁপে উঠলো।করিম নিজের মুখটা শিউলির গলার ভাজে ডুবিয়ে দিলো।সিগারেট খাওয়া কালচে পোড়া ঠোঁট দুটো শিউলির ফর্সা গলার ভাজ টার চারপাশে খুব অবাধ্য ভাবে বিচরণ করতে লাগলো।শিউলি এমন পুরুষালি স্পর্শ নতুন পেয়েছে।যার ফলে,এমন স্পর্শ টায় তার অনুভূতি গুলো ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।এক ভালোলাগাও কাজ করছে আবার খারাপ লাগাও কাজ করছে।তবে,নিজের থেকে করিমকে ছাড়তেও ইচ্ছা করছে না।করিম যেনো তার ঠোঁটের অবাধ্যতা আর একটু বাড়িয়ে দিলো,সেই সাথে তার শক্ত হাতের বিচরণও শুরু করলো শিউলির ছোট শরীরটায়।শিউলি আর না পেরে চোখ,মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো।কোমল,মসৃণ হাত দুটো দিয়ে করিমের রঙবেরঙের লিনেন শার্টের কলার টা চেপে ধরলো।শিউলির জাপটে ধরায় করিমের শরীরের কামনার তেজ যেনো আরো দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে।করিম তার মুখটা শিউলির গলার ভাজ থেকে সরিয়ে আনলো,শিউলির দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে নিলো।শিউলির কাঁপাকাঁপি ঠোঁট গুলো দেখে নিজেকে ঠিক রাখা করিমের জন্য খুব কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে।হুট করেই নিজের ঠোঁট দুটো শিউলির ঠোঁট ভাজে দিয়ে দিলো।শিউলি ছিঁটকে দূরে সরে যায়।হাত,পা তার জবাই করা মুরগির মতো থরথর করে কাঁপছে।

করিম খুব চটে যায় শিউলির আচরণে।শিউলির ছিটকে সরে যাওয়ায় মাথায় তার রাগ যেনো আগুনের ফুলকির মতো জ্বলে উঠতে শুরু করলো।চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে।শিউলি একবার সরু চোখে তাকালো করিমের দিকে।করিমের রক্তাক্ত চোখ দেখে ভয় পেয়ে গেলো।কিছুটা মিনমিনে গলায় বললো,

–“আমাকে এখন এই যেতে হবে করিম ভাই।আম্মা আমাকে সন্দেহ করে।আজকে কথা দিয়ে এসেছি এখন থেকে স্কুলের ছুটির ঘন্টা বাজার পর পরেই আমি বাড়ি চলে যাবো।এখন না গেলে আমাকে আর স্কুলে আসতে দিবে না।”

করিম নিজের রাগ টাকে যথাসম্ভব সংবরণ করে নিলো।শিউলির কথার উত্তরে মুখটাকে শক্ত করে বললো,

–“আইচ্ছা যাও।চাচি আবার অনেক চালাক।তোমারে আমি হারাতে চাই না।আর হুনো!এহন কয়েকদিন মন দিয়া পড়বা,চাচির কথামতোন চলবা।খুব ভালাভাবে থাকবা কয়েকদিন।চাচির মন থাইকা সন্দেহ টা দূরে রাহার চেষ্টা করবা।”

শিউলি মাথা দুলিয়ে দৌড়ে চলে গেলো।স্কুলের মাঠটা সে এক দৌড়েই পার করে ফেলেছে।পিছন ফিরে করিমের পানে তাকানোর সাহস তার নেই।অবশ্য,তার বেপরোয়া মনটা তো একবার চেয়েছিলো করিমকে দেখার জন্য কিন্তু লজ্জার কারণে তাকাতে পারে নি।শিউলি প্রতিদিনকার মতো মাটির রাস্তা টা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।তবে তার ভাবভঙ্গি আজ একটু আলাদা।চোখে,মুখে লজ্জার আভা ফুটে উঠেছে!সেই সাথে গাল দুটো টমেটোর মতো লাল হয়ে আছে।বারবার মনে হচ্ছে একটু আগের করিমের থেকে পাওয়া স্পর্শ গুলো যেনো সে স্বপ্নে পেয়েছে।পরক্ষণেই হাতে চিমটি কাটে শিউলি।মুচকি মুচকি হেসে বললো!উহুহু,স্বপ্ন নয় তো এইগুলো সত্যিই।শিউলি বিরবির করছে!’তার মানে!এটাই কি ভালোবাসার স্পর্শ।’

করিম স্কুলের উঁচু বারান্দার উপর লাফ দিয়ে উঠে বসলো।রঙবেরঙের লিনেনের শার্টের পকেট টা থেকে কাগজে মোড়ানো তিনটা সিগারেট বের করে নিলো।একটা ঠোঁটে চেপে ধরে দিয়াশলাই দিয়ে জ্বালিয়ে নিলো।শিউলির কথাগুলো মাথায় খেলছে তার।পরমুহূর্তেই মুখে পৈশাচিক হাসি টেনে বলতে লাগলো,

‘যা করার আমার খুব তাড়াতাড়িই করতে হইবো।না হলে চাচি আমার পথে বাঁধা হইয়া দাঁড়াইবো।শিউলি এহন আমার হাতে বন্দী।সুযোগ বুইজ্জা একদিন মনের বাসনা পূরণ কইরা ফেলমু।আহারে!চাচির লাইগা কষ্ট লাগতেছে।এক মাইয়ারে আমার থাইকা দূরে সরাইতে গিয়া আরেক মাইয়াই অনেক দূরে চইলা যাইবো।বেচারি শিউলি!মা’য়ের ভুলের শাস্তি পাইবো মাইয়াডা।’
————————–
ঘড়ির তিনবার টং টং টং আওয়াজে বুঝিয়ে দিলো মাঝরাতের নিস্তব্ধতা।রাত তিনটা বাজে বাহিরে তুমুল বৃষ্টি,সেই সাথে বাতাসের ঝাপটা।রুমের জানালার থাইগ্লাস টা খোলা।বাতাসের ঝাপটায় বৃষ্টির পানি গুলো ছিটকে গিয়ে বুরাগের রুমের ফ্লোরের মাঝখানটায় বিন্দু বিন্দু কণার মতো পড়ছে।রুমের আশেপাশের অনেক কিছুই বাতাসের তাড়নায় বৃষ্টির পানিগুলো ছুঁয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে।এইরকম একটা বৃষ্টিমুখরিত পরিবেশে বুরাগ জানালার গ্রিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।তার কোমর অবধি বৃষ্টির পানির ফোঁটায় ফোঁটায় ভর্তি।এতে বুরাগের কোনো হেলদোল নেই।ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।তবে শুধু দাঁড়িয়ে নেই,বেলীর ভাবনায় মত্ত হয়ে আছে।কিছুতেই বেলীকে ছাড়া থাকতে পারছে না।রুমে ঢুকলেই সে কিছু একটার অভাব অনুভব করতে পারে।বুরাগ বুঝে নিয়েছে সে বেলীতে বাঁধা পড়ে গিয়েছে।তার মন শুধু চুপিচুপি বেলীকে চায়।কিন্তু,এখন বেলীর অনুপস্থিতিতে তার একাকীর সঙ্গী হিসেবে আছে সিগারেট।সাইড বক্সের উপর বিদ্যমান সিগারেটের স্ট্যান্ড টাই বলে দিতে পারবে বুরাগের সিগারেট খাওয়ার রেশ।বুরাগ ভাবতে থাকে রায়ানের কথাগুলো।নিজেই নিজের মনকে প্রশ্ন করলো,সে কি আসলেই বেলীকে ভালোবাসে।কিন্তু,কোনো উত্তর আসে নি।বুরাগ দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে বিছানার উপর থেকে ফোন টা নিয়ে নিলো।কোনো কিছু না ভাবেই রায়ানের নাম্বারে ফোন দিলো।

রায়ান বিছানার মাঝখানে হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমিয়ে আছে।হা করে ঘুমানোর ফলে মুখ বেয়ে থুতু গড়িয়ে পড়ছে।এইটা রায়ানের একটা শারীরিক সমস্যা।রায়েনের মাউথ আলসার আছে যার ফলে মুখে থুতু বেড়ে যায়।এই কারণেই ঘুমানোর সময় তার মুখ থেকে লালা বা থুতু পড়ে।বাহিরে বৃষ্টির সাথে সাথে রায়ানের ঘুমটা যেনো আরো জেঁকে বসেছে।কিন্তু,ফোনের ভনভন আওয়াজে রায়ান ঘুমের মধ্যে নড়েচড়ে উঠলো।শরীর টা কিছুক্ষণ মোচড়ামুচড়ি করে আবারও ঘুমাতে শুরু করলো।কিন্তু ফোনের শব্দ তীব্র থেকে তীব্রতর হওয়ায় রায়ান বিরক্তি নিয়ে উঠে বসলো।হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে আলতো করে থুতু টা মুছে নিলো।ফোনের আওয়াজ পেয়ে বলতে লাগলো,

‘কোন বালে!আমারে এতো রাতে ফোন দিছে।’

ফোন টা হাতে নিয়ে বুরাগের নামটা দেখে কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলো।সিরিয়াস হয়ে ফোনটা রিসিভ করে কানে নিয়ে গড়গড় করে বলতে লাগলো,

–“বন্ধু!কোনো সমস্যা?এতো রাতে তুই আমারে ফোন দিলি।”
পুনরায় কিছুটা সন্দেহ গলায় বললো,
–“আচ্ছা এতো রাতে কি করোস তুই।ভাবি তো নাই।এখন তো তোর ভোস-ভোস করে ঘুমানোর কথা।”

বুরাগ রায়ানের কথা শুনে খেঁকিয়ে উঠলো,

–“মুখে লাগাম লাগা শালা!”

–“তুই উল্টা মাইন্ডে ধরোস কেন।আমি কিন্তু পজিটিভলি বলছি।”

–“তোর পজিটিভলি কথাবার্তার অবস্থা যদি এমন হয় তাহলে নেগেটিভলির কথাবার্তার মান-ইজ্জত সব শেষ হয়ে যাবে।সব লুটে নিবি তুই।”

রায়ান বড়সড় একটা হাই তুলে বললো,

–“আগে ক!এতো রাতে কেনো ফোন দিলি।তোর ঘুম নাই দেইখা কি আর মানুষ ঘুমাবে না।একদম মেইন পয়েন্টে ফোন দিয়ে দিলি শালা।বাহিরে বৃষ্টি আর এদিকে আমি কাঁথা মুড়িয়ে ঘুম আহহা্!কিন্তু,তুই একদম বারোটা বাজাই দিলি।”

বুরাগ জানালা গ্রিল ভেদ করে বাহিরের তুমুল বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে।এখনো আগের মতোই বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে।কমার যেনো নামেই নিচ্ছে না।

রায়ান ফোনের অপাশে বুরাগের কোনো আওয়াজ না পেয়ে বললো,

–“বন্ধু ঘুমাই গেছোস!ভালোই আমারে সজাগ করে দিয়ে নিজে ঘুম।”

বুরাগ গম্ভীর গলায় জবাব দিলো,

–“ঘুম আসছে না।”

রায়ান হাসতে হাসতে বললো,

–“তোরে এখন আমার কাছে মেয়ে লাগতাছে।মেয়েদের মতো বিষন্নতা নিয়ে বলছিস ঘুম আসছে না।বুঝছি ভাবিরে মিস করতাছোস।”

বুরাগ কিছুটা সিরিয়াস হয়ে বললো,

–“আচ্ছা রায়ান!মানুষের জীবনে কি দ্বিতীয় বার প্রেম হয়?প্রথম ভালোবাসা ভুলে গিয়ে আরেকজন কে ভালোবাসা যায়?”

–“জীবনে শুধু প্রথম প্রেমেই শেষ প্রেম হয় না।মানুষের জীবনে প্রেম শুধু একবার না দ্বিতীয় বারও আসে।প্রেম,ভালোবাসা এক ধরণের অনুভূতি।কিন্তু,প্রথম প্রেমের থেকে দ্বিতীয় বা শেষ প্রেমকে অনেকেই স্বার্থকতার পাতায় তুলে রেখেছে।কারণ,প্রথম প্রেমে যা খুঁজে পাওয়া যায় না তা দ্বিতীয় বা শেষ প্রেমে খুঁজে পাওয়া যায়।দ্বিতীয় বা শেষ প্রেম স্মৃতির লাস্ট পাতায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকে।সেখানে প্রথম প্রেমের সূচনা থাকলেও শেষের পাতায় কিন্তু দ্বিতীয় বা শেষ প্রেমেই জায়গা করে নেয়।”

বুরাগ কিছুটা হাসফাস করে বললো,

–“কিন্তু,স্নিগ্ধাকে আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না।ওর মুখের প্রতিচ্ছবি আমি আমার মন থেকে কিছুতেই মুছতে পারছি না।অন্যদিকে বেলীকে ছাড়া আমার ভিতর টা শূন্যতায় ভরপুর।”

রায়ান মুচকি হাসি টেনে বললো,

–“একটা প্রাণী বা পাখিকে লালিতপালিত করার পর তাকে ভুলা যায় না।মনের ভিতর জায়গা করে নেয়।আর সেখানে স্নিগ্ধা হলো একটা মানুষ।তোর কিশোর,যুবকের সঙ্গী,ভালোবাসা।তাকে তো ভুলা কিছুতেই সম্ভব না।তবে,স্নিগ্ধা তোর মনের বইয়ের সূচনাতে থাকলেও শেষ পাতায় তার কোনো অস্তিত্ব নেই।শেষ পাতা জুড়ে শুধু ভাবি আছে।সূচনা যেমনেই হোক না কেন সমাপ্তি মানুষের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।”

বুরাগ রায়ানের কথা সম্পূর্ণ কর্ণপাত করেই ফোনটা কেটে দিলো।বুকে হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিটাকে উপভোগ করতে লাগলো আর সেই সাথে তার মনের শেষ পাতার অস্তিত্ব বেলীকে অনুভব করতে লাগলো।

বুরাগের ফোন এইভাবে কেটে দেওয়ায় রায়ান কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়।ফোনটা বালিশের নিচে রেখে বিরবির করতে লাগলো,

‘হুট করে মাঝরাতে ফোন দিলো আবার হুট করে কথা শেষ হওয়ার আগে কেটে দিলো।সবই একদম আচমকা আচমকা!’
————————–
ভরদুপুরের কড়া রোদ।সূর্যের তাপ টা বেলীর মাথার মাঝ বরাবর এসে পড়ছে।কলেজ থেকে বাড়ির পথে ফিরছে।সকালে আব্বার সাথে সাইকেলে করে গিয়েছে।একটা কাজ পড়ে যাওয়ায় আব্বা তাকে নিতে আসে নি।হেঁটে হেঁটেই বাড়ি ফিরছে।গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে যতোটা সম্ভব খুব দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে বেলী।সামনেই একটা ঝোপঝাড় পড়ে।তার কয়েক কদম পার হলেই তাদের বাড়ি।এই ঝোপঝাড় টাকে বেলীর কাছে এক অন্ধকার গুহা মনে হয়।চারপাশের ঝোপঝাড় গুলো রাস্তাটাকে কেমন সরু করে রেখেছে।যার ফলে,আরো ভয়ংকর লাগে বেলীর কাছে।রাস্তাটার সামনে এসে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে নিলো বেলী।চারপাশ জনমানবশূন্য।দুপুরের দিকটা এই জায়গা টা নির্জন নির্জলা হয়ে থাকে।বুকে থুতু দিয়ে বেলী সাহস করে এগিয়ে গেলো।একপ্রকার দৌড়েই হাঁটছে সে।কিন্তু,রাস্তাটা যেনো শেষ হবার নয়।কিছুটা আগাতেই বেলীর ওড়নাতে টান পড়লো।এমন হওয়ায় বেলী ভয়ে জমে গিয়েছে।তার উপর ঝোপঝাড়ের পাশে রাস্তাটায় শুকনো পাতাগুলো মচমচে শব্দ করে উঠছে।পাতার মচমচে শব্দ টাই বলে দিয়েছে এইখানে কারোর উপস্থিতি আছে।বেলী ভয়ে পিছনে ফিরে তাকালো।পিছনে নিজের কলাপাতা রঙের ওড়না টার কোণা করিমের হাতে ধরা রাখা অবস্থায় দেখে বেলীর বুকটা অজানা এক ভয়ে ভর করে উঠলো।বেলীর হাত পা অসাড় হয়ে আসছে।শরীরের শিরা উপশিরায় যেনো রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

করিম শিস বাজাতে বাজাতে বেলীর ওড়না টা হাতে নিয়েই এগিয়ে গেলো।করিম বেলীর দিকে কিছুক্ষণ নিষ্পলক চাহনি নিয়ে তাকিয়ে রইলো।করিমের সে পলকে আছে বেলীর জন্য এক আকাশ সমান ভালোবাসা।

বেলীর শুধু ভয় হচ্ছে এই নির্জলা এক পরিবেশে করিম যদি তার সাথে খারাপ কিছু করে ফেলে।যে ছেলে বাড়ির সবার অগোচরে গোসলখানায় মুখ দিতে পারে তার জন্য এই জায়গা টা তো বেশ সুবিধারই একটা জয়গা।বেলী ওড়নাটা টান মেরে নিতে গিয়েও বাঁধা খেলো।করিম যেনো তার হাতের সর্বশক্তি দিয়ে ওড়নাকে চেপে ধরে আছে।বেলী কিছুটা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

–“আমার ওড়নাটা ছাড়ুন।আমাকে যেতে দিন।অসভ্যতামি করবেন না একদম আমার সাথে।”

করিম ওড়নাটা আরো একটু শক্ত করে ধরে নিলো।বেলীর আর একটু কাছে গিয়ে বললো,

–“অসভ্যতামি করতাছি না তো শুধু তোমারে একটু দেখতে চাইতাছি।”

বেলী দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

–“এইটা অসভ্যতামি না তাই তো!এমন একটা নির্জন জায়গায় একটা মেয়ের ওড়না ধরে রেখেছেন সেটা আপনার কাছে অসভ্যতামি না?আপনার কাছে সেইটা আম-দুধ হলেও,আমার কাছে এইটা সম্মানের ব্যাপার।আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে একটু বুঝার চেষ্টা করুন।এখন যদি এইভাবে আমাকে আর আপনাকে কেউ দেখে তাহলে আমার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।আমার ওড়না টা ছাড়ুন।”

বেলী ওড়না টা টানাটানি করছে।নিজের শরীরের জোর দিয়ে ওড়না টা টানছে।বেলীর এমন টানাটানি দেখে করিম রেগে যায়।রেগে গিয়ে বেলীর হাতটা জোরে চেপে ধরে বললো,

–“তোর শরীর চাইছি আমি?তোরে একটু দেখতে চাইছিলাম।এতেই এতো টানাটানি করতাছোস।আর,যদি এই ঝোপঝাড়ে নিয়ে তোর শরীর নিয়ে খেলতাম তাহলে বা কি করতি।”

বেলী সারা শরীর ঘিনঘিন করছে।করিমের কথা শেষ হতেই বেলী সাহস করে করিমের গালে সটান করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো।হাত টা ছাড়িয়ে ওড়না টা টান মেরে নিয়ে নিলো।চোখে তার পানি টলমল করছে।ভাঙা ভাঙা গলায় বললো,

–“তুই একটা জানোয়ার।এমনকি জানোয়ারের থেকেও খারাপ।”

বেলী ওড়নাটা মুঠো করে ধরে দৌড়ে চলে গেলো।চোখের কার্ণিশে পানি বাঁধা মানছে না।

করিম নিষ্পলক চেয়ে আছে বেলীর যাওয়ার দিকে।মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে মনে মনে ভাবতে লাগলো,

–“তোমার এই থাপ্পড় ডা আমি ভালোবাসার স্পর্শই ভাইবা নিলাম।তবে,তোমার এই থাপ্পড় ডার জন্য শিউলির অবস্থা আরো করুণ হইয়া যাইবো।তোমার আর তোমার আম্মার এক একটা ভুলের জন্য শিউলির অবস্থা আরো করুণের দিকে যাইতাছে।ভাবছিলাম শিউলিরে বাঁচাইয়া রাখমু এখন মন আমার উল্টাই গেছে।শিউলিরে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব এই দুনিয়া থাইকা পগারপার কইরা দিমু।এতে অত্যন্ত তোমার আর তোমার আম্মার তেজ একটু কমবো।”

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here