উপন্যাস প্রপর্ণ, পর্ব-১১

0
3762

#উপন্যাস_প্রপর্ণ(১১)
#কুরআতুল_আয়েন

চারদিকে বিস্তৃত মাঠ।সামনের দূরের গাছপালা গুলোকে শিউলির কাছে সবুজ দ্বীপের মতোন লাগছে।শিউলি এককোণায় বসে আছে।অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে করিমের জন্য কিন্তু করিমের এখনো কোনো দেখা মেলেনি।স্কুল অনেকক্ষণ আগেই ছুটি হয়ে গিয়েছে।খেলার কথা বলে শিউলি সবুজকে অনেকটা ইনিয়েবিনিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে।সবুজও আজকে নাছোড়বান্দার মতো আচরণ করেছে।বাড়ি গেলে সে শিউলির সাথেই যাবে নয়তো একা যাবে না।শিউলি সবুজের নাছোড়বান্দা ব্যবহার দেখেই বুঝে নিয়েছে এইসব আম্মার কাজ।আম্মায় তাকে চোখে চোখে রাখার জন্য সবুজকে বলে দিয়েছে।আম্মা যে তাকে সন্দেহ করছে তা শিউলির জানা।কিন্তু,শিউলিই বা কি করবে সে তো করিমের সাথে সময় না কাটিয়ে একমুহূর্তও থাকতে পারে না।দিন দিন যেনো করিমের প্রতি আরো আসক্তি হয়ে পড়ছে।যা কাটিয়ে উঠা খুবই দুষ্কর।শিউলির ছোট মনটা করিমের ভালোবাসার দহনে অনেক আগেই পুড়েছে।শিউলির ভালোবাসার বাতায়নে সবসময় করিমের মুখটাই ভেসে উঠে।কিন্তু শিউলি এখনো সেই মানুষটির দেখা পাচ্ছে না।এইরকম দেরি কখনো করে না করিম।এমনকি অন্যদিন শিউলি আসার আগেই করিম এসে বসে থাকে।আর,আজকে ঠিক তার উল্টো টা হচ্ছে।শিউলির হৃদয়ের মনের গহীনে অভিমানের রেশ জমা হচ্ছে।দু’চোখ ভরে পানি বন্যা হয়ে আসছে।কিছুই তার ভালো লাগছে না।থুঁতনিটা হাঁটুর উপর ভর করে রেখেছে আর সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।তার কিছুটা সামনেই দুই তিনটা গরু আপনমনে ঘাস খেয়ে যাচ্ছে।সুন্দর একটা মনোমুগ্ধকর পরিবেশ বিরাজ করছে চারপাশে।গাছপালা,লতাপাতা,ধানক্ষেত পেরিয়ে আসা মৃদু বাতাস টা শিউলির মনকে উতলা করে তুলছে।এমন একটা পরিবেশে শিউলি তার পাশে করিমের উপস্থিতি চাচ্ছে।অনেকক্ষণ বসে থাকার পর করিমের দেখা না পেয়ে শিউলি উঠে পড়লো।মাঠ পেরিয়ে রাস্তায় আসতেই সামনের দিকে করিমকে আসতে দেখে পুনরায় আগের জায়গায় এসে চুপটি করে বসে পড়লো।মনে মনে ভেবে নিয়েছে শিউলি কোনোমতেই করিমের সাথে কথা বলবে না।বরং,করিমকে দেখে শিউলির অভিমান টা যেনো দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে।

করিম খুব দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে।মাঠের কোণার দিকটায় শিউলিকে বসে থাকতে দেখে করিমের ভিতর থেকে তপ্ত একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।আস্তে পায়ে এগিয়ে গিয়ে শিউলির শরীর ঘেঁষে বসে পড়লো।শিউলির মধ্যে কোনো ভাবান্তর এলো না।আগেয় ন্যায় চুপটি করে বসে আছে।করিম শিউলির মুখপানে চেয়ে কিছুটা নিম্ন গলায় বললো,

–“আমার আইতে দেরি হইছে দেইখা তুমি মন খারাপ কইরা বইসা আছো শিউলি ফুল!”

শিউলি করিমের কথায় কোনো প্রত্যুত্তর করলো না।মাঠের ঘাসগুলো একটা একটা করে ছিড়ে পাশে রাখছে।কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না মৃদু বাতাস টায় ঘাসগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ে যাচ্ছে।ঘাসের উড়ে যাওয়া দেখে শিউলি বিরবির করে বলতে লাগলো,মৃদু বাতাসের তেজ আছে বলতে হবে।

–“কি গো!কথা কইবা না আমার সাথে।”

শিউলি তাও কিছু বলে না।করিমের কথার উত্তর না দিলেও তার কথা গুলো ঠিকই কর্ণপাত করছে।শিউলির মতিগতি পর্যবেক্ষণ করে করিমের চোখ দুটো কুঁচকে গিয়েছে সেই সাথে চোয়াল ও শক্ত হয়ে গিয়েছে।শিউলির খাপছাড়া স্বভাব টা করিমের কাছে অসম্ভব রকমের বিরক্তি লাগছে।তাও,নিজেকে যতোটা সম্ভব ঠিক করে নিয়ে আবারও বললো,

–“হুনলাম বেলী আইছে নাকি।তোমগোর পাশের বাড়ি রোকসানা আছে না হের কাছ থাইকা হুনছি।এইডাও হুনছি বেলী নাকি আগের তে আরো সুন্দর হইয়া গেছে।অবশ্য,বেলী তো আগের থাইকা পরীর লাহান সুন্দর ছিলো।”

শিউলি মাথা নিচু করেই করিমকে উদ্দেশ্য করে বললো,

–“এইজন্য কি আপনার আসতে এতো দেরি হয়েছে।”

–“হ!রাস্তার সামনে রোকসানার লগে দেহা হইলো পরে হুনলাম বেলী আইছে।তার পরে আরকি টুকটাক কথা হইলো।”

শিউলি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।তার ছোট মনটায় করিমের এই কথাগুলোই যথেষ্ট কষ্টের ছন্দে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।শিউলি উঠে দাঁড়াতেই করিম ভ্রু কুঁচকে শিউলির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।শিউলি বহু কষ্টে কান্নাটাকে দমিয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় বললো,

–“জানেন করিম ভাই!ভালোবাসার মানুষটার মুখে অন্যকারোর নাম শুনলে সেটা সহ্য করা খুব কষ্টের হয়ে যায়।পৃথিবীর সব কষ্টে যেমন কাঁদা যায় না তেমনি সব সুখেও হাসা যায় না।আপনার মুখে অন্যকারোর নাম শুনে আমার হৃদয়ে আগুন না জ্বললেও ঠিকই পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।কারণ,ভালোবাসার কষ্ট টা এমনই।যে কষ্টে আগুন জ্বলবে না ঠিকই কিন্তু পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।”

শিউলি আর দাঁড়ায় না।করিমের দিকে একপলক তাকিয়ে দৌড়ে জায়গা ত্যাগ করলো।মাঠির আঁকাবাঁকা রাস্তাটা দিয়ে বাড়ির পথে এগিয়ে যাচ্ছে।চোখের পানি গুলো এখন বাঁধা মানছে না।করিমের সামনে দমিয়ে রাখলেও এখন কিছুতে দমানো যাচ্ছে না।শিউলির কাছে বেলীকে এখন খুব অসহ্য লাগছে।করিম তো বেলীর জন্য খুব পাগল ছিলো।এমনকি করিম প্রায় সময় বেলীকে একপলক দেখার জন্য হলেও তাদের বাড়ি এসে বসে থাকতো।তার উপর বিয়ে করার জন্য অনেকবারও তার আম্মার কাছে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছে।শিউলি এলোমেলো পায়ে হাঁটছে আর ক্রন্দনরত গলায় বিরবির করছে,’কেনো এলে তুমি আপা!তোমাকে তো আমার কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না।’

করিম শিউলির কথাগুলো মিনিট দশেক সময় নিয়ে ভাবলো।আজকে করিমের কাছে শিউলিকে খুব বড় লাগছে।মনে হচ্ছে মেয়েটা কিশোরী থেকে একমুহূর্তের মধ্যেই যুবতী হয়ে গিয়েছে।পরমুহূর্তেই মাঠের ঘাসের উপর হাত ভাজ করে শুয়ে পড়লো।মাথার উপর বিশাল বড় রেন্ডিকড়ই গাছটার পাতাগুলোর ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো।মুখে একটা বিষাদ ময় হাসি টেনে বলতে লাগলো,

–“ঠিকই কইছো শিউলি ভালোবাসার মানুষটার মুখে যেমন অন্যকারোর নাম হুনলে কষ্ট হয় তার থেকে বেশি কষ্ট হয় সেই মানুষটা যদি অন্য কারোর লগে ঘর বাঁধে।যহন মনে পড়ে বেলী অন্যকারোর তহন,আমারও তো ভিতর টা পুইড়া ছাই হইয়া যায়।”
————————–
বড় বারান্দার পাশেই মাঝারি সাইজের একটা চৌকি রাখা।চৌকি টায় খুব আয়েসি ভঙিমা করে আমেনা বেগম বসে আছেন।মুখে দুটো পান একসাথে নিয়ে চিবাচ্ছেন।আমেনা বেগমের পাশে বসা বেলী খুব যত্ন সহকারে পান তৈরি করছে।সুপারি,চুন,জর্দা সব কিছু ঠিকঠাক দিয়ে দাদির জন্য এই নিয়ে ছয় নাম্বার পান বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।আমেনা বেগম পান চিবানোর পর তেতো পানের ফিক টা চৌকির কিছুটা সামনেই ফেলে দেন।আমেনা বেগমের কাছে বেলীর তৈরি করা পান টা খুব মনে ধরে।লম্বা বারান্দার আরেক কোণায় জাবেদা বসে সবজি কুটছেন।তার পাশেই রান্নাঘর।রান্নাঘরে রেহানা আর সুমনা রাতের খাবারের তোরজোর করে রাখছেন।জাবেদা সবজি কুটলেও উনি খুব চিন্তায় আছেন।সবুজের থেকে যখন শুনেছেন শিউলি আরো পরে আসবে তখনই উনি ভেবে নিয়েছেন আজকে শিউলিকে অনেক কড়া কথা শুনাবেন।মেয়েদের সাথে জাবেদা এতো কঠিন হতে চান না।তবে শিউলির মতিগতি উনার কাছে অনেক আগে থেকেই সুবিধার মনে হচ্ছে না।অবশ্য,শিউলির কিশোরীর বয়সটাকেও দোষ দেন জাবেদা।এই বয়সে তো অনেক কিছুই হয়ে থাকে।এমনকি,পতনের মূলও হলো এই কিশোরী বয়স টা।

বাড়ির ভিতরে ঢুকে বারান্দার চৌকিতে বসা বেলীকে দেখে শিউলির খুব রাগ হয়।ধপাধপ্ পায়ে এগিয়ে গেলো বাড়ির দরজার সামনে।জাবেদা দূর থেকে শিউলির দিকে কতক্ষণ সরু চোখে তাকিয়ে পরোক্ষ করে নিলেন।শিউলি দরজা দিয়ে ভেদ করে ঘরে ঢুকতে নিলেই বেলী পান তৈরি করতে করতে বললো,

–“এতো দেরি করে আসলি কেন শিউলি?স্কুল তো এতো দেরিতে ছুটি হয় না তোদের।সবুজ তো কখন চলে এসেছে।”

এমনেতেই শিউলির মনে আগুন জ্বলে ছিলো।বেলীর কথায় যেনো শিউলির মনে আগুন টা আরো দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো,কিছুটা চেঁচিয়ে বললো,

–“তাতে তোমার কি আপা!আমার যখন মন চায় আমি তখন আসবো।পারলে আমি বাড়িই আসবো না।বাহিরে রাত কাটাবো।তোমার কোনো সমস্যা আছে এতে।শুধু তুমি আমার ব্যাপারে কোনো কথা বলতে আসবে না আপা।”

বেলী আহাম্মকের মতো তাকিয়ে আছে শিউলির দিকে।কতক্ষণ অবাক চোখে শিউলির আপাতমস্তক পর্যবেক্ষণ করে নিলো।বোনটা কে চিনতে তার খুব কষ্ট হচ্ছে।যে বোনটা তার জন্য এতো পাগল ছিলো আজকে তাকেই এমন অযৌক্তিক কথা শোনাচ্ছে।বেলী শিউলিকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই শিউলির দু’গালে জাবেদা চড় বসিয়ে দিলেন।শিউলি ছলছল চোখে তাকালো আম্মার দিকে।জাবেদার শরীর রাগে কাঁপছে।বেলী বিস্ময় নিয়ে তাকালো আম্মার দিকে।আম্মাকে এইরকম রাগতে দেখে অনেকটাই হকচকিয়ে গিয়েছে সে।বেলী তার আম্মাকে এমন রাগতে কখনো দেখে নি।সবসময় চুপচাপ থাকতেন।অবশ্য,কথায় আছে চুপচাপ মানুষেরা রাগলে তাদেরকে খুব ভয়ংকর লাগে।ঠিক এমনই লাগছে বেলীর কাছে তার আম্মাকে।

জাবেদা কিছুটা মিহি গলায় চেঁচিয়ে বললেন,

–“দিন দিন এতো অবাধ্য হয়ে যাচ্ছিস তুই,বড়দের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় জানিস না।এতো অবাধ্য হবি জানলে জন্মের পরেই তোর গলা টিপে মেরে ফেলতাম।পড়াশোনা শিখে এমন আচরণ শিখেছিস তুই!দরকার নেই তোর পড়াশোনার করার।আর কি বললি তুই বাহিরে রাত কাটাবি!বাহিরে রাত কাটানোর অর্থ বুছিস তো!পড়াশোনা করে যদি বাহিরে রাত কাটানো শিখিস তাহলে সেই পড়াশোনা করার কোনো মানেই হয় না।কাল থেকে তোর স্কুল যাওয়া বন্ধ।বাড়িতে বসে বসে আমার সাথে কাজ করবি।”

শিউলির বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো।স্কুলেই তো তার একমাত্র সম্বল করিমের সাথে দেখা করার।আর সেই রাস্তাটা যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে তো তার টিকে থাকতে কষ্ট হবে।কান্নারত গলায় আম্মাকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই জাবেদা শিউলির দিকে গরম চোখে তাকালেন।তা দেখে শিউলি আর কিছু বলার সাহস পায় নি।কান্না করতে করতে চলে যায় ভিতরে।শিউলি চলে যেতেই আমেনা বেগম দাঁতের চিপায় পান রেখে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগলেন,

–“তোমার সাহস তো কম না ছোড বউ।আমার নাতনীডারে এমনে কইলা।ছোড মানুষ কি থাইকা কি কইয়া ফেলছে এর লাইগা এমন মাইর ধরাইবা। আইজকা আমার ছোড পোলা বাড়িত আসুক তারপর তোমার খবর আছে।”

জাবেদা শ্বাশুড়ির কথা মনোযোগ সহকারে কর্ণপাত করছেন,সেই সাথে পুনরায় পিঁড়িত বসে সবজি কুটায় মনোযোগ দিলেন।বেলী কেমন একটা রবোটের মতো বসে আছে।তার মনে শুধু একটা কথাই আওড়াচ্ছে,সে চলে যাওয়ার পর সবকিছু এতো পাল্টে গেলো!এমনকি শিউলিও!
————————–
ব্রিজের কার্ণিশের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বুরাগ আর রায়ান।কিছুটা সামনেই বুরাগের গাড়িটা দাঁড় করানো।মৃদু মৃদু ভাবে গাড়ির লাইটের আলোটা জ্বলছে আর নিভছে।সাথে ল্যাম্পপোস্টের হালকা আলো।আকাশে মাঝেমধ্যে মেঘেরা গর্জন করে উঠছে।মনে হচ্ছে যেকোনো সময় ঝুম বৃষ্টি নামতে পারে।রায়ান কিছুটা অসহায় গলায় বললো,

–“আমি যদি তখন তোর উপর ঝাঁপিয়ে না পড়তাম তাহলে আজকে ভাবি এইসব কথা শুনে কষ্ট পেতো না।এমনকি বাসা ছেড়ে চলেও যেতো না।আমার কেমন জানি একটা গিলটি ফিল হচ্ছে।আচ্ছা বুরাগ তুই কি সিউর ভাবি ইচ্ছা করে চলে গিয়েছে!না মানে,একটু আগেই তো তুই বললি পরীক্ষা দিয়ে গিয়েছে।”

বুরাগ রায়ানের কথায় কোনো উত্তর দিলো না।চুপ করে ব্রিজের পানিটার দিকে তাকিয়ে আছে।নিচে অন্ধকার থাকায় ব্রিজের পানির গভীরতা কতটুকু হবে তা বুঝতে পারছে না।তবে পাড়ে নৌকা গুলো থেকে ভেসে আসা হারিকেনের আলোগুলো দূর থেকে তারার মতো লাগছে।রায়ান বুরাগের মুখের দিকে চেয়ে আছে উত্তরের আশায়।বুরাগ চোখ ফিরিয়ে রায়ানের দিকে শান্ত চোখে তাকালো।গম্ভীর গলায় বললো,

–“ইচ্ছা করেই চলে গিয়েছে ও।পরীক্ষা শুধু একটা বাহানা।”

রায়ান মাথা নাড়িয়ে বললো,

–“বুঝলাম!তোর কি কষ্ট হচ্ছে নাকি?”

বুরাগ তেড়ে এসে রায়ানের গলা চেপে ধরলো।এতে রায়ান কিছুটা পিছিয়ে গেলো।বুরাগ দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

–“কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে আসছোস শালারপুত।অসহ্য কষ্ট আর যন্ত্রণার মধ্যে তুই আবার তিরস্কার করতে আসছোস।তোর মতো বন্ধু থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো।”

রায়ান আকুতিভরা গলায় বললো,

–“বাপ!ছাড় আমার গলা।মইরা যামু তো।ভাবির দুঃখে তুই তো আমারে মাইরা ফেলবি।”

বুরাগ কিছুক্ষণ কটমট চোখে তাকিয়ে রইলো রায়ানের দিকে।পরক্ষণেই ছেড়ে দিয়ে আগের ন্যায় ব্রিজের কার্ণিশের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো।

বুরাগ ছাড়তেই রায়ান নিজেকে ঠিক করে নিলো।বুরাগের দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে বললো,

–“বাহ্!ভালোই ভাবির জন্য তাহলে কষ্ট হচ্ছে তোর।এইটা ভালোবাসার পূর্বলক্ষণ।”

–“জানি না তবে ভিতর টা খুব শূন্য শূন্য লাগছে।বাসায় গিয়ে একদন্ডও শান্তি পাই না।শুধু বেলীকে অনুভব করি।”

–“তোহ!নিয়ে আয় ভাবিকে তোর কাছে।”

বুরাগ কিছুটা অভিমানিনী গলায় বললো,

–“নাহ্!আমি কিছুতেই আনতে যাবো না।দেখি কতদিন থাকতে পারে।আমাকে কিছু না বলেই চলে গেলো।রাগ,অভিমান কি শুধু তারই আছে আমার নেই।অনেক বড় ভুল করে ফেলেছে বেলী।

রায়ান বুরাগের বাচ্চামো দেখে হেসে ফেললো।পরমুহূর্তেই হাসি টা থামিয়ে বুরাগের কাছে এগিয়ে গেলো।বুরাগের পাশে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো,

–“যাকে আপন ভাবা যায়,ভালোবাসা যায় ঠিক তার উপরেই অভিমান করা যায়।আর একটা কথা কি জানিস রাগ,অভিমানের পাশে ক্ষমা করাটাও শিখতে হয় তাহলে তো সম্পর্ক গুলো আরো সুন্দর ভাবে টিকে থাকে।ভাঙন ধরার কোনো সুযোগেই আসে না।ঠিক তেমনেই!তুইও ভাবিকে ক্ষমা করে দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আয়।মানলাম ভাবি তোর সাথে কথা না বলে,তোর মনের সম্পূর্ণ কথা গুলো শোনার আগেই চলে গিয়েছে।এইটা ভাবির ভুল হয়েছে ঠিক কিন্তু,তুই যদি ভাবিকে ক্ষমা করে আবার কাছে নিয়ে আসিস তাহলে তোদের মান-অভিমানের পাল্লা শেষ হয়ে যাবে খুব দ্রুত।না হলে সম্পর্কের ফাটল গুলো তীব্র থেকে তীব্রতর হবে।তবে আর একটা কথা বলছি তোকে বুরাগ!তুই ভাবিকে ভালোবাসিস কিন্তু সেটা তুই নিজেও বুঝতে পারছিস না।হয়তোবা তোর সেই অনুভূতি গুলো কোনো কিছুর নিচে চাপা পড়ে গিয়েছে।”

বুরাগ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে রায়ানের দিকে।রায়ান বুরাগের তাকানো দেখে মুখে একটা মিষ্টি হাসি টেনে বললো,

–“হ্যাঁ বন্ধু!তুমি ভাবিরে ভালোবাসো।ভালোবাসো বলেই তো ছটফট করছো।ভালোবাসার চিপায় পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছো।”

বুরাগ শুধু মুচকি হাসলো।আর,চোখের সামনের বেলীর চেহারাটা মনে করতে লাগলো।
————————–
দক্ষিণের জানালাটার দিকটায় চুল গুলো খুলে দাঁড়িয়ে আছে বেলী।বুরাগের প্রতিচ্ছবি টা নিজের মনের ক্যানভাসে বার বার আঁকার চেষ্টা করছে।এইখানে এসে বুরাগের অনুপস্থিতি তাকে আরো কষ্ট বাড়িয়ে দিচ্ছে।বেলীর নিজেকে এই পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় প্রাণী লাগছে।নিজের রাগ,অভিমান গুলো কাউকে দেখাতে পাচ্ছে না,দুঃখবিলাস করার জন্য কাউকে পাচ্ছে না।এমনকি চিৎকার করে কাঁদতে গিয়েও বাঁধা খাচ্ছে।শুধু মৃদু হাসির আড়ালে চোখের পানি গুলো লুকিয়ে রেখেছে।বেলীর কাছে ভালোবাসা মানে!কচুপাতার উপর পড়া বৃষ্টির ফোঁটার মতো।যত্ন বা আগলে না রাখলে ঠিকই গড়িয়ে পড়ে যায়।বেলী বিরবির করে বলতে লাগলো,
‘সময়ের সাথে অভিমান,কষ্ট গুলো ঠিকই কমে যাবে কিন্তু আঘাত গুলো একদম সুপার গ্লুর মতো লেগে থাকবে।’

শিউলির ভিতরটায় খুব অস্থিরতা কাজ করছে।কালকে স্কুলে যেতে পারবে কি পারবে না তা নিয়েই একদফা চোখের পানি বিসর্জন দিয়েছে।তবে,তাকে যেকোনো মূল্যেই স্কুলে যেতে হবে।শিউলি বেলীকে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেলীর দিকেই গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো।বেলীর কিছুটা অদূরে দাঁড়িয়ে হাত কচলাতে কচলাতে বললো,

–“আপা!তখনকার কথাগুলোর জন্য আমাকে ক্ষমা করে দাও।”

শিউলির কন্ঠের আওয়াজ পেয়ে বেলী চট করে পিছনে তাকালো।শিউলি কে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেলী মুখে একটা শুষ্ক হাসি টেনে বললো,

–“আমি কিছু মনে করি নি তোর কথায়।তুই না বুঝে বলে ফেলেছিস তা আমি বুঝতে পেরেছি।”

শিউলির বেলীর কাছে গিয়ে বেলীর হাত দুটো জড়িয়ে ধরলো।খুব উত্তজিত গলায় বললো,

–“আপা!তুমি একটু আম্মাকে বুঝিয়ে বলো না আমাকে যেনো স্কুলে যেতে দেয়।আর,আমি তো তোমার কাছে থেকে ক্ষমার চেয়ে নিয়েছি,এখন তুমি আম্মাকে বললেই আমি নিশ্চিত আম্মা তোমার কথা শুনবে।”

শিউলির মতিগতি বেলী কিছুক্ষণ পরোক্ষ করে নিলো।তার কাছেও শিউলির আচরণ গুলো অন্যরকম লাগছে।তাও শান্ত গলায় বলে উঠলো,

–“ঠিকাছে!আমি আম্মাকে বলবো।”

শিউলি বেলীকে জড়িয়ে ধরলো।বেলী আলতো করে শিউলির পিঠে হাত রাখলো।তবে তার মুখে কোনো হাসি নেই।আগের মতো দু’বোনের সম্পর্ক টাও মনে হয় নেই।শিউলি মনে মনে খুব খুশি হয়েছে।তার,বুদ্ধি টা কাজে দিয়েছে।সে জানতো আপা আম্মা কে বুঝিয়ে বললেই তাকে স্কুলে যেতে দিবে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here