উপন্যাস প্রপর্ণ, পর্ব-১৫

0
3814

#উপন্যাস_প্রপর্ণ(১৫)
#কুরআতুল_আয়েন

দিনের কর্মব্যস্ততা শেষ করে যখন রাত নেমে আসে তখন মানুষ বুক ভরা আশা নিয়ে ঘুমোতে যায়।বেলীদের বাড়ির আশেপাশের সবাই এখন ঘুমোতে ব্যস্ত।বাহিরের নিকষ কালো অন্ধকার।জানালাটা বরাবরের মতো খুলেই রেখেছে বেলী।পরশু তার গণিত পরীক্ষা।বিছানায় গোল হয়ে বসে আছে।চারপাশে বই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে।পড়াশোনা থেকে অনেকটা দূরে চলে গিয়েছে বেলী।যার ফলে এখন খুব হিমশিম খেতে হচ্ছে।বুরাগ ত্রিশ মিনিটের মতো সময় ব্যয় করে বাহির থেকে ঘরে আসলো।এসেই বেলীর পাশে সটান করে শুয়ে পড়লো।এক হাত বেলীর কোলের উপর ছেড়ে দিয়েছে।বেলীর এমনেতেই পড়ার চাপে মাথা ধরে আছে তার উপর বিকাল থেকে বুরাগের কথাবার্তার ধরণ সব মিলিয়ে সে এখন অনেকটাই চটে আছে।রাগ দেখিয়ে নিজের কোলের উপর থেকে বুরাগের হাত টা সরিয়ে দিলো।বুরাগও নাছোড়বান্দা!বেলী সরিয়ে দিতে না দিতেই বুরাগ আবারও আগের ন্যায় হাত টা কোলে রেখে দিয়েছে।পুনরায় বেলীও সরিয়ে দিয়েছে।এই নিয়ে প্রায় অনেক বার এমন হলো।কিন্তু,এবার বুরাগ বেলীর কোলে হাত না রেখে কোমর জড়িয়ে ধরে রেখেছে।বেলী এবার নড়াচড়া করেও নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে সক্ষম হয় নি।তাই চুপ করেই বসে আছে।

–“পরীক্ষার সব পড়া শেষ নাকি কিছুই পড়ো নি।ওহ-হো তুমি ছাত্রী হিসেবে কেমন তা এখন আমাকে একবার পরোক্ষ করে দেখতে হবে তো।”

বেলী প্রচন্ড বিরক্তি অনুভব করছে।ভ্রু কুঁচকে বুরাগের দিকে একবার তাকিয়ে কিছু না বলে সামনের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বই গুলোর দিকে তাকালো।বুরাগ বেলীর মতিগতি পর্যবেক্ষণ করে উঠে বসলো।বিছানায় হেলান দিয়ে গণিত বই টা হাতে তোলে নিলো।বইয়ে চোখ গুজে বেলীর উদ্দেশ্যে বললো,

–“ম্যাথের সব গুলো অধ্যায় করা আছে তো।সব গুলোই খুব গুরুত্বপূর্ণ ম্যাথ।একটা ছেড়ে অন্যটা করা যায় না।বলতে গেলে জোড়ালো।”

বেলী চুপচাপ বসে হাত কচলাচ্ছে।বুরাগের কথার পিঠে কি বলবে তাই ভাবছে।তার তো তেমন কিছুই শেষ হয় নি।
বুরাগ বেলীকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে কিছুই বললো না।তবে সে বুঝে নিয়েছে বেলীর মনের কথাগুলো।বুরাগ পা দুটো ভাজ করে বসে পড়লো।

–“চুপ করে না থেকে আমাকে বলো তোমার কোন ম্যাথ গুলোতে সমস্যা আছে।যতটুকু সম্ভব আমি কভার করে দেওয়ার চেষ্টা করছি।এখন তো আর সম্ভব না সব গুলো করার।”

বেলী এবার মাথা দুলিয়ে সম্মতি বুঝালো।বুরাগ খুব সিরিয়াস হয়ে ম্যাথ বুঝিয়ে দিচ্ছে।বেলীও খুব মনোযোগ সহকারে বুঝছে।পাক্কা দুই ঘন্টার মতো বেলীকে ম্যাথ বুঝিয়ে দিয়েছে বুরাগ।বেলীকে বুঝিয়ে দিয়েই আবারও শুয়ে পড়লো।বেলী হাসি মুখে বই গুলো গুছিয়ে নিয়ে টেবিলে রেখে দিলো।লাইট অফ করে দিয়ে বুরাগের পাশে শুয়ে পড়লো।বুরাগ পা নাড়াচ্ছে আর বেলীকে দেখার চেষ্টা করছে।বেলী তা বুঝতে পেরে অন্যদিকে ফিরতে নিলেই বুরাগ কিছুটা চেঁচিয়ে উঠলো।চেঁচানো অবস্থায় বেলীকে বললো,

–“ওই পাশে ঘুরবে না এইভাবেই শুয়ে থাকবে।”

–“আমি আমার সুবিধা মতো শুয়ে থাকবো।তাতে আপনি না করতে পারেন না।আপনাকে যদি বলা হতো তাহলে আপনি কি করতেন?নিজের অসুবিধা মতো শুতেন?”

–“এতো কিছু তো শুনতে চাচ্ছি না।তুমি শুধু আমার কথা শুনবে।আর তুমি শুনতেও বাধ্য।”

–“আমার একটা স্বাধীনতা আছে।আমি আমার স্বাধীনতা মতোই চলবো।”

–“বিয়ের আগে তুমি তোমার স্বাধীনতা মতো চলতে পারো কিন্তু বিয়ের পর না।বিয়ের পর প্রত্যেক মেয়েরা নিজের স্বামীর কথা শুনতে বাধ্য।সেইম তুমিও আমার কথা শুনবে।”

বেলী কিছুটা অভিমানী গলায় বললো,

–“কিন্তু তা অল্প দিনের জন্য।তারপর আমি আমার মতো আর আপনি আপনার মতো।”

বুরাগ ঠোঁট চেপে নিঃশব্দে হেসে দিলো।বেলীর কাছে এগিয়ে গেলো।শরীর ঘেঁষে শুয়ে রইলো।কিছুটা গম্ভীর গলায় বললো,

–“তা ঠিক বলেছো।আর,কিছুদিন মাত্র আমার জীবনে তোমার স্থায়িত্ব।তবে আমাদের আজকে আরো একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।”

বেলী তাকালো বুরাগের দিকে।বুরাগের চোখ আর নাক দেখতে সক্ষম হয়েছে সে।আজকে জানালা খুলে রাখলেও আলো তেমন আসছে না।হয়তোবা আকাশ মেঘে ডাকা।বেলীর চাহনি দেখে বুরাগ দাঁত কেলিয়ে বললো,

–“শিক্ষক ছাত্রীর সম্পর্ক।তবে,আমার ছাত্রী পড়াশোনায় ভালোই আছে খারাপ না।ব্যাপার টা ভালোই হবে দ্বিতীয় বিয়ে করার পর তুমি আমার প্রাক্তন বউ হওয়ার সাথে সাথে ছাত্রীও হবে।”

বেলী উল্টো ঘুরে শুয়ে পড়লো।এমতাবস্থায় বললো,

–“দরকার নেই।আমি একাই যথেষ্ট।লাগবে না কোনো শিক্ষক।”

বুরাগ পিছন থেকে বেলীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।বেলীর পিঠে নিজের মাথাটা ঠেকিয়ে রেখেছে।মাঝে মধ্যে নাক দিয়ে বেলীর পিঠে ঘষছে।বেলী একটু নড়েচড়ে উঠলো।বুরাগ ফিসফিস করে বললো,

–“তোমার না লাগলেও আমার লাগবে।তোমাকে আমি এখন থেকে বউ না ছাত্রী হিসেবে দেখবো।কাল সকালেও তুমি পড়তে বসবে আমার কাছে।এমনকি সব গুলা পরীক্ষার আগেও বসবে।শিক্ষকের কথা অমান্য করতে নেই।”

বেলী হাসি মুখে বললো,

–“ঠিকাছে স্যার।আর,স্যার হলো বাবার সমতুল্য।তার মানে আপনি আমার–
বাকিটা বলার আগেই বুরাগ বেলীকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো।হাত দিয়ে মুখটা চেপে ধরে রাগান্বিত হয়ে তাকিয়ে আছে বেলীর দিকে।বেলী কয়েকবার চোখের পলক ফেলে আবাক চাহনি নিয়ে বুরাগকে পরোক্ষ করতে লাগলো।

বুরাগ কটমট চোখে তাকিয়ে বেলীকে বললো,

–“আমি তোমার শিক্ষক এটাই যথেষ্ট।সমতুল্য করতে হবে না তোমাকে।”

বেলীকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো বুরাগের কাছ থেকে।মাথাটা একটু দূরে সরিয়ে বুরাগকে উদ্দেশ্য করে বললো,

–“আপনিই তো বললেন,আমাকে আপনি ছাত্রী হিসেবে দেখেন বউ না।তো আমি ভুল তো কিছু বলি নি।”

–“সব শিক্ষক রা বাবার সমতুল্য হয় না।কিছু শিক্ষক ভাইয়ার সমতুল্যও হয়।পরে ভাইয়া থেকে ছাইয়া হয় মানে স্বামী হয়।”

–“যাই হোক!আপনি আমার জন্য ভাইয়াও না ছাইয়াও না।আর আমি শুনেছি শিক্ষরা পিতার সমতুল্যই হয়।”

বুরাগ দাঁতে দাঁত চেপে বেলীর গালে ছোট করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো।বেলী কিছুক্ষণ মুখটা হা করে তাকিয়ে রইলো বুরাগের দিকে।বুরাগ বেলীকে নিজের বুকে সাথে চেপে ধরেছে শক্ত করে।মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আলতো হাতে।বেলীর প্রথমে খারাপ লাগলেও এখন ভালো লাগছে।বুরাগের বুকে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে।বুরাগ বেলীর গালে আলতো করে ঠোঁট দুটো চেপে ধরলো।কিছুক্ষণ পর কোমল কন্ঠে বলে উঠলো,

–“মাফ চাই আমি,তোমাকে ছাত্রী হতে হবে না।বউ আছো বউয়েই থাকো।”
————-
গ্রামের রাস্তার এককোনায় ছোট করে একটি টিনের দোকান বাঁধানো।দোকানটিতে প্রয়োজনীয় সব জিনিস পাওয়া যায়।চাল,ডাল,আলু,পেঁয়াজ বলতে গেলে সবই।আশেপাশের মানুষেরা এইখান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে নিয়ে যায়।সাথে খাবার জাতীয় জিনিসও রয়েছে।দোকানের সামনের লম্বা বেঞ্চিটাতে করিম এক পা তোলে বসে আছে।দোকানের ভিতর থেকে মৃদু আওয়াজে ভাটিয়ালি গান বাজানো হচ্ছে।গানের তালে তালে করমিও মাথা,হাত দুলাচ্ছে।একপর্যায়ে করিম কিছুটা জোর গলায় বললো,

–“ওই হামিদ!চাচা কই আইলো না যে আইজকা দোকানে।”

–“করিম ভাই আব্বা ক্ষেতো গেছে ধান কাটতে।এইলাইজ্ঞা আমি বইছি আইজকা।”

–“এহন আমারে একটা বিড়ি দে তো।বিড়ি চিনোস তো নাকি?”

হামিদ চট করে আশেপাশে একবার তাকিয়ে নিলো।আশেপাশে কারোর দেখা না পেয়ে কিছুটা নিম্ন গলায় বললো,

–“করিম ভাই!মজা লন আমার লগে।আমি তো বিড়ি খাওয়া শিখছি আপনের থাইক্কা।আর আপনেই আমারে এই কথা কইতাছেন।”

করিম হেসে উঠলো।চুল গুলো হাত দিয়ে আর একটু ঠিক করে হাসতে হাসতে বললো,

–“তোর আম্মারে দেখছিলাম বুঝছোস।এইলাইজ্ঞা কইছি তোরে এই কথা।আমার কথা হুইন্না চাচি এহন ভাববো তুই বহুত ভালা পোলা।”

–“তাহলে ভালা করছেন করিম ভাই।”

–“আগে বিড়ি দে!”

হামিদ বিড়ির একটা প্যাকেট এগিয়ে দিলো করিমের দিকে।করিম হামিদের থেকে বিড়ির প্যাকেট টা নিয়ে একটা বিড়ি হাতে তোলে নিলো।ঠোঁটে চেপে ধরে বেঞ্চি থেকে উঠে গিয়ে দিয়াশলাই দিয়ে জ্বালিয়ে নিলো।পুনরায় বেঞ্চিতে বসে হামিদকে বললো,

–“দোকানে ব্লেইড হইবো হামিদ।”

হামিদ চাল,ডাল সবকিছু গুছাতে ব্যস্ত।এমতাবস্থায় জবাবে বললো,

–“হ!ভাই হইবো।”

–“আমারে দশ টা ব্লেইড দে তো।”

–“এতোডি নিয়া কি করবেন করিম ভাই?”

করিম সামনের কাঁঠাল গাছটার দিকে তাকিয়ে আছে।ছোট একটা কাঁঠাল ঝুলে আছে।আশেপাশে কোনো পাতা নেই।সামান্য একটা ডালের মধ্যে অবহেলায় ঝুলে রয়েছে।ঠিক তার কিছুটা উপরেই আরো কতগুলো কাঁঠালের স্তুপ রয়েছে তবে সেই কাঁঠালের স্তুপ গুলো চারপাশে পাতা দিয়ে ঘেরা।মনে হচ্ছে কোনো বাঁধা,বিপদ তাদেরকে ছুঁয়ে দিতে পারবে না।করিম অবহেলায় ঝুলে থাকা কাঁঠাল টার দিকে তাকিয়ে বললো,

–“নিজের ক্ষোভ মিটানোর লাইজ্ঞা।”

–“ব্লেইড দিয়া কেমনে ক্ষোভ মিটাইবেন?”

করিম কাঁঠালটার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে হামিদের দিকে তাকিয়ে বললো,

–“ব্লেইড দিয়া শরীর কাইট্টা ক্ষোভ মিটামু।মনের শান্তি মিটাইয়া শরীর টায় ব্লেইডের চালান দিমু।একেক টা ব্লেইডের দাগে আমার যন্ত্রণা একটু একটু কইরা কমবো।”

হামিদ কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।কিছুক্ষণ চুপ থেকে করিমের দিকে তাকিয়ে রইলো।করিমের চোখে তীব্র ক্রোধ দেখতে পাচ্ছে।হামিদ আমতাআমতা করে বললো,

–“কিয়ের এতো ক্ষোভ আপনার?”

–“অভাব,অবহেলা,যন্ত্রণা সব কিছুর ক্ষোভ।”

–“আপনে হইলেন চেয়ারম্যানের পোলা।সব আছে আপনেগোর।কোনো কিছুর অভাব নাই গা আপনের।তাও কিয়ের এতো অভাব,অবহেলা?”

করিম মুচকি হেসে হামিদকে ইশারা করে কাঁঠাল গাছটার দিকে তাকাতে বললো।হামিদ ও করিমের ইশারা পেয়ে কাঁঠাল গাছটার দিকে তাকালো।

–“একবার ভালো কইরা চাইয়া দেখ কাঁঠাল গাছটার দিকে।কিছু বুঝছোস?”

হামিদ কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো কাঁঠাল গাছটার দিকে।পরমুহূর্তেই মিনমিন গলায় বললো,

–“কিছুই বুঝবার পারলাম না ভাই।”

–“চাইয়া দেখ ভালো কইরা,নিচের কাঁঠাল টা এক্কেবারে অবহেলায় পইড়া আছে।আর উপরের কাঁঠালের স্তুপ গুলারে আশেপাশের পাতা গুলা আঁকড়াই ধইরা রাখছে যেনো তাদের কোনো ক্ষতি করতে না পারে।আমিও ঠিক ওই নিচের কাঁঠাল টার মতো অবহেলায় আছি।ভালোবাসার অভাব,অবহেলা।যারে আমি আপন কইরা নিতে চাইছিলাম ও আমারে ঠিক এইরাম ভাবে অবহেলায় দূরে সরাই দিছে।আমার ভালোবাসা ডা বুঝলো না।”

–“কে আপনারে দূরে সরাই দিছে?”

করিম ফোস করে শব্দহীন একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো।হামিদকে তাড়া দিয়ে বললো,

–“তোর এতো জানোন লাগতো না।আমারে মোট দশ টা ব্লেইড দে।দশ টা মানে দশ টা।একটাও যেনো নড়চড় না হয়।মনের ক্ষোভ গুলা এই ব্লেইড গুলা দিয়া বাহির করমু।আমার নিজেরেই ভয় লাগতাছে এই ব্লেইড গুলারে দেইখা।যহন আমি এই গুলারে কাজে লাগামু তখন হে কেমন ছটফট করবো তা দেইখাই আমি আমার শান্তি মিটামু।”
————-
পাতালা একটা সাদা চাদরের নিচে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে শুয়ে আছে লিটন আর স্নিগ্ধা।লিটনের লোমশ বুকটায় স্নিগ্ধা মাথাটা চেপে রেখেছে।স্নিগ্ধার চোখ দুটি বন্ধ কিন্তু ঠোঁটে মুচকি হাসি।লিটন স্নিগ্ধার মসৃণ হাত টা এপাশ ওপাশ করে দেখছে।বিরাট বড় এক আলিশান হোটেলে আজকে সারাটা দিন কাটিয়েছে লিটন আর স্নিগ্ধা।সকাল থেকে বিকেলে পর্যন্ত দু’জনেই ব্যস্ত ছিলো তাদেরকে নিয়ে।একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে।তার উপর আজকে আবার আকাশ মেঘলা।সব মিলিয়েই আজকের দিনটা তারা খুব সুন্দর করে কাটিয়েছে।স্নিগ্ধা ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলো,

–“এবার আমাকে ছাড়ো!তোমার বউয়ের কাছে যাও।দুপুরের তোমার যাওয়ার কথা এখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।তার উপর ফোন টাও বন্ধ করে রেখছো।”

লিটন স্নিগ্ধার মাথায় একটা চুমু খেলো।স্নিগ্ধাকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে বললো,

–“পারভীন কিছুই বলবে না।সে এখন বাচ্চাদের আসার অপেক্ষায় বিভোর হয়ে থাকে।কখন তার কোল জুড়ে বাচ্চারা আসবে।”

–“তুমি খুশি না তোমার বাচ্চাদের কে নিয়ে?তুমি বিভোর হয়ে থাকো না তোমার বাচ্চাদের অপেক্ষায়?”

–“বাচ্চাদের জন্য আবার অপেক্ষা করার কি আছে।যখন আসার সময় হবে তখন তারা চলে আসবে।আর,আমি এখন চাইলেও তো তাদের কে দেখতে পারবো না।”

–“মাঝেমধ্যে আমার খুব কষ্ট হয় পারভীন ফুপির জন্য।বেচারি যদি একবার জানে তার স্বামীর সাথে আমার সম্পর্ক আছে তাহলে যে কি হবে তাই ভেবে ভেবে দিনরাত পার করে দেই।”

লিটন শব্দ করে হেসে উঠলো।স্নিগ্ধার চুলে বিলি কাটতে শুরু করেছে।স্নিগ্ধা লিটনকে আর একটু জড়িয়ে ধরলো।

–“পারভীন জানলেও আমি তোমার কাছে চলে আসবো স্নিগ্ধা।তোমাকে বিয়ে করে আমরা নতুন করে সব কিছু শুরু করবো।”

–“তোমার বাচ্চাদের কি হবে?পারভীন ফুপি পারবে একা একা তাদেরকে সামলাতে।”

–“দেখো স্নিগ্ধা তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না।যখন বুরাগের সাথে তোমাকে প্রথম দেখি তখনই তোমাকে ভালো লেগে যায়।তোমাকে পাওয়ার নেশায় মত্ত হয়ে গিয়েছিলাম।তবে আমার প্রতি তোমারও আকর্ষণ দেখে অনেকটাই খুশি হয়েছিলাম।যার জন্য বুরাগের সাথে আমার সম্পর্ক টাও নষ্ট হয়ে গিয়েছে।বুরাগ তো আমাকে এখন ফুফাই মানে না।আর রইলো পারভীন,সে তার নিজের সন্তানদের নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করবে তা আমার দেখার বিষয় না।”

বলেই হেসে উঠলো লিটন সাথে স্নিগ্ধাও হেসে দিলো।স্নিগ্ধা লিটনের বুক থেকে মাথা টা তোলে নিলো।নিজের থুঁতনিটা লিটনের বুকে ঠেকিয়ে বললো,

–“তোমার মতো বুইড়াকে যে আমার কি করে ভালো লেগে গেছিলো তা বুঝতেই পারি নি।মন থেকে কিছুতেই সরাতে পারছিলাম না তোমাকে।”

লিটন টান মেরে স্নিগ্ধাকে নিজের কাছে নিয়ে আসলো।
দু’জনে এইভাবে আরো ঘন্টাখানেক সময় কাটালো।নিজেদের শরীরগুলো আবারও একে অপরের কাছে বিলিয়ে দিলো।
—————————————————————————–
সময় খুব দ্রুত অতিবাহিত হয়ে যায়।চোখের পলকেই বছর পেরিয়ে নতুন বছরের আগমন চলে আসে।সেখানে কয়েকটা দিন চলে যাওয়া কোনো ব্যাপারেই না।বেলীর পরীক্ষা মাঝপথে আছে।পরীক্ষার শুরু থেকেই বুরাগ বেলীকে গাইড দিয়ে এসেছে।বাকি সময় টুকু বেলীকে জ্বালালেও পড়ানোর সময় বুরাগকে চেনাই যায় না।খুব গম্ভীর,মনোযোগ দিয়ে বেলীকে প্রতিটি পরীক্ষার জন্য তৈরি করেছে।প্রতিদিনের মতোই আজকেও বুরাগ বেলীকে নিয়ে পড়তে বসেছে।কিন্তু বেলীর আজকে পড়ায় মন নেই।বাহিরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে।অবাধ্য মন তার বাহিরের বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছা করছে।আর এইদিকে বুরাগ পড়া বুঝিয়েই যাচ্ছে।কিছুক্ষণ পর বেলীর রেসপন্স না পেয়ে বেলীর দিকে তাকালো বুরাগ।বেলীকে বাহিরে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুখে একটা দুষ্টুমির হাসি টেনে বেলীর হাত ধরে টান মেরে নিজের নিকটে নিয়ে আসলো।বুরাগের বাহুডোরে আবদ্ধ বেলী।বেলী বিস্ময় নিয়ে তাকালো বুরাগের দিকে।

–“বাহিরে বৃষ্টি,সাথে হিমেল হাওয়া,পাশে সুন্দরী বউ।বউয়ের নেই পড়ায় মন তাহলে আমি কেন শুধু শুধু আমার গলা চেঁচিয়ে ফাটাবো।তার থেকে ভালো আমি এখন রোমান্স করবো।আর,তাছাড়াও আমার খুব রোমান্স পাচ্ছে।”

–“উহুহু!আমার পরীক্ষা”

–“পরীক্ষা তো কালকে এখন তো না।আর তুমি তো নিজেই পড়ায় মনোনিবেশ করো নি।তাহলে এখন কেন বলছো!”

–“ইয়ে মানে এখন করবো।সব পড়াই মনোযোগ দিয়ে শুনবো।”

বুরাগ বেলীর গাল টেনে বললো,

–“কিন্তু আমি এখন পড়াবো না তোমায়।রোমাঞ্চকর মুহূর্তে আছি আমি।সময় টা উপভোগ করতে দাও।”

বুরাগ বিছানা থেকে নেমে পড়লো।বেলীকে কোলে তোলে নিয়ে জানালাটার দিকে এগিয়ে গেলো।চেয়ার টেনে প্রথমে বুরাগ বসে পড়লো।নিজের কোলে বেলীকে সযত্নে বসিয়ে চেপে ধরে রেখেছে।বেলীর কাঁধে থুঁতনিটা রেখে হিসহিসিয়ে বলতে শুরু করলো,

–“এক পশলা বৃষ্টিকে উপভোগ করতেও তোমাকে প্রয়োজন আমার।বৃষ্টির পরেই প্রকৃতি কেমন প্রাণ ফিরে পায়।একই ভাবে আমিও তোমাকে ফিরে পেতে চাই।আমাদের খারাপ সময় গুলো মুছে দিয়ে নতুন ভাবে সব কিছু ঠিক করতে চাই!”

বেলী বৃষ্টির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো।বুরাগের দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছে।বুরাগও বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে।দু’জনের ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি।

অন্যদিকে,
শিউলি আর করিমও একসাথে বৃষ্টি উপভোগ করছে।আজকে স্কুলে যায় নি।স্কুলের নাম করে করিমের সাথে ঘুরতে বের হয়েছে।কিন্তু মাঝপথে বৃষ্টি এসে যেনো শিউলির খুশি আরো দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।আর সেই সাথে করিমের লালসাও।শিউলির অর্ধভেজা শরীর টা করিমের কামনা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।শিউলি দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে ব্যস্ত।করিম গুটিগুটি পায়ে শিউলির পাশে এসে দাঁড়ালো।

–“আমারে বিশ্বাস করো শিউলি?”

শিউলি বৃষ্টি থেকে চোখ ফিরিয়ে করিমের দিকে তাকালো।করিমের কথা শুনে,মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,

–“অনেক বিশ্বাস করি আপনাকে করিম ভাই।নিজের থেকেও বেশি।”

–“নিজের থাইক্কাও বেশি।এতো ভালোবাসো আমারে তুমি?”

–“কোনো সন্দেহ আছে আপনার এতে।আমি খুব ভালোবাসি আপনাকে।আপনাকে ছাড়া থাকা আমার জন্য ইদানীং খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”

করিম একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,

–“আইচ্ছা শিউলি!তোমারে যদি আমি কখনো মাইরা ফেলি,তোমার বিশ্বাস,ভালোবাসা নিয়া যদি আমি খেলি?”

শিউলি চট করে করিমের দিকে তাকালো।পরক্ষণেই মুখে হাসি টেনে বললো,

–“আমি বিশ্বাস করি না করিম ভাই আপনি এইরকম করবেন।আপনি তো আমাকে ভালোবাসেন,আর ভালোবাসার মানুষ কখনো এইরকম করতে পারে না।আপনার সাথে এখনো আমার অনেক পথচলা বাকি।”

করিম কিছু বলে না।মুখটা প্রসারিত করে দূরের বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইলো।সামনের হিজল গাছটার কোটরে একটি প্যাঁচা বসে আছে।বৃষ্টির পানিতে শরীরটা একদম কুঁচকিয়ে রেখেছে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here