উপন্যাস প্রপর্ণ, পর্ব-১৭

0
3842

#উপন্যাস_প্রপর্ণ(১৭)
#কুরআতুল_আয়েন

নিস্তব্ধতা!শব্দটি শুনলেই মন টা কেমন বিষিয়ে উঠে।সেই সাথে আবার গভীর রাত।বাড়ির বারান্দা টার মধ্যে হাত পা জড়িয়ে বসে আছেন জাবেদা।পাশে সিমন্টের তৈরি পাল্লাটায় মাথাটা হেলান দিয়ে রেখেছেন।চোখের কার্ণিশ থেকে বেয়ে পড়া পানি গুলো শুকিয়ে সাদা দাগ বসে গিয়েছে।বারবার বাহিরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছেন।জাবেদার পাশে রেহানা নিঃশব্দে বসে আছেন।উনার বুকটা কেন জানি মোচড় দিয়ে উঠছে বারংবার।কিন্তু,উনি জাবেদার সামনে উনার দূর্বলতা টা দেখাতে চান না।উনি জাবেদাকে স্বান্তনা দিচ্ছেন একটু পর পর।রেশমি বিছানায় রোবটের মতো শুয়ে আছে।সে বসতে চেয়েছিলো সবার সাথে।কিন্তু,রেহানা জোর করে ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছেন।পোয়াতি বলে ঘরে শুয়ে থাকতে বলেছেন।কিন্তু,রেশমির কিছুতেই শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে না।শিউলির জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে।

উঠোনের এককোণায় একটা শেয়াল খুব বিশ্রী ভাবে ডাকছে।সেই সাথে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক।সব মিলিয়েই একটা অন্যরকম পরিবেশ তৈরি হয়েছে।জাবেদা প্রাণহীন ভাবে সামনের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রেহানাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

–“বড়ো ভাবি!আমার শিউলি টা এখনো কেন আসছে না।ও তো আমাকে বলে গিয়েছিলো বেশি দেরি করবে না।মেলায় একটু ঘুরে ঠিক আবারও আমার বুকে ফিরে আসবে।বিকালে গিয়েছিলো মেলায় কিন্তু এখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গিয়েছে তাও কেনো আসছে না শিউলি।ও কি বুঝতে পারছে না তার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।”

জাবেদার কথা শুনে রেহানা কেঁদে উঠলেন।শাড়ির আঁচলে মুখে গুজে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।রেহানার কান্না শুনে জাবেদা মাথা টা ঘুরিয়ে রেহানার দিকে তাকালেন।কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,

–“বড়ো ভাবি!আমি জানি শিউলি ফিরে আসবে।ওর কিছু হবে না।একটু পরেই ও দৌড়ে এসে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলবে,আম্মা আমি এসে গেছি।আর,গেছে তো বেলীর বাপ,ভাইজান রা শিউলিকে খুঁজতে ঠিক সাথে করে নিয়ে আসবেন।”

–“তাই যেনো হয় জাবেদা।তুই কোনো চিন্তা করিস না।”

জাবেদা পুনরায় সিমেন্টের পাল্লার সাথে মাথাটা এলিয়ে দিয়েছেন।ভিতরটা ফেটে যাচ্ছে উনার।শুধুমাত্র জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন।

বাড়ির ভিতর টর্চ লাইট জ্বালিয়ে ঢুকে পড়লেন অলি সাহেব আর উনার বড় দুইভাই কাশেম আর খালেদ সাহেব।জাবেদা তাদেরকে আসতে দেখেই দৌড়ে অলি সাহবের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।অলি সাহেব জাবেদাকে এইভাবে দেখে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলেন।জাবেদা পিছনে তাকিয়ে পুনরায় অলি সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

–“বেলীর বাপ!শিউলি কই?আমার শিউলি কেনো আসলো না।”

অলি সাহেবের মুখটা খুব বিধস্ত হয়ে আছে।উনার বুকটা শুধু বারবার কেঁপে উঠছে।যখন উনি মেয়েকে খুঁজতে গিয়েছেন তখন প্রতিটি রাস্তা নিঃশব্দে কেঁদে গিয়েছেন।একজন বাবার জন্য এর থেকে কষ্টের আর কি হতে পারে।অলি সাহেব কান্না আটকানোর ফলে কথাও বলতে পারছেন না।জাবেদা অলি সাহেবের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে কাশেম সাহেবের দিকে এগিয়ে গেলেন।পুনরায় আবারও বলতে লাগলেন,

–“বড় ভাইজান!আপনি বলুন না আমার শিউলি কোথায়।আমি তো ওর জন্য সেই কখন থেকে বসে আছি।”

কাশেম সাহেব মাথাটা নিচু করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন নিঃশব্দে।পরক্ষণেই মিনমিনে গলায় বললেন,

–“পায় নি আমরা শিউলি কে।আশপাশ টা খুঁজে দেখেছি কিন্তু শিউলির কোনো দেখা মেলে নি।তুমি শান্ত হও জাবেদা।কিছুই হবে না আমাদের শিউলির।

জাবেদা কাশেম সাহেবের কথা কর্ণপাত করেই অলি সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ালেন।হাতদুটো শক্ত করে চেপে ধরে বললেন,

–“আপনি বলেছিলেন আমাকে,আমার শিউলিকে ফিরিয়ে আনবেন।আমি আমার মেয়েকে চাই।ও যেই অবস্থাতা তেই থাকুক না কেনো আমি আমার শিউলি কে চাই।একবার আসুক শুধু শিউলি,আমার আঁচলের নিচে লুকিয়ে রাখবো ওকে।”

জাবেদার কথায় অলি সাহেব জাবেদার কাঁধে হাত রেখে বললেন,

–“জাবেদা কিছু হবে না আমাদের মেয়ের।শিউলি সকালেই তোমার কাছে চলে আসবে।”

–“সত্যি আসবে তো।”

অলি সাহেব জাবেদার কথায় মাথা নাড়ালেন।জাবেদা এখন মানসিক ভাবে দূর্বল হয়ে আছে তাই তিনি জাবেদার কথায় সায় দিয়ে যাচ্ছেন।কিন্তু,ভিতরে ভিতরে উনি নিজেকে কিছুতেই ঠিক রাখতে পারছেন না।
—-
রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।চারপাশ থেকে পাখিদের কিচিরমিচির ডাক ভেসে আসছে।সামনের বুড়ো বটগাছটার উপর এক ঝাঁক পাখি বসে আছে,সেই সাথে তাদের অনবরত কিচিরমিচির ডাক।বারান্দায় বসে জাবেদা ব্যাপার টা খেয়াল করলেও উনার মনে হাজারো রকমের অস্থিরতা।আগের মতোই বারান্দায় বসে শিউলির আসার জন্য অপেক্ষা করছেন।কেউ বুঝিয়ে সুঝিয়ে উনাকে ঘরে নিতে পারেন নি।আশেপাশের বাড়ির লোকেরা বড় বড় পা ফেলে মসজিদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।যাওয়ার আগে জাবেদার মুখপানে একবার চেয়ে পুনরায় আবার তাঁদের গন্তব্যে হাঁটা ধরে।সকালের মিষ্টি বাতাসটা জাবেদার গায়ে এসে ছুঁয়ে দিলেও জাবেদার মনে প্রশান্তির দেখা মিলছে না।জাবেদা শুধু যেকোনো মূল্যে শিউলি কে চায়।শিউলির কথা মনে পড়তেই জাবেদা হু হু করে কেঁদে উঠলেন।পাশের চৌকিতে বসা অলি সাহেবের চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠলো।তড়িঘড়ি করে চোখের পানিটা মুছে নিলেন।চৌকি ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন মসজিদে যাওয়ার জন্য।

জাবেদা এইভাবে বসে থাকলেও চোখ পড়ে আছে বাড়ির সামনের মাটির সরু রাস্তাটায়।হুট করেই,বাড়ির সামনের রাস্তা টা দিয়ে নজরুল কে তাঁদের বাড়ির দিকে দৌড়ে আসতে দেখে জাবেদা উঠে দাঁড়ালেন।দুই বাড়ির পর নজরুলদের বাড়ি।জাবেদাকে খালাম্মা বলে ডাকে।নজরুলের বাবা মারা গেছেন বেশিদিন হয় নি।নজরুলের বাবা মারা যাওয়ার পর নজরুলের মা কুসুমা যেনো দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলেন।তখন কুসুমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন জাবেদা।নিজের বোন হিসেবে দেখেছেন।মাঝেমধ্যে শাক-সবজি,চাল,ডাল দিয়ে সাহায্য করে থাকেন।নজরুল কে দৌড়ে আসতে দেখে জাবেদা নজরুলের দিকে এলোমেলো পা’য়ে এগিয়ে গেলেন।

নজরুল জাবেদার কাছে এসে হাঁপাচ্ছে।জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে।তার মুখ দিয়ে কথাই বের হচ্ছে না।বলতে গিয়েও যেনো বলতে পারছে না।জাবেদা নজরুলকে দেখে ভাঙা গলায় বললেন,

–“এতো সকালে তুই নজরুল।কুসুমা ঠিক আছে তো।”

নজরুল কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইলো জাবেদার দিকে।নজরুল ভেবে পাচ্ছে না মানুষ টা কি দিয়ে গড়া!এতো কষ্টের মধ্যেও তার মা’য়ের খোঁজ নিচ্ছে।তার মা ঠিক আছে কি’না তা জানতে চাইছে।নজরুলের চোখে পানি চলে এসেছে।জোরে একটা শ্বাস নিলো নজরুল।পরমুহূর্তেই আমতাআমতা করে বললো,

–“খালাম্মা!আম্মা ঠিক আছে।আম্মার কোনো কিছু হয় নাই।”
কিছুক্ষণ থামে নজরুল।হাসফাস করছে শুধু,বলতেও পারছে না আসল কথাটা।জাবেদা মুখে একটা শুষ্ক হাসি টেনে ধরলেন।জাবেদার শুষ্ক হাসি দেখে নজরুল আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না।শব্দ করে কেঁদে উঠলো।জাবেদা ভয় পেয়ে গেলেন নজরুলের কান্নার গলা শুনে।

–“খালাম্মা!ধানক্ষেতের আইলের পাশে কে জানি শিউলি রে মাইরা রাইখা গেছে।গ্রামের মানুষ জড়ো হইয়া আছে।আমি দেইখাই দৌড়াইয়া আইসি খালাম্মা।”

নজরুলের কথা কর্ণপাত হতেই জাবেদা বিস্ময় নিয়ে তাকালেন নজরুলের দিকে।কানের মধ্যে নজরুলের কথা টা আবারও বাজতেই জাবেদা স্তব্ধ হয়ে মাটিতে ধপাস করে বসে পড়লেন।গগন বিদারী আওয়াজে কেঁদে উঠলেন।মাটি গুলো বারবার আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছেন।কান্না করছেন আর মাটি গুলো খামছাচ্ছেন।

জাবেদার কান্নার আওয়াজ পেয়ে অলি সাহেব ঘর থেকে দৌড়ে বের হয়ে আসলেন।জাবেদা কে পাগলের মতো কান্না করতে দেখে অলি সাহেব ভয় পেয়ে গেলেন।সামনে নজরুলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন,

–“নজরুল কি হয়েছে রে!তোর খালাম্মা এমন করছে কেনো।আর তুইও কান্না করছিস কেনো।”

নজরুল কান্নারত অবস্থায় বললো,

–“খালু!শিউলিরে কে জানি মাইরা ধানক্ষেতের মধ্যে ফালাই রাখছে।”

নজরুলের কথাটা শুনে অলি সাহেব কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন।হাতে টুপি নিয়ে দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন।একজন অভুক্ত্য প্রাণীর মতো দৌড়ে যাচ্ছেন।গাল বেয়ে পানি পড়ছে অলি সাহেবের।আর,বিরবির করে বলছেন,আমাকে শক্তি দাও আল্লাহ!আমি যেনো একটু জোর গলায় কান্না করতে পারি,আমার শিউলিকে দেখার জন্য ধৈর্য দাও আল্লাহ।
————————–
বুরাগের বুকে বেলী নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে।বুরাগও পরম আবেশে বেলীকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।কাক ডাকার শব্দে বুরাগের ঘুম ভেঙে যায়।কপাল টা কুঁচকে রেখেছে।বেলীকে নিজের বুকে দেখে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটে।বেলীর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলো আলতো হাতে।এমতাবস্থায় ফোনটা বেজে উঠলো বুরাগের।বুরাগ হাত বাড়িয়ে ফোনটা হাতে নিতেই কিছুটা চমকে উঠলো।মা’য়ের নাম্বার দেখে কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলো।বুরাগ ভেবে পাচ্ছে না এক বাসায় থেকে কেন মা ফোন করলো আর এতো সকালেই কেন।চিন্তাগুলো দূরে সরিয়ে দিয়ে বুরাগ ফোন টা কানে চেপে ধরলো।বুরাগ কিছু বলার আগেই অপাশে মা’য়ের গলা পেয়ে থেমে গিয়েছে।

আফিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলতে শুরু করলেন,

–“বুরাগ আমি এখন যা বলবো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবে।”

–“কিছু হয়েছে মা।এতো সকালে তোমার ফোন দেখে খুব চিন্তা হচ্ছে মা।”

–“বুরাগ আমাদের এখনই যেতে হবে।”

–“কোথায় যাবো মা!আর,তুমি এইভাবে কাঁপা কাঁপা গলায় কথা বলছো কেন?”

আফিয়া অনেক কষ্টে কান্না আটকে বললেন,

–“আমাদের বেলীদের বাড়ি যেতে হবে।কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের রওনা দিতে হবে।”

–“কি সব বলছো মা তুমি।কালকেই তো আসলাম।আবার আজকে কেন যাবো।”

আফিয়া শব্দ করে কেঁদে উঠলেন।এমতাবস্থায় বললেন,

–“যেতে হবে বুরাগ।শিউলিকে শেষ দেখা দেখবে না!বেলীকে শেষ দেখা দেখতে দিবে না তার বোনকে।”

–“মা কিসব বলছো তুমি।”

–“আমি ঠিক বলছি বুরাগ।শিউলিকে কে জানি মেরে ফেলেছে।আজকে সকালে ধানক্ষেতের পাশে পাওয়া গিয়েছে শিউলির লাশ।তুমি বেলীকে তৈরি করো।আমরাও তৈরি হচ্ছে।”

বুরাগ কথাটা শুনে নিঃশব্দে কতোক্ষণ উপরের দেয়াল টার দিকে তাকিয়ে রইলো।এমন একটা সংবাদ শোনার জন্য সে কিছুতেই অপেক্ষা করে ছিলো না।সে তো আজকের দিনটা সুন্দর করে শুরু করতে চেয়েছিলো বেলীর সাথে।কিন্তু,এমন একটা সংবাদ বুরাগের ভিতর টা তছনছ করে দিচ্ছে।যতোদিন ছিলো বেলীদের বাড়িতে ততদিনে শিউলির সাথে ভালো একটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো।ভাই বোনের সম্পর্ক।বারবার,বুরাগের চোখের সামনে শিউলির মুখ টা ভেসে উঠছে।

–“কি হলো বুরাগ!তুমি চুপ কেন?”

–“মা!আমি কি বলবো বেলীকে।আমার মাথায় কিছুই কাজ করছে না।”

–“তুমি কি বোকা বুরাগ।কি বলবে মানে কি।সত্যি টা বলতেই হবে।একটা সময় তো বেলী জানবে।আর এখন এতো কিছু বলার সময় নেই আমার।তুমি তাড়াতাড়ি বেলীকে তৈরি করো।”

আফিয়া বলেই ফোনটা খট করে কেটে দিলেন।খাটের কোণায় বসে চোখের পানি ফেলছেন।একটু আগেই উনার কাছে ফোন এসেছিলো বেলীদের বাড়ি থেকে।তখনি খবর টা শুনে কোহিনূরের রুমের দিকে যেতে নেন।তার আগেই কোহিনূর এসে আফিয়াকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন।

বুরাগ আস্তে গলায় বেলীকে ডাকছে।কিন্তু,বেলীর কোনো সাড়াশব্দ নেই।বাধ্য হয়ে বুরাগ একটু গলার আওয়াজ টা একটু বাড়িয়েছে।বেলীর এবার নড়েচড়ে উঠলো।মাথা তুলে বুরাগের দিকে তাকিয়ে,ঘুম জড়ানো কন্ঠে বুরাগকে বললো,

–“কি হয়েছে বলুন তো।এতো ডাকছেন কেন?”

বুরাগ আমতাআমতা করে বললো,

–“বেলী উঠো তো।উঠে ফ্রেশ হয়ে আসো।আমাদের এখনি এক জায়গায় যেতে হবে।”

বেলী আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়লো।চুল গুলো খোঁপা করতে করতে বললো,

–“কোথায় যাবো বলুন তো এতো সকালে।”

–“উফফ!বেলী এতো কথা না বলে গোসল করে একটা শাড়ি পরে নাও।তুমি রেডি হয়ে আসো আমি পরে বলছি তোমাকে।”

বুরাগের ধমকি গলার আওয়াজ পেয়ে বেলী বুরাগের দিকে একবার তাকিয়ে দৌড় লাগায় আলমারির দিকে।কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যাওয়ার আগে বুরাগের দিকে তাকিয়ে আনমনে বলতে লাগলো,

–“আজকে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।ভিতর টা খুব কাঁপছে।কেন এমন হচ্ছে!”

–“ওইসব কিছু না বেলী।তুমি গোসল করে আসো দেখবে ভালো লাগবে।”

বেলী সম্মতি জানিয়ে চলে গেলো।বেলী চলে যেতেই বুরাগ মাথাটা দু’হাত দিয়ে চেপে ধরলো।মনে মনে বলতে লাগলো,কীভাবে বলবো তোমায় বেলী আসল কথাটা।তোমার কেন অস্থিরতা,কষ্ট লাগছে তা তুমি বুঝতে না পারলেও আমি তো বুঝে গিয়েছি।শিউলি আর তোমার তো রক্তের সম্পর্ক।একজনের কিছু হলে তো আরেকজনের কষ্ট হবেই।কিন্তু,তবুও আমাকে সত্যি টা বলতেই হবে তোমাকে।

একপ্রকার দ্রুতই ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসলো বেলী।হন্তদন্ত হয়ে বুরাগের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

–“এবার তো বলুন আমরা কোথায় যাবো।কেন জানি আমার ভালো লাগছে না।”

বুরাগ কিছু না বলেই ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো।বেলী কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে চিন্তায় বসে পড়লো বিছানায়।মনে মনে আওড়াতে লাগলো,কি এমন কারণে আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন উনি।

প্রায় মিনিট দশেক পর বুরাগ বেরিয়ে আসলো।বুরাগকে বেরোতে দেখে বেলী জোর গলায় বললো,

–“আপনি কি কিছু লুকাচ্ছেন আমার থেকে।কোথায় যাবো আমরা বলুন তো।”

বুরাগ বেলীর মায়াময় মুখটা দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।বেলীকে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে হাত দুটো চেপে ধরে বললো,

–“বেলী আমি তোমাকে কিছু কথা বলবো।তুমি আগেই কোনো রিয়েক্ট করবে না।”

বেলী মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।

–“বেলী আমাদের এখনই তোমাদের বাড়ি যেতে হবে।আমি জানি তোমার মনে প্রশ্ন জাগছে।কালকে তো এলে তবে আজকে কেন।কিন্তু,তাও আমাদের যেতে হবে।কারণ,শিউলিকে লাস্ট দেখা তো দেখতে হবে বেলী।”

বেলী উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বুরাগের দিকে।বুরাগ শুকনো একটা ঢোক গিলে বললো,

–“শিউলি মারা গেছে বেলী।ওকে কে জানি মেরে ফেলেছে।”

বেলী কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো।আচমকাই ঢলে বুরাগের বুকে পড়ে গেলো।বুরাগ বেলীকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে পড়লো।খবরটা নিতে পারে নি বেলী।যার ফলে এমন হয়ে গিয়েছে।
—————————————————————–
বাড়ির উঠোন টায় শিউলির নিথর দেহটা পড়ে আছে।জামা কাপড় গুলো ছিঁড়ে গিয়েছে।শিউলির দেহটার কিছুটা সামনেই জাবেদা বসে আছেন।মাটিতে এলোমেলো ভাবে বসে শিউলির মুখটায় চেয়ে রইলেন।শিউলির মুখের চেহারাটা যেনো পাল্টে গিয়েছে।ব্লেডের আঁচড়ে যেনো চামড়া গুলো শরীর থেকে পড়ে যাবে এমন ভাব।বারান্দার চৌকিটাতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছেন অলি সাহেব।শিউলিকে দেখেই সেখানেই জ্ঞান হারান তিনি।আমেনা বেগম বিলাপ করে কান্না করছেন শিউলির জন্য।তার পাশেই বেলী নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে।একটু পর পর শিউলির চেহারাটার দিকে তাকাচ্ছে।কিছুক্ষণ আগেই বেলীরা এসে পৌঁছছে।হাসি,খুশি শিউলিকে দেখে ভয়ে কান্না করে দিয়েছে।রেশমি তাদের আঁকড়ে ধরে আছে।তামিম রাস্তায় আছে।শিউলির খবর পেয়ে যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে অনেকক্ষণ আগেই রওনা দিয়েছে।শিউলির খবর পেয়ে সুমনাও চলে এসেছেন।সারাটা রাস্তা কেঁদেছেন উনি।সবুজও কেমন চুপ হয়ে গিয়েছে।গ্রামের মানুষেরা জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কেউ ছি ছি করে অনেক কথা শুনাচ্ছেন আবার কেউ আহাজারি করছেন,আর বলছেন অকালে মেয়েটা চলে গেলো।পুলিশও চলে এসেছে।কয়েকজন শিউলির লাশের কাছে আছেন আর কয়েকজন শিউলিকে যেখানে পাওয়া গিয়েছে সেখানে আছেন।

হঠাৎ করেই জাবেদার বাড়ির সামনের রাস্তাটায় চোখ পড়ে।সেখানে চেয়ারম্যান সাজ্জাদ আহমেদ কে দেখে জাবেদা দৌড়ে গেলেন।দৌড়েই সাজ্জাদ আহমেদের পাঞ্জাবির কলার টা শক্ত করে মুঠো করে নিলেন।এমন হওয়ায় সাজ্জাদ আহমেদ ভয় পেয়ে যান কিছুটা।তিনি খবর পেয়ে দেখতে এসেছিলেন।আর যেহেতু উনি গ্রামের চেয়ারম্যান।জাবেদা দাঁতে দাঁত পিষে বলতে লাগলেন,

–“তোর ছেলে করিম কোথায়?আমি জানি করিমের কাজ এইটা।ও আমার কাছ থেকে আমার কলিজাকে কেঁড়ে নিয়েছে।ওর এতো রাগ,ক্ষোভ থাকলে আমাকে শেষ করে দিতো।কিন্তু আমার কলিজাকে কেন এইভাবে কষ্ট দিলো।দেখ,একবার চেয়ে আমার মেয়ের মুখটা।কি করেছে দেখ তুই।”

সাজ্জাদ আহমেদের এবার একটু টনক নড়লো।কাল বিকাল থেকে এখন পর্যন্ত করিমের কোনো দেখা নেই।তাছাড়াও এটাও জানেন,করিম কতো টা পাগল বেলীর জন্য।বেলীকে না পাওয়ার ক্ষোভ যে করিম শিউলির উপর মেটাবে সেটা কখনোই ভেবে দেখেন নি।তাও কিছুটা জোর দিয়ে বললেন,

–“ছাড়ুন আমার পাঞ্জাবির কলার।আপনি কার গায়ে হাত দিয়েছেন আপনি জানেন।আর,আমার ছেলে কেন এইসব করবে।শুধু উল্টো পাল্টা কথা বলছেন।”

–“আমি জানি এইসব তোর কুসন্তান করিমের কাজ।ওকে আমি ছাড়বো না কিছুতেই।”

এরিমধ্য পুলিশের বড় একজন বলাবলি করছে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যেতে হবে।জাবেদার কানে কথাটা আসতেই জাবেদা সাজ্জাদ আহমেদের কলার ছেড়ে পুলিশদের দিকে এগিয়ে গেলেন।তাদের মধ্যে একজনের পা জড়িয়ে ধরে আহাজারি করে বলতে শুরু করলেন,

–“পুলিশ বাবু!আমার মেয়েকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবেন না।ওকে আর কষ্ট দিবেন না।দেখুন না ওর শরীর টা কতো কষ্ট সয়েছে।আরো কষ্ট দিবেন আপনারা।আমার মেয়েটা আর এইসব সহ্য করতে পারবে না।”

জাবেদা পা ছেড়ে দিয়ে শিউলির লাশের কাছে এগিয়ে গেলেন।কতক্ষণ ছোটবাচ্চাদের মতো চেয়ে রইলেন।ফর্সা মুখটা কালো হয়ে গিয়েছে।আঁচড়ের দাগ গুলো কালচে হয়ে আছে।জাবেদা আর না পেরে বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।শিউলিকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে রেখেছে।শিউলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।একটু পর শিউলির দেহ টা পুনরায় মাটিতে শুয়ে দিয়ে আঁচড়ের দাগ গুলোতে চুমু দিতে লাগলেন।এক একটা চুমু দিচ্ছেন আর বলছেন,

–“শিউলি দেখ!আম্মা তোকে আদর করে দিচ্ছে,আরাম পাচ্ছিস তো শিউলি।একটু বল আমাকে!আমি আরো আদর করে দিচ্ছি দাঁড়া।”

জাবেদা পাগলের মতো শিউলির আঁচড়ের দাগগুলোতে আদর করে দিতে লাগলেন।পা,দুটো ছিলে যাওয়ায় সেখানে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।পায়জামা টা রক্তে ভিজে যাওয়ায় জাবেদা বুঝে গিয়েছেন তার মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে।কতক্ষণ চেয়ে রইলেন শিউলির রক্তমাখা পায়জামা টার দিকে।পুনরায় আবারও চেঁচিয়ে উঠলেন,

–“এইরকম রক্ত জড়িয়ে তো তোকে আমি এনেছিলাম শিউলি।তোকে এতো কষ্ট দিয়েছে ওই করিম।আমি জানি এইটা করিমের কাজ।ওকে আমি শেষ করে দিবো।ছাড়বো না আমি কাউকে।”

রক্ত চোখে তাকিয়ে আছেন জাবেদা সাজ্জাদ আহমেদের দিকে।যার অর্থ,যা কিছু হয়ে যাক না কেন জাবেদা ছেড়ে দিবেন না।

জাবেদার কান্না,আহাজারি দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে।যেই জাবেদাকে গ্রামের পুরুষেরা মাথার চুল পর্যন্ত দেখেনি,হাতের আঙুল গুলো দেখেছিলেন শুধু সেই জাবেদার আজকে হাটু অবধি শাড়ি উঠে রয়েছে,বুকে আঁচলের ঠিক নেই।চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে।

বেলী এবার একটু নড়েচড়ে উঠলো।আম্মার আহাজারি দেখে গুটিগুটি পায়ে আম্মার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলো।কিন্তু,কিছুদূর আগানোর পরেই বেলী গড়গড় করে বমি করে দেয়।মাথা ঘুরিয়ে সেখানেই পড়ে যায়।যার ফলস্বরূপ,বেলীর মাথাটা একটা বড় পাথরের সাথে গিয়ে লাগে।মাথার চারপাশ টা যেনো রক্তে ভরে গিয়েছে।রক্ত বেয়ে বেয়ে সারা মুখে এসে পড়ছে।বুরাগ চমকে পাশে তাকালো।বেলীর মাথায় রক্ত দেখে চিৎকার দিয়ে উঠলো।বেলীর কাছে একপ্রকার দৌড়ে গেলো।বেলীর নিস্তেজ শরীর টা নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলো।মুহূর্তেই বুরাগের সাদা শার্ট টা রক্তে ভরে গিয়েছে।বেলীর রক্তাক্ত মুখটা দেখে বুরাগ শব্দ করে কেঁদে উঠলো।ভিতর টা তার খুব শূন্য অনুভব করছে।গ্রামের মানুষেরা এবার বলাবলি শুরু করে দিয়েছে,ইসস!রে জাবেদা কি একদিনেই দুই মেয়েকে হারিয়ে ফেলবে!!এক মুহুর্তেই আশাকুঞ্জ নিবাস কেমন প্রাণহীন হয়ে পড়েছে।জাবেদা ঝাপসা চোখে বেলীর রক্তমাখা মুখ আর মাথাটার দিকে তাকিয়ে রইলো।

চলবে..

(আজকের পার্ট টা লিখতে আমার নিজেরেই খারাপ লাগছে।😪)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here