#উপন্যাস_প্রপর্ণ(১৮)
#কুরআতুল_আয়েন
পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো বেলী।তার কাছে চারপাশ টা কেমন ঘুটঘুটে অন্ধকার লাগছে।মাথাটাও কেমন ঝিম মেরে ধরে রেখেছে।কিছুক্ষণ চোখ দুটো বন্ধ করে পুনরায় চোখ মেলে তাকালো।এখন তার চোখে সবকিছুই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।সামনে একজন গম্ভীর লোককে বসে থাকতে দেখে মাথাটা উঁচু করে দেখার চেষ্টা করছে বেলী।কিন্তু,ব্যথার যন্ত্রণায় মাথাটা উঁচু করা সম্ভব হচ্ছে না।উপরের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে,অভিযান চালাচ্ছে আসলে সে কোথায় আছে।নিজের ঘরের দেয়াল থেকে বেলীর শব্দ করে বলে উঠলো,
–“আম্মা কোথায়!আর শিউলি কই?আমার বোনটা কোথায়।আমি যাবো ওর কাছে।”
বেলীর গলার আওয়াজ পেয়ে বুরাগ দৌড়ে ঘরে ঢুকলো।এতোক্ষণ বুরাগ বাহিরেই দাঁড়িয়ে ছিলো।বেলীর জন্য নিঃশব্দে কান্না করছিলো।কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটা মনে পড়তেই বুরাগের বুকটা আঁতকে উঠেছিলো।বেলীকে হারানোর ভয় টা মনের ভিতর জেঁকে বসেছে।তার যে এখন,বেলীকে ছাড়া সবকিছুই নিঃস্ব লাগে।ঠিকসময় ডাক্তারকে খবর না দিলে কি থেকে যে কি হয়ে যেতো তা ভাবতেই বুরাগ জোরে একটা নিঃশ্বাস নিলো।তখনি ঘর থেকে বেলীর গলার আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে ঘরে চলে যায়।বেলীকে দেখে শুকনো একটা ঢোক গিললো।মাথাটা সাদা ব্যান্ডেজ দিয়ে মুড়িয়ে রেখেছে।মুখটা কেমন শুকিয়ে আছে।বেলীর পাশে আফিয়া বসে আছেন।চোখ দিয়ে যেনো আর পানি পড়ছে না।মনে হয় তাদেরও বিতৃষ্ণা ধরে গিয়েছে পড়তে পড়তে।বেলীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আলতো হাতে।এতোক্ষণ সবাই ছিলো বেলীর কাছে জাবেদা বাদে।জাবেদা শুধু শিউলির নিথর দেহটা বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন।কিন্তু,ডাক্তার সাহেব জায়গা খালি করতে বলায় আফিয়া সবাইকে বের করে দিয়ে নিজে থেকে গিয়েছেন।
বেলী অনেক নড়াচড়া করছে।উঠতে গেলেই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় বুরাগ।কিছুটা গম্ভীর গলায় বেলীকে বললো,
–“চুপ করে শুয়ে থাকো বেলী।ডাক্তারের কাজ টা করতে দাও।বেশি সময় লাগবে না আর একটু শুয়ে থাকো।”
বেলী নাছোড়বান্দা হয়ে জবাবে বললো,
–“আমি আম্মার কাছে যাবো!শিউলিকে একটু বুকে জড়িয়ে ধরবো।ওকে তো আর কাছে পাবো না।আমাকে আর আপা বলেও ডাকবে না।”
শব্দ করে কেঁদে উঠলো বেলী।বেলীর কথা শুনে আর কান্না দেখে বুরাগ মুখটাকে অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো।শিউলির জন্য তারও কম কষ্ট হচ্ছে না।শিউলির লাশ টাই বলে দিবে এতো টুকু শরীরে কীভাবে এতো অত্যাচার সহ্য করেছে।
ডাক্তার সাহেব বেলীকে চেকআপ করে নিজের যাবতীয় জিনিসপত্র গুলো গুছিয়ে নিচ্ছেন।উনার মুখ দেখে কিছুই বুঝা যাচ্ছে না।বেলী কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ভদ্রলোকের দিকে।ভদ্রলোকের হাতে স্টেথোস্কোপ দেখে বেলী বুঝে নিয়েছে, একটু আগে যেই গম্ভীর লোকটাকে মাথা উঁচু করে দেখতে গিয়েছিলো তিনি ছিলেন এই ডাক্তার সাহেব।
বুরাগ নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে ডাক্তারের সামনে এসে দাঁড়ালো।ডাক্তারের মুখচোখ গম্ভীর দেখে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লো।বুরাগ কিছু বলতে যাবে তখনি ডাক্তার সাহেব আস্বস্ত করে বললেন,
–“চিন্তার কোনো কারণ নেই!আঘাত টা তেমন একটা বেশি লাগে নি।এখন সবকিছু ঠিক আছে।তবে খুব বিশ্রামের মধ্যে থাকতে হবে।তার উপর মা হতে চলেছে।এইসময় টা খুব সচেতনতার সাথে থাকতে হবে।দেখেশুনে রাখবেন।”
ডাক্তার সাহেবের কথা শুনে বুরাগ আর বেলী দু’জনেই চমকে উঠলো।সেই সাথে আফিয়াও চমকে উঠেছেন।বুরাগ কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো।বেলীর মনে হচ্ছে নিজের কানে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না।আফিয়া কতোক্ষণ চুপ থেকে বসে রইলেন!পরমুহূর্তেই উনার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
ডাক্তার সাহেব চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন।বুরাগ এগিয়ে আসতেই উনি বললেন,
–“আপনার আসতে হবে না।এইখানে যা অবস্থা আপনাকে দরকার হতে পারে।আমি একাই চলে যেতে পারবো।”
ডাক্তার সাহেব চলে যাওয়ার পর পরই আফিয়া বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন,বুরাগের সামনে গিয়ে বললেন,
–“তুমি বেলীর কাছে থাকো বুরাগ।আমি ওইদিক টায় যাচ্ছি।একটু পরেই শিউলিকে দাফন করানো হবে।ভুলেও বেলীকে কান্না করতে দিবে না।”
বুরাগ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।আফিয়া চলে গিয়েছেন।যাওয়ার আগে দরজা টা হালকা করে চাঁপিয়ে দিয়ে গেছেন।
বুরাগ কিছুক্ষণ নিষ্পলক চেয়ে রইলো বেলীর দিকে।বেলী মা হবে কথাটা বারবার কানে বাজছে।এইরকম কিছুর জন্য তো সে প্রস্তুত ছিলো না।কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই কি থেকে যে কি হয়ে গেলো তা বুরাগও বুঝতে পারছে না।
অন্যদিকে বেলীর মনে কোনো অনুভূতিই কাজ করছে।সবকিছু বাদ দিয়ে তার চোখে বারবার শুধু শিউলির মুখটা ভেসে উঠছে।নিজেকে ঠিক রাখতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার।চোখের কার্ণিশ বেয়ে ঝরে পড়া পানি গুলো গলা স্পর্শ করে বালিশে এসে থামছে।আর,জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে শুধু।বুরাগ বেলীর অবস্থা দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে যায়।দ্রুত গতিতে এগিয়ে গেলো বেলীর দিকে।বেলীর পাশে আধশোয়া হয়ে বেলীর মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলো।কিন্তু,বেলী রক্তমাখা শার্ট টা দেখে ভয়ে বুরাগের বুক থেকে মাথাটা সরিয়ে আনলো।রক্ত দেখেই শিউলির রক্তাক্ত শরীরটা মুহুর্তেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো।বুরাগ বুঝতে পারছে না বেলী এমন কেন করছে।বুরাগ বেলীর চোখ অনুসরণ করে নিজের রক্তমাখা শার্টটার দিকে চোখ পড়লো।পরমুহূর্তেই শার্ট টা খোলে ছুঁড়ে নিচে ফেলে দিলো।বেলীর মাথাটা পুনরায় নিজের বুকের সাথে চেপে রেখেছে।খুব শক্ত করে চেপে ধরেছে বেলীকে।মনে হচ্ছে ছাড়লেই বেলী কোথাও হারিয়ে যাবে।
—-
পড়ন্ত বিকেল।শেষ রোদটুকু ঝলমলিয়ে যেনো আশেপাশে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে।একটু পরেই সন্ধ্যাকে আগমন জানিয়ে এই বিকেলের অবসান ঘটবে।সেই সাথে,শিউলিও সবাইকে বিদায় জানিয়ে নিজের আসল গন্তব্যে চলে যাবে।যেই গন্তব্যের উদ্দেশ্যে একদিন সবাইকে পাড়ি জমাতে হবে।তফাৎ হবে এইটুকুই কেউ আগে যাবে তো কেউ পরে যাবে।সাদা কাপড়ে শিউলির দেহটা মুড়িয়ে রাখা হয়েছে।জাবেদা কিছুতেই ময়নাতদন্ত করতে দেন নি।পুলিশরা বারবার বলেছিলো কিন্তু কেউ জাবেদার সাথে পেরে উঠে নি।জাবেদার এক কথা,আমার শিউলিকে আর কোনো আঘাত পেতে দিবো না।তাই পুলিশরাও আর কিছু করতে পারে নি।তবে,জাবেদার কথা অনুযায়ী পুলিশ করিমকে খোঁজার সন্ধানে লেগে পড়েছে।করিমদের বাড়িতে গিয়ে তল্লাশি করেও যখন করিমকে পায় নি তখন তারা তাই সন্দেহ করে নিয়েছে।করিমকে খোঁজার জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা লাগিয়ে দিয়েছে।
শিউলির সারাজীবনের বিদায়ের সময় হয়ে এসেছে।অলি সাহেব কাঁপা কাঁপা হাতে অযু করে এসে শিউলির পছন্দের একটা পাঞ্জাবি পড়লেন।পাঞ্জাবি টা শিউলির খুব পছন্দের ছিলো।গতবছর ঈদে শিউলি টাকা জমিয়ে পছন্দ করে কিনে দিয়েছিলো।সেই সাথে মাথায় টুপি পড়ে নিলেন।শিউলির দেওয়া আতর টাও লাগিয়ে নিয়ে নিজেকে তৈরি করে নিয়েছেন শিউলির আসল গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।ঘর থেকে বের হয়ে জাবেদার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।জাবেদা কে ধরে মাটি থেকে তোলে শিউলির লাশের কাছে নিয়ে গেলেন।ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন,
–“শেষ দেখাটা দেখে দাও জাবেদা!প্রাণভরে দেখে নাও আমাদের কলিজাকে।পরে তো আর সেই সুযোগ পাবে না।”
অলি সাহেবের কথা অনুযায়ী জাবেদা শিউলির মুখটার দিকে তাকালেন।শিউলির কাছে এসে বসে পড়লেন।আলতো হাতে শিউলির মুখটায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।কোমল কন্ঠে বলে উঠলেন,
–“সেই যে ঘর থেকে বের হয়েছিলি আর ফিরলি না তুই।আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলি।ওপারে গিয়ে ভালো থাকিস শিউলি।আমাকে ছাড়া তুই থাকতে পারলেও আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারবো না।তুই চিন্তা করিস না আমি করিমকে ছাড়বো না।ওকে তোর থেকেও বেশি কষ্ট পেতে হবে।”
জাবেদা আর না পেরে চিৎকার দিয়ে উঠলেন।অলি সাহেব জাবেদার কান্নার দিকে আর না তাকিয়ে শিউলির লাশের দিকে এগিয়ে গেলেন।শেষ বারের মতো শিউলির মুখটা দেখে সাদা কাপড় দিয়ে বেঁধে দিলেন।লাশ নেওয়ার খাট টা নিজের কাঁধে তোলে নিলেন।আরেকপাশে বুরাগও কাঁধে তোলে নিয়েছে।পিছনের দিকটায় অলি সাহেবের বড় দুইভাই কাশেম সাহেব আর খালেদ সাহেব কাঁধে নিয়েছেন।
জাবেদা বারবার শিউলির কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।কিন্তু পারছেন না।চোখের পলকেই শিউলিকে নিয়ে চলে গেলো তাঁরা।জাবেদা শিউলি বলেই আরেকবার গগণ বিদারী চৎকার দিয়ে উঠলেন।
বিকেলে পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছে।শিউলির কার্যক্রম শেষ করে মাগরিবের নামাজ আদায় করে সবাই বাড়ির পথে হাঁটা ধরলো।বুরাগের কেন জানি বেলীর জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে।মনটায় কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না।ইচ্ছে করছে বেলীকে নিজের থেকে দূরে না সরাতে।বেলীকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে।তবে,করিমকে যদি হাতের নাগালে একবার পায় তাহলে তার অবস্থা খুব খারাপ করে দিবে।বুরাগ পরমুহূর্তেই ফোনটা বের করে পুলিশের নাম্বারে ফোন দিলো।কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলো ফোন রিসিভ হওয়ার অপেক্ষায়।ফোন রিসিভ হতেই বুরাগ চোয়াল শক্ত করে বললো,
–“ওই করিমকে যেকোনো মূল্যে ধরা চাই আমি।ওকে ধরার জন্য যা যা করা লাগে তাই যেনো করা হয়।বাংলাদেশেই তো থাকবে নাকি!আর যদিও বাংলাদেশ থেকে চলেও যায় তাহলেও ওকে ধরার চেষ্টা থামিয়ে দিবেন না আপনারা।”
ফোনটা কেটে দিলো বুরাগ।সবার পিছনে ও ছিলো।আরো একবার পিছন ফিরে শিউলির কবর টার দিকে তাকালো।কবরস্থানে আরো একটা নতুন কবর যুক্ত হলো।ফোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুনরায় হাঁটা ধরলো।
আশাকুঞ্জ নিবাস নিস্তব্ধতায় ভরপুর।আশেপাশের সবাই যে যার মতো ঘুমিয়ে গিয়েছে।এখন রাত প্রায় এগারো টা বাজতে চললো।অলি সাহেবের কিছুক্ষণের জন্য চোখ লেগে গিয়েছিলো।আচমকাই স্বপ্নে শিউলির মুখটা ভেসে উঠতেই বুকের ভিতর টা অস্থিরতায় ভরে উঠলো।বিছানা ছেড়ে উঠে বসলেন।খুব কষ্ট করে বললেন,
–“জাবেদা এক গ্লাস পানি দাও তো।খুব পিপাসা পেয়েছে।গলা যেনো পানির ছোঁয়ায় কাতরাচ্ছে।”
অলি সাহেব হাত দিয়ে বুকে বারবার ঢলছেন।শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে।জাবেদাকে পুনরায় ডেকে বললেন,
–“জাবেদা তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছো।সজাগ থাকলে একটু পানি দাও না।আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।”
জাবেদার কোনো উত্তর না পেয়ে অলি সাহেব বুক থেকে হাত নামিয়ে বিছানায় হাত রাখলেন।বিছানায় জাবেদাকে না পেয়ে কিছুটা ভয় পেয়ে যান।আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিলেন।অন্ধকার ঘরটা মুহূর্তেই আলোকিত হয়ে গিয়েছে।কিন্তু ঘরে জাবেদাকে দেখতে না পেয়ে কিছুটা চিন্তায় পড়ে যান অলি সাহেব।ঘরের দরজা খোলা থেকে অলি সাহেব ঘর ছেড়ে বাহিরে বেরিয়ে আসলেন।
বেলী শুয়ে শুয়ে নিঃশব্দে কান্না করছে।শিউলিকে দেখতে ইচ্ছা করছে খুব।কিন্তু,সেটা আর কিছুতেই সম্ভব না।সবার উপর অভিমান জমেছে বেলীর।যখন ঘুম থেকে উঠে শুনেছে শিউলিকে দাফন করা হয়েছে গিয়েছে তখন থেকেই নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে।বুরাগ মাথাটা চেপে ধরে বসে আছে।সে কিছুতেই বেলীর কান্না থামাতে পারছে না।বেলীকে শান্তও করতে পারছে না।নিজেকে স্বাভাবিক করে বেলীর দিকে তাকালো।মাথায় হাত রাখতে নিলেই বেলী রাগে বুরাগের হাত টা সরিয়ে দিলো।বুরাগ তাও জোর করে বেলীর মাথায় হাত রেখে বললো,
–“একটু শান্ত হও বেলী।তোমাকে এখন অনেক শক্ত হতে হবে।”
বেলী কেঁদেই যাচ্ছে।বুরাগের হাত টা আবারও সরিয়ে দিয়েছে।ক্রন্দনরত অবস্থায় বললো,
–“আমার সাথে কথা বলবেন না আপনি।আপনিও তো আমাকে ডেকে দিতে পারতেন।তাহলে শেষ দেখাটা তো দেখতে পেতাম শিউলিকে।”
–“বেলী তুমি খুব অসুস্থ ছিলে।ডাক্তার দেখে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর তুমি ঘুমিয়ে গিয়েছিলে।তোমাকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছিলো তাই তুমি ঘুমিয়ে ছিলে।শিউলিকে দেখার মতো তোমার অবস্থা ছিলো না।আর তাছাড়াও তোমার মাথার আঘাতের জন্য তো তুমি উঠে বসতেই পারতে না।সেখানে দাঁড়াতে কি করে।এখন যেমন আছো তখন এইরকম থাকলে ঠিকই তোমাকে নিয়ে যেতাম আমি।কান্না থামিয়ে এখন একটু উঠে বসো।অনেকক্ষণ হলো শুয়ে আছো।উঠে বসলে ভালো লাগবে।”
বেলী কিছু বলে না।বেলীকে চুপ থাকতে দেখে বুরাগ বেলীকে আস্তে করে তোলে বিছানায় হেলান দিয়ে বসালো।তখনি বেলীর চোখ যায় দেয়ালে টাঙানো তার আর শিউলির ছবিটার দিকে।কি সুন্দর করে বেলীর গলা জড়িয়ে রেখে, মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে শিউলি।বেলী নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারছে না।আবারও বেলী কান্নায় মেতে উঠলো।
বুরাগ চিন্তায় পড়ে গিয়েছে।বেলী যদি এইভাবে কান্না করতে থাকে তাহলে অসুস্থ হয়ে যাবে।সেই সাথে তাদের অনাগত সন্তানেরও ক্ষতি হতে পারে।বুরাগ বেলীকে নিজের সাথে চেপে ধরে রেখেছে।কোমল কন্ঠে বলে উঠলো,
–“বেলী একটু চুপ করো!এবার তুমি অসুস্থ হয়ে পড়লে আমাদের সন্তানের কি হবে বলো!ওরও যদি কোনো ক্ষতি হয়ে যায়।তাহলে পারবে নিজেকে ঠিক রাখতে।”
বেলী কান্না থামিয়ে দিয়েছে।সে তো ভুলেই গিয়েছিলো তার মধ্যে আরো একটি প্রাণ বেড়ে উঠছে।তার আর বুরাগের অংশ।নিজের হাতটা পেটের উপর রেখে দিয়ে আছে।বুরাগ বেলীকে চুপ থাকতে দেখে আর কিছু বলে নি।বেলীকে বুকে নিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে রেখেছে।
অলি সাহেব সারা বাড়ি খুঁজে দেখেছেন তাও জাবেদার কোনো খোঁজ পান নি।আর না পেরে,জোরে জোরে জাবেদা বলে ডাকছেন।অলি সাহেবের ডাকে যেনো আশেপাশের পাখিদেরও ঘুম ভেঙে যাওয়ার উপক্রম।কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই বাড়ির সবারই যেনো ঘুম ভেঙে গিয়েছে।
কোহিনূর ঘর থেকে বের হতে পারছেন না।হাসি,খুশি ভয়ে এখনো কান্না করছে।এখন উনার স্বামী আলামিন থাকলেও হতো।হাসি,খুশিকে সামলে নিতে পারতো।কিন্তু,বড় ভাই আজাদ রহমানের সাথে উনিও ব্যবসার কাছে বাহিরে গিয়েছেন।যার কারণে আর আসতে পারেন নি।কোহিনূর ভাইয়ের ডাক ঠিকই শুনতে পাচ্ছে।হাসি,খুশিকে সাহস জুগিয়েও বের হতে পারছেন না তিনি।একটু পর হাসি খুশি শুধু বলে উঠছে ভয় করছে।লাস্টে উপায় না পেয়ে হাসি আর খুশিকে নিয়ে বের হয়ে আসলেন।
অলি সাহেবের গলায় আওয়াজ পেয়ে বেলী আর বুরাগও কিছুটা চমকে উঠেছে।বেলী বুরাগের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“আব্বার গলা তো এইটা।আব্বার কি হয়েছে।”
বুরাগ বেলীর চোখের পানি গুলো মুছে দিয়ে বললো,
–“তুমি শুয়ে থাকো আমি দেখছি।”
–“আমিও যাবো আপনার সাথে।আমার খুব চিন্তা হচ্ছে।আর ঘরে থাকতে ভালো লাগছে না।আমাকেও নিয়ে চলুন।”
বুরাগ প্রথমে না করতে চাইলো।কিন্তু পরে ঠিকই রাজি হয়ে বেলীকে নিয়ে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো।
—-
অলি সাহেব জাবেদাকে ডেকেও জাবেদার কোনো সাড়া পেলেন না।চুপ করে বাহিরে বসে পড়লেন।অলি সাহেবের গলার আওয়াজ শুনে সবাই বাহিরে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ালো।বেলী অলি সাহেবের কাছে এসে ভাঙা গলায় বললো,
–“কি হয়েছে আব্বা!তুমি আম্মার নাম ধরে ডাকছিলে কেনো।”
প্রাণহীন চোখে তাকালেন অলি সাহেব বেলীর দিকে।বেলীর মাথার আঘাত টা দেখে কেঁদে উঠলেন।পরমুহূর্তেই বসা থেকে উঠে গিয়ে বেলীকে নিজের বুকে চেপে ধরে বললেন,
–“তোর আম্মাকে কোথাও পাচ্ছি না।কই চলে গেলো আমাকে ছেড়ে।প্রথমে শিউলি চলে গিয়েছে তারপর তোর আম্মাকে পাচ্ছি না।বেলী তুইও কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবি।আমার বেঁচে থাকার সম্বল গুলো একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে।”
বেলী কেঁদেই যাচ্ছে।কান্নার ফলে গলা দিয়ে কথা আসছে না।কথা বলতে গিয়েও বলতে পারছে না।বুরাগ কিছু একটা ভেবে অলি সাহেবের কাছে এসে দাঁড়ালো।অলি সাহেবের কাঁধ জড়িয়ে ধরে বললো,
–“কেউ আপনাকে ছেড়ে আর যাবে না বাবা।মা কোথায় আছেন তা আমি বুঝে গিয়েছি।আপনি আমার সাথে আসুন।”
অলি সাহেব বুরাগের দিকে তাকালেন।বুরাগ কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো অলি সাহেবের দিকে।অসম্ভব সুন্দর গড়নের মুখ অলি সাহেবের।বেলীর চেহারার গড়নও অনেকটা অলি সাহেবের মতো।কিন্তু,কষ্টের চাপে মুখ থেকে সৌন্দর্য টা আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।বুরাগ আস্বস্ত করে বললো,
–“মা হয়তোবা শিউলির কবরের কাছে গিয়েছেন।এখনো মেনে নিতে পারছেন না শিউলির ঘটনাটা।চলুন আমার সাথে আপনি।”
বেলী উত্তেজিত হয়ে বললো,
–“আমিও যাবো তোমাদের সাথে।”
বুরাগ রাগান্বিত হয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো বেলীর দিকে।কোহিনূর আর আফিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
–“মা আর ছোট আম্মু তোমরা বেলীকে সামলাও।আমি আসছি।আর,সাথে হাসি আর খুশিকেও দেখে রেখো।তাদের মুখচোখে ভয়ের চাপ।বেলীর সাথে কিছুটা সময় কাটাতে দাও।”
অন্ধকারে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক।চাঁদের আলোয় স্পষ্ট সবকিছু দেখা যাচ্ছে।জাবেদা চুপ করে শিউলির কবরের পাশে বসে আছেন।নতুন মাটি গুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন।ইচ্ছে করছে শিউলিকে বের করে এনে নিজের বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে।হাতে শিউলির একটা ছবি মুঠো করে রেখেছেন।সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পরপরই তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন।শিউলিকে একদন্ড দেখার জন্য।শিউলির কবর টা হাত দিয়ে বুলিয়ে দিচ্ছেন।যার ফলে উপরের মাটি গুলো ঝরা পাতার মতো গড়িয়ে নিচে পড়ে যাচ্ছে।
অলি সাহেব দ্রুত পা’য়ে হাঁটছেন।পিছন পিছন বুরাগ আসছে।কাশেম আর খালেদ সাহেব আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু বুরাগ যাবে বলে আর উনাদেরকে আসতে দেয় নি।কররস্থানের পাশে শিউলির কবরের পাশে বসা জাবেদাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।অলি সাহেব দৌড়ে গিয়ে জাবেদার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।জাবেদাকে তোলে দাঁড় করিয়ে বললেন,
–“তোমাকে আমি খুঁজতে খুঁজতে শেষ হয়ে গিয়েছি জাবেদা।তোমার শিউলিকে দেখতে ইচ্ছা করছিলো আমাকে বলতে আমি নিয়ে আসতাম তোমাকে।একা কেন এসেছো তুমি।বাড়ি চলো এবার।”
–“না!আমি শিউলির কাছে থাকবো।আপনি কি ভুলে গেছেন শিউলি মাটিতে শুতে পারে না।মনে ছিলো বুনির বিয়ের আগের দিন অনেক মানুষ থাকায় শিউলি মাটিতে শুয়েছিলো।তারপর কি ব্যথায় না ছিলো আমার মেয়েটার শরীরে।আজকেও তো ওর শরীর ব্যথা হয়ে যাবে।আমাকে থাকতে হবে এইখানে আপনি চলে যান এইখান থেকে।”
–“জাবেদা তাও আমাদের এখান থেকে যেতে হবে।আমাদের শিউলি আরামে ঘুমোচ্ছে জাবেদা।মাটিতে শুয়ে থাকলেও সে এখন আরামে ঘুমোচ্ছে।দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে শিউলি চলে গিয়েছে অনেক দূরে।দূর থেকে ও তোমাকে দেখছে।যদি তুমি এইরকম করো তাহলে শিউলি কি ঠিক থাকবে বলো!”
জাবেদা কিছু বলেন না।নিষ্পলক চেয়ে আছেন শিউলির কবরের দিকে।চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।দূর থেকে বুরাগ একমনে চেয়ে আছে তাঁদের দিকে।ইচ্ছা করেই দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে আছে।তাদের দেখছে আর মনে মনে ভাবছে আমার যদি মেয়ে হয় তাহলে আমি তাকে খুব আগলে রাখবো।একটা আঁচড়ও আসতে দিবো না তার শরীরে।
চলবে..