উপন্যাস প্রপর্ণ, পর্ব-১৯

0
3010

#উপন্যাস_প্রপর্ণ(১৯)
#কুরআতুল_আয়েন

নতুন একটি সকালের সূচনা হলো।সবকিছু আগের মতো থাকলেও আশাকুঞ্জ নিবাসে শিউলির অনুপস্থিতি যেনো প্রতিটি মানুষকে কুড়েকুড়ে খাচ্ছে।প্রতিটি মানুষ শিউলির স্মৃতি গুলো মনে করে যেনো কাঁতরাচ্ছে।আর,অন্যদিকে হয়তোবা শিউলি উপর থেকে সবাইকে দেখছে।জাবেদা শিউলির একটা জামা বুকে আগলে নিয়ে বসে আছেন।মা’য়ের মনকে বুঝানো তো বড্ড মুশকিল।তাও বাস্তবতা মানুষকে মেনে নিতে হবে।সবকিছু মেনে নিয়েই বাকি জীবনটা কাটাতে হবে।গ্রামের আরেকদফা মানুষ যেনো জড়োসড়ো হয়ে আছে আশাকুঞ্জ নিবাসে।সবাই বাড়ির সামনের জায়গা টা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে।কারোর কোলে ছোট ছোট বাচ্চাও রয়েছে।বাচ্চা গুলো থেমে থেমে একটু পর পর ট্যা ট্যা করে কান্না করছে।সবাই নানান রকমের প্রশ্ন,কথা জুড়ে দিয়েছে।জাবেদা তাঁদের কথার কোনো উত্তর দিচ্ছেন না।চুপ করে এককোণায় বসে শিউলির মুখটা মনে করছেন।অলি সাহেব হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসলেন।সবাইকে যেতে বললেন,কিন্তু এতে গ্রামের মানুষদের মধ্যে কোনো ভাবান্তর হলো না।তাঁরা পুনরায় আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে।

বেলী গুটিগুটি পা’য়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।মাথার ব্যথাটা একটু কমার দিকে।তবে,মাঝেমধ্যে চিনচিনে ব্যথা করে উঠে।ঘরটা তার কাছে কেমন বন্দী বন্দী লাগছে।বারবার মনে হচ্ছে একটু পরেই শিউলি দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে তার বুকে।শিউলির কথা মনে পড়তেই বেলী দেয়ালে টাঙানো ছবিটার দিকে তাকালো।ছবিটা নেওয়ার খুব প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।কিন্তু,অনেকটা উপরে হওয়াতে হাতের নাগাল অবধি আসছে না।তাই টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো,চেয়ার টা টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে।শরীর দূর্বল থাকায় কাঠের চেয়ার টা টানতে খুব হিমশিম খেতে হচ্ছে বেলীকে।
এমন সময় বুরাগ বাহির থেকে সবেমাত্র ঘরে ঢুকলো।বেলীকে চেয়ার টানতে থেকে কিছুটা অবাক হয়।পরমুহূর্তেই সন্তানের কথা মনে পড়তেই বুরাগ মুখে থমথমে ভাব নিয়ে বেলীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।বেলী বুরাগকে দেখে কিছুটা থতমত খেয়ে যায়।চেয়ার টা ছেড়ে দিয়ে কিছুটা দূরে দাঁড়ালো।বুরাগ কিছুক্ষণ বেলীর দিকে ভ্রুকুটি কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।চেয়ারটা জায়গা মতো রেখে দিয়ে বললো,

–“কি করছিলে চেয়ার টা নিয়ে?”

বেলী আমতাআমতা করে বললো,

–“দেয়ালে টাঙানো ছবিটা নিতে যাচ্ছিলাম।আমার থেকে অনেকটা উঁচু তে তো তাই আর কি চেয়ার টা নিয়ে যাচ্ছিলাম।”

–“তুমি কি ভুলে গেছো বেলী!তুমি যে অসুস্থ!তোমার এখন সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে।আর তুমি একদমই আমার কথা শুনছো না?আমাকে বলতে পারতে,আমার দেরি হলে আমার জন্য অন্তত একটু অপেক্ষা করতে পারতে।”

বুরাগের কড়া গলার কথা শুনে বেলী চুপচাপ বিছানায় এসে বসে পড়লো।ভিতর থেকে দমকা হাওয়ার মতো কান্না আসছে।বুরাগের কথা গুলো শুনে যেনো আরো কান্না আসছে।বুরাগ ছবি টা নিয়ে এসে বেলীর পাশে বসলো।বেলীকে কান্না করতে দেখে খুব মায়া হচ্ছে বুরাগের।বুরাগের কেন জানি এখন নিজের প্রতিই রাগ হচ্ছে।নিজেই নিজেকে বকছে আর বলছে,কি রে তুই বুরাগ!বউটাকে কান্না করিয়ে দিলি!বেচারির তো মনের কোনো ঠিক নেই।নিজে নিজে বিরবির করছে আর আড়চোখে বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে।বেলীর চোখের পানি গুলো মুছে নিতে গেলেই বেলী উল্টো ঘুরে বসে পড়লো।বুরাগ মিনিট দশেক চুপ থেকে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললো,

–“বুঝলে বেলী দুই দুইটা বাবু আমাকে সামলাতে হবে?তখন যে আমার কি অবস্থা হবে তাই ভাবছি শুধু।”

বেলী চট করে বুরাগের দিকে ঘুরে বসলো।নাক টেনে টেনে বুরাগকে বললো,

–“মানে?দুইটা বাবু কীভাবে?”

বুরাগ বেলীকে নিজের কোলে বসিয়ে দিলো।বেলীর পেটে আলতো ভাবে হাত রেখে বললো,

–“এইখানে একজন আছে আর একজন আমার কোলে বসে আছে।আমি তো ভাবতেই পারছি না আমার আবেগী বউ একদম বাচ্চা হয়ে গিয়েছে।কিছু বলতে গেলেই শুধু কান্না করে দেয়।এই দু’জনকে সামলাতে গিয়ে আমাকে অনেক নাকানিচুাবানী খেতে হবে তা বেশ বুঝতে পারছি।”

বেলী গাল ফুলিয়ে বসে আছে বুরাগের কোলে।মনোযোগ সহকারে শাড়ির আঁচল টা নিয়ে এপাশ ওপাশ করছে।সব কিছুর চিন্তা বাদ দিয়ে বেলী পড়ে আছে শাড়ির আঁচল নিয়ে।বুরাগ বেলীকে কোনো কথা বলতে না দেখে নিজের দিকে ফিরালো।বেলীকে বাচ্চাদের মতো নিচের ঠোঁট টা ফুলিয়ে রাখতে দেখে বুরাগ শব্দ করে হেসে দিলো।বুরাগের হাসির আওয়াজ পেয়ে বেলী উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে বুরাগের দিকে।বুরাগকে চোখ দিয়ে ইশারা করে বললো,

–“আপনি হাসছেন কেন?”

–“তোমাকে দেখে হাসছি।তোমাকে আজকে খুব বাচ্চা বাচ্চা লাগছে।”

–“জানেন!এই কথাটা মাঝমধ্যে শিউলিও বলতো আমাকে।যখনি আমি মন মরা হয়ে বসে থাকতাম তখনি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থেকে বললো,
আপা তোমাকে একদম বাবুদের মতো লাগছে।

বেলী আর বলতে পারলো না।চুপ করে মাথা নিচু করে বসে রইলো।চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।বুরাগ মুখে একটু হাসি টেনে বললো,

–“এইভাবে কান্না করলে,শিউলি তো খুব কষ্ট পাবে।একটু শান্ত হও বেলী।তোমাকে অনেক শক্ত হতে হবে।মা,বাবাকে তোমার সামলাতে হবে।আমাদের সন্তানের কথা ভাবতে হবে তোমাকে।”

বেলী কিছুই বলতে পারছে না।কান্না গুলো গলার ভিতরে থুতুর মতো দলা হয়ে আছে।তার উপর মাথাটা কেমন ঘুরছে।সাথে বমি বমিও লাগছে।বুরাগ বেলীর থুঁতনিটা উপরে তুললো।বেলীর কপালে ঠোঁট দুটো চেপে ধরলো।কপালে থেকে গালে নামতেই বেলী বুরাগকে ছিটকে সরিয়ে দিলো।বুরাগ বেলীকে কিছু বলতে নিবে তার আগেই বেলী বমি করে দিলো বুরাগের বুকে।মুহুর্তেই বুরাগের টি-শার্ট টা বমিতে ভরে গেলো।বুরাগ তাড়াহুড়ো করে বেলীকে চেপে ধরলো।বেলীর বমির দফা শেষ হতেই বুরাগ বাথরুমে নিয়ে গিয়ে পরিষ্কার করিয়ে দিলো।বেলী অপরাধীর চোখে তাকিয়ে আছে বুরাগের দিকে।বুরাগ সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বেলীর জন্য একটা শাড়ি নিয়ে এসে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,

–“দরজা টা লাগিয়ে তুমি শাড়িটা পরে নাও।আমি বাহিরেই আছি।ভিজা শরীরে থাকা যাবে না তোমার।”

–“কিন্তু,বিছানাটা তো নোংরা হয়ে গিয়েছে।আমি আগে এইটা পরিষ্কার করে নেই।তারপর শাড়ি পড়ে নিচ্ছি।”

–“আমিই করে নিতে পারবো।তুমি আগে শাড়ি পড়ে নাও।”

–“আমার জন্য আপনার আজকে এইসব করতে হচ্ছে।কেন যে এতো বেখেয়ালি ছিলাম”

–“আর একটা কথা বললে থাপ্পড় দিবো তোমাকে।তাড়াতাড়ি করে শাড়িটা পরে নাও।”

বেলীকে আর কিছু বলতে না দিয়ে বুরাগ বাহিরে চলে গেলো।দরজাটা লাগিয়ে দিয়েছে।বেলী শাড়ি পরে বুরাগকে আসতে বললো।বুরাগ ঘরে এসেই বিছানার চাদর টা পাল্টে দিয়েছে।আর একটা টি-শার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো।বেলী এইসুযোগে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো।সকাল থেকে ঘরে থাকতে থাকতে একদম নেতিয়ে গিয়েছে।মনটাকে একটু রিফ্রেশ করার জন্য বাহিরের আবহাওয়া দরকার।

জাবেদা চুপচাপ মনমরা হয়ে বসে আছেন।পাশেই টেবিলটার উপর সকালের খাবার টাও অযত্নে পড়ে রয়েছে।যেভাবে রাখা ছিলো সেভাবেই আছে।খাবারের কোনো নড়চড় হয় নি।অলি সাহেব জাবেদার হাতদুটো আঁকড়ে ধরলেন।কোমল কন্ঠে বলতে লাগলেন,

–“এইভাবে আর মনমরা হয়ে থেকো না জাবেদা।বেলী মা হবে জাবেদা।তুমি না বাচ্চা খুব পছন্দ করতে।তোমার খেলার সাথী আসছে।”

জাবেদা এবার একটু নড়েচড়ে বসলেন।বেলীর কথা মনে আসতেই জাবেদা কিছুটা অস্থির হয়ে উঠলেন।অলি সাহেবের হাত দুটো ধরে উত্তেজিত অবস্থায় বলতে লাগলেন,

–“বেলী!ঠিক আছে?আমি একটু দেখবো বেলীকে।”

অলি সাহেব জাবেদার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর বলছেন,

–“ঠিকাছে!বেলী।তুমি চিন্তা করো না।চলো,তোমাকে বেলীর কাছে নিয়ে যাই।”

এরিমধ্যে বেলী এসে দাঁড়ালো তাঁদের দরজার সামনে।গুটিগুটি পা’য়ে এগিয়ে আসলো জাবেদার দিকে।জাবেদা কতোক্ষণ বেলীর মাথার দিকে তাকিয়ে রইলেন।বেলীকে পাশে বসিয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন।বেলীও জাবেদার সাথে সাথে কেঁদে উঠলো।অলি সাহেব কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিরবির করে বলতে লাগলেন,
সবাই আছে শুধু শিউলি নেই।ওকে ছাড়া সব কিছুই অসম্পূর্ণ।বেলী আর জাবেদাকে ঘরে রেখে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বাহিরে বের হয়ে আসলেন।

জাবেদা বেলীকে নিজের সাথে চেপে ধরে আছেন।বেলীর মাথায় অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছেন।বেলীকে আদর করছেন,আর কান্নারত গলায় বলছেন,

–“একদম কান্না করবি না।এই সময়ে তোকে অনেক সাবধানতার সাথে থাকতে হবে।”

বেলী জাবেদার আঁচলে মুখ লুকিয়ে বললো,

–“তুমিও আর কান্না করো না আম্মা।তুমি কান্না করলে আমারও খুব কষ্ট হয়।”

জাবেদা কিছু বলেন না,চুপ করে চোখের পানি বিসর্জন দিচ্ছেন।বেলীও সবকিছু ভুলে গিয়ে জাবেদার বুকে মুখ লুকিয়ে আছে।জাবেদা যেনো বেলীকে দিয়েই শিউলিকে ভুলার চেষ্টা করছেন।কিন্তু তা তো আর কোনোভাবে সম্ভব না।
—-
বিকেলের শেষ সময়টা এক দুর্দান্ত সময়।চারপাশ যেনো তখন সুন্দরের লীলাখেলায় ব্যস্ত থাকে।বুরাগ পুকুর পাড়ের সামনের জায়গা টায় বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে।দূর থেকে বেয়ে আসা মৃদু হিমেল হাওয়া টা বুরাগের শিরা উপশিরায় গিয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে।বাতাসের তালে তালে পুকুরের পানিতে হালকা হালকা ঢেউয়ের তাল যেনো তৈরি হচ্ছে।চারপাশ একদম নিস্তব্ধ।আশেপাশের বাড়ির লোকজনেরও মনে হয় দেখা নেই।দূরের মাঠটায় কিছু ছোট ছোট বাচ্চারা নিজেদের মতো দৌড়াচ্ছে আর খেলছে।বুরাগ আপনমনে চেয়ে রইলো তাদের দিকে।কি সুন্দর নিশ্চিন্তে খেলছে তারা।বুরাগ ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো।কাঁধে কারোর স্পর্শ পেয়ে পিছনে তাকালো বুরাগ।মা’কে দেখে শুধুমাত্র এক টুকরো হাসি দিলো।

আফিয়া শাড়ির আঁচল কাঁধ পর্যন্ত টেনে নিয়ে বুরাগের পাশে এসে দাঁড়ালেন।উনিও খুব মুগ্ধ হয়ে মৃদু হিমেল হাওয়া টা অনুভব করছেন।বুরাগ সামনের দিকে তাকিয়ে বললো,

–“মা!বাবার সাথে কথা হয়েছে তোমার।সব কিছু ঠিক আছে।”

আফিয়ার ভ্রুজোড়া যেনো আপনাআপনিই কুঁচকে গিয়েছে।কিছুটা আমতাআমতা করে বললেন,

–“হঠাৎ এইসব কথা বলছো কেন তুমি?তোমার বাবার সাথে আমার আর কি হবে।সবই তো ঠিকঠাক।”

বুরাগ একটা তাচ্ছিল্যের হাসি টেনে বললো,

–“বাবা!তোমাকে অত্যাচার করে একবারো তো আমাকে বললে না মা।”

আফিয়া চমকে উঠলেন।শুকনো একটা ঢোক গিলে বললেন,

–“এইসব তুমি জানলে কীভাবে।আমি তো তোমাকে এইসব কথা বলি নি।আর,তোমার বাবা যাই করুক না কেন উনি তো আমার স্বামী।”

–“তাই বলে কি তোমার সাথে এইসব করবে।তোমার গা’য়ে হাত তুলবে।ভাগ্যিস ওইদিন ফুপি তোমাদের চার দেয়ালের আড়ালের কথা আর বাবার থাপ্পড়ের শব্দটা শুনে নিয়েছিলো।”

–“এইসব তোমাকে পারভীন বলেছে।তখন তো রুমে ছিলো।”

–“ছিলো তা ঠিক।কিন্তু,যখন একা একা থাকতে খারাপ লাগছিলো তখন তোমার কাছে যাওয়ার জন্য রুম থেকে বের হয়ে আসে।তোমাদের রুমে ঢুকার আগেই বাবা আর তোমার কথা গুলো শুনে নেয়।তারপরেই আমাকে সব কিছু ফোনে বলে দেয়।”

আফিয়া মুখে একটু শুকনো হাসি টেনে বললেন,

–“এইসব কোনো ব্যাপার না বুরাগ।এইসবের সাথে সামলে নিয়েই এতো গুলো বছর পার করেছি।”

–“উহুহু!ভুল বললে মা!আমার মুখের দিকে তাকিয়েই তুমি এইসব সহ্য করেছো।আর বাবাও,আমার জন্য তোমাকে মেনে নিয়েছিলো।আমিই হলাম মূল কাটা।যার জন্য তোমাকে এইসব সহ্য করতে হয়েছে।আমি না থাকলে হয়তো তোমার জীবন টা অন্যরকম ভাবে আরো গুছাতে পারতে।”

আফিয়া চমকে তাকালেন বুরাগের দিকে।ছেলের এইসব কথাবার্তা শুনে কান্না আর দমিয়ে রাখতে পারছেন না।বুরাগের কোমলতার চাহনি দেখে আফিয়া কেঁদে দিলেন।বুরাগ এক হাত দিয়ে মা’কে জড়িয়ে নিয়েছে নিজের সাথে।আফিয়া বুরাগের হাত দুটো চেপে ধরে বললেন,

–“ভুলেও এইসব কথা আর কখনো বলবি না।তুই আছিস বলেই তো আমার বেঁচে থাকার সম্বল আছে।আজকে দাদি হওয়ার আনন্দ পাচ্ছি।”

বুরাগ হেসে উঠলো।মুখে কিছু বলে নি।আফিয়া বুরাগের হাসির দিকে তাকিয়ে বললেন,

–“বেলীকে ভালোবাসিস অনেক তাই না।”

বুরাগ সরু চোখে তাকালো মা’য়ের দিকে।পুনরায় মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে।আফিয়া আবারও বললেন,

–“আমি জানি আমার ছেলেকে।ভালোবাসিস তাহলে বলছিস না কেন।এখনো সময় আছে বলে দে।না হলে,পরে সময় নাও পেতে পারিস।”

–“পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমিও বলে দিবো আমার মনের কথা বেলীকে।বেলীকে আমি কিছুতেই হারাতে পারবো না।”

আফিয়া কিছু বলেন না।আজকে উনার মনে অনেক প্রশান্তির দেখা পাচ্ছেন।এতো কষ্টের মধ্যেও একটু শান্তির দেখা পাচ্ছেন।
অন্যদিকে,বুরাগ মনেমনে আওড়াতে লাগলো,ঠিক বলেছো মা,বেলীকে আমি অনেক ভালোবেসে ফেলেছি।আমার মনে শুধু বেলীর বসবাস।সেখানে আর কারোর স্থান নেই।এমনকি স্নিগ্ধার স্থান টাও বেলী দখল করে নিচ্ছে।
—-
গভীর রাত!রোকসানার এপাশ ওপাশ করেও চোখে ঘুম আসছে না।একটা ফোনের জন্য কতোক্ষণব্যাপী অপেক্ষা করে আছে।পাশেই বুড়ো দাদি ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছে।হঠাৎ করেই শেয়ালের ডাকে রোকসানা কিছুটা চমকে উঠলো।বুকে থুতু দিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলতে লাগলো,
কখন থাইকা অপেক্ষা করতাছি ওর ফোনের লাইজ্ঞা।কিন্তু,তার ফোন দেওয়ার খবরেই নাই।বালের ছেড়া কই যে গেছে তাও জানি না।আমারে একটু জানায় গেলে কি হইতো।আমার কি চিন্তা হয় না।কতো কষ্ট কইরা পথের কাটা সরাইছি ভাবছিলাম রাজরানি হমু কিন্তু,সেই আশা আমার নিরাশা হইয়া গেছে।

বুড়ো দাদির নাক ডাকার শব্দে যেনো রোকসানার আরো বিরক্তি ধরে যাচ্ছে।বালিশের নিচ থেকে বাটন ফোন টা বের করে নিলো।ফোনের বাটন গুলোও পড়ে গিয়েছে।পিছনের ব্যাটারি টা একটা শক্ত কাগজ দিয়ে আটকানো।ফোনটা নিয়ে অনেক কষ্টে বাটনে চাপ দিয়ে দেখে নিলো কোনো ফোন এসেছে কিনা।একরাশ বিতৃষ্ণা নিয়ে ফোনটা রাখতেই আলো জ্বলে উঠলো।ফোনের আলোয় কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির নাম্বার টা দেখে রোকসানার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।তড়িঘড়ি করে ফোনটা কানে চেপে ধরে বলতে লাগলো,

–“ওই কই আছো তুমি।আমার খুব চিন্তা হইতাছে তোমার জন্য।”

ফোনের অপাশের ব্যক্তিটি শরীরের আড়মোড়া ভেঙে আয়েসি ভঙ্গিতে বললো,

–“আমি জব্বর আছি।আগে কও ওই জায়গার কি অবস্থা এহন।”

রোকসানা মুখ ভেঙচি মেরে বললো,

–“এতোক্ষণে ফোন দিয়া তুমি এহন শিউলিগোর বাড়ির খবর নিতাছো।তুমিই তো জানো কি খবর হইতে পারে।শিউলিরে মাইরা ফেললা কেন করিম।”

ফোনের অপাশে করিম বিকট হাসিতে মেতে উঠলো।হাসতে হাসতে বললো,

–“কি আর করমু।আমার শরীরের তেজ মিটাইছি ওরে মাইরা।চাচির কি অবস্থা!খুব দেখতে মন চাইতাছে।”

–“তুমি যেমন চাইছিলা তার থাইকা বেশি দূর্বল হইয়া গেছে চাচি।বেচারি সহ্য করতে পারতাছে না।ইসস!নাও মারতে পারতা আমগোর শিউলিরে।”

–“এতো দরদ কবে থাইকা হইলো তোমার শিউলির প্রতি।ভুইলা গেছো শিউলিরে মারতে তুমিও তো উইঠা পইড়া লাগছিলা।মাথার পিছনে তো বাঁশ দিয়া বাড়িটা তুমিই দিছিলা।অবশ্য,এতে আমার কাজ ডা অনেক সহজ হইছে।”

রোকসানা মুচকি হেসে বললো,

–“তুমি বুঝো না!আমি তোমারে ভালোবাসি।আর তুমিও তো আমারে ভালোবাসি।আমাদের পথের কাটা ছিলো ওই শিউলি।এইজন্য তো ওরে পথ থাইকা দূরে সরাইয়া দিছি।দরদ তো একটু অভিনয় কইরা দেহাইলাম বুঝো না।এহন কও,আমারে কবে বিয়া কইরা ঘরে তুলবা তুমি।”

–“একটু সময় লাগবো আমার।ওইদিকের খবর দিও কখন কি হয়।সবকিছু ঠান্ডা হইলে নিজের বাড়ি আইসা তোমগোর বাড়িতে বিয়ার প্রস্তাব পাঠামু।”

–“হ!ঠিক কইছো।পুলিশ আইছিলো তো।চাচি তোমারে খোঁজার জন্য পুলিশরে কইছে।তহন!আমার পরাণ যায় যায় অবস্থা।”

করিম আবারও বিকট হাসিতে মেতে উঠলো।এমতাবস্থায় বললো,

–“চাচির তেজ দেহা যায় এহনও যায় নাই।যাই হোক,পুলিশ আমারে কিছুই করতে পারবো না।আব্বায় সামলাই নিবো।আইচ্ছা!বেশিক্ষণ কথা কওয়া যাইবো না।সময় বুইজ্জা আমিই তোমারে ফোন দিমু।”

করিম ফোনটা কেটে দিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলো।সিগারেট ঠোঁটে চেপে ধরে বললো,কতো মাইয়া আমারে বিয়া করতে চায় কিন্তু বেলীডা একবারও আমার দিকে তাকাইলো না।নিজের বোইন ডাও প্রাণ দিয়া দিলো।বেচারি শিউলি!!

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here