#উপন্যাস_প্রপর্ণ(৩৩)
#কুরআতুল_আয়েন
জাবেদা হাতে স্টিলের বাটি নিয়ে কলপাড়ে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই বাড়ির সামনের সরু রাস্তাটায় পুলিশদের কে দেখে কিছুটা চমকে উঠলেন।বারান্দার নিভু নিভু লাইটের আলো দিয়ে জাবেদা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন পুলিশের দলটাকে।উনাদের বাড়ির দিকেই আসছে।কিন্তু এই রাতের বেলায় তাঁদেরকে এইখানে দেখে জাবেদার বেশ খানিকটাই খটকা লাগছে।জাবেদা তাড়াতাড়ি করে মাথায় শাড়ির আঁচল টা টেনে নিয়ে ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন।
অলি সাহেব তখন হিসাবনিকাশ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।জাবেদা কে তাড়াহুড়ো করে ঘরে আসতে দেখে জাবেদার দিকে একপলক তাকিয়ে বললেন,
–“এইভাবে তাড়াহুড়ো করে হাঁটছো কেনো জাবেদা।কোনো কিছু হয়েছে নাকি।”
অলি সাহেবের কথার পিঠে জাবেদা কিছু বলছেন না।উনি শুধু সারা ঘর জুঁড়ে পায়চারী করছেন।একবার ঘরের এই মাথায় তো আরেকবার ঘরের ওই মাথায়।অলি সাহেব এবার বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন।হিসাবনিকাশের খাতা বিছানার উপর রেখে দিয়ে জাবেদার দিকে এগিয়ে গেলেন।জাবেদার কাঁধ ঝাঁকিয়ে পুনরায় বলতে লাগলেন,
–“আরে!জাবেদা এইভাবে সারা ঘর ঘুরছো কেনো।কি হয়েছে তা বলবে তো।’
জাবেদা এবার মুখ খুলেছেন।ঠোঁটে রোদের মতো ঝিলিক মারা এক হাসি টেনে বললেন,
–“জানেন!এইমাত্র বাড়ির সামনের সরু রাস্তাটায় আমি পুলিশদেরকে দেখেছি।আমাদের বাড়ির দিকেই আসছে।তার মানে কি শিউলির খুনের কিছু ভালো সংবাদ নিয়ে এসেছে।না হলে,এতো রাতে আসার কি দরকার ছিলো তাঁদের!!”
অলি সাহেব খানিকটা সময় নিয়ে ভেবে দেখলেন!তবে কিছু বললেন না।জাবেদাকে তাড়া দিয়ে বললেন,
–“চলো তো বাহিরে গিয়ে দেখি।”
অলি সাহেবের কথা শুনেই জাবেদা আগে বের হয়ে গিয়েছেন।অলি সাহেব জাবেদার দিকে একপলক তাকিয়ে বিরবির করে বললেন,মা’য়ের মন তো সন্তানের জন্য সবসময় অস্থিরতায় ভরপুর থাকে।
আশাকুঞ্জ নিবাসে একটি গোল বৈঠক তৈরি হয়েছে।জাবেদার চোখে ভেসে উঠেছে তীব্র ক্রোধ আর রাগ।এতোদিনের মনে আশা পূরণ হতে চলেছে।আজকে যাই কিছু হয়ে যাক না কেনো কিছুতেই ছাড়বেন না উনি করিমকে।প্রতিশোধ নিবেন শিউলির মৃত্যুর।পুলিশের মুখে যখন শুনেছিলেন করিমের দেখা পেয়েছেন তাঁরা, তখন থেকেই জাবেদা অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে বসে আছেন।এমনকি সেই থেকেই জানতে পেরেছে আজকে মাঝরাতের দিকে করিম তাদের বাড়ির দিকে রওনা দিবে।তাঁরা কোনো রিস্ক নিতে চান না তাই এই মাঝরাতেই করিমকে ধরার জন্য সবকিছু প্রটেকশন নিয়ে তাঁরা চলে এসেছেন আশাকুঞ্জ নিবাসে।অলি সাহেবের চোখেও ক্রোধ ভেসে উঠেছে।তবে,উনি পুলিশের উপর বিশ্বাস করছেন।যা হবে ভালোই হবে।আর,মনে আরো একটা শান্তি পাচ্ছেন করিমের খোঁজ পেয়ে।শিউলির খুনের শেষ পরিণতি এবার ঘটবে।
মাঝরাতের দিকেই হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি পড়ায় রাস্তাঘাট কাদায় ভরে উঠেছে।এই কাদাযুক্ত রাস্তা দিয়ে করিমের সামনে এগিয়ে আসতে খুব কষ্ট হচ্ছে।তাও,পা টিপে টিপে অনেকটা এগিয়ে এসেছে।এইতো সামনের মাঠটা পেরুলেই তাদের বাড়ি।করিম একরাশ আনন্দ নিয়ে সেদিকেই এগিয়ে যেতে লাগলো।কিন্তু কিছুটা পথ এগিয়ে যেতেই চোখের উপর আলো পড়তেই করিম চোখ,মুখ খিঁচিয়ে বন্ধ করে নিলো।প্রথমে ভেবেছিলো বর্জ্রপাত হবে কিন্তু,বর্জ্রপাত হওয়ার কোনো শব্দ না পেয়ে করিম ভয়ে চোখ মেলে তাকালো।চারপাশের টর্চের আলো তাকে ঘিরে নিয়েছে।করিম ভেবে পাচ্ছে না এরা কারা হতে পারে।উল্টো দিকে দৌড় দিতে গেলেই একজন পুলিশ কর্মকর্তা চেঁচিয়ে বললেন,
–“এক পাও আগাবি না তুই।তোর খেলা শেষের দিকে।”
করিমের পা দুটো সেখানেই থেমে যায়।আমতাআমতা করে বললো,
–“কিসের খেলার কথা কইতাছেন আপনারা!”
পুলিশের দলগুলো যেনো বেশ মজা পেয়েছে করিমের এই কথায়।বিকট হাসিতে মত্ত হয়ে গেলো তাঁরা।এমতাবস্থায় একজন বলে উঠলেন,
–“কিরে ভুলে গেলি নাকি!শিউলিকে ধর্ষণ করে মারার খেলা।যার জন্য এতোদিন তুই পলাতক ছিলি।”
করিমের পা দুটো অনবরত কেঁপেই যাচ্ছে।এই বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকেও তার শরীর বেশ জ্বালাপোড়া করছে।তাহলে সবাই জেনে গিয়েছে সে শিউলিকে মেরেছে।সবাই যেহেতু জেনেই গিয়েছে সেই সুবাদে করিম হিরো গিরি দেখিয়ে বলতে লাগলো,
–“ওরে মাইরা বেশ করছি।প্রতিশোধ নিছি আমি।কি হইতো বেলীরে আমার সাথে বিয়া দিলে।আমি কি ওরে সুখী করতে পারতাম না।আজকে,যদি বেলী আমার হইতো তাইলে কি আমি শিউলিরে ওইরম কইরা মাইরা ফেলতাম!!কখনোই না।কিন্তু,চাচি আমারে বুঝলো না।আমার সব বুদ্ধি চাচি পানিতে ডুবাইয়া দিলো।ভাবছিলাম বেলীর গোসলখানায় উঁকি দিছি কথাটা গ্রামবাসীরে শুনাইয়া দিয়া বেলীর বদনাম করমু।পরে,চাচি বাধ্য হইয়া আমার লগে বেলীরে বিয়া দিবো।কিন্তু,চাচি কি করলো ওই বুরাগের লগে বিয়া দিয়া দিলো।তাই তো আমি শিউলিরে আমার প্রেমের নেশায় মত্ত করছিলাম।তবে,একটা কথা কমু শিউলি অনেক বোকা।বেচারি আমারে বহুত ভালোবাসতো আর বিশ্বাস করতো।না হইলে কি,মেলার কথা কইয়া আমার লগে ঘুরতে যাইতো।সেদিন সব ঠিক কইরা রাখছিলাম আজকাই শিউলিরে উপরে পাঠাই দিমু।যেইডা ভাবছি ওইটাই হইছে।যখন এক একটা ব্লেইডের আঁচড় দিতাছিলাম না কি শান্তি যে লাগতাছিলো আমার মনের ভিতর কইয়া বুঝাইতে পারমু না।”
করিম আর কিছু বলার আগেই গালে একটা থাপ্পড় পড়লো।আচমকাই থাপ্পড় পড়ায় করিম কিছুটা পিছিয়ে যায়।সামনে একজন পুলিশের কর্মকর্তা কে দেখে করিম শুধু এক টুকরো মুচকি হাসলো।
পুলিশের কর্মকর্তা টা রেগে গিয়ে বললেন,
–“তুই তো মানুষ না!তুই একটা জানোয়ার।কীভাবে পারলি শিউলির সাথে এইরকম একটা কাজ করতে।ও তো ছোট ছিলো।কতোটা যন্ত্রণা সহ্য করেছে ও!তুই কি বুঝতে পারছিস কুত্তার বাচ্চা!”
করিম তেড়ে এসে বললো,
–“যা করছি বেশ করছি!!প্রতিশোধ নিছি আমি।বরং,আমি ওরে আরাম দিয়া খুন করছি।ভালো কইরা শরীরে আঁচড় দিতে পারি নাই তো।ওরে আরো কষ্ট দেওয়া ঠিক ছিলো।ওর ভাগ্য ভালো ওই কষ্ট থাইকা বাঁইচা গেছে।তবে,শরীরের জ্বালা আরো মিটতো যদি শিউলির জায়গায় চাচি থাকতো।
প্রতিটি মানুষ করিমের কথায় ঘৃণিত চোখে তাকালো।কথাগুলো বলেই করিম পাগলের মতো বিকট হাসিতে মেতে উঠলো।তার কিছুক্ষণের মধ্যেই করিমের গলায় এক কুপ বসিয়ে দিলেন জাবেদা।করিম গগণ বিদারী চিৎকার দিয়ে উঠলো।টর্চলাইটের আলোতে করিম জাবেদাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।জাবেদাকে বেশ ভয়ংকর দেখাচ্ছে।চোখ গুলো রক্তের মতো লাল হয়ে আছে।মুখে মুখে বিন্দু বিন্দু পানির ছোঁয়া।সেই সাথে মুখে তীব্র ক্রোধের ছাপ।
করিম হাত বাড়িয়ে জাবেদা কে ধরতে গেলেই জাবেদা করিমের হাত কেটে দেন।মুহুর্তেই রক্ত ছিটকে গিয়ে জাবেদার চোখে মুখে গিয়ে পড়লো।পুলিশের কর্মকর্তারা জাবেদার দিকে এগিয়ে আসতে নিলেই জাবেদা তাঁদেরকে থামিয়ে দিয়ে বলতে লাগলেন,
–“ওর থেকে প্রতিশোধ একমাত্র আমি নিবো।আমি আমার মেয়েকে কথা দিয়েছি।তার মৃত্যুর প্রতিশোধ শুধুমাত্র আমিই নিবো।শিউলিকে যতোটা কষ্ট দিয়ে মেরেছে তার থেকে দ্বিগুণ কষ্ট দিয়ে আমি ওকে মারবো।আমার হাজতবাস হলেও আমি রাজি।আমার ফাঁসি হলেও আমি মহাখুশি।তার একটাই কারণ,আমি ওকে নিজে মারতে চাই।আর,এর পরেও যদি আমাকে কেউ আটকাতে আসে তাহলে তাকে মারতেও আমি দু’বার ভাববো না।”
পুলিশের কর্মকর্তারা জাবেদার এরূপ রূপ আর চোখের চাহনি দেখে ভয় পেয়ে যান।তাঁরা আর আগানোর সাহসা পান নি।সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন থম মেরে।করিম মাঠের মাঝখানে শুয়ে ছটফট করছে।সামনে তার হাতের বাকি অংশ টা ছটফট করে লাফাচ্ছে।জাবেদা সেদিকে তোয়াক্কা না করেই করিমের আরেক হাতে কুপ বসিয়ে দিলেন।আর বলতে লাগলেন,
–“তুইও যেমন আমার শিউলিকে মেরে প্রতিশোধ নিয়েছিস ঠিক আমিও তোকে মেরে প্রতিশোধ নিচ্ছি।তোর জন্য আমি আমার শিউলিকে হারিয়েছি।রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিস তুই!আমার শান্তি কেড়ে নিয়েছিস তুই।”
জাবেদা চিৎকার দিয়ে উঠলেন।করিমের বুকে কয়েক কুপে মেরে আবারও বলতে লাগলেন,
–“কেনো এইভাবে আমার কোল থেকে শিউলিকে কেড়ে নিয়েছিস।বল না!তোর রাগ তো আমার উপর ছিলো তাহলে আমাকে মেরে ফেলতি।আমার শিউলিকে কেনো কেড়ে নিলি।জানিস মারা যাওয়ার পর ওকে চেনা যাচ্ছিলো না।ফর্সা মুখটা কালো হয়ে গিয়েছিলো।ওর শরীর থেকে পঁচা নর্দমার মতো দুর্গন্ধ আসছিলো।ওর পায়জামা রক্তে ভিজা ছিলো।তুই কতো টা কষ্ট দিয়েছিস আমার মেয়েকে।ঠিক তার থেকেও আমি তোকে বেশি কষ্ট দিবো।আজকের দিনটার জন্য আমি অনেক অপেক্ষা করেছিলাম।অবশেষে আমার অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়েছে।”
জাবেদার কথাগুলো সম্পূর্ণ করিমের কানে গিয়ে ঠেকছে।ছটফট করলেও সে জাবেদার কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে।নিভু নিভু চোখ নিয়ে আবারও তাকিয়ে দেখে নিলো জাবেদার মুখ পানে।আগের থেকে মনে হয় জাবেদাকে আরো বেশি ভয়ংকর লাগছে।জাবেদার এই চেহারা দেখে করিম চট করে চোখ বন্ধ করে নিলো।জাবেদা আর দেরি না করে করিমের বুকে কুপ দিতেই লাগলেন।বুকটা একদম ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছেন।তাও জাবেদা থেমে যান নি!পাগলের মতো করিমের সারা শরীর টাতেই ক্ষতবিক্ষত করেছেন।এক পর্যায়ে জাবেদা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।হাত থেকে বটি টা ধুম মেরে ঘাসের উপর পড়ে যায়।পুলিশের কর্মকর্তাদের আত্না যেনো কেঁপে উঠেছে জাবেদার এরূপ আচরণ দেখে আর করিমের ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখে।
_____
বিছানার এককোণায় বসে বেলী পাগলের মতো কান্না করছে।বুরাগ কাছে আসতে নিলেই বেলী দূরে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে।বুরাগ শিউলিকে কোলে নিয়ে অসহায় চোখে তাকালো বেলীর দিকে।বেলী নিজের চুল খামচে ধরে বসে আছে।ছোট্ট শিউলি খিঁদেয় সেই কখন থেকে কান্না করে যাচ্ছে।বুরাগ বেলীর আর্তনাদ আর শিউলির কান্না কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না।মায়াময় দৃষ্টি নিয়ে বুরাগ শিউলির দিকে তাকালো।খিঁদের তাড়নায় শিউলির মুখটা একদম ছোট হয়ে গিয়েছে।বুরাগ আর না পেরে বেলীর হাত ধরে কেঁদে দিলো।সে কিছুতেই শিউলির মুখটার দিকে তাকাতে পারছে না।ভাঙা ভাঙা গলায় বললো,
–“বেলী!একটু শান্ত হও প্লিজ।একবার শিউলির দিকে তাকাও!তাকিয়ে দেখো ও কীভাবে কান্না করছে।শুধুমাত্র একটু খাওয়ার জন্য।ও তো দুধের বাচ্চা বলো!কেনো ওকে কষ্ট দিচ্ছো তুমি।একটু কোলে নাও না।”
বেলী তাকালো শিউলির ছোট্ট মুখটায়।গোলগোল চোখ দুটো নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।চোখের পাঁপড়ি গুলো ভিজে একদম একটার সাথে আরেকটা লেগে আছে।ঠোঁট দুটো শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে।বেলী বুরাগের কাছ থেকে শিউলিকে কেড়ে নিয়ে নিজের বুকের মাঝে চেপে ধরলো।অসংখ্য চুমুতে ভরিয়ে দিতে
লাগলো শিউলির মুখটা।শিউলি কে বুকে নিয়ে বেলী ডুকরে কেঁদে উঠলো।খুব যেতে ইচ্ছে করিছে বেলীর জাবেদার কাছে।মাঝরাতে হয়ে যাওয়া ঘটনা টা যখন শুনেছে বেলী তখন থেকেই পাগলের মতো আচরণ কর যাচ্ছে।সে তার বোনকে হারিয়েছে এখন তার আম্মাকেও কিছুতেই হারাতে চায় না।বুরাগ বেলীর দিকে তাকিয়ে চোখের পানিটুকু মুছে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো।
দুই দুইটা খুন করেছে জাবেদা।সকাল হতে না হতেই করিমের মৃত্যুর খবর টা যেনো বাতাসের বেগে সারা গ্রাম ছড়িয়ে গিয়েছে।করিমের মা ছুটে আসলেও করিমের বাবা একটিবারের জন্যও করিমের লাশের দিকে ছুটে আসেন নি।বরং,উনি আরো শান্তি পেয়েছেন!অত্যন্ত করিমের জন্য উনার এখন আর ভাবতে হবে না।মরে গিয়েছে মানে!আপদ বিদায় হয়েছে।
অন্যদিকে,,
করিমের মারা যাওয়ার খবর পেয়েই রোকসানা পাগলের মতো দৌড়ে এসেছে করিমের লাশের কাছে।করিমের ক্ষতবিক্ষত শরীর টা দেখে রোকসানা আঁতকে উঠেছিলো।তাও,সেসবের তোয়াক্কা না করেই রোকসানা করিমের লাশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বিলাপ করে বলেছিলো,
–“তুমি আমারে ছাইড়া কেন চইলা গেলা।আমাদের না বিয়া করার কথা ছিলো।তার আগেই তুমি আমারে ফাঁকি দিয়ে চইলা গেলা।দোষ তো আমিও করছিলাম।তাহলে তুমি কেন আমারে একা রাইখা গেলা।আমারেও নিয়া যাইতা তোমার সাথে।শিউলিরে মারার পিছনে তো আমারও হাত আছিলো।তাহলে,আমারে কেন নিলা না তুমি।আমারেও নিয়া যাও তুমি তোমার সাথে।”
ব্যাস!!রোকসানার এই কথাটাই রোকসানার জীবনের কাল হতে দাঁড়ায়।জাবেদা রোকসানার কথাগুলো শুনতেই রোকসানার দিকে তেড়ে এসে বললেন,
–“কি বললি তুই!শিউলিকে মারার পিছনে তোরও হাত ছিলো।তুইও খুনী।”
রোকসানা জাবেদার দিকে এসে চিল্লিয়ে বললো,
–“হ্যাঁ হ্যাঁ!!আমিও খুনী।আমিও খুন করছি শিউলিরে।ও আমার সুখের পথে কেন আইছিলো!আমার আর করিমের মাঝখানে বাঁধা হইতে আইছিলো শিউলি।তাই তো,ওরে মাইরা ফেলার বুদ্ধি টা করিমরে আমিই দেই।এমনকি শিউলির মাথায় বাঁশ দিয়ে আঘাত টা আমিই করছিলাম।”
জাবেদা আর কিছু বলেন নি।পুরো গ্রামবাসীর সামনে পাকাপোক্ত হাত দিয়ে করিমের মতো রোকসানাকেও ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছেন।জাবেদাকে দেখে গ্রামের প্রতিটি মানুষ ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গিয়েছিলো।
এতো কিছু অলি সাহেব চুপ করে দেখেছেন।বুকে উনি অনেক তীব্র ব্যথা অনুভব করছেন।ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারছেন না জাবেদার কাছে।পুলিশরা জাবেদাকে হাতকড়া পড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগলো।জাবেদা মুচকি হেসে তাকিয়ে রইলেন করিম আর রোকসানার লাশের দিকে।একটিবারও জাবেদা নিজের প্রিয় মানুষ গুলোর দিকে তাকিয়েও দেখলেন না।তার একটাই কারণ,তাঁদের দেখলে উনি নিজেকে কিছুতেই ঠিক রাখতে পারবেন না।অলি সাহেবের মুখের দিকে তাকানোর সাহস জাবেদার আর নেই।
জাবেদাকে নিয়ে যেতেই অলি সাহেব চোখ দুটো বন্ধ করে নিলেন।বুকে হাত দিয়ে আবছা আবছা কন্ঠে বলতে লাগলেন,
–“তুমি নিষ্ঠুর জাবেদা!খুব নিষ্ঠুর।আমার কথাটা একটিবারের জন্যও ভাবলে না।আমার কি হবে জাবেদা!তোমাকে ছাড়া আমার একদন্ডও চলবে না।ফিরে এসো জাবেদা!”
আর কিছু বলার আগেই অলি সাহেব নেতিয়ে পড়ে গেলেন।মুহুর্তেই অলি সাহেবের চারপাশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছে।
______
সেদিনের ঘটনার পর এক সপ্তাহ কেটে যায়।অলি সাহেব স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছেন।অন্যদিকে জাবেদা জেলে আছেন।
বেলী এতোকিছু সহ্য করতে না পেরে একদম পাথর হয়ে গিয়েছে।সবসময় মনমরা হয়ে বসে থাকে।এমনকি,ছোট্ট শিউলিকেও বেলী ভালোমতো খেয়াল রাখে না।বুরাগ বেলীর মুখের দিকে তাকাতেও পর্যন্ত পারে না।এইভাবে কেটে যায় আরো কয়েকটা দিন।কিন্তু,দিনদিন বেলী শিউলির প্রতি অবহেলা বাড়িয়ে দিচ্ছে।ছোট্ট শিউলি খাওয়ার জন্য কাঁদতে কাঁদতে একটাসময় ঘুমিয়ে যায়।বুরাগ বেলীর এরূপ আচরণ আগে সহ্য করলেও এখন আর কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না।শিউলির প্রতি অবহেলাও সে মেনে নিতে পারছে না।কিন্তু,বুরাগ বেলীকে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারে না।তার মনে শুধু একটা কথাই কাজ করে,বেলী মানসিকভাবে অনেক দূর্বল তাই এইরকম করছে।
বেলী বিছানায় অন্যমনস্ক হয়ে বসে ছিলো।বিছানার ঠিক মাঝখানে শিউলি শুয়ে শুয়ে খেলছিলো।খেলতে খেলতে শিউলি যে কখন বিছানার কিনারায় চলে আসে তা বেলী একদন্ডও বুঝতে পারে নি।আচমকাই শিউলি ধুম করে নিচে ফ্লোরে যায়।শিউলির গলার আওয়াজ পেয়ে বেলী নিচে তাকিয়েই চমকে উঠলো।বেলী শিউলিকে কোলে তোলে নিবে তার আগেই বুরাগ এসে শিউলিকে আগলে নিলো।পড়ে যাওয়ার কারণে শিউলির কপালের জায়গায় টা লাল হয়ে গিয়েছে।বুরাগ শিউলির দিকে তাকিয়ে বেলীর গালে একটা চড় বসিয়ে দিলো।রাগান্বিত হয়ে বেলীকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“তুই মা হওয়ার যোগ্যই না।ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে যা আমার বাসা থেকে।তোকে আমার সহ্য হচ্ছে না।”
বেলী শিউলির কান্না দেখে কাছে আসতে নিলেই বুরাগ বেলীকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দেয়।আঙুল তুলে শাসিয়ে বললো,
–“খবরদার!আমার মেয়ের দিকে একদম আসবি না।আমি আমার মেয়েকে একাই সামলাতে পারবো।তোর মতো উদাসীন মা’য়ের কোনো প্রয়োজন নেই।যে কিনা নিজের সন্তানকে সামলাতে পারে না!আরে!তুই যদি আমার মেয়েকে খেয়ালেই রাখতি তাহলে তোকে রেখে সে কখনো নিচে পড়ে যেতো না।তোর তো আমার মেয়ের দিকে খেয়ালেই ছিলো না।আর,এখন একদম দরদ দেখাতে আসবি না।”
বুরাগ রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো।সাথে বেলীও বুরাগের পিছু ছুটলো।বেলী যতোই বলছে ও শিউলিকে কোলে নিতে চায় ততই বুরাগ বেলীর কথার অগ্রাহ্য করে চলে যেতে লাগলো।
চলবে..