#উমা [কপি করা নিষেধ]
৩২তম_পর্ব
নির্বাচনের দিন,
অবস্থা ভালো নয়, দেশের রাজনীতি দলের মাঝে এক অরাজকতা তৈরি হয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হবার এবং না হবার জন্য সকল ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। অভিনব সিংহ ছেলের প্রথম নির্বাচনে তাকে সাহস দিতে এসেছে। এদিকে নিজের মনে এক ছাই ছাপা আগুন জ্বলছে। এই প্রথম সে নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছে না। কিন্তু তাতে কিছুই হবে না, অভিনব সিংহ কাঁচা খেলোয়াড় নন। তিনি তার ভিত্তি মজবুত রাখার জন্য সকল পদক্ষেপ নিয়ে রেখেছেন। নির্বাচন শুরু হয়েছে, রুদ্র ভোট দিয়ে পার্টির লোকের সাথে কথা বলছিলো, তখন বাদল এসে তাকে এক পাশে টেনে বলে,
“রুদ্র, সর্বনাশ হয়েছে”
“কি হয়েছে?”
অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করে রুদ্র। বাদল বলে,
“উমা বৌদি বাড়ি নেই, সারাবাড়ি তন্নতন্ন করে খুজেছি কিন্তু তাকে কোথাও পাই নি।“
বাদল হাফাতে হাফাতে কথাটি বললো, এদিকে বাদলের চিন্তিত কন্ঠের বলা কথাটি শুনে চমকে উঠলো রুদ্র। ব্যাগ্র কন্ঠে বলল,
“কোথাও পাওয়া যায় নি মানে?”
বাদল এক নিঃশ্বাসে সব কিছু খুলে বলতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পূর্বে,
মাঘের প্রকোপে রোদের কঠিন তেজ মিইয়ে যাচ্ছে, দক্ষিণের শীতল হিনহিনে বাতাসে উড়ছে উমার কোকড়া চুল গুলো। পদার্থবিজ্ঞানের বইটি খোলা। খাতাটা অবহেলায় তার দিকে চেয়ে আছে, কিন্তু উমার যেনো সেদিকে মোটেই মনোযোগ নেই। মহাকর্ষের অংক কষতে কষতে তার অবুঝ মন খানা অন্য অংক কষতে ব্যস্ত। রুদ্র বেড়িয়ে যাবার পর থেকে একাকীত্বের কালো মেঘ হর্তালে নেমেছে। একাগ্রতা যেনো বাস্পের মতো উড়ে গেছে। ও বাড়িতে থাকলে এতো কষ্ট হতো না। হবে কেনো, সকাল হতেই লক্ষী দেবীর হিনহিনে স্বরটা কর্নকুহরে যেয়ে উত্তেজনা তৈরি করতো। মালিনী দেবীর ঠেস মারা বাক্য আর ফুলির মার মুখড়া স্বভাব। উমার যেনো সবকিছুই বড্ড মনে পড়ছে। ক্লেশ থাকলেও অবাড়িতে মানুষ তো ছিলো, কিন্তু এ বাড়িতে সেই মানুষের বড্ড অভাব। বই এ মুখ গুজে রাখলেও বেশিক্ষন থাকতে পারে না সে। এই তো বিগত এক ঘন্টা যাবৎ কেবল পাঁচ খানা অংক করেছে সে। চিন্তা ছিলো রুদ্রের আসার আগে পুরো অধ্যায় শেষ করবে, কিন্তু হলো কোথায়। সাদা তুলোর মতো উড়ে যাওয়া মেঘের দিকে তাকিয়ে রয়েছে এক রাশ উদাসীনতা নিয়ে। উমার উদাসীনতা বাড়ার আগেই নিচের কলিংবেল বাজলো। এ এক অন্য জিনিস, গ্রামে থাকতে এই কলিংবেলটি শুধু ভ্যান এবং রিক্সাতে দেখেছিলো সে। এখানে একটা কলিংবেল আছে। রুদ্র তাকে সর্বদা দরজা আটকে রাখতে বলেছে। যে আসে সে এই কলিংবেল বাজায় উমা “কে” বলে হাক দেয়। বাহিরের মানুষটির কন্ঠ চেনা মনে হলেই সে দরজা খুলে। উমার বইটি বন্ধ করে নিচে নামে। কোমল কন্ঠে বলে,
“কে?”
“বৌদি আমি, শাবীব”
শাবীবের রুদ্রের বন্ধু, শুধু বন্ধুটি বললে কম হবে। তার দোকানের হিসাব ও সেই দেখে। বাদল, রক্তিম, শাবীব এই তিনজন যেনো রুদ্রের তিনটি ঢাল। বাদলের সাথে রুদ্রের মারপিট লাগলেও সে ক্ষমা চাইবার পর সে তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। কালীগঞ্জের দোকানটিতে তারা তিনজন কর্মরত। শাবীবের কন্ঠ শুনে খানিকটা অবাক হলো উমা। এই সময়টাতে তাদের রুদ্রের সাথে থাকার কথা বলেই তার জানা ছিলো। কিন্তু হুট করেই তার এখানে আগমনটি বেশ অবাক করলো উমাকে। উমা দরজা খুলে অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“এ কি শাবীব দাদা আপনি এখানে?”
“বৌদি, আপনাকে নিতে আসলাম, তৈরি হয়ে নিন”
শাবীবের কথায় চোখজোড়া কুচকে আসলো উমার। বিস্ময় যেনো দ্বিগুন হলো। কোথায় যাবে তারা? কে পাঠিয়েছে শাবীবকে? অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“নিতে আসলেন? কোথায় যাবো আমরা?”
“রুদ্র পাঠিয়েছে, আসলে আজ তো নির্বাচন তাই ওকে বাহিরেই থাকতে হবে। কেন্দ্রে গ্যাঞ্জাম হবার একটা সম্ভাবনা আছে। তাই ও পাঠালো আপনাকে নিতে। বাড়িতে একা একা থাকাটা ঠিক হবে না আপনার”
উমার মনে ঈষৎ সন্দেহ জাগলো। রুদ্র তাকে এমন কিছু বলে নি। তাহলে হুট করে কেনো শাবীবকে পাঠালো। কিন্তু মানা ও করতে পারছে না, রুদ্র অকারণে তো তাকে পাঠাবে না। আর শাবীব রুদ্রের বিশ্বস্ত একজন বন্ধু। সে উমার কোনো ক্ষতি করতে পারে না। তাই ক্ষীন সন্দেহের রেখাটি মুছে ফেললো সে। স্মিত হেসে বললো,
“আপনি দাঁড়ান, আমি তৈরি হয়ে আসছি।“
ঘন্টা খানেক বাদে উমা শাড়ি বদলে এলো। শাবীব একটা জীপ গাড়িতে করে এসেছে। গাড়িটা বেশ নতুন। হয়তো নেতাদের কারোর হবে। তাই বেশী সন্দেহ করলো না উমা। এদিকে, বাদল তার মিনিট পনেরো বাদেই রুদ্রের বাড়ি আসে। বাসার দ্বারে ঝুলতে থাকা তালা তাকে চিন্তায় ফেলে। আশেপাশে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে একটি জীপে করে উমা চলে গিয়েছে। ভয়ের চোটে সে ছুটে যায় রুদ্রের কাছে।
রুদ্র শান্ত চিত্তে সবকিছু শুনলো। কিছুক্ষণ থেমে সে উলটো বাদলকে প্রশ্ন করে উঠলো,
“তুই আমার বাড়ি কেনো গিয়েছিলি?”
রুদ্রের প্রশ্নে খানিকটা থতমত খেয়ে গেলো বাদল। আমতা আমতা করে বললো,
“আমি গিয়েছিলাম দোকানের চাবি নিতে। তুই তো বলেছিলি বৌদিকে দিয়ে আসবি”
রুদ্র শান্ত দৃষ্টিতে বাদলের দিকে তাকিয়ে রইলো, তার কথাটা ঠিক বিশ্বাস হলো না রুদ্রের। কিন্তু এখন সবথেকে প্রধান প্রশ্ন উমা কোথায়? কার জীপে উঠেছে উমা? উমা এতটা বোকা নয় যে অপরিচিত কারোর সাথে চলে যাবে। রুদ্রের চোখ গেলো অভিনব সিংহের দিকে। তিনি নির্বাচন অফিসারের সাথে বেশ হেসে হেসেই কথা বলছেন। রুদ্র জায়গা থেকে নড়তে পারছে না। নিজের মেম্বার হওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না। ভয়টি রকিবুল মাস্টারকে নিয়ে। রকিবুল মাস্টারের বিরোধীরা ভোট চুরির পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে আছে। তার মাঝে তার বাবাও রয়েছে। অভিনব সিংহ চান না নির্বাচন টি সুষ্ঠুভাবে হোক। রকিবুল মাস্টার চেয়ারম্যান হোক সেটা সে কখনোই চান না। অপর পক্ষে রুদ্র চায় যেনো রকিবুল মাস্টার চেয়ারম্যান হন। এই মানুষটি গোবেচারা দেখালেও চরম ধূর্ত, সেকারণে সে চায় যেনো এই মানুষটি তার বাবার জায়গায় আসুক। তাই সে এখান থেকে সরতে চাচ্ছে না। কিছুক্ষন পর নির্বাচন শেষ হবে, ব্যালোট গোনা হবে। তাই চাইলেও রুদ্র সরতে পারছে না। বাদল চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“বৌদিকে খুজতে যাবি না?
“দেখছি”
শান্ত কন্ঠে কথাটা বললো রুদ্র। রুদ্রের মস্তিষ্কে কি চলছে তা আন্দাজ করতে পারলো না বাদল। এদিকে শাশ্বত এই কেন্দের রিপোর্টিং এর জন্য সকল কেন্দ্রে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই কেন্দ্রেও এলো সে। তাকে দেখেই রুদ্র গেলো তার কাছে। বাদল তার সাথে আসতে চাইলে রুদ্র করা কন্ঠে মানা করে দিলো। শাশ্বত রুদ্রকে দেখেই বলল,
“কি অবস্থা? কে জিতবে?”
“মাস্টার জেতার সম্ভাবনা বেশী। কিন্তু একটা ঝামেলা হয়েছে”
“কি?”
রুদ্র খানিকটা বসা গলায় বললো,
“কেউ উমাকে অপহরন করেছে”
কথাটা শুনতেই থমকে গেলো শাশ্বত। রুদ্রের চোখজোড়া এক অজানা ভীতি দেখতে পেলো শাশ্বত। কিন্তু ভীতিটি উমার জন্য কি না ঠাহর করতে পারলো না।
জিপ থামলো অজানা এক জায়গায়। উমার জায়গাটি চেনা নেই। শাবীব গম্ভীর স্বরে বললো,
“বৌদি, থেমে পড়ুন”
শাবীবের কন্ঠে গায়ে কাটা দিলো উমার। বক্ষস্থলে এক অজানা ভয় তাকে আষ্টেপিষ্টে ধরলো। কন্ঠে জড়তা এলো উমার। কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“এটা কোথায় শাবীব দা?”
“নামুন, জেনে যাবেন”
“উনি কোথায়? উনাকে তো দেখছি না”
“রুদ্র সময় হলে ঠিক আসবে। আপনি ভয় পাবেন না। থেমে আসুন”
শাবীবের কন্ঠে শীতল, শীতল কন্ঠ উমার হৃদয়কে আরোও বেশি ভীতু করে তুললো। তার সন্দেহ হলো, শাবীব এখানে তাকে শুধু শুধু আনে নি। খুব বড় কিছু ঘটতে চলেছে। উমা মাথানত করে জীপ থেকে নামলো। খুব পুরোনো একটি জায়গা, ভাঙ্গা বাড়ি। সূর্যালোকেই গা ছমছম করছে, না জানি সন্ধ্যের পর কিরুপ দেখাবে। লাল বাড়িটির জানালা, দরজা কিছুই নেই। ভাঙ্গা অংশে মস, ফার্ণের বসবাস। পরগাছা থেমে এসেছে দেয়াল ভেদ করে। এই বাড়িতে কোনো শুভ মতলবে তাকে আনা হয় নি সেটা বুঝতে বাকি রইলো না উমার। উমার নিজের মস্তিষ্ককে প্রস্তুত করলো তার পালাতে হবে। শাবীব তার পাশেই চলছিলো। তার খেয়াল অন্যদিকে যেতেই উমা পালানোর জন্য ছুট লাগালো। কিন্তু তার ইচ্ছে থাকলেও সফল হতে পারলো না। যেই না পালাতে যাবে অমনি পেছন থেকে সজোরে কেউ আঘাত করলো তাকে। প্রচন্ড ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলো উমা। চাহনী ঝাপসা হতে লাগলো। ক্রমেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে…………………
চলবে
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ আগামীকাল রাতে দিবো।]
মুশফিকা রহমান মৈথি
৩১তম পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/434482131606898/