উমা [কপি করা নিষেধ] ৩১তম_পর্ব

উমা [কপি করা নিষেধ]
৩১তম_পর্ব

ষোড়শীর শান্ত বাক্যে কি জানি ছিলো। কঠিন রুদ্রের চোখের কোনায় আবেগ জমলো। আপ্লুত হৃদয় যেনো আজ বাধ মানছে না। হাতের খোলা বাধন হলো শক্ত, সুগভীর। কাঁপা কন্ঠে বললো,
“সর্বগ্রাসী অগ্নির ন্যায় তুমি
যতবার ছুয়ে যাও
ততবার পুড়ি
ছারখার হই
তবুও খেই হারা পথিকের ন্যায় বারে বারে তোমার কাছে আসি
চরম অবহেলায় বুজে আসা আখির নেত্রে শুধু তোমাকেই রাখি
ভঙ্গুর হৃদয়ের শুধু একটাই বুলি
ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি”

রুদ্রের চোখের পানে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো উমা। চোখ থেকে নোনাজলের স্রোত গড়িয়ে পড়লো, কোমল গাল জোড়া ভিজে এলো। এই জলের উৎস কোনো বেদনা কিংবা বিষাদ নয় বরং প্রশান্তির উষ্ণ পরশ। রুদ্র উমার দিকে আবেগপ্রবন চাহনীতে তাকিয়ে রইলো। প্রবল আকাঙ্ক্ষায় তৃষিত হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠলো। তীব্রর নিষিদ্ধ ইচ্ছা ডানা মেললো সংগোপনে। বাধাহীন মিলনে লিপ্ত হলো কপোত কপোতী। শীতল মাঘের প্রকোপের মাঝে দুটি হৃদয়ের অবাধ্য ভালোবাসায় উষ্ণ হয়ে উঠলো শীতল ঘরটি।

এখানের হেসেলটি গ্রামের মতো না, গ্যাসের চুলো অথচ ম্যাচ লাগে না। বেশ দাম দিয়ে কিনেছে রুদ্র। শহরের ধাচে অনেকটাই সাজানো গুছানো। উমা রান্না সেরে তারপর যায় কলেজে। রুদ্র নির্বাচনের কাজে তাড়াতাড়ি বের হয়। তাকে খাবার প্যাকেট করে দিতে হয়। নয়তো বান্দা বাসায় আসে সেই রাতে, কাজের টানে খেতেই ভুলে যায় সে। বেশ কর্মঠ হয়েছে রুদ্র। সকাল সকাল বেরিয়ে দোকানে যায়, সেখানে কাজ সেরে পরিষদের অফিসে যায়। আগের ন্যায় বেলা অবধি ঘুমোয় না সে। উমার তাই রান্নাটা সকালেই সেরে ফেলতে হয়। উমার কলেজ শেষ হয় একটা নাগাদ, তারপর প্রাকটিক্যাল থাকলে থাকতে হয় নয়তো বাড়ি চলে আসে সে। বাসায় এসে একা একা ই খেতে হয় তার। রুদ্র টেলিফোন লাইন নিয়েছে, তাই মাঝে মাঝে রাজশ্রী এবং গোপালের কন্ঠটি শোনার ভাগ্য হয় তার। আগে মনে হতো চেয়ারম্যান বাড়ি বন্দী শালা কিন্তু এখন এই বাড়িটিকে বন্দীশালা লাগে তার। ও বাড়িতে শাশুড়ী ছিলেন, পিসি ছিলেন, সবথেকে বড় ফুলির মা ছিলেন। ফুলির মা মানুষটার সাথে সুখ দুঃখ ভাগ করতে ভালোই লাগতো তার। কিন্তু এখানে সারা বাড়ি জুড়ে দুটো জীব। একজন কাজের মহিলা আছেন, কিন্তু সে ছোটা কাজ করে। তার নখরা অন্যরকম। উমা কতোবার বললো,
“মাসি, স্নান করে পুজোর ঘর কুড়িয়ো”

কিসের কি, চল্লিশোর্ধ্ব মহিলা হিনহিনে স্বরে সাফ মানা করে দিলেন,
“তোমার এক ঘর কুড়োতে আমার স্নান করতে হবে? দুবার স্নান করবো নাকি?”

উমাও তেজ দেখিয়ে বলেছে,
“তাহলে আমার পুজোর ঘরে তুমি পা দিবে না।“

উমাকে আজকাল গিন্নী গিন্নী ঠেকে রুদ্রের কাছে। ও বাড়িতে একটা মোবাইল কিনে পাঠিয়েছে, কিন্তু নে্টওয়ার্ক না পাবার কারণে পনেরো হাজার টাকার যন্ত্রটি হয়ে গেছে নির্জীব জড় পদার্থ। উমা চিঠি লেখে, তার চিঠি লিখতে খুব ভালো লাগে। রাজশ্বীর বেশ ভালোভাবে পড়তে পারে বিধায় তার দায়িত্ব চিঠি পড়ে সবাইকে শোনানো। লক্ষী দেবী ছেলের জন্য ব্যাকুল হয়েছেন। কিন্তু কাজের চাপে রুদ্রের ও বাড়ি যাওয়া হচ্ছে না। যদিও কারণটি সেটি নয়। আসল কারণটি উমার জানা নেই। রুদ্র স্নান সেড়ে কালো একখানা শার্ট পড়েছে। লোকটিকে দেখতে একেবারে উত্তম কুমারের ন্যায় লাগছে। ফর্সা মুখে চাপ দাঁড়িটি বেশ চমৎকার বানিয়ে। উপরে ঘোলাটে চোখে এক অজানা আকর্ষন। টেবিলে বসে সে হাক দিলো,
“কই গো, নাস্তা দাও। দেরী হয়ে যাচ্ছে তো।“
“দেরী টি কি আমার জন্য হচ্ছে?”
“বাহ রে আমি কি করলুম? সকালে দুবার স্নান আমার কার জন্য করা লেগেছে শুনি?”

উমা চোখ গরম করে ঈষৎ রাগান্বিত কন্ঠে রুদ্র দমলো। হ্যা, দোষটি বেশিরভাগ ই তার। কিন্তু উমার ও রয়েছে, কে বলেছে এতো মায়াবিনী হতে? রুদ্র অপরাধীর ন্যায় মাথা নত করে বলল,
“নব্বই ভাগ নিলেও দশ ভাগ দোষ তোমার আছে”
“কি করে শুনি?”
“এতো সুন্দরী বউ থাকলে ভালোবাসতে ইচ্ছে হবে না?”
“তাহলে হোক দেরী, আমি তো মা দূর্গা নই। আমার দুটো হাত।“

স্পষ্ট স্বরে কথাটা বললো উমা। রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“এজন্যই বাবাকে বলেছিলাম, বাচ্চামেয়ে বিয়ে দিয়ো না। এরা বড্ড ঝগরুটে”
“তা কে বলেছিলো শুনি, ভরা লোকের সামনে আমাকে সিঁদুর পরাতে?”

উমা ছেড়ে দেবার পাত্রীটি নয়। সে তার বিতর্ক যুদ্ধে আজ রুদ্রকে পরাজিত করবেই। রুদ্র উঠে তার পেছনে দাঁড়িয়ে বললো,
“সেখানেও কোথাও না কোথাও তোমার দোষ, কে বলেছে এতো মায়াবন বিহারিনী হতে?”
“হয়েছে, টেবিলে বসুন। আলুরদম হয়ে গিয়েছে।“
“আজ, লুচি আলুর দম?”
“হ্যা, ভাত হতে একটু দেরি হবে। হলেই টিফিনে পুড়ে দিচ্ছি।“

ঠিক সেই সময়ে বসার ঘরে রাখা ফোনটি বেজে উঠে। রুদ্র ফোনটি ধরে। পরমূহুর্তে তার মুখোভাব পালটে যায়। ধীর স্বরে বলে,
“বিকালে দোকানে আসিস, সেখানেই তোর সাথে কথা বলবো আমি।“

ফোন রেখে দিতেই উমা প্রশ্ন করে উঠে,
“কার ফোন এসেছে? গ্রাম থেকে?”
“না গো, নির্বাচনের কাজে”

পুরোপুরি কথাটা এড়িয়ে যায় রুদ্র। উমা সেদিকে মনোবেশ না করে বলে,
“নির্বাচনের কেন্দ্র আমাদের কলেজ ও হয়েছে জানেন?”
“জানি, সেদিন তো তোমার বন্ধ।“
“হ্যা, সারাদিন বাসায় ই তাকতে হবে।“
“আচ্ছা, পড়ালেখা ভালো হচ্ছে তো? মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়া কিন্তু চারটে খানি করা না? বহু মানুষের মধ্যে বাছাই হয়। আর লেটার না পেলে কিন্তু চলবেই না। এখন নতুন কি এক গ্রেড সিস্টেম করেছে। জিপিএ ফাইভ বলে। তাই কিন্তু ভালো করে পড়তে হবে।“

উমা বোকা হাসি দিলো, লোকটির সবকিছুর মাঝেও উমার পড়ালেখার দিকে খোঁজ আছে দেখে বেশ খুশি ই হলো সে। রুদ্র চলে যাবার পর সব গুছিয়ে নিলো। নয়টা বাজলেই রওনা দিবে। আজ নয়টার ক্লাসটি হবে না। নতুন সই, নতুন পরিবেশে মন্দ লাগছে না উমার। পড়াশোনার বেগ ও মন্দ নয়। শুধু একটু বেশি কষ্ট করতে হচ্ছে কারণ সে বড্ড পিছিয়ে আছে।

সূর্য পশ্চিমে হেলে গেছে। চারটা বাজতেই আজকাল বিকেল হয়ে যায়। দোকানে অপেক্ষা করছে রুদ্র। অপেক্ষা শাশ্বতের। শাশ্বত টেলিফোন করেছিলো। খবর নিয়ে জেনেছে শাশ্বত নাকি সাতক্ষীরাতেই বদলি হয়ে এসেছে। তার মনোবাঞ্ছা এখনো জানতে পারে নি যদিও তবে এটা তার জন্য যে শুভ নয় সেটা রুদ্র জানে। শাশ্বত এলো সাড়ে চারটার দিকে,
এসেই হেসে বললো,
“আসলে কাজের জন্য দেরি হয়ে গিয়েছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছিলি কি?”

রুদ্র বিরক্তি প্রকাশ করলো। চোখ কুচকে বললো,
“কেনো এতো জরুরী তলপ?”
“আরে দাঁড়া এতো তাড়া কেনো? একটু বসতে দে। সময় তো আছে”
“দেখ শাশ্বত অহেতুক সময় নষ্ট করার সময় আমার নেই, আজ কাজ শেষ দ্রুত যাবো বাড়ি। উমা একা রয়েছে বাসায়।“
“ওহ, তাহলে ছোট করে বলি। কান টানলে মাথা আসে জানিস তো?”

শাশ্বতের প্যাচানো কথায় চোখ কুচকে আসে রুদ্রের। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে,
“সোজাসোজি বল কি বলতে চাস?”
“এতোকাল অভিনব সিংহ অর্থাৎ মামা মশাই কি কি কার্য সাধন করেছে তার সকল প্রমাণ আমার কাছে আসে। আমি সেটা নিয়ে কাজ করতেই পারি, যেহেতু এখন আমি একজন সিনিয়র রিপোর্টার। কিন্তু আমি সেটা নিয়ে কাজ করলে তোর রাজনীতি জীবনের অংকুরেই বিনাস হবে। আমি বড্ড দ্বিধায় আছি কি করব?”
“আমার থেকে কি চাস, ঝেড়ে কাশ তো”
“মামা মশাই এর পতন গোড়া থেকে। আমি চাইলেও তাকে নাড়াতে পারবো সরাতে নয়, আর তাকে নাড়ালে তোর পতন হবে। আমি চাই না সেটা। কারণ তুই আমার তুরুপের এক্কা।“
“বাবার পেছনে লাগার কারণ?”
“তোকেও তো আমি জিজ্ঞেস করি নি মামার বিরুদ্ধে এতো ষড়যন্ত্র কেনো করছিস?”

রুদ্র বাকা হাসি হাসলো। তার হাসি দেখে শাশ্বত স্পষ্ট স্বরে বলল,
“তাহলে আমাকে সাহায্য করছিস?”
“শর্ত আছে?’
“কি?”
“আমার ঢাল হতে হবে, আমার জন্য নয় উমার জন্য। সেদিন বলেছিলি না সময় হলে ওকে বলি দিবো কি না, আমি সেটা পারব না। কিন্তু শেয়াল কুকুরের ত অভাব নেই, তাই আমার ঢাল হতে হবে।“
“যদি কোন অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকিস তবেই আমার সাহায্য পাবি।“

স্পষ্ট কন্ঠে শাশ্বত কথাটা বললো, রুদ্র উত্তর দিলো না। শুধু হাসলো। তার মস্তিষ্কের ভেতর কি চলছে তা শাশ্বতের অজানা। হয়তো শাশ্বত কখনো জানবেও না এই মাতালটি যে জাতে মাতাল তালে ঠিক_______

নির্বাচনের দিন,
অবস্থা ভালো নয়, দেশের রাজনীতি দলের মাঝে এক অরাজকতা তৈরি হয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হবার এবং না হবার জন্য সকল ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। অভিনব সিংহ ছেলের প্রথম নির্বাচনে তাকে সাহস দিতে এসেছে। এদিকে নিজের মনে এক ছাই ছাপা আগুন জ্বলছে। এই প্রথম সে নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছে না। কিন্তু তাতে কিছুই হবে না, অভিনব সিংহ কাঁচা খেলোয়াড় নন। তিনি তার ভিত্তি মজবুত রাখার জন্য সকল পদক্ষেপ নিয়ে রেখেছেন। নির্বাচন শুরু হয়েছে, রুদ্র ভোট দিয়ে পার্টির লোকের সাথে কথা বলছিলো, তখন বাদল এসে তাকে এক পাশে টেনে বলে,
“রুদ্র, সর্বনাশ হয়েছে”
“কি হয়েছে?”

অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করে রুদ্র। বাদল বলে,
“উমা বৌদি বাড়ি নেই……………

চলবে

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ আগামীকাল রাতে দিবো।]

মুশফিকা রহমান মৈথি

৩০তম পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/434267711628340/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here