উমা [কপি করা নিষেধ] ৩০তম_পর্ব

উমা [কপি করা নিষেধ]
৩০তম_পর্ব

দু দিন পর,
শাশ্বত চেয়ারে বসে রয়েছে। সামনে থাকা গোলাকার পেপার ওয়েটটির দিকে তার নজর। ঠোঁটের কোনায় বিস্মিত হাসি। আজ সকালে খবর পেয়েছে এবার ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে অভিনব সিংহ দাঁড়াচ্ছে না। অথচ রুদ্র মেম্বারের পদে দাঁড়িয়েছে। ব্যাপারটা তাকে শুধু বিস্মিত ই করে নি, বিনোদন ও দিয়েছে। বাপ ছেলে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ছে কিন্তু সংগোপনে। এখন তার সামনে একটা প্রশ্ন, প্রশ্ন টা সহজ। সে কার হয়ে লড়বে এবং কার বিপক্ষে লড়বে! নাকি সে সমাজবাদী পার্টির মতো দুজনের বিরুদ্ধে লড়বে। শাশ্বত গভীর চিন্তায় মগ্ন ঠিক সেই সময় একখানা খাম দিয়ে যায় পিয়ন। খাদি খামটা দেখে খানিকটা অবাক হয় শাশ্বত। অবাক কন্ঠে বলে,
“কে পাঠিয়েছে মন্সুর মিয়া?”
“জানি না স্যার”

পিয়ন চলে গেলে খামটি খুলে শাশ্বত। খামটি খুলতেই হাসির প্রলেপ বিস্তৃত হয় তার। সে বুঝে গেছে কার পাল্লা ভারী। শাশ্বতের মামা মশাই অর্থাৎ অভিনব সিংহ এতোকাল নিজের এক অভেদ্য প্রাচীর গড়েছিলেন। আজ সেই অভেদ্য প্রাচীরে ফাটল ধরেছে। আর এই সূক্ষ্ণ ফাটলের নাম রুদ্র। খামটিতে সেই নীলনকশা রয়েছে যাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে অভিনব সিংহের লংকায় আগুন জ্বলতে বেশি সময় বাকি নেই। কিন্তু রুদ্র এতোটাই ধূর্ত সে ঠিক নিজেকে সেই আগুনের তাপ থেকে বাঁচিইয়ে নিবে। ইতিহাস জানে, নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে ইংরেজ হারালেও সেখানে ঘি ঢেলেছিলো মীর জাফর। অভিনব সিংহের ক্ষেত্রে সেই মীর জাফরটি তার আপন পুত্র রুদ্র। কিন্তু প্রশ্নটি একটি খামটি কে পাঠালো! সে কি চায়! শাশ্বত মনে মনে স্থির করলো সে এখন রুদ্রের সাথে থাকবে, কারণ পরিষদে রুদ্র নিজের এক চ্যানেল বানিয়ে ফেলেছে, সেই চ্যানেল অনুসারে আসছে ভোটে সে শুধু বিজয়ী ই হবে না, আগামী নির্বাচনে তাকে চেয়ারম্যানের পদে দাঁড় করানো হবে। রুদ্র এই রাজনীতিতে এসেছে মাত্র এক মাস, অথচ সে অভিনব সিংহের বিরুদ্ধে বিষাক্ত জাল বুনেছে, যে জালে অভিনব সিংহ পা রাখলেই চোরাবালির ন্যায় তলিয়ে যাবে। তবে শাশ্বতের একটি ব্যাপার কিছতেই মাথায় ঢুকছে না, ছেলে হয়ে নিজের পিতার বিরুদ্ধে এতো ভয়ংকর ষড়যন্ত্র রুদ্র কেনো করছে! কি এমন কারন রয়েছে যার জন্য রুদ্র ই অভিনব সিংহ এর সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হয়েছে, রকিবুল মাস্টার এবার আবারো সাহস করে নির্বাচনে দাঁড়াবেন। এবার তার চেয়ারম্যান হবার সম্ভাবনা অধিক। কিন্তু রাজনীতির চালটি দাবার মতো, ঘোড়ার আড়াই চাল কখন কিভাবে সব এলোমেলো করে দেয় সেটা আন্দাজ করা দুষ্কর। এবার খেলা জমেছে, দেখা যাক এই খেলায় কে বাজীমাত করে!

১৭.
মাঘের মাঝামাঝি, নিন্মচাপের আবির্ভাব বাড়ছে। দুদিন ধরে কেমন নরম আবহাওয়া, মেঘলা আকাশ, সূর্যের প্রভা যেনো কালো মেঘের আধারে কোথাও ঢেকে গেছে। ক্ষণে ক্ষণে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে, শীত ও বেড়েছে। চাদরেও শীত কাটছে না। অনেকে বলছে তাকি ঘূর্নিঝড় হবে, হলেও হতে পারে। বঙ্গোপসাগরের সন্নিকটে এই সাতক্ষীরা জেলার উপর তো কম ঝড় যায় না। আর সবথেকে বেশি ঝুকিতে থাকে গ্রামাঞ্চল। উমার ঘুম প্রতিদিনের ন্যায় আপনাআপনি ভেঙ্গে যায়। শাড়িখান জড়িয়ে স্নানে যায় সে। শীতে স্নান করার পর গায়ে কাটা দেয় ফলে চেয়ারের উপর থাকা লাল কার্টিগানটি গায়ে জড়ায় উমা। ভোরের সূর্য ঢাকা পড়েছে কালো মেঘের আধারে। রুদ্র তখন ও লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুম। উমা আয়নার সামনে দাঁড়ালো ভেজা চুলটা ছেড়ে দিতেই সাপের মতো নেমে এলো কাধ বেয়ে। আয়না দিয়ে রুদ্রের ঘুমন্ত স্নিগ্ধ মুখখানা দেখতে পাচ্ছে সে। কাল রাতের মূহুর্তগুলো জীবন্ত হয়ে যায় উমার চোখে। উমা খেয়াল করো রুদ্রের সান্নিধ্য পেতেই কেমন যেনো নেতিয়ে পরে উমা। মোম যেমন অগ্নির কাছে যেতেই গলে যায়, তার অবস্থাটিও তাই হয়েছে। যে মানুষটির স্পর্শ তাকে বিষিয়ে তুলতো আজ সেই মানুষটির বেষ্টনিতে থাকতে মন আকুল হয়ে উঠে। এ বাড়িতে আসার পর যেনো তা বহুগুনে বেড়ে গিয়েছে। উমার মনে হুট করেই একখানা দুষ্টুমি খেলে গেলো, সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো রুদ্রের দিকে; ভেজা চুলের মাথা থেকে শীতল জলবিন্দু গড়াচ্ছে, সেই চুলগুলো ঝাড়তেই রুদ্রের মুখে পানি ছিটা পড়লো। পৌষের ঠান্ডায় গায়ে কাটা দিলো রুদ্রের। কপাল কুঞ্চিত করে চোখ মেলতেই উমা খিলখিল করে হেসে উঠলো। রুদ্রের রাগ যেনো বাস্পীভূত্ হলো উমার কোমল কল্লোলে, হবে না কেনো ষোড়শী মুক্তদানা হাসি যে তার হৃদয় ভেদ করে। ভোরের উমার স্নিগ্ধতা তার শীতলে হৃদয়ে উষ্ণতার ওম দেয়। রুদ্র ও কম যায় না, হাত টেনে নিজের কাছে টেনে নেয় উমাকে। উমা ভীত কন্ঠে বললো,
“কি করছেন?”

উত্তর দেয় না বরং বাঁকা হাসি হাসে রুদ্র। তারপর শক্ত করে নিজ বেশ বেস্টনীতে নিয়ে অধর ছোয়ায় উমার কোমল অধরে। রুদ্রের এমন কার্যে লজ্জায় লাল হয়ে উঠে উমা। কোমল গালে রক্ত জমে। অধর আলাদা হতেই উমা লজ্জায় বুক গুজে রুদ্রের বুকে। তার হৃদস্পন্দন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। নিশ্বাস ঘন হচ্ছে। রুদ্র ভাবে তার ষোড়শী হার মেনেছে। কিন্তু তার ষোড়শী তাকে অবাক করে দু হাত মেলে জড়িয়ে ধরে তাকে। উমার এমন কার্যে অবাক হয় রুদ্র। কাছে তো আগেও এসেছে সে। প্রতি রাতে আসে, কিন্তু উমা নিজ থেকে কখনোই তার আবেশে নেয় নি রুদ্রকে। বরং সর্বদা একটা ভীত নজরে তার দিকে চাইতো সে। উমার এমন কার্যে অবাক কন্ঠে রুদ্র প্রশ্ন করে,
“কি হয়েছে উমা?”

উত্তরে কেমন ছলছল নয়নে তার দিকে যায় উমা। সেই চাহনী যেনো অনেক কিছু ব্যাক্ত করছিলো। তবুও কন্ঠের তৃষ্ণা রুদ্রকে উতলা করে তুললো, রুদ্র ব্যাগ্র কন্ঠে বলল,
“কাঁদছো কেনো?”

উমা উত্তর দিলো না, শুধু চোখের কোনা দিয়ে এক বিন্দু জল গড়িয়ে পড়লো। রুদ্র গভীর চুম্বন দিলো তার চোখে, পুনরায় বলল,
“বললে না যে কাঁদছো কেনো?”
“আমার ভয় হয়”

এবার মুখ খুললো উমা, রুদ্র আকুল কন্ঠে বললো,
“কিসের ভয়?”
“হারানোর ভয়”
“আমায় হারানোর ভয়? আমি তো জানতাম আমার মত নিষ্ঠুর মানুষটিকে কেবল ঘৃণা করো তুমি। তাহলে এই ভয়টা কেনো?”

রুদ্রের প্রশ্নে থমকে যায় উমা, হ্যা লোকটিকে ঘৃণা করতো। খুব ঘৃণা করতো। এই বিয়ের প্রথম রাত থেকে ঘৃণা করতো। কিন্তু এখন সেই ঘৃণাটি যেনো কোথাও মিলিয়ে গেছে। মনমন্দিরের দ্বারে প্রবল বেগে এই মানুষটি করা নেড়েছে। যা উপেক্ষা করাটা ছোট্ট উমার পক্ষে সম্ভব নয়। লোকোটি খারাপ উমাও জানে, রাগ উঠলে কিছুই মনে থাকে না। কিন্তু এই লো্কটিই তার পেছনে ঢাল হয়ে থাকে। তার জীবনের নিভু দীপখানা জ্বালিয়ে নিকষকৃষ্ণ পথে আলোর কীরন দিয়েছে। এই লোককে কিভাবে ঘৃণা করবে সে। তার জানা নেই ভালোবাসা কি, তার জানা নেই প্রেম কি। তবে এটুকু জানে রুদ্র ছাড়া জীবনটা তার বৃথা। তার মস্তিষ্ক, হৃদয়, সর্বত্র কেবল একজন পুরুষের রাজত্ব, সে কেবল রুদ্র। রুদ্র হাল ছেড়ে দিলো, ভাবলো উমা তাকে কখনোই আপন করে নিবে না। উমার নরম মনে তার বাজে প্রভাব ফেলেছে সে, জোর করেছে ইচ্ছের বিরুদ্ধে। এই মেয়েটি কেনো তাকে ভালোবাসবে। কম অত্যাচার তো করে নি সে। রুদ্রের হৃদয় আহত হয়। সে উমাকে ছেড়ে দিতে নিলেই উমা তাকে অবাক করে আরোও নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরে। ধীর স্বরে বলে,
“যাকে মনে ঠায় দিয়েছি, তাকে ঘৃণা কিভাবে করি”

ষোড়শীর শান্ত বাক্যে কি জানি ছিলো। কঠিন রুদ্রের চোখের কোনায় আবেগ জমলো। আপ্লুত হৃদয় যেনো আজ বাধ মানছে না। হাতের খোলা বাধন হলো শক্ত, সুগভীর। কাঁপা কন্ঠে বললো,
“সর্বগ্রাসী অগ্নির ন্যায় তুমি
যতবার ছুয়ে যাও
ততবার পুড়ি
ছারখার হই
তবুও খেই হারা পথিকের ন্যায় বারে বারে তোমার কাছে আসি
চরম অবহেলায় বুজে আসা আখির নেত্রে শুধু তোমাকেই রাখি
ভঙ্গুর হৃদয়ের শুধু একটাই বুলি
ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি” ………………………

চলবে

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ আজ রাত ১০.৩০ এ দিবো।]

মুশফিকা রহমান মৈথি

২৯তম পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/433168218404956/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here