উমা [কপি করা নিষেধ] ৩৪তম_পর্ব

#উমা [কপি করা নিষেধ]
৩৪তম_পর্ব

১৯.
স্নানঘরের বেসিনে দাঁড়িয়ে গরগর করে বমি করে যাচ্ছে উমা। জল অবধি সহ্য হচ্ছে না তার। বমির দাপটে ছোট মুখখানা আরো বেশি ছোটো হয়ে গিয়েছে। ফর্সা মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। শরীরটা দুর্বল লাগছে, মাথার পেছনটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বেসিনকে ভর করে খুব কষ্টে নিজেকে সামলে নিলো সে। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বখানা মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষন করে নিলো সে। কিছুক্ষণ পূর্বের ঘটনা একই সাথে নাস্তা করছিলো উমা, রুদ্র, রাজশ্বী এবং গোপাল। দুধের গন্ধেই গা গুলিয়ে এলো উমার। অহেতুক সবাইকে বিরক্ত না করে জল খেয়ে নিলো সে। কিন্তু তাতে লাভ হলো না। মুখ চেপে ছুটে আসতে হলো স্নানঘরের দিকে। এই শরীর খারাপটা বেশ কদিন ধরেই হচ্ছে, এতোদিন আমলে নেয় নি। ভেবেছে হয়তো ভাজাপোড়া, অসময় করে খাবার জন্য পেট সহ্য করে নি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ব্যাপারটা সেটা নয়। বিগত দুমাস যাবৎ মাসিক হচ্ছে না তার। উমার মনে তীব্র সন্দেহ বাসা বেধেছে। তার মধ্যে কি নতুন জীবের সঞ্চার হয়েছে? চিন্তার ঘোর কাটলো রুদ্রের আতংকিত কন্ঠে,
“তুমি ঠিক আছো তো উমা? দ্রুত গতিতে উঠে এলে কেনো? উমা, আমার কিন্তু চিন্তা হচ্ছে”
“আমি ঠিক আছি”

ধীর স্বরে উমা কথাটা বললো। তারপর মুখ ধুয়ে বেড়িয়ে এলো সে। উমার শুকনো মুখখানা দেখে আলতো হাতে তার গাল স্পর্শ করলো রুদ্র। চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“মনে হচ্ছে না তুমি ঠিক আছো। বলো তো ডাক্তার ডাকি”
“সামান্য পেট খারাপ হয়েছে, এতে এতো ব্যস্ত হবার কিছুই হয় নি।“
“কোনো কিছুই সামান্য হয় না উমা, সব কিছুর কিছু না কিছু প্রভাব আছে”

রুদ্রের জিদের কাছে হার মানতে হলো উমার। মাথা নাড়িয়ে বললো,
“বেশ, বাবুর যা ইচ্ছে”
“আমি মিনুকে বলছি চিরা ভিজিয়ে দই দিয়ে দিতে।“
“মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করছে না, আর দুধেল জিনিস তো না, গন্ধেই গা গুলোয়”
“তাহলে কলা, চিরা দিতে বলসি, এবার বাহানা দিও না।“

উমা স্মিত হাসলো। তারপর ধীর পায়ে নেমে এলো নিচ তালায়। গোপাল তখন পেট পুজোতে ব্যাস্ত। রাজশ্বীর চোখ উমার দিকে। চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“দিদি, তুই ঠিক আছিস?”
“হু, তোর খাওয়া শেষ?”
“হ্যা, আমার খাওয়া শেষ। তুই কি কলেজে যাবি?”
“আজ উমা যাবে না রাজী, তুমি একাই চলে যাও। আমি গোপালকে স্কুলে দিয়ে আসবো।“

কথার মাঝেই রুদ্র কথাটা বলে উঠে। উমা কিছু বলে না, শরীরটা সত্যি ই চলছে না। আজ কলেজ যাবে না সে। খাওয়া শেষে উমার কপালে উষ্ণ পরশ দেয় রুদ্র, ধীর স্বরে বলে,
“ব্যস্ততা না থাকলে যেতাম না, কিন্তু যেতে হবে কাজ আছে জানোই। তুমি নিজের খেয়াল রেখো।“
“মিনু আছে তো, চিন্তা করবেন না”

রুদ্র, গোপাল এবং রাজশ্বী একত্রে বেরিয়ে পড়লো। উমা মিনুকে ডেকে বললো,
“টেবিলটা গুছিয়ে দাও মিনু”
“খাবার কি এখন ই দিবো দিদি?”
“একটু পরে দিও, খেতে ইচ্ছে করছে না। তোমার পড়াশোনা কতদূর?”
“পড়াশোনা তো ভালো মতোই চলছে দিদি, শুধু অক্ষরে গন্ডগোল খানা বাধছে। স্বর অ আর স্বর আ গুলিয়ে ফেলছি।“
“বাহ গোড়াতেই গলদ বানিয়ে বলছো ভালো চলছে। এ মাসে অক্ষর পার হওয়া হবে না। বিকেলে বই নিয়ে বসো। সারাক্ষন টিভি দেখলে হবে? ডিশলাইন কেটে দিবো ভাবছি।“

মিনু মাথানিচু করে নিলো। সত্যি সে টিভি দেখতে খুব ভালোবাসে। নতুন ডিশলাইন নেবার কারণে তার টিভি দেখার মাত্রাটা বেড়ে গেছে। উমা গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“যাও কাজগুলো করে নাও। আমি উপরে গেলাম”

উমা নিজের রুমের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। শীতল বাতাসে চুল উড়ছে সে। সালটি ২০০৮, পৌষের প্রথম দিন। দেখতে দেখতে চারটি বছর কেটে গেছে। তার এবং রুদ্রের বিয়ের ও চারটি বছর কেটে গেছে। চার বছরে অনেক কিছু বদলেছে, বদলেছে উমাও; প্রতিদিন, প্রতিমূহুর্তে সে আরোও শক্ত হয়েছে, হয়েছে আরোও আত্নবিশ্বাসী। বর্তমানে সাতক্ষীরা কলেজে প্রানীবিজ্ঞানে অনার্স করছে সে। তার ডাক্তার হওয়াটি আর হলো না। ইচ্ছে তো ছিলো, কিন্তু ভাগ্য হাল ছেড়ে দিলো। অবশ্য এতে উমার আফসোসটি নেই। কারণ সে দৃঢ় প্রকল্প নিয়েছে জ্ঞানের অন্ধকার এই প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সরাবেই। একটি কল্যান সংঘঠন নির্মান করে গতবছর সিডরের পর। মানুষের কাছে সাহায্য, শিক্ষা, কর্মস্থলের খোঁজ নিয়ে সে যায়। নাম “ধরনী কল্যান সংঘঠন” অবশ্য এই বুদ্ধিটা রুদ্রের ই ছিলো। রুদ্রের সাহায্য উমা এগিয়ে যাচ্ছে। আজ তার সংঘঠনের সাথে অনেক নারী, পুরুষ, বাচ্চা জড়িত। মিনুও তাদের ই একজন। সিডরের প্রকোপে তার বাবা মারা যায়, লোকটি একজন কাঠুরে ছিলো। মা তো আগ থেকে যমের কাছে ছিলো। এগারো বছরের মেয়েটিকে উমা পায় সংঘঠনের মাধ্যমে। তার যাবার জায়গা ছিলো না বলে সে নিজ গৃহে আশ্রয় দেয়। রাজশ্বী এবং গোপাল উমার সাথেই আছে। রতী গত হয়েছে তিন বছর হয়েছে। কেউ তাকে হত্যা করেছে, কিন্তু খুনীর খোজ মিলে নি। রুদ্র রাজশ্বী এবং গোপাল কে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছে। রুদ্রের ব্যাবসা বড় হয়েছে। তত্ত্ববধায়ক সরকার আসার রাজনীতির অবস্থা পালটে গেছে। অহেতুক কারণে রকিবুল মাষ্টারকে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অভিনব সিংহ ও কয়েকবার জেলে গিয়েছেন, কিন্তু তার পরিচিতির কারণে তাকে আটকে রাখতে পারে নি। রুদ্র এর রাজনৈতিক কোনো ছাপ না থাকায় সে বেঁচে গেছে। তবে সামনের বছরের মাঝামাঝিতে পুনরায় আবারো নির্বাচন হবে, রুদ্র সেটার জন্য প্রস্তুত। এবার অদ্ভুত ভাবে বাপ বেটার মধ্যে যুদ্ধ হবে, অভিনব সিংহ পৌরসভার মেয়র পদের জন্য দাঁড়াবেন। এবং তার বিপরীতে রুদ্র দাঁড়াবে। এই চার বছরে অনেক কিছুই জানতে পেরেছে উমা। বাবা ছেলের ভেতরের যুদ্ধ ও তার জানা, রুদ্র ও বাড়িতে যায় না তেমন। যদি দরকার হয় লক্ষী দেবীকে এ বাড়ি নিয়ে আসে। গোপিনাথপুর আর আগের মতো নেই। অনেক বদলেছে। কালীগঞ্জ ও বলদেছে অনেক। উমা অতীতের খেয়ালে ডুবে ছিলো ঠিক তখন ই তার মোবাইলটি বেজে উঠে। এখন মোবাইল ফোন সকলের হাতে চলে এসেছে। বেকার যন্ত্রটি এখন কাজ করে। উমার কাছেও একটি আছে। উমা মোবাইল ধরতেই শিউলী বলে উঠে,
“উমা, আজ আসবি অফিসে?”
“শরীরটা ভালো লাগছে না শিউলী আপা। আজ বাসায় ই থাকবো ভাবছি”
“তুই আসলে ভালো হতো, জরুরী দরকার ছিলো”
“কেনো কি হয়েছে?”

শিউলির ব্যাকুল কন্ঠে ভ্রু কুচকে আসে উমার। এক রাশ বিস্ময় নিয়ে প্রশ্নটি করে সে। শিউলি তখন ধীর স্বরে বলে,
“শিল্পীর জামাই আবার ওকে মেরেছে”

কথাটি শুনতেই চোয়ালজোড়া শক্ত হয়ে যায় উমার। শিল্পী নামক মেয়েটি তাদের সংঘঠনেই কাজ করে। বেশ ভালো কাথা সেলাই করে সে। সেগুলো রুদ্র শহরে পাঠায়। মেয়েটির বর কিছুদিন পর পর প্রহার করে তার উপর। উমা অনেকবার মেয়েটির বরকে বুঝিয়েছে কিন্তু শোনার ইচ্ছে ই রাখে না সে। উমা ধীর স্বরে বলে,
“আমি বিকেলের দিকে আসছি”
“ঠিক আছে”

শিউলি ফোনটি রেখে দিলো। শিউলী রকিবুল মাস্টারের মেয়ে। এখন অনার্স ফাইনাল ইয়ারে। সে এই সংঘঠনের সেক্রেটারি। উমার সাথে সেও “ধরনী কল্যান সংঘঠন” তৈরিতে সাহায্য করে। তাই এই সংঘটনের সেক্রেটারী হিসেবে সে কর্মরত। উমা ফোন রেখে আকাশের দিকে তাকালো। মিহি বাতাসে তার চুল ঊড়ছে। চোখে দৃঢ় প্রতীক্ষা। আজ একটা শেষ দেখেই ছাড়বে সে।

শাশ্বত সংবাদপত্রের অফিসে বসে রয়েছে। তার প্রমোশন হয়েছে, এখন সে সিনিয়ার রিপোর্টার। কিন্তু ঢাকায় তার যাওয়া হয়। এই সাতক্ষীরার অফিসেই তার কাজ। মামামশাইকে একেবারে বসিয়ে দেবার পরিকল্পনায় ছিলো সে। কিন্তু পারে নি, মামার পরিচিতির কারণে। উলটো সে এবার পৌর মেয়রের পদে দাঁড়াচ্ছে। রুদ্র তার প্রতিপক্ষ। এই চারবছরে বাপ ছেলের বেশ কবার দ্বন্দ ই হয়েছে। অভিনব সিংহের চোরাকারবারি প্রায় ধরা পড়েই গেছিলো। কিন্তু একটুর জন্য বেচে গেছেন তিনি। সময় থাকতে থাকতে সব ব্লাক মানি সরিয়ে ফেলে অভিনব সিংহ। মজার ব্যাপার, শাশ্বতের কাছে এখনো বেনামি খাম আসে। খামে অভিনব সিংহের অপকীর্তির সব প্রমাণ থাকে। কিছু কিছু ধরতে পারে, কিন্তু কিছু কিছু থেকে মুক্তি পেয়ে যায় সে। আজও একটি খাম এসেছে শাশ্ব্তের কাছে। খামটি টেবিলেই আছে। শাশ্বত এখনো জানে না খামগুলো কে পাঠায়। এর কারণ উমার সংগঠন। তাই সবাই চাইছে যেনো এবার রুদ্র পৌর মেয়র হোক। রুদ্রের বৈভব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যাপারটা সন্দেহ জাগাচ্ছে শাশ্বতের মনে। কিন্তু প্রমান পাচ্ছে না। শাশ্বত চিন্তা ছেড়ে খাদি খামটি হাতে নিলো। খামটি খুলতেই তার চোখ কুচকে আসলো, বেশ কিছু পেপার কাটিং। কাটিং গুলো মনোযোগ দিয়ে দেখলো শাশ্বত। তাতে লেখা,
“দারোগা উত্তম চ্যাটার্জির কাটা দেহ পাওয়া গেলো রেললাইনের ধারে……………

চলবে

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে পোস্ট করবো ইনশাআল্লাহ]

মুশফিকা রহমান মৈথি

৩৩তম পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/435819201473191/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here