উমা [কপি করা নিষেধ] ৩৭তম_পর্ব

#উমা [কপি করা নিষেধ]
৩৭তম_পর্ব

হাতের ফাঁকে সিগারেট জ্বালালো রুদ্র। সুখটান দিতে যাবে তখন ই ফোনটা বেজে উঠে। ফোনের নাম্বারটা অচেনা। অচেনা নাম্বার দেখে ভ্রু কুঞ্চিত হয় তার। ফোনটি রিসিভ করতেই মুখোভাব বদলে যায় রুদ্রের। হিনহিনে স্বরে বলে,
“আমি এখন বাড়ি চলে এসেছি, এই ব্যাপারে আগামীকাল কথা বলবো। যে কাজ দেওয়া হয়েছে সেটা হয়ে গিয়েছে?”
“……”
“ভালো, শুনেছি আগামী মাসে বাবার সম্মেলন। সম্মেলনের আগেই আমাদের সব করতে হবে। মনে থাকে যেনো, রাখছি”

বলেই ফোনটা রেখে দিলো রুদ্র। এগিয়ে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ালো সে। প্যান্টে হাত গুজে দৃষ্টি দিলো আকাশের পানে। জানালা দিয়ে পূর্ণ চন্দ্রমার স্নিগ্ধ কিরণ গলিয়ে পরছে ঘরে। আলো জ্বালায় নি রুদ্র। মাঝে মাঝে অন্ধকারে থাকতে খুব ভালো লাগে তার। নিজের ভেতরটায় উঁকি দিতে পারে। অন্তরাত্মার সাথে মাঝে মাঝে পরিচিত হতে হয়, গল্প করতে হয়। লুকানো মাটির ব্যাংকটা ভেঙ্গে দেখতে হয় কি পেয়েছে কি হারিয়েছে। রুদ্র সেটাই করে। মনের আঙ্গিনায় লুকিয়ে রাখা মাটির ঘড়াটা ভাঙ্গে, বিশ্লেষণ করে নিজের দেনা পাওয়া। তারপর আবার নতুন ঘড়া মাটিতে লুকায়। আঙ্গুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেটটা ছাই হচ্ছে ক্রমশ। সে জানে না কতকাল লড়বে। একটা সময় লড়তে লড়তে অস্ত্র ফুরিয়ে যাবে। তখন ক্রমশ তেড়ে আসা তীরগুলো বুকে নিতে হবে। রক্তক্ষরণ হবে, সেই রক্তক্ষরণে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে কিছু স্বপ্ন। এতো ঝড়ের মাঝে একটি জায়গা আছে সেখানে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুদ্র। সেই মানুষটাকে যদি কেউ আঘাত করে মাথা ঠিক থাকে না। হয়তো সেজন্য হাজারো ভুল করে, ভুলগুলো মাঝে মাঝে ভয়ংকর হয়। সেই ভুলগুলোকে পাপ বলে। রুদ্রের আইনের ভয় নেই। ভয় উমাকে হারাবার, উমার চোখে নিজের প্রতি ঘৃণার ঝলক দেখার। যেমনটা চারবছর আগে ছিলো। রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তখন ই দরজা ঠেলে উমার প্রবেশ হয়। এসেই সুইচ অন করে বাতি জ্বালালো উমা। রুদ্র পেছনে ফিরে তাকালো। উমা ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো। ধীর কন্ঠে বললো,
“খাবেন না?”
“গোপাল, রাজশ্বী খেয়েছে?”

নিজের টেবিলে বসতে বসতে রুদ্র জিজ্ঞেস করলো। হাতের সিগারেটের ফিল্টারটি ফেললো ছাইদানিতে৷ উমা তার কাছে এগিয়ে আসলো। এলোমেলো ফাইলগুলো গুছাতে গুছাতে বললো,
“ওদের খাওয়া শেষ, গোপাল ঘুমিয়ে পড়েছে। রাজশ্বী পড়ছে। মিনু ঘুমিয়ে পড়েছে শুধু আমি আর আপনি বাকি”
“ওহ”
“আপনি এখনো রেগে থাকবেন?”
“আমি তো রেগে নেই”

বেশ নির্লিপ্ত কন্ঠে কথাটা বলে রুদ্র। নতুন প্রজেক্টের ফাইল খুলে বসে সে। উমার রাগ হয়। লোকটার এমন গা ছাড়াভাব তার মোটেই ভালো লাগে নি। বকাঝকা করতে ইচ্ছে করলে করো না বাপু! অহেতুক মুখ ফুলিয়ে রাখার কি মানে? উমা এগিয়ে যেয়ে ফাইলটা রুদ্রের হাত থেকে নিয়ে নেয়। উমার কান্ডে এক রাশ বিরক্তি ভরা চাহনীতে তাকায় রুদ্র। উমা তখন রাগান্বিত স্বরে বলে,
“বলেছি তো আর হবে না, শিল্পী আপার কথাটা না শুনলে সত্যি যেতাম না৷ আর আমার শরীর এখন ভালো আছে। দুপুরে খুব লম্বা ঘুমিয়েছি। বিশ্বাস না হলে মিনুকে জিজ্ঞেস করেন”

উমার দিকে কিছুসময় স্থির চাহনীতে তাকিয়ে থাকে রুদ্র। তারপর তর্জনী দিয়ে কিছুক্ষন কপাল ঘষে উমার হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে। তার কোমড় জড়িয়ে ধরে মুখ গুজে রুদ্র। রুদ্রের তপ্ত নিঃশ্বাসে কেঁপে উঠে উমা। কাঁপা হাত বুলিয়ে দেয় রুদ্রের কালো চুলের মাঝে। নিঃশব্দ মূহুর্তগুলো ঘন হতে থাকে। উমা সেভাবেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। রুদ্রের বেষ্টনী খুব শক্ত না, আবার হালকাও না। উমা স্মিত হেসে বলে,
“ভয় পেয়েছিলেন?”
“খুব”
“আর হবে না।”

রুদ্র কথা বলে না। নিঝুম ঘরে নিঃস্তব্ধতার মেলা বসে। রুদ্রের এমন আচারণগুলো আরো মোহে ডুবায় উমাকে। প্রায় নিজেকে একটি প্রশ্ন করে,
“কেনো ভালোবাসে সে রুদ্রকে?”

মন উত্তর দেয়,
“কারণ সে রুদ্র”

উমা স্মিত হাসে। রুদ্র আরো নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরে উমাকে। উমাও পরম যত্নে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

২০.
পড়ার টেবিলের ল্যাম্পখানা জ্বলছে। রুদ্র গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। উমার এই সময়টা পড়তে ভালো লাগে। নিবিড় শান্ত পরিবেশে পড়াটা ভালো হয়। সারাদিন নানা কাজে থাকলেও পড়াশোনার ব্যাপারে বেশ দৃঢ় সে। তাই প্রতিরাতে নিজের পড়াখানা এগিয়ে রাখে। তার ইচ্ছে সরকারী চাকরি করার। জানানেই এই স্বপ্ন কি আদৌও সফল হবে কি না। উমা তার প্রানী বিজ্ঞানের মোটা বইটা খুলে বসে। পাতা উলটাতে উলটাতে হঠাৎ থেমে যায়। হলুদ রঙ্গের খামটা চোখে পড়ে তার। খামটিতে কি আছে সে ভালো করেই জানে। নিখিলের সেই চিঠিটা এখনো কাছে রেখেছে সে। উমা বুকের বা পাশের চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করে। কাঁপা হাতে চিঠিটা খুলে সে। এলোমেলো হাতের লেখা। মাত্রাগুলো একটাও ঠিক নেই। বছর কেটে যাওয়ায় লেখাগুলো বসে গেছে। বলপয়েন্ট কলমের কালো রঙ্গ খয়েরি হয়ে গিয়েছে। সাদা কাগজটা হলদেটে বর্ণ নিয়েছে। উমা চোখ বুলায় কাগজে। সাধু চলিত মেশানো চিঠিটা পড়তে খুব ভালো লাগে উমার।

প্রিয় উমা,
কেমন আছো তুমি? এই চিঠিখানা যখন পাইবে তখন হয়তো আমি তোমার সম্মুখে উপস্থিত থাকিবো না। তবে স্মরণ রাখিও আমার আশীর্বাদ সর্বদা তোমার সাথেই থাকিবে। বাবা হিসেবে কর্তব্য পালন করার ক্ষেত্রে তোমার পিতা বহুঅংশে অপারগ। আমি তাহা জানি, কিন্তু সত্যি বলিতে তোমাকে আমি কখনো কম স্নেহ করি নি। প্রত্যেকে পিতার একটাই প্রার্থনা থাকে ভগবানের কাছে। তার পুত্র কন্যারা যেনো সুখে থাকে। আমিও সেটাই চাহিয়াছিলাম। তাই তোমার মায়ের মৃত্যুর পর রতীলে বিবাহ করি। বিয়েখানা করার উদ্দেশ্য তোমার জন্য একজন ভালো মা বাছাই। কিন্তু ভাগ্যের ফেরটাই বদলে যায়। রাজশ্বী হবার পর তোমার অবুঝ কাজে তার প্রান যাইবার উপক্রম হয়। রতী কন্যা শোকে তোমাকে ভালোমন্দ বলে। সেদিন প্রথমবার আমি তোমাকে শাসন করি৷ সেদিন থেকে তুমি আমার থেকে বহুক্রোশ দূর চলে যাও। কিন্তু তোমাকে কাছে টানার কিংবা এই কষ্টের থেকে মুক্তি দেবার কোনো উপায় পাই নাই। দোকানের কাছে সারাদিন মগ্ন থেকে জানিতেও পারি নাই বাড়তে তোমার সাথে কি কি হয়েছে! তুমিও এতো ভালো মেয়ে ছিলে কখনো নিজ থেকে আমাকে কিছুই বলিতে না। আমার ই দোষ ছিলো আমি তোমার অব্যক্ত কথা বুঝবার চেষ্টাও করি নি। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও উমা। কিন্তু আমি কখনোই নিজের বোঝা ভাবী নি। তোমার সাথে রুদ্রের বিয়ে খানা হয়তো তোমার জন্য অন্যায় ছিলো। তোমার মতের বিরুদ্ধে বিয়েখানা আমি ঠিক করি। কিন্তু তা এজন্য মোটেই নয় যে তোমাকে আমি বোঝা ভাবী। আমি বিয়েখানায় সম্মতি দেই কেবল তোমার মঙ্গল ভেবে। তোমার শ্বশুরটি মোটেই ভালো মানুষ নয়। আমার ভয় ছিলো তোমার কোনো ক্ষতি না করিয়ে দেয়। এই ভয়ে আমি সম্মতি দেই এই বিয়েতে।

আমি জানি এই কথাগুলোতে আমার পাপ ধুইয়া যাইবে না। আমি মানুষটা বরাবর ই কাপুরুষ। কখনো অন্যায়ের উপরে কথা বলার সাহস আমার হয় নি। নর্দমার কিটের মতো জীবন ব্যাহিত করেছি। তোমার মতো কন্যার পিতা হবার যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু ইহজীবনে তোমাকে রাজশ্বী এবং গোপালকে সমান ভালোবেসেছি৷ আমার এখনো স্মরণ আছে সেই মূহুর্ত যখন মা তোমাকে আমার কোলে দিয়েছিলো। সদ্য ফুটন্ত শিউলিকে যেনো আমার হাতে পেয়েছিলাম। দিনখানা সপ্তমী ছিলো। মায়ের ত্রিনয়নের সাথে তোমার জনম হইয়াছিলো। তাই তোমার নাম উমা রাখিয়াছিলাম। আমার মতে তুমি সর্বদা দেবীর অংশ ই রইবে। পারলে তোমার এই কাপুরুষ পিতাকে ক্ষমা করে দিও। আমি আশীর্বাদ করি যেনো তুমি খুব বড় মানুষ হতে পারো। কখনো অন্যায়ের সামনে মাথানত করবে না উমা। মা অন্নপূর্ণার মতো নিজেকে দয়ালু করবে। দরিদ্র মানুষের পীড়নকে অনুধাবন করার চেষ্টা করিও। মনে রাখিবে, ধরণীও নারী, তুমিও নারী। তোমাতেই জীবের সঞ্চার। নারী নরম হলে মায়াবতী, কঠিন হলে মা কালী। তুমি রক্তজবা হও। এই আশীর্বাদ রইল। আর একখানা কথা, পারলে ওই বাড়ি থেকে পালাবার প্রচেষ্টা করিও। ওরা ভালো না। তোমার পরান নেবার মূহুর্তে দুবার ভাববে না।

ইতি
তোমার বাবা
নিখিল

উমা তাকিয়ে রয়েছে চিঠিটির দিকে। খেয়াল করলো গালদুটো ভিজে এসেছে তার। এ যেনো নতুন নয়। চারবছর যাবৎ এই চিঠিটা আগলে রেখেছে উমা। কিন্তু এই যাবৎ চিঠির শেষ কথাগুলোর মর্মার্থ বুঝতে পারে নি সে। মৃত্যুর পূর্বেও তার পিতা কিছু বলবার প্রচেষ্টায় ছিলেন। চেয়ারম্যান বাড়ির কোনো রহস্যের কথাটা বলতে চেয়েছিলেন তিনি। উমা চিঠিটা বইয়ের ভাজে রেখে দিলো। পেছনে ফিরে রুদ্রের ঘুমন্ত মুখখানা দেখলো সে। বাবা জীবিত থাকতে তাকে বলতো,
“বাবা, তুমি চিন্তা করো না। যতক্ষণ আমার পাশে এই মানুষটা আছে আমার কিছু হবে না”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো উমা। ঠোটে এক চিলতে হাসি অঙ্কিত হলো।

কালীগঞ্জ থানায় বসে আছে শাশ্বত৷ অপেক্ষা তার বন্ধুর। এক কালে এই থানার দারোগা ছিলেন উত্তম বাবু। আবদুল্লাহ বদলি হয়ে অন্য থানায় গিয়েছে। নতুন অসি শ্রাবণ মুখোপাধ্যায় শাশ্বতের খুব ভালো বন্ধু। একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে তারা। শাশ্বতের আগমনে প্রথম দিন অবাক হয় শ্রাবণ। শাশ্বত তাকে সবটা বললে সে চিন্তিত স্বরে বলে,
“এতোকাল আগের তথ্য কি পাওয়া যাবে? এ খানিকটা খড়ের গাদায় সুই খোজার মতো হবে না তো?”
“জানি কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। এটুকু তো জানাই যাবে বাবার শেষ কেসখানা কি ছিলো।”
“কিন্তু সময় লাগবে বন্ধু। এতো সহজে কিছুই হয় না। টাকাও যাবে। তবে খানিকটা লুকিয়েও কাজ করতে হবে। বোঝোই তো সরকারী ব্যাপার স্যাপার।”
“তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।”

সেদিনের পর আজ এসেছে শাশ্বত। শ্রাবণ লাঠিটা টেবিলে রেখে লজ্জিত কন্ঠে বললো,
“অনেক সময় কি চলে গিয়েছে?”
“না না আমি কেবল ই আসলাম”

বসতে বসতে শ্রাবণ বলল,
“যেকারণে তোমাকে ডেকেছি, একটা সুতো পেয়েছি বন্ধু। আমার মনে হয় কাকার মৃত্যুতে এই সুতোর হাত আছে”
“কি সুতো?”
“উত্তম কাকু শেষ যে কেসখানা নিয়ে কাজ করছিলেন, সেটি একটি তদন্ত। মাদকদ্রব্য পাচার তদন্ত……….

চলবে

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে পোস্ট করবো ইনশাআল্লাহ]

মুশফিকা রহমান মৈথি

৩৬তম পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/438859514502493/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here