#উমা [কপি করা নিষেধ]
৩৮তম_পর্ব
সেদিনের পর আজ এসেছে শাশ্বত। শ্রাবণ লাঠিটা টেবিলে রেখে লজ্জিত কন্ঠে বললো,
“অনেক সময় কি চলে গিয়েছে?”
“না না আমি কেবল ই আসলাম”
বসতে বসতে শ্রাবণ বলল,
“যেকারণে তোমাকে ডেকেছি, একটা সুতো পেয়েছি বন্ধু। আমার মনে হয় কাকার মৃত্যুতে এই সুতোর হাত আছে”
“কি সুতো?”
“উত্তম কাকু শেষ যে কেসখানা নিয়ে কাজ করছিলেন, সেটি একটি তদন্ত। মাদকদ্রব্য পাচার তদন্ত, প্রতিবছর বর্ডার থেকে প্রচুর পরিমানে মাদকদ্রব্য, ঔষধ, গরু পাঁচার হয় আমাদের দেশে। বেনাপোল বর্ডারটা অন্যতম। যদিও কড়া প্রহরী থাকে বিডিআর (তখন বিজিবি বিডিআর ছিলো) বাহিনীর, তবুও এই অমানুষ গুলো তাদের কাজ ঠিক ই করে। লাস্ট এই কেসটাই কাকুর আন্ডারে ছিলো। কিন্তু কাকু কোনো রিপোর্ট করেন নি। তার পূর্বেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এখন তিনি কি সেই গোষ্ঠীকে আদৌও পাকরাউ করেছিলেন কি না জানা নেই।”
শাশ্বত মনোযোগ দিয়ে ফাইলটা দেখতে থাকে। সুতোটা খুব ই সরু। যে কোনো মূহুর্তে ছিড়ে যাবার ভয় রয়েছে। শ্রাবণ হাত জোড়ো করে থুতনি ঠেকায়, ধীর স্বরে বলে,
“বন্ধু আমি তোকে কখনোই হতাশ করতে চাই না। কিন্তু সত্যি বলতে সময়টা অনেক বেশি হয়ে গিয়েছে। এখন পুরোনো কঙ্কাল চেটেও কিছু বের হবে না।”
শ্রাবণের কথা যৌক্তিক। কিন্তু শাশ্বতের মনে এক দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে এই রহস্যের শেষবিন্দুতে সে পৌছাতে পারবে। শাশ্বত স্মিত হাসি দিয়ে বললো,
“দেশে এখন সব সম্ভব। বিদ্যুতের খাম্বাচুরি যদি ধরা পরে, এই রহস্যের জট ও খুলবে। এই ফাইলটা নিয়ে যেতে চাই পারবো?”
“হ্যা, এগুলো তোর জন্যই আমি প্রস্তুত রেখেছি। তুই নিতে পারিস। কিন্তু বন্ধু, কেউ যেনো এই ব্যাপারটা না জানে। আমার চাকরি মিয়ে টানাটানি হবে।”
“নিশ্চিন্তে থাক বন্ধু, কিচ্ছু হবে না।”
শাশ্বত বেড়িয়ে গেলো থানা থেকে। ব্যাগে মোটা ফাইল। যেখানে উত্তম বাবুর আন্ডারে থাকা সকল কেসের কুষ্ঠি আছে। শাশ্বত পিচের রাস্তায় হাটতে লাগলো। কড়া রোদে তার চামড়া ঝলসে যাচ্ছে। কিন্তু এই প্রকোপের মাঝেও পৌষের হিম বাতাস বইছে। উড়ছে এলোমেলো চুলগুলো শাশ্বতের। শাশ্বতের মনে হাজারো প্রশ্নের দলা জমেছে। উত্তর গুলো নিকষকৃষ্ণ আধারে হাতড়াতে হচ্ছে। যে তাকে আড়ালে থেকে এতো কিছুর খোঁজ দিচ্ছে সে জানে এই রহস্যের বীজ কোথায়! সেই মানুষটাকে যদি খুজে বের করা যেতো। হয়তো তখন এই জটগুলো এক এক করে খুলে যেতো।
অফিসে পৌছাতেই শাশ্বতের জুনিয়র সুমন ছুটে এলো তার কাছে। সুমন হাফাচ্ছে, শাশ্বত তার ব্যগ্রতা দেখে বাকা হেসে বললো,
“কি গো সুমন বাবু? কিছু না করেই হাফাচ্ছো দেখি? খুব কঠিন খবর রিপোর্ট করতে দিলাম কি?”
সুমন নিজেকে সামলে বললো,
“স্যার, আপনাকেই খুজছিলাম। আমি রিপোর্টটা প্রায় তৈরি করে ফেলেছি। শুধু আপনার একটু গাইড পেলে জব্বর হতো।”
“বাহ, সুমন বাবু দেখি খুব ফাস্ট হয়ে গেছে। আমি ভাবলুম, এক কোনে বসে মাথা চাপড়াচ্ছে।”
“কি যে বলেন স্যার, আপনি ই তো বলেন, “when life gives you a lemon, make it lemonade””
শাশ্বত হাসে, কিন্তু সুমনের কথাটি তার মনের কর্ণিশে জমা হতাশার কালো বাদলকে সরিয়ে আশার নতুন প্রভা উজ্জ্বলিত করে। শাশ্বতের হাসি প্রসারিত হয়। যতই আধার থাকুক এবার তদন্তের শেষ অবধি যাবেই সে। এর মাঝেই পিয়ন মন্সুর মিয়ার আগমন হয়। ধীর স্বরে বলে,
“স্যার একখানা মেয়ে এসেছে। বলছেন আপনার সাথে দেখা করতে চায়।”
শাশ্বত খানিকটা অবাক হয়। অবাক হবার ই কথা, যে পুরুষ ইহজীবনে নারী প্রলভনে আকৃষ্ট হয় নি সেই পুরুষের কাছে নারী আসবে ব্যাপারখানা বেশ অবাক করেছে তাকে। মালিনী মুখে ফেনা তুলে ফেললো,
“বাবু, বিয়েটা কর”
কিন্তু কে শুনে কার কথা, সে বিয়ে করবেই না। কোনো মেয়েকেই তার মনে ধরে না। আর যার ক্ষণিকের মায়া মনে উঁকি দিয়েছিলো সেই নারী তার ধরা ছোয়ার বাহিরে। শাশ্বতের অবাক হবার আরো একটি কারণ হলো, এই সংবাদপত্র অফিসে নারীর আনাগোনা বড্ড বিরল। সংবাদ পত্র অফিস তো কোনো কফি শপ না, সে মেয়েরা আসবে আড্ডা দিতে। শাশ্বত গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“আমার অফিসে পাঠিয়ে দাও।”
মন্সুর মিয়া ঘাড় কাত করলো। মানে সে বুঝতে পেরেছে। শাশ্বত সুমনের উদ্দেশ্যে বললো,
“প্রতিবেদন টা পাঠিয়ে দিও। আমি কারেকশন করে দিবো ক্ষণ”
“জ্বী স্যার”
শাশ্বত ব্যাগটা খুব যত্নে আগলে রাখলো তার আলমারীতে। তারপর চোখের চশমাটা ঠিকে করে বসলো কম্পিউটারের সামনে। কম্পিউটারের প্রচলন এখন বেশ বেড়েছে। প্রায় সকল অফিসেই একটা কম্পিউটার থাকবে। এখন প্রিণ্ট বের করে কালকের মধ্যে কিছু প্রতিবেদন ফ্যাক্স করতে হবে। ক্রাইম রিপোর্টার হবার এই এক ফয়দাও। যেকোনো ক্রাইম হলেই বড় একখানা প্রতিবেদন করতে হয়। এই যে গত পরশু, দেবহাটা উপজেলায় এক স্কুল যাত্রী মেয়েকে এক গোষ্ঠী মিলে ধর্ষন করেছে। শুধু তাই নয়, তাকে ধর্ষণ করে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। মেয়েটির লাশ ভোরের দিকে ড্রেনের পাশে নগ্ন অবস্থায় পায় পুলিশ। তদন্ত চলছে, তবে মেয়েটির মা-বাবার মতে এই কাজটি ইউনিয়নের এক নামী নেতার দলবলের কাজ। তদন্ত চলছে। দেখা যাক, দোষীটি ধরা পরে নাকি? উপরন্তু নতুন এক মৎস চাষের জন্য বেশ কিছু বেনামী জমি দখল হয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছু গ্রামের দরিদ্র কৃষকেরা বিলীন হয়ে যাচ্ছে গ্রাম ছেড়ে। রাতারাতি তারা খুলনা, যশোর পাড়ি দিচ্ছে। এই বিষয়টাও ভাবাচ্ছে শাশ্বতকে। ভাবছে এই বিষয়ের তদন্ত ও করবে সে। এর মাঝেই নরম মেয়েলী কন্ঠটি কানে এলো তার,
“আসতে পারি? ”
কি বোর্ড থেকে মুখ তুললো শাশ্বত। চোখ জোড়া কুচকে এলো তার। এক কৌতুহল জমলো মনে, অবাক কন্ঠে বললো,
“তুমি? এখানে?”
মেয়েটি আর কেউ নয়, রাজশ্বী। চটের ব্যাগটা সামনে ফ্যাকাশে মুখে আবারো সে জিজ্ঞেস করলো,
“আসবো”
“এসো”
রাজশ্বী ধীর পায়ে এসে বসলো। তার কপালে ঘামের সরু মতি, ঠোঁট জোড়া ঈষৎ কাঁপছে। বেশ স্নায়ুবিক লাগছে তাকে। শাশ্বত চশমাটা খুলে রাখলো। হাত জড়ো করে থুতনি ঠেকিয়ে এক রাশ বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“পেয়ারা গাছের পেত্নী আজ এখানে?”
“আপনাদের একখানা বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম। ইন্টার্ণ রিপোর্টার নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি”
ঈষৎ কাঁপা কন্ঠে কথাটা বললো রাজশ্বী। শাশ্বতের বিস্ময় আসমান ছুলো। বলে কি এই মেয়ে, সে সাংবাদিকতায় আসতে চায়? অবাক স্বরে বলে,
“তুমি সাংবাদিক হতে চাও।”
“জ্বী, পার্টটাইম জব হিসেবে করতে চাই। বর্তমানে আমি প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছি সাতক্ষীরা কলেজে। ওখানে কিছু বলা ছিলো না। তাই এসেছি।”
শাশ্বত কিছু বললো না। বরং মনোযোগ দিয়ে সামনে বসা মেয়েটিকে দেখতে লাগলো। চার বছরে কতটা বদলেছে মেয়েটি। কে বলবে এই সেই মেয়ে যে বট গাছে বসে সবাইকে পেয়ারা ছুড়তো আর ভয় দেখাতো।
ক্লাস শেষ হয়েছে দুপুর গড়িয়ে গেছে। এখন বাড়ি ফেরার সময় হয়ে এসেছে উমার। চাদরটা ভালো করে মুড়িয়ে নিলো। বেশ ঠান্ডা লাগছে। অফিস গেলে মন্দ হতো না। কিন্তু রুদ্রের কড়া বারণের পর আর অবাধ্য হতে মন চাইলো না উমার। হাতটাও সাড়ে নি এখনো। এক সপ্তাহ হয়ে গেলো এখনো ব্যাথা কমে নি। হাতের ব্যাথাটা শীতের কারণে ব্যাথা বাড়ছে। এর মাঝেই তার ফোনটা বেজে উঠলো উমার। অচেনা নম্বরটি দেখে কৌতুহল জাগলো উমার। ফোন ধরতেই অপাশ থেকে একখানা তীক্ষ্ণ বৃদ্ধ কন্ঠে কানে এলো,
“উমা রায় বলছেন?”
“জ্বী, আপনি কে বলছেন?”
“আমি মহানগর ডায়াগনস্টিক থেকে বলছি। আপনার রিপোর্ট খানা নিয়ে যাবেন।”
রিপোর্টের কথাটা শুনেই অনুভূতিশুন্য হয়ে গেলো উমা। বিগত সপ্তাহেই রক্ত এবং প্রসাব পরীক্ষা করতে দিয়েছিলো উমা। সেই রিপোর্টটাই হয়তো এসেছে। বুকটা ধরফর করছে উমার। কৌতুহল হচ্ছে ফলাফলের আসায়। উমা ধীর স্বরে বললো,
“রিপোর্টে কি এসেছে জানতে পারি?”
মহিলা কিছুক্ষন থেমে বললো,
……….
চলবে
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে পোস্ট করবো ইনশাআল্লাহ]
মুশফিকা রহমান মৈথি
৩৭তম পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/439493357772442/