উড়ো পাতার ঢেউ পর্ব: ০৭

0
817

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ০৭
__________________

“বোকা অনেক বানিয়েছো। সব কিছু সেটআপ করে রেখে কী নাটকটাই না করলে! নতুন করে আর বোকা বানানোর ব্যর্থ চেষ্টা করো না। আমি বোকা নই। যদি বোকা হতাম তাহলে তোমাদের গ্যাংয়ের প্ল্যানটা ধরতে পারতাম না। তুমি একজন আততায়ী এটা বুঝতে পারতাম না। আমি একজন চালাক এবং বড়ো লোক মানুষ। কথাটা মাথায় রাখো।”

ইরতিজা বুঝতে পারলো এই ছেলেটাকে বুঝিয়ে কোনো লাভ হবে না। ছেলেটা পাগল না কি? শেষমেশ একটা পাগলের কাছে এসে পড়লো? ভাবতে বুক মোচড়ানো একটা কান্না জেগে উঠতে চাইছে। মানুষের জীবনে এত কঠিন কঠিন সময় কেন আসে? তার জীবনে যদি এই সময়টাকে কঠিন সময় বলে গণ্য করা হয় তাহলে কি ভুল হবে? ছেলেটা তাকে আততায়ী ভেবে সন্দেহ করছে! সে কি জীবনে একটা ককরোচ মেরে দেখেছে? তাকে আততায়ী ভাবছে কোন হিসাবে? ইরতিজা একটু-আধটু অতিষ্ঠ। সেই অতিষ্ঠতা থেকে বললো,
“হ্যাঁ ধরলাম আমি একজন আততায়ী। কিন্তু যদি আততায়ী হতাম তাহলে কেন ওরকম ভাবে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম? অজ্ঞান হয়ে তোমার সাথে এসে কী লাভ হলো আমার? আমি তো ভালোয় ভালোয় ওখান থেকে চলে যেতে পারতাম।”

“কেন তুমি এরকম করেছো সেটা তো বুঝতে পারছি না। হয়তো চেয়েছিলে বোকা বানিয়ে খুব কাছ থেকে আক্রমণটা করবে। তুমি জানতে তুমি অজ্ঞান বলে তোমাকে গাড়ির পিছনের আসনে রাখা হবে, আর আমি গাড়ি ড্রাইভ করবো। চেয়েছিলে আমি যখন গাড়ি ড্রাইভে ব্যস্ত থাকবো সে সময়ে তুমি কিছু একটা দিয়ে আমার গলা পেঁচিয়ে ধরবে। আমার শ্বাস রোধ করার প্ল্যানে ছিলে তুমি। হ্যাঁ…এবার এটা পরিষ্কার।”

“তুমি ভুল। তোমার কাছে তো কোনো গাড়ি দেখিনি আমি। তোমার কাছে গাড়ি আছে কি-না কী করে জানবো আমি?”

“গত পনেরো দিন ধরে তোমাদের গ্যাং পেরেশান করে চলছে আমায়। আর আমার কাছে গাড়ি আছে কি নেই সেটা জানো না তুমি?”

আর ভালো লাগছে না। সত্যিই আর সহ্য করতে পারছে না এসব। মানুষ কোনো কিছু নিয়ে যখন ভুল বোঝে ওই সময়টার মতো তিক্ত সময় আর হয় না। ইরতিজা বললো,
“তাহলে আমি তোমার শ্বাস রোধ করে তোমাকে মেরে ফেললাম না কেন?”

ক্যানিয়ল বাঁকা হেসে বললো,
“কেন মারোনি সেটা তোমার থেকে ভালো কে জানে?”

“আমি ভুলে গিয়েছি। মনে করিয়ে দাও।”

“নাটক! আচ্ছা তারপরও মনে করিয়ে দিচ্ছি। মারোনি কারণ, তুমি তো আশা করেছিলে আমি একা থাকবো গাড়িতে। কিন্তু আমি একা তো ছিলাম না…”
ক্যানিয়ল ক্লোজেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে দেখিয়ে বললো,
“মি. হেনরিও আমার সাথে ছিল। তার উপস্থিতিতে আমাকে মারতে পারবে না এটা মাথায় রেখে তুমি নিশ্চুপ ছিলে।”

ইরতিজার আর কথা বলার শক্তি নেই। গলা দুর্বল। পুরো শরীরই অসাড় অসাড় লাগছে। মাথায় যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে। পড়ে যাওয়ার ফলে লাগা আঘাতের কারণে এমনটা হচ্ছে বোধ হয়। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে ঝিমিয়ে থেকে বললো,
“তাহলে এখন কী করবে? আমি আততায়ী বলে আমাকে বন্দি করে রাখবে? না কি প্রিজনে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে?” খুব হালকা কণ্ঠের প্রশ্ন।

“পৃথিবীতে আমি দুটো জিনিস খুব ঘৃণা করি। এক হচ্ছে পুলিশ, দুই হচ্ছে ডক্টর। ঘৃণা করি বলে পুলিশদের টানবো না এর মাঝে। না হলে তোমাকে পুলিশেই দিতাম। আর তোমাকে আটকেও রাখবো না আমি। কারণ এটা আমার সুন্দর চরিত্রের সাথে বেমানান। আমি তোমার গ্যাংয়ের মতো নিকৃষ্ট নই যে একটা মেয়েকে বন্দি করে রাখবো।”

ইরতিজা কথা বাড়াতে চাইলো না। কথা বাড়িয়ে আর কী লাভ? পাগল যা বলছে বলুক। এখান থেকে যেতে পারলেই বাঁচে। মনে খুশির দোল লাগছে। মাথায় হাত দিয়ে হিজাব ঠিক আছে কি না চেক করে নিলো। পকেটে হাত দিয়ে মোবাইল বের করতেই মনের খুশির দোলটা ছুটে পালালো। আকাশ ভেঙে পড়লো মাথায়। তার প্রিয় মোবাইলের গ্লাসে ফাটল ধরেছে! দ্রুত মোবাইল অন করার জন্য বাটন চাপলো। কিন্তু অন হলো না। ইরতিজা তার প্রিয় মোবাইলের জন্য কেঁদে উঠলো। তার দামীয় মোবাইলটা বিক্রি করে দিয়ে সে এই মোবাইলটা কিনেছিল। এটা কম দামের মোবাইল ফোন। তবুও মোবাইলটা তার খুব প্রিয়। এটার ক্যামেরায় খুব ভালো ছবি ওঠে। ইরতিজা মোবাইলের গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে স্নেহের সাথে বললো,
“ওহ মাই ফোন! মাই ফোন!”
অশ্রুসিক্ত চোখে ক্যানিয়লের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি কী করেছো আমার ফোনটার সাথে?”

ক্যানিয়ল অবাকের চূড়ায় উঠে বললো,
“আমি কী করেছি তোমার ফোনের সাথে?”

ইরতিজার দৃষ্টি নত হয়ে আসে। ছেলেটা তো কিছু করেনি, পড়ে যাওয়ার ফলে মোবাইল আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে। এতটাই মারাত্মক ভাবে পড়েছিল যে মোবাইলের গ্লাসে ফাটল ধরেছে! ইরতিজা নিজের জন্যও মায়া অনুভব করলো। মুখ করুণ করে মোবাইলটার গায়ে হাত বুলিয়ে চলছিল অনবরত। এর মাঝে শুনতে পেল ক্যানিয়লের তাচ্ছিল্য কণ্ঠ,
“নীচু মন মানসিকতার মেয়ে! একটা মোবাইলের জন্য এরকম করছে। উফ, ডার্টি!”

ইরতিজা রক্ত চক্ষুতে তাকালো,
“কী বললে?”

ক্যানিয়ল পাত্তা দিলো না। হেনরির দিকে তাকিয়ে বললো,
“মি. হেনরি, এই নীচু মন মানসিকতার মেয়েটাকে নিয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে। একে দেখলেও আমার শরীর কাঁপিয়ে জ্বর চলে আসছে।”

অপমানে দগ্ধ হলো ইরতিজা। ছেলেটার এত বড়ো সাহস তাকে এভাবে অপমান করে? রাগে গমগম করে বলে উঠলো,
“নিজের সীমা ছাড়িয়ে যেয়ো না। তুমি জানো এই মোবাইল আমার কত প্রিয়? এই মোবাইলে কত ভালো ফটো তোলা যায় তোমার কোনো আইডিয়া আছে? এটা আমার ফোন, আমি এটার জন্য কষ্ট অনুভব করবোই। তুমি কী বুঝবে এর মর্ম? মানুষ হয়ে মানুষের জন্যই তোমার মায়া নেই, মোবাইলের জন্য আর কী মায়াই বা থাকবে?”

ক্যানিয়ল তুচ্ছ হেসে বললো,
“মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে ফটো তোলো তুমি? কেন? তুমি এতটাই গরিব যে তোমার একটা আলাদা ক্যামেরা কেনার ডলার নেই?”

ইরতিজার ভিতর ক্রোধের প্রদীপ ফোঁস করে জ্বলে উঠলো। বসা থেকে সোজা নেমে গেল সে। ক্যানিয়লের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,
“ধনী হয়ে অহংকারে মাটিতে পা পড়ছে না, তাই না? গরিবদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছো? পাপ করছো, খুব পাপ করছো! হ্যাঁ, আমি এতটাই গরিব যে আমার আলাদা ক্যামেরা কেনার ডলার নেই। তুমি ডলার দাও। ক্যামেরা কেনার জন্য নয়…”
ইরতিজা নিজের মোবাইল দেখিয়ে বললো,
“আমার মোবাইলের যে ক্ষতি করেছো এর ক্ষতিপূরণ দাও।”

“আমি ধনী ঠিক আছি, কিন্তু অর্থের অপচয় আমি করি না। তোমার মোবাইল তোমার কারণে আঘাত পেয়েছে। আমি তোমাকে ওভাবে রাস্তায় ধপ করে পড়ে যেতে বলিনি। নিজের ইচ্ছাতেই পড়েছিলে।”

“কিন্তু এর জন্য তুমিই দায়ী।”

ঝামেলাটা আর নিতে পারছে না ক্যানিয়ল। বললো,
“ও কে, আমি তোমাকে নতুন ফোন দিচ্ছি।”

ক্যানিয়ল রুম থেকে বের হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো হাতে একটা মোবাইল নিয়ে। তার কাছে অনেকগুলো মোবাইল অবহেলা-অযত্নে পড়ে থাকে। সেখান থেকেই একটা মোবাইল তুলে নিয়ে এসেছে ইরতিজার জন্য। ইরতিজার দিকে মোবাইলটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“নাও।”

ছেলেটা মজা করছে কি না বুঝতে পারছে না ইরতিজা। একটু সময়ের ভিতর কোত্থেকে গিয়ে একটা মোবাইল নিয়ে এলো? যাই হোক, সে নেবে না এই মোবাইল। বললো,
“আমি নেবো না এই ফোন। তুমি আমার
ফোনের ক্ষতিপূরণ দাও।”

ক্যানিয়ল অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে বললো,
“তুমি এই ফোন ফিরিয়ে দিচ্ছ? তুমি জানো এই ফোনের দাম কত? তোমার ফোনের থেকে পাঁচগুণ বেশি দাম হবে।”

“আমাকে লোভী ভাববে না একদম।”

“ঠিক আছে, আমিও তোমার ফোনের ক্ষতিপূরণ দিতে পারবো না। চলে যাও তুমি।”

ইরতিজা কথা বাড়ানোর প্রয়োজন অনুভব করলো না। মোবাইলটা না হয় নিজের অর্থ খরচ করেই সারিয়ে তুলবে। খুব বেশি অর্থ ব্যয় হবে না এটা ঠিক করতে। এখন এখান থেকে বের হতে পারলেই শান্তির নিঃশ্বাস নেবে। হেনরি নামের লোকটা ইরতিজার দিকে ওর সাইড ব্যাগ এগিয়ে দিলো। মোবাইলটা কেন ব্যাগের ভিতর রাখেনি? পকেটে রেখেছিল কোন দুঃখে? ব্যাগে থাকলে বোধহয় কোনো ক্ষতি হতো না। আর ভুল না করে মোবাইলটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো। মি. হেনরি বললো,
“চলো।”

ক্যানিয়লের দিকে শেষবার তাকিয়ে ইরতিজা মি. হেনরির পিছন পিছন বেরিয়ে এলো। মেইন ডোর দিয়ে বের হওয়ার সময় মনে পড়লো, আরে, তার সবজির ব্যাগ কোথায়? মি. হেনরি যে সাথে আছে সেটা খেয়াল ছিল না ইরতিজার। সে এটা জিজ্ঞেস করার জন্য ছুটে এলো ক্যানিয়লের কাছে।
ক্যানিয়ল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে বসে চোখ মুদিত করেছিল। ইরতিজা ছুটে আসাতে দাঁড়িয়ে গিয়ে বললো,
“কী ব্যাপার? তুমি আবার এসেছো কেন?”

“আমার ক্রয় করা সবজিগুলো?”

ক্যানিয়ল ইরতিজার মুখে ব্যাঙ্গাত্মক দৃষ্টি দিয়ে বললো,
“তোমার কি ধারণা ওই রাস্তায় পড়ে থাকা সবজিগুলো আমি দুই হাত দিয়ে কুড়িয়ে তোমার জন্য নিয়ে আসবো?”
ক্যানিয়ল ওষ্ঠে বিদ্রুপ হাসি ফুঁটিয়ে আবারও চেয়ারে বসে চোখ বুজলো।
ইরতিজার আজ কত বড়ো ক্ষতি হলো সেটা শুধু সে নিজে জানে। একে তো সে নিজে আঘাত পেয়েছে, মোবাইলও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সবজিগুলো তো একেবারে ফেরারিই হয়ে গেছে। থাক, মেনে নিলো সব। ভাগ্যের লিখন কে পরিবর্তন করতে পারে? ইরতিজা চুপচাপ চলে যাচ্ছিল। ক্যানিয়ল ডাকলো,
“শোনো…”

ইরতিজা দাঁড়িয়ে গেল।
ক্যানিয়ল বললো,
“তুমি ছিঁচকাঁদুনে একটা মেয়ে! ছিঁচকাঁদুনে মেয়েরা সব সময়ই বিরক্তিকর হয়। তুমিও বিরক্তির ঊর্ধ্বে নও। খুবই বিরক্তিকর একটা মেয়ে তুমি।” কথাগুলো এমনভাবে বললো যেন বলতেই সে বিরক্তিতে শেষ হয়ে যাচ্ছিল।

অপমানে আরক্ত হয়ে উঠলো ইরতিজা। মুখ ছুটে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল ইংলিশ গালি। খুব কষ্টে আটকে রাখলো। অপমানটুকু হজম করে নিতে চাইলো, কিন্তু পারলো না। ইংলিশে না বলুক, বাংলা তো উত্তম মাধ্যম হিসেবে আছে। রাগে বাংলাতেই কটমট করে বললো,
“তুই আস্ত একটা পাজি ছেলে! জীবনে যত পাজি ছেলে দেখেছি তুই হলি তাদের ভিতর সেরা। সেরা পাজি একটা!” কথাটা বলতে ঘৃণা হচ্ছিল ইরতিজার। এই দ্বিতীয়বার কারো প্রতি এমন ঘৃণা অনুভব করলো। প্রথম ঘৃণা করা মানুষটা হলো- জোনাস।

ক্যানিয়লের প্রতিটা লোম পর্যন্ত সচকিত হয়ে উঠলো ইরতিজার কথায়। তার না জানা ভাষাটায় কী বলছে অনুমান করার চেষ্টা করলো। তার সম্পর্কেই বাজে কোনো মন্তব্য করছে এটা বুঝতে একদমই কষ্ট হলো না। বসা থেকে উঠে দ্রুত পায়ে ইরতিজার দিকে এগিয়ে এসে বললো,
“হেই পাকিস্টানি গার্ল, কী বললে তুমি? আরেকবার বলো। উর্ডুতে গালি দিচ্ছ আমায়?”

ইরতিজা আবারও বাংলাতে বললো,
“তুই খুব খারাপ, খুব!”

ক্যানিয়ল তর্জন করে উঠলো,
“জাস্ট শাটআপ ইওর মাউথ। আমার সম্বন্ধে উর্ডুতে কী বলছো তুমি? তুমি কীভাবে সাহস করতে পারো আমার সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করার? কী ভেবেছো? আমি উর্ডু পারি না? মি. হেনরির পঞ্চাশটা ভাষায় দক্ষতা আছে। তুমি…”

ইরতিজা ক্যানিয়লের কথার মাঝেই বেরিয়ে এলো। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পরই হঠাৎ কেউ ডাকলো,
“এই যে…”

ইরতিজা ডাক অনুসরণ করে তাকালো। মি. হেনরি ডেকেছে। কালো একটা গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে মি. হেনরি। বললো,
“তোমাকে তোমার বাসায় নামিয়ে দিই, চলো।”

ইরতিজা না করে দিলো,
“না না কোনো দরকার নেই, আমি একা চলে যেতে পারবো।”

রাস্তায় পা রেখে ইরতিজার টনক নড়লো। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো কিছুই তার পরিচিত নয়। এটা কোন জায়গা? কোন এরিয়া? আকাশ এখনও মেঘলা। ঠান্ডা হাওয়া বয়ে চলেছে। ঘরের ভিতর থাকায় শীত টের পায়নি এতক্ষণ, কিন্তু বাইরে বেরিয়ে যেন তীব্র শীতের কবলে পড়লো। কোন দিকে যাবে বুঝতে পারছে না। চোখের সামনে শুধু কয়েকটা বাড়িঘর দেখতে পাচ্ছে। সোজা একটা রাস্তা। কোনদিকে গেলে বাস স্ট্যান্ড পাওয়া যাবে? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যখন এসব ভাবছিল, তখন শুনতে পেল হর্নের শব্দ। সামনে একটা গাড়ি থামলো। কাচ সরে যেতে মি. হেনরিকে দেখতে পেল। মি. হেনরি বললো,
“গাড়িতে ওঠো, পথ চিনে যেতে পারবে না।”

আর কোনো উপায় নেই, মি. হেনরির গাড়িতেই উঠতে হলো ইরতিজার। মি. হেনরি জিজ্ঞেস করলো,
“কোথায় থাকো?”

“রেডমন্ড।”

“সেটা তো ঠিক আছে, কিন্তু থাকো কোথায়?”

“রেডমন্ডই তো থাকি।”

“সেটা আমিও জানি তুমি রেডমন্ড থাকো। কিন্তু রেডমন্ডের কোথায় থাকো?”

ভীষণ বোকার পরিচয় যে দিয়ে ফেলেছে বুঝতে পারলো ইরতিজা। দ্রুত এরিয়ার নামটা বললো। এরিয়ার নামটা শুনে লোকটা যেন একটু গম্ভীর হয়ে গেল। অন্যমনস্ক হয়ে কী যেন ভাবলো। ইরতিজা তা দেখে বললো,
“চেনো না জায়গাটা?”

“চিনবো না কেন? ভালো করেই চিনি।”

আসার পথে গাড়ি থামিয়ে মি. হেনরি ইরতিজার প্রয়োজনীয় সবজিগুলো কিনে দিলো। ইরতিজা নিতে অস্বীকৃতি জানালেও পরে আবার নিয়েছে। শত হলেও সত্যি এদের কারণেই তার যত লস হয়েছে।
ইরতিজাকে নামিয়ে দেওয়ার একটু পরই ক্যানিয়লের কল এলো। মি. হেনরি রিসিভ করলো।

ওপাশ থেকে ক্যানিয়ল বললো,
“মেয়েটাকে নামিয়ে দিয়েছো বাসায়?”

“হুম।”

“সবজিগুলো কিনে দিয়েছো?”

“হুম।”

“আচ্ছা শোনো, আমার একটা পিস্তল প্রয়োজন।”

“তোমার কাছে তো পিস্তল আছে।”

“ওটা তো আসল নয়। আসল পিস্তল প্রয়োজন আমার। দেখলে না মেয়েটা কীভাবে পিস্তল নিয়ে প্রশ্ন তুললো?”

“পিস্তল কিনবে? কিন্তু আমার তো মনে হয় রিভলবার কিনলে ভালো হয়।”

“রিভলবার আমার পছন্দ নয়, তুমি পিস্তল অর্ডার দিয়ো।”

________________

ড্রাই মেশিনে চুল শুকিয়ে নিচ্ছে ইরতিজা। কত ধকল গেল আজ তার উপর দিয়ে! মনে হতে হাত-পা কাঁপছে। গলার কাছটায় হাত বুলাচ্ছে বার বার। এখানটাতেই তো ছুরি ধরা হয়েছিল। এমন অভিজ্ঞতা আর কারো জীবনে না আসুক। ক্যানিয়লের কথাও বার বার মনে পড়ছে। পাজি ছেলেটা কি না তাকে আততায়ী বলে! আবার অপমানও করে! কত সাহস! বলে ছিঁচকাঁদুনে! হ্যাঁ, বেশ হয়েছে সে ছিঁচকাঁদুনি, তাতে ওর সমস্যা কী? ক্যানিয়লের কথা ভাবতে ভাবতে ইরতিজার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
খোলা জানালা দিয়ে হুড়মুড় করে বাতাস ঢুকছে। শীতল নয় তেমন। বাইরে এখন রোদ উঠে গেছে। চোখের সামনে এখন ঝলমলে রেডমন্ড। বাড়ি ফিরতে দেরি হওয়ায় প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এত দেরি কেন হয়েছে? সত্যিটা ঘরের কাউকেই বলা সম্ভব নয়। বলেওনি।

নওরিন দরজায় উঁকি দিয়ে বললো,
“হোয়াট’স ইওর প্রবলেম?”

ইরতিজা তাকালো। বোনের গম্ভীর মুখ দেখে বুঝে গেল তার বোনের মন ভালো নেই এ মুহূর্তে। কিন্তু হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন বোধগম্য হলো না তার। বললো,
“মানে?”

“ফোন বন্ধ করে রেখেছো কেন? সাজিদ কল দিয়েছিল তোমাকে, তোমার ফোন বন্ধ পেয়ে আমাকে কল দিয়েছে। তোমার ফোন অন করো।”
নওরিন এ পর্যন্ত বলে চলে গেল।

ইরতিজার মোবাইল চার্জে। বন্ধ অবস্থায় চার্জ হচ্ছে। রিশন কীভাবে তার মোবাইল এত দ্রুত ঠিক করে দিয়েছে জানে না। মোবাইলটা ঠিক করানোর জন্য কোথায় দিলে ভালো হবে সে ব্যাপারে জানার জন্য জুহিকে কল দিয়েছিল। জুহি বললো রিশনের সাথে যোগাযোগ করতে। জুহির কথা মতো তাই করলো। রিশনের কাছে মোবাইল দিয়ে আসার কিছুক্ষণ পরই আবার রিশন সেটা ফেরত দিয়ে গেছে। বলেছে, ‘চার্জে দাও, আর কোনো প্রবলেম থাকবে না’।
ইরতিজা তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিল। ভেবেছিল মোবাইলটা বোধহয় আর কোনো দিনও ঠিক হবে না। কিন্তু যখন দেখলো চার্জ হচ্ছে তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়লো। রিশনের ভালো গুণ আছে বলতে হয়।
চার্জ এখনও ফুল হয়নি। ইরতিজা ‘বিসমিল্লাহ’ বলে মোবাইল অন করলো। কিছুক্ষণ এটা-ওটা টিপে দেখলো মোবাইল আসলেই ঠিক আছে কি না। হ্যাঁ, ঠিক আছে। কিন্তু গ্লাসের ফাটলের দিকে তাকালেই মন খারাপ হয়ে যায়। মন খারাপি নিয়েই সাজিদকে কল দিলো।
আজকে আর সাজিদ বেয়াদবের পরিচয় দিলো না, খুব মিষ্টি করে সালাম দিলো প্রথমে। ইরতিজাও সুন্দরভাবে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলো।

“কেমন আছেন?” সাজিদ প্রশ্ন করলো।

“ভালো নেই।” সরল এবং সত্য উত্তরটাই দিলো ইরতিজা।

তার অকপটে সত্যতে সাজিদ অবাক হয়ে বললো,
“ভালো নেই কেন?”

“এমনিই। সবাই সব সময় ভালো থাকে না।”

“হ্যাঁ, সেটা ঠিক। আপনি তো আবার খারাপ মেয়ে! খারাপ মেয়েদের তো খারাপ থাকলেই সুন্দর লাগে। আপনাকে বোধহয় এখন খুব সুন্দর লাগছে ইরতিজা। আমাকে একটা ছবি তুলে পাঠাতে পারবেন? দেখতাম, খারাপ মেয়েকে খারাপে ঠিক কেমন লাগছে।”

“আপনি আমার মেজাজ খারাপ করে দিচ্ছেন। মেজাজ খারাপ করে দেবেন বলেই কি কল দিয়েছেন?”

“কল তো আমি দিইনি। কল তো তোমার থেকেই এসেছে।”

“আপনি আমার বোনের কাছে কল দিয়েছিলেন, সে বলেছে আমাকে। কেন কল দিয়েছিলেন?”

“আমার বউ খুঁজে পেয়েছেন কি না সেটা জানতে। পেয়েছেন?”

ইরতিজা আজ আর মিথ্যা বলতে পারলো না। মেয়েদের ফটো ডাউনলোড করা আছে তার কাছে, চাইলে একটা দুটো পাঠিয়ে দিয়ে মিথ্যা সান্ত্বনা দিতে পারে, কিন্তু দিলো না। বললো,
“কাউকে খুঁজে পাইনি। তবে নিরাশ হবেন না। আমি খুব সুন্দর একটা বউই খুঁজে দেবো আপনাকে। যাই হোক, আপনি ওয়াশিংটন কবে ফিরবেন?”

“কেন? বিয়ে করার খুব তাড়া বুঝি?”

“ছি! কীসব বলছেন? বিয়ে করার তাড়া থাকবে কেন? আর আপনাকে তো বলেছি, আমি আপনাকে বিয়ে করবো না।”
ইরতিজার লজ্জা লাগছে। লোকটার এটা বলার কি কোনো দরকার ছিল? লোকটা এমন কেন? যে মেয়ে এই লোকটার বউ হবে সেই মেয়ের তো দুঃখের সীমা থাকবে না। ইরতিজার এখনই খারাপ লাগছে সাজিদের ভবিষ্যৎ বউয়ের কথা চিন্তা করে।

সাজিদ বললো,
“অল্প কিছুদিনের ভিতরই ফিরছি। আমি ওয়াশিংটন আসলে আপনি খুশি হবেন, না কি বেজার?”

“এটা তো ভেবে দেখিনি।”

“তাহলে ভাবুন। আর ভেবে আমাকে উত্তর জানাবেন। যদি খুশি হন তাহলে তাড়াতাড়ি ফিরবো। আর যদি বেজার হন, তাহলে আরও তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো। রাখছি। আসসালামু আলাইকুম।”

সাজিদ কল কেটে দিলে কিছু মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে বসে রইল ইরতিজা। সাজিদের প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে। খুশি হবে? না কি বেজার হবে? দুটোর একটার ফিলও তো আসছে না তার মাঝে। মোবাইলটা বেজে উঠলো হঠাৎ। ইরতিজা ভেবেছিল আবারও সাজিদ কল দিয়েছে। কিন্তু কল দিয়েছে জোনাস। হৃদয়ে একটা তিক্ত কষ্ট মোচড় দিয়ে উঠলো। ছেলেটা কেন কল দেয় তাকে? কলটা এখন রিসিভ না করলে খুব ভালো হবে না? ভিতরে লুকায়িত এক সত্ত্বা বলে উঠলো, উহুঁ, মোটেও ভালো হবে না।
ইরতিজা কল রিসিভ করলো।

“আমি ভেবেছিলাম তুমি কল রিসিভ করবে না। কলটা এখনই কেটে যেত। যদি তুমি রিসিভ না করতে আমি দ্বিতীয়বার আর কল দিতাম না। কলটা রিসিভ করার জন্য তোমাকে মন থেকে ঘৃণা জানাচ্ছি টিজা।”

“আমিও এক বুক ঘৃণা নিয়ে তোমার কলটা রিসিভ করেছি জন। কিন্তু এটা করা উচিত হয়নি আমার। তুমিও ভুল করেছো কল দিয়ে। দ্বিতীয়বার যেমন কল দেবে না ভেবেছো, তেমনি প্রথম বারও কল দেওয়া উচিত হয়নি তোমার। কলটা না করাই উচিত ছিল।”

জোনাস হাসলো। সাংঘাতিক হাসি এটা। মন্ত্র পড়ে যদি এই হাসিটা নিঃশেষ করে দেওয়া যেত! নিঃশেষ করে দিতে পারলেই ইরতিজার মন তৃপ্তি পেতো।
জোনাসের হাসি থেমে গেছে। চাপা তিক্ত অনুভূতি নিয়ে বললো,
“আমি ভালো নেই টিজা, একদম ভালো নেই আমি। কেন তুমি বার বার স্মরণ করো আমায়? কেন আমার হৃদয়ে কষ্ট দাও? তুমি খুব বাজে টিজা, খুব বাজে।”

জোনাসের কথাগুলো কোনো অবুঝ বাচ্চার করা অভিযোগের মতো শোনালো। ওই অভিযোগে নিজের অজান্তেই বিদঘুটে কষ্ট অনুভব হচ্ছে। ইরতিজা বললো,
“আমি তোমাকে একবারের জন্যও মনে করিনি জন। তুমি ভুল ভাবছো।”

“তুমি মিথ্যাবাদী মেয়ে! আমি জানি তুমি আমাকে মনে করো, আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো। তুমি না বললেও সব জানি আমি। মন বেতারে ঠিকই সব খবর এসে পৌঁছায় আমার কাছে।”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here