উড়ো পাতার ঢেউ পর্ব: ৪২

0
486

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪২
_________________

জোনাস চলে গেছে। ক্যানিয়লের মুখ ডুবেছে ভাবনার অতল জলে। বেশ কিছু সময় সে একাকী ভাবলো। তারপর ইরতিজাকে জিজ্ঞেস করলো,
“মাঝরাতে সাইকেলে ঘোরার কথা ছিল মানে? কী বোঝালো? তোমাদের দুজনের মাঝরাতে সাইকেলে ঘোরার কথা হয়েছিল?”

ইরতিজা দুই পাশে ঈষৎ মাথা নেড়ে বললো,
“না।”

“তাহলে যে বললো মাঝরাতে সাইকেলে ঘোরার কথা ছিল?”

“ও চেয়েছিল আমাকে নিয়ে সাইকেলে ঘুরতে। কিন্তু আমি চাইনি।”

“তুমি কী চেয়েছিলে? ওর সাইকেল ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে?”

ভাঙনের কথা উঠতেই ইরতিজার হৃদয়ের পাড় গুড়মুড় শব্দ করে ভেঙে পড়লো সমুদ্রের নোনা জলে। ভীষণ অবসন্ন বোধ এসে প্রতিটা শিরায় শিরায় অবসাদ ছেয়ে দিলো। ক্লান্তিতে হঠাৎ লেগে আসতে চাইলো চক্ষুদ্বয়। ইরতিজা ব্যাগটা পিঠে নিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
“আমার শরীর ঠিক লাগছে না। বাসায় চলে যাচ্ছি আমি।”

ইরতিজা লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এলো। বেশি দূর হেঁটে আসার আগে ক্যানিয়লও বের হলো লাইব্রেরি থেকে। ইরতিজা আর তার মাঝে বেশ কিছুটা দূরত্ব। সে পিছন থেকে উচ্চরবে জানতে চাইলো,
“ওর কি এখনও তোমার প্রতি ফিলিংস আছে?”

প্রশ্নটা কানে আসা মাত্রই দাঁড়ালো ইরতিজা। শরীরের লোমগুলোও দাঁড়িয়ে গেল। ধীর লয়ে পিছন ফিরে তাকালো সে। বললো,
“আমার প্রতি ওর গভীর ঘৃণা আছে।”
কথাটা বলার সময় কণ্ঠ কেমন কম্পিত হয়ে উঠলো ইরতিজার। আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে চলে গেল দ্রুত পা ফেলে।

ক্যানিয়ল ভ্রুর মধ্যস্থলে ভাঁজ ফেলে বিড়বিড় করলো,
“ঘৃণার মানুষটার সাথে সাইকেলে ঘুরতে চায়? স্ট্রেইঞ্জ!”

_______________

শ্রেণিকক্ষটি প্রায় ফাঁকা পড়ে আছে। পাঠদান এখনও শুরু হয়নি বলে শিক্ষার্থীদের বড়ো অংশটাই এখন বাইরে অবস্থান করছে। গুটিকতক স্টুডেন্ট দেখা যাচ্ছে কক্ষটির ভিতর। তার মধ্যে জোনাস একজন। নীরব পরিবেশে জোনাসকে সমাচ্ছন্ন করে রেখেছে ইরতিজার ভাবনা। ইরতিজা তাকে ভালো না বাসলে, ইরতিজার মাঝে সে নিজের জন্য যে আর্দ্র বিষয়টি উপলব্ধি করতো, ওটা কী ছিল? ওটা কি ইরতিজার বন্ধুত্বপূর্ণ অনুভূতির অংশ ছিল? ওটা কি কেবলই বন্ধুত্বই ছিল?
দুটি অদৃশ্য হস্ত কষ্টের রং উলটে-পালটে মাখিয়ে দিতে লাগলো জোনাসের হৃদয়ে। ভীষণ কষ্ট তার হৃৎপিণ্ডকে দগ্ধ করছে!
ক্যানিয়লের আগমন দৃষ্টি কাড়লো জোনাসের। হৃদয়ের দগ্ধতায় বর্ষণ ঝরে হঠাৎই তা সচকিততায় রূপধারণ করলো। তবে সে ঘাবড়ালো না।
ক্যানিয়ল জোনাসের সম্মুখে বসলো। জোনাস তাকে যথাসম্ভব গ্রাহ্য না করার চেষ্টা করলো। ক্যানিয়লও কিছু না বলে নীরবে চোখ বুলিয়ে গেল জোনাসের উপর। ক্যানিয়লের এমন পর্যবেক্ষণ দৃষ্টির সম্মুখে অস্বস্তি হচ্ছিল জোনাসের। শেষ পর্যন্ত সে ক্যানিয়লকে উপেক্ষা না করতে পেরে বললো,
“কিছু বলবে?”

“আমার মনে হচ্ছে না আমি যেসব বলবো তা শুনতে তুমি ইচ্ছুক!”

“অনিচ্ছা হলেও শুনে নেবো।”

“ভালো। ইজার প্রতি কি তোমার ফিলিংস আছে এখনও?”

“নিজের প্রথম পছন্দকে কেউ সহজে ভুলতে পারে না। টিজা আমার মনে কাঁটার মতো গেঁথে আছে, থাকবে।”

“কিন্তু ওই কাঁটাটা যে মন থেকে উঠিয়ে ফেলতে হবে, সেটা কি জানো?”

“আমি কাঁটাটা উঠাবো না, সুতরাং এটা জানার প্রয়োজন বোধ নেই আমার।”

“ইজা তোমাকে পছন্দ করে না। তুমি আগে ওর বন্ধু ছিলে, কিন্তু এখন তুমি ওর কাছে শত্রু হিসেবে আছো, সেটা কি জানো?”

“না জানার মতো বিষয় নয় এটা।”

“তাহলে তুমি ওর সাথে শত্রুর মতোই থাকো। একজন শত্রুর আচরণ কখনও বন্ধুর মতো হলে সেটা কুৎসিত লাগে।”

“কিন্তু আমি যে নিজের শত্রু পরিচয়টা পালটাতে চাইছি।”

“মিত্র থেকে শত্রু হওয়ার পথটা হয়তো সহজ, কিন্তু শত্রু থেকে মিত্র হওয়ার পথটা অত্যন্ত কঠিন বলে মনে করি আমি।”

জোনাস হেসে বললো,
“কিন্তু আমি মোটেই ওর মিত্র হওয়ার চেষ্টা করছি না। মিত্রর থেকে নিশ্চয়ই আমি একজন প্রেমিক রূপে ভালো শোভা পাবো। আমি শত্রু থেকে ওর প্রেমিক হতে চাই।”

জোনাসের কথাটায় ক্যানিয়লের শরীর রাগে উত্তপ্ত হলো। রাগ নিবারণের জন্য হাত খিঁচে ধরলো সে। বললো,
“নক্ষত্রটা যখন অনুজ্জ্বল ভাবে আমার অন্তরিক্ষে ছিল তখনই তুমি এটা ছুঁয়ে দেখার অধিকার রাখোনি। আর এটা যখন এখন উজ্জ্বল ভাবে আমার অন্তরিক্ষ আলোকিত করছে, তখন তো তুমি অবশ্যই এটা ছুঁয়ে দেখার অধিকার রাখছো না। যার উপর তোমার অধিকার নেই তার থেকে সর্বদা দূরত্বে থাকাই শোভনীয়। দূরে থাকো। ইট’স মাই ফার্স্ট এন্ড লাস্ট এডভাইস টু ইউ।”

“কিন্তু আমার এখানে আগমনের একমাত্র কারণই ও। কারণের বিষয় বস্তুকে পাল্টে ফেলা যায় না সহজে।”

“তোমার এখানে আসাটা অহেতুক। কোনো কারণ নেই। ছোটো বেলায় কীভাবে নিজের মানুষদের আঁকড়ে ধরে রাখতে হয় জানতাম না। আর না জানার ফলে গুরুত্বপূর্ণ একজনকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু সেই সময়টার পর এখন অনেক সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। এখন আমি জানি কীভাবে নিজের মানুষদের নিজের কাছে রাখতে হয়।”

“আমিও নাছোড়বান্দা!”

“নাছোড়বান্দা হয়ে লাভ কী? যখন জানোই ছেড়ে দিতে হবে।”

জোনাস ভীষণ রেগে গেল। বসা থেকে দাঁড়িয়ে গিয়ে চাপা গর্জনে বললো,
“ইউ শাট আপ।”

রাগের পরিমাণ ক্যানিয়লের মাঝেও বৃদ্ধি পেল। চোয়াল শক্ত করে উঠে দাঁড়ালো সে। রক্ত হিম করা চাহনিতে জোনাসের চোখে তাকিয়ে বললো,
“আমার মনে হয় আমার সাথে উচ্চৈঃকণ্ঠে কথা বলার আগে তোমার একবার আমার সম্বন্ধে ভালো করে জেনে নেওয়া উচিত। ইজাকে বিরক্ত করা বন্ধ করো। নয়তো অন্যদের সাথে যেমনটা হয়, তোমার সাথেও তেমনই ঘটবে। বি কেয়ারফুল, ও কে?”

জোনাস স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে রইল।
ক্যানিয়ল শেষ মুহূর্তে ঠোঁটে অদ্ভুত হাসির প্রভা ছড়িয়ে চলে গেল।

_______________

আজকের দিনটাই কেমন অলস ভঙ্গির। নিস্তেজ ভাব আদৌ প্রকৃতির মাঝে, না কি তার মন মাঝে বুঝতে পারছে না ইরতিজা।
ইউনিভার্সিটি থেকে চলে এসেছে অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। দুপুরের কড়া রোদ নাচছে প্রকৃতির উপর। হেলেদুলে বাতাস বইছে। বাতাসে দোল খাচ্ছে বারান্দায় টাঙানো তারাগুলো। নতুন লাগানো হয়েছে এগুলো। নওরিন কিনে এনেছে। এগুলোকে এক প্রকার লাইট বলা চলে। কারণ এগুলোতে আলো উৎপন্নের প্রক্রিয়া আছে। রাতের বেলায় এগুলো জ্বালিয়ে দিলে দারুণ দেখা যায় না কি।
আজকের রোদ প্রখর হলেও তাপমাত্রা কিন্তু উষ্ণতম নয়। বরং শীতল। ইরতিজার গায়ে প্রয়োজনীয় উষ্ণ কাপড় জড়ানো।
বেশ কিছুটা সময় ধরে সে উদাসী মনে বসে ছিল। অলস ভঙ্গিতে কিছু বিষয়ের আলপনা এঁকে চলছিল মনে। আর উপলব্ধি করছিল সবচেয়ে সুন্দরতম বিষয়টুকু ক্যানিয়লকে ঘিরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎ অপরিচিত একটা রিংটোন কানে এলো। একটু শোনার পর বুঝতে পারলো আসলে এটা অপরিচিত রিংটোন নয়, রিংটোনটা নওরিনের মোবাইল ফোনের। নওরিন কিছুক্ষণ আগে ছিল তার এখানে। যাওয়ার সময় নিশ্চয়ই ফোনটা ভুলে রেখে গেছে। ইরতিজা বারান্দা থেকে রুমে এলো। বেড সাইড টেবিলে ফোনটা বাজছে। হাতে নিয়ে কলারের নামটা দেখে একটু বিস্মিত হলো সে। সাজিদ?
সেদিন কথা বলার পর সাজিদ আর তার কাছে কল দেয়নি। একটা ভুল ধারণা নিয়ে তাকে ভুল বুঝেছে! সাজিদ তাকে জীবনে আর কোনোদিন কল না দিলেও তার কিছু আসে যায় না। কিন্তু সাজিদ তো মূলত ভুল ধারণার উপর ভিত্তি করে রাগ করে কল দিচ্ছে না। যে বিষয়টা আসলে অমন ছিল না, সেই বিষয় নিয়ে কেন রাগ করবে সাজিদ? সাজিদের এমন রাগের কারণে ইরতিজারও এবার বেজায় রাগ হলো। সে নওরিনকে খুঁজলো। কিন্তু পেল না। সাজিদের কল ইতোমধ্যে রিং হয়ে কেটে গেছে। ইরতিজার হঠাৎ কৌতূহল হলো। সাজিদ তো তার কাছেই তেমন একটা কল দেয় না। এখন রাগ করে যোগাযোগ একেবারেই বন্ধ। তাহলে নওরিনের কাছে কল দিয়ে কী বলবে সে? হঠাৎ নওরিনকে কেন কল দিচ্ছে? হঠাৎ? না কি নওরিন আর সাজিদের রোজই কথা হয়? ভীষণ কৌতূহল চেপে ধরলো ইরতিজাকে। বিষয়টা কিছুটা হলেও খতিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করলো সে।
নওরিনের ফোনটা বেজে উঠলো আবার। ইরতিজা আরও বিস্মিত হলো। সাজিদ তাকে কখনও একবারের বেশি কল দেয় না। কোনো কারণে সেই কলটা রিসিভ না করতে পারলে পরে নিজের কল ব্যাক করতে হতো। দ্বিতীয় বার কল দিতো না সাজিদ। নওরিনের ফোনে সাজিদের দ্বিতীয়বার কল করাটা দেখে তাই বিস্ময়ান্বিত হতেই হলো তার। কলটা কেটে যাবে যাবে এমন মুহূর্তে এলেই কোনো কিছু না ভেবেই হঠাৎ টুপ করে কলটা রিসিভ করে ফেললো ইরতিজা। ওপাশ থেকে সাজিদের কণ্ঠ শুনতে পেল,
“আসসালামু আলাইকুম!”

ইরতিজা মনে মনে সালামের উত্তর দিলেও মুখে উত্তরের ধ্বনিটা প্রকাশিত হলো না। তার এপাশটা নীরব রইল। এই নীরবতার দেখাদেখি ওপাশটায়ও নীরবতা ঘনিয়ে এলো। একেবারে নীরব সময় কাটলো এক কি দুই মিনিট। এরপর ওপাশ থেকে সাজিদের গমগমে কণ্ঠ ভেসে এলো,
“হোয়াই ডিড ইউ রিসিভ দ্য কল? হোয়্যার ইজ ইওর সিস্টার?”

ইরতিজা চমকে উঠলো। সাজিদ কী করে বুঝতে পারলো এটা ও ছিল? আর সাজিদের কথা বলার ধরন দেখে রীতিমতো মেজাজ খারাপ হয়েছে ওর। ও কিছু বললো না। আবারও খুঁজতে আরম্ভ করলো নওরিনকে। খুঁজতে খুঁজতে চলে এলো একেবারে সুইমিং পুলের ধারে। এখানে দেখা যাচ্ছে নওরিনকে। প্রতিবেশী এক মেয়ের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। ইরতিজা ফোনটা নওরিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“কল দিয়েছে।”

ফিয়ন্সে কল দিয়েছে এমন ভেবে নওরিনের হৃদয়ে খুশির একটা দোল দেখা দিলো। কারণ ফিয়ন্সের সাথে ইদানিং কথাবার্তা হচ্ছে না তার। কল দিলে কল রিসিভ করে না সে। নওরিন উল্লাসের সহিত জিজ্ঞেস করলো,
“কে কল দিয়েছে?”

ইরতিজা উত্তর না দিয়ে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে চলে এলো। ফোন হাতে নিয়ে ভুল ভাঙলো নওরিনের। এটা তার ফিয়ন্সে নয়, সাজিদ।

“হ্যালো!”

“কেমন আছেন?” সাজিদের প্রশ্ন।

“আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?

“ভালো।”

“হঠাৎ আমাকে কল দিলেন যে?”

“একটা বিষয় জানানোর ছিল আপনাকে। কিন্তু বিষয়টা জানার পর আপনি কেমন রিয়াক্ট করবেন সেটা ভেবে আমি চিন্তিত।”

সাজিদের এ কথায় নওরিন একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। বিস্মিত তো সে বটেই। হঠাৎ কী এমন জানাবে সাজিদ?
নওরিন বললো,
“হ্যাঁ আপনি বলুন যা বলতে চান।”

সাজিদ একটু নীরবতা পালন করে বললো,
“আমার মনে হচ্ছে আপনার ফিয়ন্সের অন্য কারো সাথে রিলেশনশিপ চলছে!”

কথাটা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না নওরিন। তাই একটু ঝটকা লাগলো হঠাৎই কথাটা শুনে। বলে উঠলো,
“কী বলছেন আপনি?”

“আপনার ফিয়ন্সেকে একটা মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে ঘুরতে দেখেছি। আমার মনে হয় না কেউ তার বোনের সাথে এভাবে ঘুরবে, বা নিজের ফ্রেন্ডের সাথে। দেখে মনে হচ্ছিল দুজন কাপল। হবে হয়তো ওটা আপনার উডবির গার্লফ্রেন্ড!”

নওরিনের মস্তিষ্কে বিদ্রোহ চলছে। মাথা ঘুরছে। শরীর আর নিজের চেতনা ধরে রাখতে পারছে না। এটা কী শুনছে? এটা সত্যি? না কি কোনো ঠাট্টা? শরীর মৃদুভাবে কাঁপতে শুরু করলো তার। এমনটা কখনও আশা যোগ্য ছিল না হামাদের থেকে। হামাদ কি সত্যিই এমনটা করছে? এই জন্যই কি হামাদের তার প্রতি এত অবহেলার সৃষ্টি হয়েছে? বুক ফাঁটানো এক হাহাকার বেরিয়ে আসতে চাইছে নওরিনের ভিতর থেকে। কিন্তু সে খুব কষ্টে আটকে রাখলো তা। নিজেকে যথাসম্ভব কঠিন রাখলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here