উড়ো পাতার ঢেউ পর্ব: ৫৯

0
689

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৫৯
_________________

আজাদ চৌধুরীর মস্তিষ্ক এক মুহূর্তের জন্য শান্তি পাচ্ছে না। প্রবল চাপ মস্তিষ্কের উপর। গত রাতের কথা মনে পড়ছে তার। ইরতিজা বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরেছিল। ফিরেছিল বললে ভুল, সাজিদ ফিরিয়ে এনেছিল।
বাড়ি ফেরার পর যেন ইরতিজা মাথা সোজা রেখে দাঁড়াতে পারছিল না বাবার সামনে। সে মস্তক নত করে দাঁড়িয়েছিল। ইতস্তত করে কিছু বলতে চাইলে আজাদ চৌধুরী ওকে বললেন,
“এখন কিছু বলার দরকার নেই। তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে এমন ভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে থাকলে। রুমে যাও। যা বলার সকালে বলবে।”

ইরতিজা লিভিং রুমে উপস্থিত সকলের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিশ্চুপ রুমে চলে আসে। ভেজা কাপড়-চোপড় পাল্টে শুয়ে পড়ে।
রাত বাড়তে থাকে কিন্তু ইরতিজার চোখে ঘুম ধরা দেয় না, মনে একটু শান্তির পরশ মেলে না। ভিতরে এক অসহ্যকর পরিস্থিতি।
এক সময় রুম থেকে বের হয় ইরতিজা। ধীর পা ফেলে লিভিং রুমে এসে দেখে বাবা একা সেই আগের মতোই বসে আছে সোফায়।
ইরতিজা এগিয়ে এসে বসে বাবার পাশে।

আজাদ চৌধুরী বললেন,
“রাত অনেক হয়েছে ইরতিজা। যাও ঘুমিয়ে পড়ো।”

কিন্তু ইরতিজা শোনে না তার কথা। সে বাবার হাত দু খানা ধরে বললো,
“স্যরি আব্বু! আমি তোমার মনে কষ্ট দিয়েছি। আমার উচিত হয়নি এটা করা। আমি তোমার অবাধ্য হয়েছি! তুমি যখন চেয়েছিলে সাজিদের সাথে আমার বিয়ে হোক, তখন আমার উচিত ছিল সাজিদকে নিয়ে ভেবে দেখা। কিন্তু আমি ওনাকে নিয়ে কখনও ভাবিইনি। তোমরা ভুল বুঝে সাজিদের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছিলে, যেটা আমি মেনে নিতে পারিনি। অর্টনের সাথে তো তেমন কিছু ছিলই না আমার, বা ওর প্রতি আমার বিশেষ অনুভূতি জন্ম নিতো এমনটাও হতো না। ওকে নিয়ে এটা ভাবাও ইম্পসিবল ছিল আমার কাছে। আমি নিশ্চিত অর্টনও আমায় নিয়ে এসব ভাবতো না কখনও। ও যা করেছিল ওটা শুধুই বন্ধুত্ব থেকে। অথচ ওই ঘটনাটার জন্য আমার এনগেজমেন্ট হয়ে গেল! খুব বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম আমি যখন সবাই আমাকে অবিশ্বাস করেছিল।
আমি চাইনি তোমাকে কষ্ট দিতে আব্বু। কিন্তু ক্যানিয়লের প্রতি আমার অনুভূতি তো জানান দিয়ে আসেনি। জানি না কখন কীভাবে আমরা একে অপরকে ভালোবেসে ফেললাম! তবে এখন যেটা জানি সেটা হচ্ছে, আমার হৃদয় থেকে ক্যানিয়লের জন্য অনুভূতি মুছে ফেলা সম্ভব নয়। আমার সমগ্র হৃদয় জুড়ে ও। আমার হৃদয় থেকে ওর অস্তিত্ব বিলীন করে নতুন করে সাজিদের অস্তিত্ব সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। আমি বেঁচে থাকাকালীন কখনোই সম্ভব নয় এটা।”

আজাদ চৌধুরী মনোযোগ সহকারে ইরতিজার কথা শুনলেন। কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি কোনো কথা বলতে চাইলেন না এ ব্যাপারে। বললেন,
“এই ব্যাপারে এখন কথা না বলি আমরা। অনেক রাত হয়েছে, তোমার ঘুমানো উচিত।”

ইরতিজা তবু শুনলো না, বললো,
“ক্যানিয়ল বলে আমি ওর হ্যাপিনেস, ভালো থাকার মাধ্যম। আমি যার ভালো থাকার মাধ্যম তার কাছে কি আমি ভালো থাকবো না আব্বু?”

আজাদ চৌধুরী কিছুক্ষণ মেয়ের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। ইরতিজার চোখে উদ্‌বেগ। ওই চোখ তাকে বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আকুল হয়ে চেয়ে আছে কখন সে বুঝবে সেই খুশিতে হেসে উঠবে সেজন্য।
আজাদ চৌধুরী ওই দৃষ্টি সীমার মধ্যে আর স্থির থাকলেন না, দ্রুত পদে বেডরুমে চলে এলেন। পালিয়ে এলেন যেন।
গত রাতের পালিয়ে আসার কথা মনে পড়লে এখনও তার বুক ঠকঠক করে। সে এখনও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষম। কী করবে সে? একবার তার মনে হয় ইরতিজা যাকে বেছে নিয়েছে সে ভুল। সেই ছেলের সাথে ভালো থাকবে না ইরতিজা। যদিও সে ছেলেটাকে দেখেনি, চেনে না। আবার মনে হয় সাজিদের সাথে বিয়ে দেওয়া কি ঠিক হবে? যেখানে ইরতিজা চায় না সাজিদের সাথে বিয়ে হোক! জোর করে বিয়ে দিলে কি সুখী হবে তার মেয়ে? আবার নওরিনের কথাও মনে পড়ে যায়। নওরিন জীবনসঙ্গী করার জন্য যাকে বেছে নিয়েছিল সেই ছেলেটা নওরিনের ভুল পছন্দ ছিল! ইরতিজার ক্ষেত্রেও যে তেমন হবে না তার কী নিশ্চয়তা আছে? না কি ইরতিজা সঠিক মানুষকে বেছে নিতে পেরেছে?
আজাদ চৌধুরীর দিগভ্রান্ত লাগছে। মাথার ভিতর সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ শারমিন আহমেদের কণ্ঠ কানে এলো,
“এরকমভাবে বসে আছো যে? অফিসে যাবে না?”

আজাদ চৌধুরী সামনে শারমিন আহমেদের দিকে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন,
“ইরতিজা কোথায়? রাতে খেয়েছিল কিছু?”

“রাতে খায়নি কিছু। এখন বাসায় নেই। বাইরে হাঁটাহাঁটি করতে গিয়েছে বোধহয়। ফ্রিজে খাবার রাখা আছে, খিদে লাগলে সেখান থেকে খেয়ে নেবে কিছু। তুমিও তো কিছু খাওনি! কিছু খাবে?”

“শুধু আমি আর ইরতিজাই কি কিছু খাইনি? বাসার বাকি দুজন খেয়েছে কিছু?”

শারমিন অপ্রস্তুত হলেন স্বামীর প্রশ্নে। তবে দ্রুতই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলেন,
“নওরিন বাইরে থেকে কিছু খেয়ে নেবে। আমিও অফিসের ক্যান্টিন থেকে কিছু খেয়ে নেবো। কিন্তু তোমরা দুজন কী করবে সে বিষয়ে আমি চিন্তিত।”

শারমিন চলে গেলেন। আজাদ চৌধুরী বড়ো করে নিঃশ্বাস ফেললেন। সোফার পিছনে থাকা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। ইরতিজাকে দেখতে পাচ্ছেন না। আজ পুরো দিনে হয়তো মেয়েটা আর বাসায় আসবে না, বাইরে বাইরেই কাটিয়ে দেবে।

______________

মি. হেনরির গাড়ি যখন পুরোনো বাড়ি মুরহাউজের সামনে এসে থামলো তখন ক্যানিয়ল ইরতিজাকে কোলে নিয়ে বের হয়েছে বাইরে। মি. হেনরি গাড়ি থেকে নেমেছিল কেবল, ক্যানিয়ল এরই মাঝে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে চলে গেল। একবার খেয়ালও করলো না মি. হেনরি এসেছে। মি. হেনরি ক্যানিয়লের লোকেশন ট্র্যাক করে এসেছে এখানে। প্রথমে সে ভেবেছিল ক্যানিয়ল হয়তো নাইলা সালেমের কাছে যাচ্ছে। কিন্তু যখন দেখলো ক্যানিয়ল নাইলা সালেমের কাছে যায়নি, তখন সে বুঝতে পারলো অন্য কিছু ঘটেছে। এই মুহূর্তে ইরতিজাকে এমন দেখে সে বুঝতে পারলো কত বড়ো সাংঘাতিক ঘটনা এখানে ঘটেছে। সে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো। দেখলো বেশ কিছু ছেলে-মেয়ে মার খেয়ে পড়ে আছে এখানে। মিরান্ডাকে দেখতে পেল হলঘরের এক কর্ণারে বসে আছে। রুমাল দিয়ে নাকের র’ক্ত মুছছে। সে এসেছে তা খেয়াল করেনি।
মি. হেনরি পুরো হলঘরের উপর দৃষ্টি বুলালো। লন্ডভন্ড অবস্থার মতো লাগছে হলঘরটা। মিরান্ডা উঠে দাঁড়াতেই মি. হেনরিকে দেখতে পেল। হকচকিয়ে গেল সে। কিছু না বলেই দ্রুত পায়ে হলঘর থেকে বেরিয়ে গেল মিরান্ডা।
মি. হেনরিও একটু সময় পর বাইরে বের হতে উদ্যত হয়েছিল। কিন্তু আচমকা হলঘরের একটা জায়গায় দৃষ্টি পড়তে ভ্রু কুঞ্চন হলো তার।

_______________

ইরতিজাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে ক্যানিয়ল। ইরতিজার চিকিৎসা চলছে এখন। ক্যানিয়লের কান্না পাচ্ছিল খুব। সে তড়িঘড়ি করে ওয়াশরুমে চলে এলো। অজস্র কষ্টে তার বুক জ্বালা করছে। তার জীবন এখন কত দুর্বিষহ পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে যাচ্ছে সেটা সে ব্যতীত হয়তো আর কেউ উপলব্ধি করতে পারছে না। হঠাৎ করে তার জীবন দুর্বিষহ যন্ত্রণায় ঢেকে গেল কেন? তার রোদ্রজ্জ্বল জীবন ঢাকা পড়েছে এক টুকরো ঘন কালো মেঘে। ওই কালো মেঘ থেকে বৃষ্টি ঝরে। ঝড় হয়। লন্ডভন্ড করে দেয় হৃদয়ের যাবতীয় সকল কিছু। ওলটপালট করে পুরো তাকে।

মি. হেনরি হসপিটালে এসে ইরতিজার খোঁজ পেলেও ক্যানিয়লকে দেখতে পেল না। এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগলো ক্যানিয়লকে। কিন্তু কোথাও দেখতে পাচ্ছে না।
খুঁজতে খুঁজতে শেষমেশ ওয়াশরুমে এসে পেল ওকে।

“ক্যানি!” ডাকলো মি. হেনরি।

ক্যানিয়ল পিছন ফিরে তাকালো। মি. হেনরি কাছে এগিয়ে এসে বললো,
“এখানে এরকম ভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? সবকিছু ঠিক আছে।”

“কিছু ঠিক নেই মি. হেনরি। আমার আশেপাশের যাবতীয় সবকিছু এলোমেলো এখন। আমি নিজেও লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছি। আমার সাথে এরকম কেন হচ্ছে? হঠাৎ এত কঠিন কঠিন শাস্তি কেন দেওয়া হচ্ছে আমাকে? কয়েকদিন পূর্বেও আমি একজন সুখী মানুষ ছিলাম, কিন্তু মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে আমি ভেসে এলাম দুঃখের সমুদ্রে। টেরও পেলাম না কখন যে এখানে ভেসে এসেছি। এই সমুদ্রে সাঁতার কাটতে পারছি না আমি। তলিয়ে যাচ্ছি পানির গভীর অতলে। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না মি. হেনরি। মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছি!”

কথাগুলো বলতে বলতে ক্যানিয়ল আরও দুর্বল হয়ে পড়লো।
“ইজা আমার বিষাদ আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র মি. হেনরি। আমি যখন আমার উজ্জ্বল নক্ষত্রকে অমনভাবে পড়ে থাকতে দেখলাম নিশ্চল অবস্থায়, তখন আমার কেমন অনুভূতি হয়েছিল তুমি জানো না। আমার হৃৎস্পন্দন থেমে গিয়েছিল ওকে দেখে। আমি মারা যেতে চলেছি এমন অনুভব করেছিলাম তখন।”
ক্যানিয়ল একটু থেমে আবার বললো,
“ইজা বলেছিল আমি কাঁদলে ও আমার মাথায় সান্ত্বনার হাত রাখবে, কিন্তু আজ ওর এমন অবস্থা! আমার এই কঠিন মুহূর্তে মাথায় এখন কে হাত রাখবে মি. হেনরি? দেখো আমি কাঁদছি, অথচ আমার মাথার উপর ওর হাতটা নেই! ওই হাতটার শূন্যতা ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে আমার অভ্যন্তরকে।”

মি. হেনরি সদ্য মাকে হারানোর শোকে কাতর এবং প্রেয়সীর করুণ অবস্থায় দিশেহারা হওয়া ছেলেটাকে কী বলে সান্ত্বনা দেবে বুঝতে পারছে না। সে দুই হাতের বেষ্টনে জড়িয়ে ধরলো ক্যানিয়লকে। পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
“শান্ত হও, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। তুমি আবারও একজন সুখী মানুষ হয়ে উঠবে। শান্ত হও। তোমাকে তো এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যানিয়ল নিজেকে ধাতস্থ করতে সক্ষম হলো। চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো সে। ইরতিজার কাছে গেল। ইরতিজার জ্ঞান ফিরেছে। ইরতিজার পরনে এখন মেডিকেল পেশেন্ট ড্রেস। মুখে বেশ কিছু ক্ষত দেখা যাচ্ছে। এক চোখের পাশে আঘাত লাগায় সে স্থানটা ফুলে উঠেছে। এছাড়াও আঘাতের কারণে দু গালও ফুলে উঠেছে। ঠোঁটের ক্ষতও গভীর। দুই হাতেও মারের দাগ। ইরতিজাকে দেখার পর ক্যানিয়লের চোখে আবারও অশ্রুর দল চিকচিক করে উঠলো। বুকের ভিতরেও চিনচিন করে উঠতে লাগলো ব্যথারা। সে ইরতিজার স্যালাইন লাগানো হাতটা দুই হাত দিয়ে আলতো পরশে ধরলো। ইরতিজার চোখের পাতা অর্ধ উন্মীলিত এবং অর্ধ বোজা অবস্থায় আছে। পিটপিট করছে চোখের পাতা। পুরো চোখ খুলে তাকাতেই ক্যানিয়লের চোখে পানি দেখে তারও কান্না পেল। সে দাঁত দিয়ে নিম্ন ওষ্ঠ কামড়ে ধরলো কান্না আটকানোর চেষ্টায়। কিন্তু চোখের জল বাধ মানলো না, ঝরে পড়লো কোণ বেয়ে। বললো,
“আমি ঠিক আছি।”

“মিথ্যাবাদী! আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি ঠিক নেই।”

ইরতিজা দু চোখ বুজে ফেললো কিছু সময়ের জন্য। চোখের কোণ বেয়ে টপাটপ পড়তে লাগলো উষ্ণ অশ্রু। সে আবার চোখ মেলে চাইলো। কাঁপা কাঁপা হস্ত খানা দিয়ে ক্যানিয়লের কপোল স্পর্শ করে বললো,
“কেঁদো না। তুমি কাঁদলে তোমার ওই সুন্দর আঁখি জোড়া আরও বেশি সুন্দর দেখায়। কিন্তু আমার হৃদয়ে অসুন্দর অনুভূতির সৃষ্টি করে!”

ক্যানিয়ল কপোল স্পর্শ করা ইরতিজার হাতটায় অধর ছুঁইয়ে হাতটা বেডে নামিয়ে রাখলো। বললো,
“সব ঝামেলা মিটে গেলে আমরা দুজন সুখী জীবনযাপন করবো। একসাথে!”

মি. হেনরি রুমের বাইরে অপেক্ষা করছিল। ক্যানিয়লকে বেরিয়ে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালো। ক্যানিয়ল শেষ আরেকবার তাকালো ইরতিজার দিকে। তারপর বললো,
“তুমি এখানে থাকো মি. হেনরি। আমার ড্যাডের সাথে কিছু কথা আছে। আমি তার সাথে জরুরি দেখাটা সেরে আসছি।”

ক্যানিয়ল এক পা এগোনো মাত্রই মি. হেনরি প্রশ্ন করলো,
“মিরান্ডার শাস্তি এখনও বাকি তাই না?”

ক্যানিয়ল ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। বললো,
“উত্তরটা রাতেই পেয়ে যাবে।”

বলে সে ক্রমাগত পা ফেলে এগিয়ে গেল নিজ গন্তব্যে। প্রথমে ড্যাডের অফিসে গেল, কিন্তু জানতে পারলো ড্যাড বাড়িতে চলে গেছে। তারপর আবার বাড়ির পথ ধরলো।
বাড়ির অভ্যন্তরে প্রবেশ করার পর প্রথমে দেখা হয়ে গেল মাদার সোফিয়ার সাথে। তিনি ক্যানিয়লের কপালে মেডিকেল প্লাস্টার দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
“কী হয়েছে তোমার?”

ক্যানিয়ল উত্তর দিলো না, ড্যাডের বেডরুমের দিকে যেতে লাগলো।
ইয়াদা এবং ইয়াদার মেয়ে মোরিন সোফিয়ার সাথে ছিল। ইয়াদা বললেন,
“জানো না কী হয়েছে? নিশ্চয়ই কাউকে মারার সময় নিজেও খেয়েছে দু-এক ঘা।”

মোরিন বললো,
“কিন্তু ওকে অস্বাভাবিক লাগলো!”

ড্যাডের বেডরুমে যাওয়ার পথে নাইলা সালেমের সাথেও দেখা হয়ে গেল ক্যানিয়লের। ক্যানিয়লকে দেখে সে অবজ্ঞাত হেসে বললো,
“কার হাতে মার খেয়েছো?”

নাইলা সালেমকে দেখে রাগ, ঘৃণায় দগ্ধ হয়ে উঠলো ক্যানিয়লের অন্তঃকরণ। বিষাক্ত লাগছে নাইলা সালেমের সাথে তার এই সাক্ষাৎ। দু চোখের ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“তুমি যদি আমার ড্যাডের স্ত্রী আর সামুরার মা না হতে, তাহলে তোমার শাস্তি আমি নিজ হাতে দিতাম। সবার শাস্তিকে ছাপিয়ে আমার থেকে সেরা শাস্তিটা তুমিই পেতে!”

নাইলা সালেমের দুই ভ্রুর মধ্যস্থলে কুঞ্চনের সৃষ্টি হলো। তিনি হঠাৎ ক্যানিয়লের এমন কথার অর্থ বুঝতে না পেরে বললেন,
“কী? কী বলছো তুমি?”

ক্যানিয়ল উত্তর না দিয়ে ড্যাডের রুমে এসে দরজা বন্ধ করলো। মুহাম্মদ ইসহাক একজন বিদেশি ক্লায়েন্টের সাথে ভিডিয়ো কনফারেন্সের মাধ্যমে কথা বলছিলেন। আকস্মিক ক্যানিয়লের এমন প্রবেশে তার মনোযোগ বিনষ্ট হলো। ক্যানিয়ল বললো,
“তোমার সাথে ইম্পরট্যান্ট বিষয় শেয়ার করার আছে ড্যাড।”

মুহাম্মদ ইসহাক ভিডিয়ো কনফারেন্স শেষ করার পর উঠে দাঁড়ালেন। জানতে চাইলেন,
“কী এমন ইম্পরট্যান্ট বিষয় যা শেয়ার করার জন্য আমার কাজের সময় হাঙ্গামা করতে হলো তোমার?”
মুহাম্মদ ইসহাকের দৃষ্টি ক্যানিয়লের কপালে গিয়ে আটকালো।
“আঘাত পেয়েছো কীভাবে?”

ক্যানিয়ল ড্যাডের শেষ প্রশ্নের উত্তর দিলো না। বললো,
“এটা আমার মমের ব্যাপারে ড্যাড। তুমি কি জানো মম আমাকে, তোমাকে, এই বাড়ি, সবকিছু ছেড়ে কেন চলে গিয়েছিল?”

দীর্ঘকাল পর এই প্রসঙ্গ ওঠায় মুহাম্মদ ইসহাক বুকের অন্তরালে সূক্ষ্ম ব্যথার টের পেলেন। জানতে চেয়ে বললেন,
“কেন?”

কষ্টে ক্যানিয়ল মুখে আর কিছু উচ্চারণ করতে পারছিল না। পকেট থেকে পেনড্রাইভ বের করে দিলো ড্যাডকে।

“এটা মমের মৃত্যুর আগের ভিডিয়ো, যেটা সে আমার জন্য তৈরি করেছিল। আমি মনে করি তোমারও এটা দেখা উচিত।”

________________

বাড়ি থেকে রাস্তায় বের হয়ে ক্যানিয়ল একটু প্রশান্তিময় নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। তার একটা কাজ সম্পন্ন হয়েছে। শুধু মমের চলে যাওয়ার কারণই নয়, এতদিন যাবৎ তার উপর হয়ে আসা অ্যাটাক এবং হুমকিমূলক কলের ব্যাপারেও সে ড্যাডকে জানিয়েছে। এটা যে নাইলা সালেমের কাজ ছিল এ বিষয়ে এখন জানেন মুহাম্মদ ইসহাক। ক্যানিয়ল নিজ থেকে এটা কখনও ড্যাডকে জানানোর কথা চিন্তা করেনি। কিন্তু যে মুহূর্তে সে জানতে পারলো তার মমের চলে যাওয়ার পিছনের কারণটা নাইলা সালেম, তখন নাইলার প্রতি থেকে সকল করুণা বিতাড়িত হয়েছে তার। ক্যানিয়ল নিশ্চিত নাইলা সালেমের এবার চোখের জল ফেলতে হবে তার ড্যাডের পা জড়িয়ে ধরে। গগন পৃষ্ঠে চক্ষু মেলে ক্যানিয়ল আবারও বড়ো করে নিঃশ্বাস ফেললো। পথ ধরলো হসপিটালের।
______________

“ইজার ফ্যামিলির কাউকে জানানো প্রয়োজন মি. হেনরি।”

“কাকে জানাবে?”

“আমি তো হুট করে ওর মম-ড্যাডকে ইনফর্ম করতে পারবো না। প্রথমে ওর দুই কাজিন, জুহি আর রিশনকে জানাতে পারি। তারপর ওরা দুজন না হয় ইজার ফ্যামিলিকে জানাবে।”

মি. হেনরি মাথা দুলিয়ে সায় দিলো,
“হ্যাঁ, সেটা করা যেতে পারে। আমি কল করবো ওদের।”

ক্যানিয়ল কৃতজ্ঞতার সুরে বললো,
“থ্যাঙ্ক ইউ, সব রকম পরিস্থিতিতে আমার সাথে থাকার জন্য।”

মি. হেনরি একটুখানি হাসলো। এতক্ষণ দুজন ইরতিজার রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। ক্যানিয়ল রুমে প্রবেশ করতে উদ্যত হলে মি. হেনরি বললো,
“ওহ ক্যানিয়ল, আমি একটা বিষয় জানাতে ভুলে গিয়েছিলাম তোমায়।”

“কী সেটা?”

“একটা ক্যামেরা।”

ক্যানিয়ল ভ্রু কুঁচকে বললো,
“ক্যামেরা?”

“হ্যাঁ, যেটা আমি ঘটনাস্থলে পেয়েছি। ইরটিজাকে ওখানে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু রেকর্ড হয়েছে সেই ভিডিয়ো ক্যামেরায়। আসলে মিরান্ডা যে দলটাকে ভাড়া করেছিল ইরটিজাকে মা’র’ধ’র করায় সাহায্য করার জন্য, ওই দলটা মিরান্ডাকে ব্ল্যাকমেইল করার একটা পরিকল্পনা করেছিল। ওরা ভেবেছিল পুরো ঘটনাটার ভিডিয়ো করে সেটা দিয়ে মিরান্ডাকে ব্ল্যাকমেইল করে ডলার হাতাবে। কিন্তু ওদের পরিকল্পনা সফল হয়নি। কারণ ক্যামেরাটা ওরা সরিয়ে ফেলার আগে ক্যামেরাটা আমার হাতে এসে পড়েছে।”
এটুকু বলে একটু সময়ের জন্য থামলো মি. হেনরি। অতঃপর আবার বললো,
“তোমার কি মনে হয় না এটা মিরান্ডাকে চরম শাস্তি দেওয়ার একটা মাধ্যম হতে পারে? ওর…”

“আমি বুঝতে পারছি তুমি কী বলতে চাইছো, আর বলার দরকার নেই।” মি. হেনরিকে পুরো কথা শেষ করতে দিলো না ক্যানিয়ল।
মি. হেনরি হাসলো। ক্যানিয়লের হাতে তুলে দিলো ভিডিয়োটা। বললো,
“ভিডিয়োর একটা কপি স্যার ইসহাকের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। আর একটা তোমায় দিলাম।”

ক্যানিয়ল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“তোমার কী মনে হয়? এই ভিডিয়োটা দেখতে পারবো আমি? এটা আমার সহ্য ক্ষমতার আওতায় থাকবে?”

“দেখা উচিত তোমার। ইরটিজার শরীরের সবগুলো ক্ষ’ত’ই মিরান্ডার তৈরি করা! ও একাই মে’রে’ছে ইরটিজাকে। বাকিরা শুধু সাহায্য করেছে।”

ক্যানিয়ল ক্ষোভের সাথে বললো,
“ওর শরীরেও ঠিক ইজার মতোই ক্ষ/তর সৃষ্টি হবে। অনেকদিন যাবৎ আমার হকি স্টিকগুলোয় কোনো র/ক্তে/র দাগ লাগেনি। আজ লাগবে।”

ক্যানিয়ল রুমে প্রবেশ করলো। ইরতিজা ঘুমাচ্ছে। বাইরে বিকেলের আকাশে কালো মেঘের চলাচল। ক্যানিয়ল বসলো ইরতিজার পাশে টুল টেনে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
“তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো পাকিস্টানি গার্ল। তুমি সুস্থ হয়ে উঠলে একবার প্রাণ খুলে কাঁদতে চাই। তখন আমার মাথার উপর তোমার হাতটাও অবশ্যই থাকা চাই।”

________________

বৃষ্টি নেমেছে। প্রবল বৃষ্টি। আকাশের বুকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। হঠাৎ করেই এত ভারি বৃষ্টি শুরু হলো। না হঠাৎই বা বলা যায় কীভাবে? আজ সারাদিনই তো আকাশ মেঘলা ছিল। ওয়েদার ফোরকাস্টও জানিয়েছিল বিকেলে বৃষ্টি হবে। জুহি একবার ক্যানিয়লের বাসায় যাবে চিন্তা করেছিল, কিন্তু বৃষ্টির কারণে আটকা পড়েছে। দরজা-জানালা সব বন্ধ করে ঘরের ভিতর বসে আছে এখন। সকাল থেকে ইরতিজাকে একবারও দেখেনি। কোথায় গেছে এ বিষয়ে চিন্তা করলেই রিশন বলেছিল,
“কোথায় আর গেছে, ক্যানিয়লের কাছে নিশ্চয়ই। জানোই তো ক্যানিয়লের মম মারা গেছে!”

জুহিও ভেবেছে তাই হবে। কল দিয়েছিল ইরতিজাকে বেশ কয়েকবার। কিন্তু ইরতিজার ফোন বন্ধ। মেয়েটা এখন কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ সময় ওকে সঙ্গ দেওয়া জরুরি। শারমিন আহমেদ একবার জুহিকে জিজ্ঞেস করেছিল, ইরতিজার সাথে তার যোগাযোগ হয়েছে কি না? ইরতিজা ক্যানিয়লের সাথে আছে এটা তো আর বলা যায় না। তাই সে বলেছে,
“আসলে আমাদের এক ভালো ফ্রেন্ড, ওর নাম বেথ, ও সিয়াটলে থাকে। টিজা ওর কাছেই গেছে। টিজার মন খারাপ তো তাই ওর সাথে সময় কাটাচ্ছে। আমার আর রিশনেরও তো যাওয়ার কথা ছিল বেথের ওখানে, কিন্তু আমরা একটা কাজে ফেঁসে গেছি। বিকেলে আমি আর রিশন যাব ওখানে। টিজাকে নিয়ে সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবো।”

“ওহ আচ্ছা। আমি কল দিয়েছিলাম ওকে, কিন্তু ওর ফোন সুইচ অফ। চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। তুমি নিশ্চিত, ও বেথের ওখানেই গেছে তো?”

জুহি হেসে জবাব দিয়েছে,
“অফকোর্স। তুমি চিন্তা করো না।”

শারমিন আহমেদ বিশ্বাস করলেন জুহির কথা। আজ জুহির মিথ্যা বলার সময় ভীষণ ভয় করছিল। মনে হচ্ছিল মিথ্যা বলার ব্যাপারে শারমিন আন্টি ধরে ফেলবেন। কিন্তু তা হয়নি। কিন্তু ইরতিজা ফোন বন্ধ করে রেখে কোথায় উধাও হয়ে গেছে? সেই থেকে এখন পর্যন্ত ফোন বন্ধ! ক্যানিয়লের বাসায় থাকলে ফোন বন্ধ করে রাখার তো মানে হয় না। জুহির চোখ-মুখ সচকিত হয়ে উঠলো হঠাৎ। ক্যানিয়ল আর ইরতিজা দুজন মিলে দূরে কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে না তো? জুহি দাঁড়িয়ে গেল বসা থেকে। এমন হলে তো সে ফেঁসে যাবে। শারমিন আন্টির কাছে যে সে মিথ্যা বলেছে!
হন্তদন্ত হয়ে রুম থেকে বের হওয়ার জন্য ছুটলো জুহি। দরজার কাছে আসতেই রিশনের সাথে তার মাথা ঠুকে গেল। দুজনেই ব্যথা পেল সামান্য। জুহি রেগে গিয়ে বললো,
“ইডিয়ট, দেখে চলতে পারো না?”
বলে সে আবারও ছুট লাগালেই রিশন বললো,
“টিজা হসপিটালে আছে জুহি। ও খুব বাজেভাবে আহত হয়েছিল। আমাদের এখনই হসপিটালে যেতে হবে।”

জুহি পিছন ফিরে বললো,
“বাজেভাবে আহত হয়েছিল মানে? কী বলছো তুমি? কোথা থেকে শুনলে?”
অস্থির দেখালো জুহিকে।

“এত প্রশ্ন করো না, আমাদের এখনই যাওয়া উচিত।”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here