উড়ো পাতার ঢেউ পর্ব: ৬০

0
826

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৬০
_________________

মুহাম্মদ ইসহাকের রুমের বাইরে ছোটো-খাটো এক ভিড় করেছে বাড়ির অন্য সদস্যরা। রুমের ভিতরে আছেন মুহাম্মদ ইসহাক আর নাইলা সালেম। তৃতীয় কোনো ব্যক্তি তাদের মাঝখানে উপস্থিত নেই। নাইলা সালেম ইসহাকের দুই হাত ধরে কান্না ভেজা আকুল কণ্ঠে বলছেন,
“তুমি আমাকে অবিশ্বাস করছো ইসহাক? তোমার ওই কুলাঙ্গার ছেলেটা তোমাকে কি বললো না বললো সেটা তোমার কাছে ইম্পরট্যান্ট হয়ে গেল? অথচ তোমার কাছে আমার কথার কোনো গুরুত্ব নেই? আমি কাঁদছি এটাও কি তোমার কাছে তুচ্ছ? আমাকে বিশ্বাস করো দয়া করে। ইসহাক, ক্যানি যা বলে গেছে ওর একটা কথাও সত্যি না। আমি তোমাকে বলছি, এটা একটা ফাঁদ! ও আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। ইসহাক প্লিজ বিশ্বাস করো আমাকে।”
নাইলা সালেম মুহাম্মদ ইসহাকের দুই গাল স্পর্শ করে বললেন,
“লাভ ইউ ভেরি মাচ। আই লাভ ইউ মোর দ্যান ইন মাই লাইফ। প্লিজ বিলিভ মি। ক্যানি মিথ্যা বলেছে। ও এমনই। ও আমাকে অপছন্দ করে বলে তোমার কাছে মিথ্যা বলেছে আমার সম্পর্কে। বোঝার চেষ্টা করো তুমি।”

মুহাম্মদ ইসহাক নাইলা সালেমের দুই হাত গাল থেকে সরিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে বললেন,
“নাটক বন্ধ করো নাইলা। ষড়যন্ত্র তোমার চেয়ে ভালো আর কে করতে জানে? উমরানের প্রতিটা কথা সত্যি। আর এই ভিডিয়োও সত্যি। তুমি এত নীচ, এত জঘন্য আমার জানা ছিল না। তোমার কাজের জন্য তোমাকে শাস্তি ভোগ করতেই হবে।”
মুহাম্মদ ইসহাক ছেড়ে দিলেন নাইলা সালেমের হাত।

“না, না ইসহাক। শাস্তির কথা বলো না দয়া করে। আমি তোমার সাথে শান্তিতে থাকতে চাই আমার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগ পর্যন্ত। তুমি আমাকে অবিশ্বাস করো না, করো না অবিশ্বাস। বিশ্বাস করো। ক্যানিয়লের একটা কথাও সত্যি না, ও একটা মিথ্যাবাদী! এই ভিডিয়ো… এই ভিডিয়োটাও জাল।”

মুহাম্মদ ইসহাক গ্রাহ্য করলেন না নাইলা সালেমের কথা। এমনকি নাইলা সালেমের চোখের জলও তার কাছে মূল্যহীন। বললেন,
“আমি অতি শীঘ্র তোমাকে ডিভোর্স দেবো এবং তোমার নামে থাকা সকল সম্পত্তি, ব্যাংকে জমা থাকা সমস্ত টাকা আমি ফেরত নিয়ে নেবো। তোমার সাথে এই বাড়ি এবং আমার আর কোনো সম্পর্ক থাকবে না।”

মুহাম্মদ ইসহাকের কথা শুনে ক্ষণকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলেন নাইলা সালেম। তার কান্নার স্তর ভারী হয়ে এলো আগের চেয়ে। বললেন,
“না, তুমি এটা করতে পারো না। এমন হলে আমি মারা যাব। আমি তোমাকে কখনও ছাড়তে পারবো না, আর না তো সকল অর্থ-সম্পদ ছাড়া সম্ভব আমার পক্ষে। আমি তোমাকে ছাড়বো বলে এত কষ্ট করে বিয়ে করিনি। আমাদের বৈবাহিক সম্পর্ক দীর্ঘকাল আগের। এটা তুমি এখন এভাবে শেষ করে দিতে পারো না ইসহাক।”

“তুমি ছাড়তে অনিচ্ছুক হলেও তোমাকে এসব ছাড়তে হবে।”

নাইলা সালেম হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন ফ্লোরে। অনুনয়ের সুরে বললেন,
“এরকম করো না ইসহাক। আমি মরে যাব তাহলে। আমি তোমাকে, এই বাড়ি কিছুতেই ছাড়তে পারবো না। প্লিজ!”

ভেজানো দরজাটা শব্দ করে খুলে গেল। দুজনের দৃষ্টিই চলে গেল দোরগোড়ায়। নাইলা সালেমের বড়ো ছেলে এরদোয়ান দাঁড়িয়ে আছে। এরদোয়ান অফিসে ছিল। রাম্মিকা তাকে কল করে জানিয়েছিল মমের সাথে ড্যাডের ঝামেলা হয়েছে এবং এটা খুবই গুরুতর, সে যেন একবার তাড়াতাড়ি বাসায় আসে। বোনের কথা অনুযায়ী এরদোয়ান বাসায় চলে আসে, আর এসেই শোনে ডিভোর্সের কথা। যা শুনে সে আর বাইরে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। মমকে ফ্লোরে হাঁটু মুড়ে বসে থাকতে দেখে এরদোয়ান কষ্ট পায়। সে মুহাম্মদ ইসহাকের দিকে চেয়ে বললো,
“মমকে ক্ষমা করে দাও ড্যাড। আমি মমের হয়ে ক্ষমা চাইছি তোমার কাছে। প্লিজ মাফ করে দাও। ‘ডিভোর্স’ এই শব্দটা উচ্চারণ করো না। প্লিজ ড্যাড, শান্ত মাথায় বোঝার চেষ্টা করো।”

“তুমি কি জানো এরদোয়ান তোমার মম কত জঘন্য কাজ করেছে? তোমার মম একজন জঘন্য মানুষ! খুনি! এই জঘন্য মানুষের হয়ে ক্ষমা চেয়ে তুমি নিজেকে কলুষিত করো না।”

“কিন্তু তুমি ডিভোর্সের কথা কীভাবে বলতে পারো? যা হওয়ার ওটা অতীতে হয়ে গেছে। তুমি অতীতের প্রভাব বর্তমানে কেন ফেলছো?”

“অতীতের প্রভাব তো বর্তমানে পড়েই রয়েছে মাই সান। অতীতে যদি তোমার মম ওই জঘন্য কাজ না করতো তাহলে উমরান মা হীন বড়ো হতো না, বেলাও এভাবে মারা যেত না! আর উমরানের উপর অ্যাটাক হওয়ার কথা গুলো ভাবো! অতীতের প্রভাব বর্তমানে তোমার মমই ফেলে রেখেছে। শুধু অতীতে তোমার মমের শাস্তি পাওয়া উচিত ছিল, সেটা সে পায়নি। যেটা তাকে বর্তমানে ভোগ করতে হবে, এই যা ব্যাপার।”

এরদোয়ান মমের দিকে তাকালো। নাইলা সালেম কেঁদে যাচ্ছে বিরামহীন। তার কর্মের জন্য তাকে একদিন শাস্তি ভোগ করতে হতে পারে সেটা সে ভেবে দেখেনি কখনও। অথচ আজ সে জীবনের সেই কঠিন মুহূর্তের মুখোমুখি। এই মুহূর্তকে চাইলেও সে পরিবর্তন করতে পারবে না। এটা কোনো দুঃস্বপ্ন নয় যে চোখ মেললেই দুঃসময় পলায়ন করবে। তার বাস্তব জীবনই এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। সে এখন এই দুঃস্বপ্ন কাটানোর জন্য চোখের পাতা বারংবার খুললে এবং বন্ধ করলেও তার দুঃসময় তাকে দুঃখে ভাসিয়ে নেওয়ার জন্য চিরঞ্জীব থাকবে। খারাপ কাজ করার আগে উচিত এর পরিণাম কী হবে সে সম্পর্কে ভেবে দেখা। এটা মানুষকে খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে সাহায্য করে। যা নাইলা সালেম করেননি।

নাইলা সালেম ইসহাকের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন,
“তুমি খারাপ মানুষ ইসহাক! তোমার স্ত্রী তোমার সামনে চোখের জল ফেলছে, অথচ তোমার তাতে কিছু এসে যায় না। তুমি নির্দয়!”

“নির্দয় মানুষের সাথে নির্দয় থাকাই শ্রেয়। হৃদয় দিয়ে তাদেরই অনুভব করতে হয় যারা হৃদয়বান। তোমার মতো নির্দয় মানুষ এতদিন আমার হৃদয়বান ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে ছিলে এটাই অনেক।”

এরদোয়ান কী বলবে? তার মস্তিষ্ক শূন্য। কিছু বলার নেই তার এই মুহূর্তে। একবার দরজায় তাকালো। দরজার ওপাশে রাম্মিকার জলপূর্ণ দৃষ্টি জোড়া তার দৃষ্টির অগোচর রইল না।

মুহাম্মদ ইসহাকের মোবাইলটা বেজে উঠলো। সে শেরিফের নাম দেখে তাৎক্ষণিক কল রিসিভ করলেন। ওপাশ থেকে সুন্দর কণ্ঠ ভেসে এলো,
“হ্যালো মি. ইসহাক, আমি শেরিফ বলছিলাম।”

“হ্যাঁ বলো শেরিফ।”

“ক্যানিয়লের উপর হওয়া হামলার যে তদন্ত করা হচ্ছিল, সেই তদন্তে একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে। আমার মনে হয় আপনি একবার পুলিশ স্টেশনে আসলে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে সুবিধা হতো।”

“ও কে শেরিফ। আমি এই মুহূর্তে ফ্রি আছি। আমি এখনই আসছি তোমার ওখানে।”

“ধন্যবাদ মি. ইসহাক। আমি আপনার অপেক্ষায় রইলাম। দেখা হচ্ছে।”

কল কাটার পর মুহাম্মদ ইসহাক রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। দরজার বাইরে উপস্থিত ভিড়টার উপর দৃষ্টি বুলালেন একবার। তারপর সোজা চলে গেলেন।
নাইলা সালেম ভীত হয়ে তাকিয়ে রইলেন স্বামীর চলে যাওয়ার পথে। হঠাৎ শেরিফের কল আসা এবং ইসহাককে পুলিশ স্টেশনে ডাকার ব্যাপারটাতে সে ভড়কে গেছে। কোনো রকম ভাবে তদন্তে তার নামটা উঠে আসেনি তো? যদিও ইসহাক এখন সবই জানে। কিন্তু তারপরও আইনি ব্যাপারটাকে ভীষণ ভয় পান নাইলা সালেম। ইসহাক যদি তাকে আইনি ভাবেও শাস্তি দেওয়ার কথা চিন্তা করে? তাহলে?

__________________

জুহি ইরতিজার কপালে চুমু খেয়ে বললো,
“তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও মাই লাভলি ফ্রেন্ড।”

ইরতিজা একটু হাসার চেষ্টা করলো। যদিও হাসিটা প্রস্ফুটিত করতে পারলো না ওষ্ঠাধরে। জুহির চেহারায় এখনও কান্না কান্না ভাব ভেসে বেড়াচ্ছে। মন খারাপের সুরে বললো,
“তোমাকে এমন দেখতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে টিজা।”

ইরতিজার হৃদয়ে হঠাৎ দুঃখের দোলা লাগলো। কিছু সময়ের জন্য সে অন্যদিকে মুখ ফেরালো। বললো,
“আব্বু, মা, আপু তারা এখনও কেউ জানে না, তাই না?”

“হুম, জানে না। আমি বুঝতে পারছি না তাদের কীভাবে বিষয়টা জানানো উচিত। আমি ভেবেছিলাম তুমি ক্যানির কাছে আছো তাই শারমিন আন্টকে বলেছিলাম তুমি বেথের বাসায় আছো। কিন্তু এখন উনি জানতে পারবেন আমি মিথ্যা বলেছিলাম। কী ভাববে সে আমার সম্পর্কে?”

“তুমি নিজের চিন্তায় আছো? টিজার সম্পর্কে জানতে পারলে তাদের কেমন অনুভূতি হবে সে ব্যাপারে তোমার চিন্তা নেই?” পাশ থেকে বললো রিশন।

জুহির মেজাজ চটে গেল সাথে সাথে। ভ্রু কুঞ্চন করে রিশনের দিকে চেয়ে বললো,
“আমি সব ব্যাপার নিয়েই চিন্তিত, বুঝেছো? আমি তোমার মতো ভাবনাহীন জীবনযাপন করি না। তুমি তো পারো শুধু সব জায়গায় গিয়ে ভিডিয়ো শ্যুট করতে। আর কোনো যোগ্যতা কি আছে তোমার?”

“দেখো, আমার যোগ্যতার দিকে আঙুল তুলো না। তুমি একজন নিষ্কর্মা মেয়ে! তোমার কোনো আইডিয়া আছে এইসব ভিডিয়ো দিয়ে আমি মাসে কত ডলার ইনকাম করি?”

“হ্যাঁ, ইনকাম করো আর সকল ডলার গার্লফ্রেন্ডদের পিছনে খরচ করো।”

রিশন রেগে গেল,
“বাজে বকো না। আমার জীবনে মাত্র একটা গার্লফ্রেন্ডই ছিল। আমি তোমার মতো নই।”

জুহি দাঁড়িয়ে গেল বসা থেকে। ভাইয়ের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
“এই কথার মানে কী রিশন? মানে তুমি আমাকে খারাপ বলার চেষ্টা করছো? আমি তোমার চেয়ে বয়সে বড়ো সেটা কি ভুলে যাচ্ছ তুমি?”

“তুমি আমার চেয়ে মাত্র কয়েক মিনিটের বড়ো। এমন ভাব করো না যেন তুমি আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়ো।”

“তোমার সাথে এখানে আর একটা কথা বাড়াতে চাই না। বাসায় চলো, তারপর তোমার সাথে আমার আসল বোঝাপড়া শুরু হবে।”
জুহি আবারও বসলো টুলে। কিঞ্চিৎ বিরক্ত সুরে বললো,
“ক্যানি কোথায় গেল? সব দোষ ওর। একটা সাইকো মেয়ের সাথে এনগেজমেন্ট করেছিল কোন আক্কেলে?”

________________

ক্যানিয়ল এতক্ষণ মি. হেনরির দেওয়া ভিডিয়োটা দেখছিল। দেখতে দেখতে মিরান্ডার প্রতি তার ক্ষোভটা পাহাড়সম হলো। রাগে রক্তিম হয়ে উঠলো মুখ। শিরা-উপশিরায় আগুন জ্বলে যাওয়ার অনুভূতি!
ভিডিয়োতে দেখা গেছে মিরান্ডা ইরতিজাকে ওই বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর ইরতিজা অবাক হয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। হয়তো সে ভাবছিল তাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছে। আর ঠিক সেই সময় মিরান্ডা অপ্রস্তুত ইরতিজার গলায় চিকন রশি জাতীয় একটা বস্তু পেঁচিয়ে ধরে। ইরতিজার দম বন্ধ হয়ে আসছিল, সে ছটফট করছিল তখন। মিরান্ডা ছেড়ে দেয় ইরতিজাকে। সঙ্গে সঙ্গে ইরতিজা বসে পড়ে ফ্লোরে। কাশতে থাকে। মিরান্ডা ইরতিজার সামনে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে। ক্ষুব্ধ ভাবে কিছু বলতে বলতে জোরে চড় মারে ইরতিজাকে। ইরতিজার দুই গাল চেপে ধরে আবারও কিছু বলে। তারপর ওখানে উপস্থিত ছেলে-মেয়ে গুলোকে বলে বেরিয়ে আসার জন্য। মিরান্ডার নির্দেশ অনুযায়ী একটা মেয়ে ইরতিজার হিজাব এবং গায়ের জ্যাকেট খুলে ফেলে। এরপর কয়েকজন মিলে ইরতিজাকে বেঁধে ফেলে পিলারের সাথে। ইরতিজার মুখে টেপ লাগিয়ে দেওয়া হয়। মিরান্ডা ক্রমাগত থাপ্পড় মারতে শুরু করলো ইরতিজার দু গালে। এরপর ওর বাঁধন খুলে দেওয়া হয়। ইরতিজা পড়ে যায় ফ্লোরে। মিরান্ডা চিকন বেত জাতীয় বস্তু দিয়ে ইরতিজার শরীরে আঘাত করতে থাকে। দাগের সৃষ্টি হয় ইরতিজার হাতে, শরীরে। মিরান্ডা হাতে হাতুড়ি পর্যন্ত তুলে নিয়েছিল, কিন্তু হাতুড়ি দিয়ে মাথায় আঘাত করতে গিয়ে হঠাৎ সে থেমে যায়। হাতুড়ি নামিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু আচমকা আবার হাতুড়ি দিয়ে ইরতিজার পেটে আঘাত করে! ব্যথায় কুঁকড়ে যায় ইরতিজা।
এ পর্যন্তই ইরতিজাকে মারধর করা হয়েছিল। তারপর ক্যানিয়লকে কল দেয়। পুরো ভিডিয়ো দেখতে যেমন ইরতিজার জন্য কষ্ট হচ্ছিল, তেমনি মিরান্ডার প্রতি রাগে ভিতরটা কাঁপছিল ভূমিকম্পের ন্যায়। সময় নিয়ে ধীরে ধীরে নিজেকে ধাতস্থ করলো। ওয়াশরুম থেকে ফিরে এলো ইরতিজার রুমে। ক্যানিয়লকে দেখে দাঁড়ালো জুহি। কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে নিলেই ক্যানিয়ল বললো,
“ইজার মম-ড্যাডকে জানিয়েছো?”

________________

আজাদ চৌধুরী ইরতিজার দিকে রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। যে মেয়ের গায়ে কোনোদিন তিনি টোকাটি পর্যন্ত দেয়নি, সেই মেয়ে কারো হাতে এমন বাজেভাবে মার খেয়েছে দেখে তার হৃদয়ের পাড় ভাঙছিল। কষ্ট, রাগ বিষয় দুটো পেঁচিয়ে ধরছিল তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে। ইরতিজাও বাবার দিকে চেয়ে রয়েছে। সে ঠাহর করতে পারছে বাবার মানসিক অবস্থা। সে কিছু বলার পাচ্ছে না। শুধু বিরামহীন নয়নে বাবার সুন্দর কষ্ট লালিত মুখটি দর্শন করে গেল।
শারমিন আহমেদের চোখ গলে কয়েক ফোঁটা নয়ন জল গড়িয়েছে ইতোমধ্যে। নওরিনের হৃদয়ের পাতায়ও কষ্টের দাগ ঝাপসা থেকে গাঢ়তা ছড়িয়েছে। কীভাবে কী হয়েছে ঘটনাটা সম্পর্কে জুহি আর রিশন মিলে তাদের কাছে ব্যাখ্যা করেছে। সব শোনার পর আজাদ চৌধুরী কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন। তার পা দুটো আর সামনে এগোলো না। থেমে গেল ইরতিজার রুমের দরজার সামনেই। এই মুহূর্তে সে একটা বিষয় স্পষ্ট বুঝতে পারলো, তার মেয়ে যাকে বেছে নিয়েছে তার কাছে তার মেয়ে অবশ্যই ভালো থাকবে না।
যে মুহূর্তে সে এই কথাটা ভাবছিল তখনই ক্যানিয়ল তার কাছে এসে দাঁড়ায়। আজাদ চৌধুরী তা খেয়াল করেননি। ক্যানিয়লের সালাম তাকে জাগ্রত করে তুললো,
“আসসালামু আলাইকুম।”

খুব কাছে সালামের ধ্বনি শুনে আজাদ চৌধুরী সম্মুখে তাকালেন। দেখতে পেলেন এক সুদর্শন আমেরিকান যুবক তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নিঃসন্দেহে এই ছেলে রূপে অনন্য। আজাদ চৌধুরী শান্ত চাহনিতে খুব তীক্ষ্ণভাবে দেখে নিলো একবার ক্যানিয়লকে। আগে দেখা না হলেও তিনি বুঝতে পারলেন এই সেই ছেলে। ইরতিজা কি এই ছেলের রূপ দেখেই আকৃষ্ট হয়েছিল?
আজাদ চৌধুরী সালামের জবাব দিলেন,
“ওয়াআলাইকুমুস সালাম।”

ক্যানিয়ল সে সময় আজাদ চৌধুরীকে চিন্তিত দেখেছিল, তাই বললো,
“চিন্তা করবেন না, ইজা ঠিক আছে।”

“কিন্তু আমার ধারণা তোমার সাথে বেশিদিন থাকলে ঠিক থাকতে পারবে না ও।”

ক্যানিয়লের নম্র দৃষ্টি জোড়া হঠাৎ একটু নড়ে উঠলো। বললো,
“আপনার এমন ধারণা হওয়ার কারণ আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আসলে এই ধারণা সত্যি নয়। একবার ওর সাথে এমন ঘটেছে বলে দ্বিতীয়বারও যে এমন ঘটবে এমনটা ভাববেন না। কারণ এটা ঘটবে না। ঘটতে চাইলেও আমি ঘটতে দেবো না।”

আজাদ চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“দুঃখিত ছেলে! আমার মনে হয় না তোমার আর ইরতিজার সম্পর্কটা যথার্থ। যা ঘটার ঘটে গেছে! এখন থেকে তুমি এবং ইরতিজা একে অপরের থেকে দূরে থাকলে সেটা ভালো হবে।”

“এমন করবেন না মিস্টার। আপনার মেয়ের হাতে ইতোমধ্যে আমার পরানো রিং আছে। আমি নিশ্চয়ই ওর থেকে দূরে থাকার জন্য সেটা ওকে পরিয়ে দিইনি। বরং ওকে নিজের আরও কাছে আনার জন্য আমি সেটা করেছি। যদিও আমরা এখনও তেমন কাছাকাছি নই। আমি চাইবো আপনি আমাদের সম্পর্কটা একদম কাছাকাছি করে দেন। মানে আমি বলছি, আমাদের দুজনের বিয়ে দিয়ে দেওয়াটা সুন্দর এবং সঠিক কাজ হবে।”

“কিন্তু আমি সেটা করবো না।”

“বেশ, তাহলে আমি আপনার মেয়েকে নিয়ে খুব দূরে কোথাও চলে যাব। আপনার আর কোনো সুযোগ থাকবে না আপনার মেয়েকে দেখার। আপনাদের অনুমতি ছাড়াই আমরা বিয়ে করবো। বলুন, সেটা কি ভালো হবে?”

“খারাপের সীমাকেও ছাড়িয়ে যাবে সেটা।”

ক্যানিয়ল হাসলো। বললো,
“আমি কখনও এমনটা করবো না। আর ইজাও কখনও আপনাকে ছেড়ে, আপনার অনুমতি ব্যতীত আমার সাথে যাবে না, আমাকে বিয়ে করবে না। ও বলেছিল ও আপনাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। এখন আপনি ওকে কতটা ভালোবাসেন আমি সেটা দেখতে চাই মিস্টার। আপনি কি পারবেন ওকে কষ্ট দিতে? আমাকে ছাড়া ও কষ্টে থাকবে। এই কষ্ট সাধারণ কষ্ট নয়। সাংঘাতিক! ভালোবাসলে সেই মানুষটা কষ্ট পাক এটা কীভাবে কাম্য হতে পারে? তাও কি না সাংঘাতিক কষ্ট!”

“কিন্তু তোমাকে আমি ইরতিজার জন্য সঠিক মনে করছি না।”

“কিন্তু আমি অবশ্যই সঠিক। আপনি এটা মানুন আর নাই বা মানুন আমি ওর জন্য একদম সঠিক। আমি শুধু আপনাকে এটাই বলবো, যদি আমাকে ছাড়া ও সাংঘাতিক কষ্টে থাকে তাহলে আমার কষ্টটা ওর লাগা কষ্টের চেয়ে আরও সাংঘাতিক হবে। ও না থাকলে আমার আকাশে নক্ষত্রও থাকবে না। শূন্য আকাশটা হাহাকার করবে। আমার দু চোখ থেকে উড়ো পাতার ঢেউ বিলীন হয়ে যাবে, আমি দেখবো সেই আগের ন্যায় শ্বেত তুষারের ঝরে পড়া। আমি আপনার মেয়েকে ছাড়া একটা মুহূর্তও ভালো থাকতে পারবো না। আপনার কী অধিকার আছে আমার ভালো থাকা এভাবে বিনষ্ট করার? কোনো অধিকার নেই। অথচ আপনি একই সাথে আমার এবং ইজার দুজনের ভালো থাকাই বিনষ্ট করতে চান। না করবেন না। আমি আশা রাখি আপনিও ইজাকে সর্বোচ্চ ভালোবাসেন। দয়া করে আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণিত হতে দেবেন না।”

ক্যানিয়ল আর দাঁড়ালো না, চলে এলো। এখন যেহেতু ইরতিজার ফ্যামিলির মানুষজন এসেছে সেহেতু ফ্যামিলির মানুষজনের সাথেই ইরতিজাকে থাকতে দেওয়া উচিত। ফ্যামিলির মানুষজনের ভিতর তার উপস্থিতি বিব্রতকর। ক্যানিয়ল হাসপাতাল থেকেই বেরিয়ে পড়লো। গাড়ি নিয়ে চলে এলো ইরতিজার এলাকায় থাকা তার বাড়িটায়। যেখানে তার হকি স্টিক গুলো অযত্নে পড়ে রয়েছে অনেকদিন যাবৎ। সে সেখান থেকে একটা হকি স্টিক নিয়ে মিরান্ডার এপার্টমেন্টে যাওয়ার মনস্থির করলো। রাগে তার প্রতিটা শিরা দপদপ করছে।
আজ আকাশে উজ্জ্বল চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় কী মনোরম সৌন্দর্যের পসরা বসেছে প্রকৃতিতে। অথচ এখন সময়টা কারো কারো ক্ষেত্রে খুব বিদঘুটে। কেউ এই মুহূর্তে ক্ষুব্ধ। কারো মনে প্রতিশোধের নেশা!

_______________

থানা থেকে ফিরে মুহাম্মদ ইসহাক অফিসে এসেছিলেন। ল্যাপটপ খুলে মি. হেনরির পাঠানো একটা ভিডিয়ো পান তিনি। ভিডিয়োটা দেখতে দেখতে তার চোখ কখনো স্ফীত হয়ে উঠছিল, কখনো বা ভ্রু কুঞ্চিত করে চোখ সরু হচ্ছিল। তিনি বিস্মিত হচ্ছিলেন, এবং রাগান্বিতও হলেন। পুরো ভিডিয়ো সমাপ্ত করে তার মুখ ফুঁড়ে যে কথাটা বেরিয়ে আসে সেটা হলো,
“এই মেন্টাল মেয়ের সাহস কী করে হয় আমার ছেলেকে মারার নির্দেশ দেওয়ার? এই মেয়ে এখনও বাইরে মুক্তভাবে কীভাবে ঘোরাফেরা করছে? এলজে তার মেন্টাল মেয়েকে মানসিক হসপিটালে ট্রান্সফার করছে না কেন?”

মুহাম্মদ ইসহাক মিরান্ডার বাবা এলজেকে কল দিলেন। অল্পতেই কল রিসিভ করলেন এলজে। ইসহাক রাগান্বিত কণ্ঠে বলে উঠলেন,
“মিরান্ডা এসব কী করেছে এলজে? ওর সাহস কী করে হলো আমার ছেলেকে মারতে চাওয়ার? ও নিজেকে কী মনে করে? আর ওই মেয়েটাকে মারার অধিকারই বা ও কোথায় পেল? মেয়েটা কী অন্যায় করেছে? আমার ছেলের সাথে মেয়েটার রিলেশনশিপ, আমি বুঝবো মেয়েটাকে আমি কী করবো না করবো। ও এমনভাবে মারার কে? ফেমাস হয়ে গিয়ে কি নিজেকে খুব বড়ো মনে করছে? আমার ছেলের গায়ে আঘাত করতেও বাধছে না ওর? তুমি তোমার মেয়েকে সামলাও এলজে। আমি রেগে গেলে তার পরিণাম ভালো না-ও হতে পারে।”

“আমি বুঝতে পারছি না ইসহাক তুমি কী বলছো। মিরান্ডার উপর রাগান্বিত কেন তুমি? আমাকে কি একটু খোলাসা করে বলতে পারো সবকিছু?”

মুহাম্মদ ইসহাক সব খুলে বলেন এলজেকে। এলজে সবটা শোনার পর তারও রাগ হয় মেয়ের প্রতি। সে মিরান্ডাকে কল দেয়। কিন্তু মিরান্ডা কল রিসিভ করে না। সে তাৎক্ষণিকই মিরান্ডার এপার্টমেন্টে যেতে পারেন না অফিস থেকে। কারণ কিছু ইম্পরট্যান্ট কাজ ছিল তার। সে সন্ধ্যায় যায় মিরান্ডার এপার্টমেন্টে। মুহাম্মদ ইসহাক যখন তাকে কল করেছিল তখন সেটা শেষ বিকেলের এক মুহূর্ত ছিল।
এলজে এসে মিরান্ডার এপার্টমেন্টে নক করে। মিরান্ডা সে সময় বাসায়ই অবস্থানরত, কিন্তু দরজা খোলে না। এলজে অনেকক্ষণ যাবৎ ডাকাডাকি করে কিন্তু মিরান্ডা সাড়া দেয় না। এলজে মেয়ের কাজে বিস্ময় প্রকাশ করেন। দরজার বাইরে থেকেই প্রস্থান করেন তিনি।

এলজে যে সময় এসেছিল সে সময় মিরান্ডা কাউচে শোয়া ছিল। এরকম ভাবেই শুয়ে রইল অনেকক্ষণ। রাত নামলো ধরায়। শুয়ে শুয়ে সে গ্লাসে ওয়াইন ঢেলে তা মুখে ঢালছিল। আজ অনেক দিন পর সে মদ্যপান করেছে। মদ্যপান করছিল মস্তিষ্ককে একটু শান্তি প্রদান করতে, কিন্তু তবুও শান্ত হচ্ছিল না মস্তিষ্ক। মিরান্ডা প্রচুর বিরক্ত এবং তার অন্তরে এখন ঝড়ো হাওয়ায় দোলমান পাখির বাসার মতো ক্ষোভ বাসা বেঁধেছে। তার গাল, নাক এখনও ব্যথা করছে। নাকটায় বেশি ব্যথা অনুভব হচ্ছে। ক্যানিয়ল রাক্ষুসে ছেলেটা এমনভাবে তাকে চ/ড় মারার সাহস কোথায় পেল?
মিরান্ডা আরও এক গ্লাস ওয়াইন গলায় ঢাললো। ওয়াইনের উৎকট স্বাদের জন্য চোখ খিঁচে ধরলো ক্ষণ সময়ের জন্য। সে এখন হালকা নেশাগ্রস্ত। টেবিলের উপরে থাকা গ্লাসটাকে নাড়াতে নাড়াতে বললো,
“ইচ্ছা করছে ক্যানির গালে নিরানব্বইটা থা/প্প/ড় মারি। শালা বদ! আমাকে রেখে অন্য একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে?”

রাগে মিরান্ডা গ্লাসটা ছুঁড়ে মারলো। ফ্লোরে পড়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল গ্লাসটা। বিতৃষ্ণা লাগছে তার কাছে সব। অনেক কল এসেছিল কিন্তু সে একটা কলও রিসিভ করেনি। এপার্টমেন্টেও অনেকে খোঁজ নিতে এসেছিল কিন্তু সে দরজা খোলেনি। মুরহাউজ থেকে আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত পুরো সময়টা সে এপার্টমেন্টেই অবস্থান করছে। কেন সে সবার থেকে এত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আছে? দরজায় নকের শব্দ কানে এলো। মিরান্ডা দরজার দিকে তাকালো। আবার কে এসেছে? মিরান্ডা এবার দরজা খোলার প্রয়োজন মনে করলো। কেন সে পড়ে থাকবে মরা মানুষের মতো? সে উঠে বসলো। স্নিকার্স জোড়া পায়ে গলিয়ে এগিয়ে গেল দরজা খুলতে। দরজা খুলতেই দেখতে পেল ক্যানিয়ল দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাতে একটা হকি স্টিক। হঠাৎ কেমন ভয় ছমছম করে উঠলো মিরান্ডার মাঝে। বললো,
“তুমি?”

“কী ব্যাপার মিরান্ডা? আগে কখনো আমি তোমার এপার্টমেন্টে আসলেই তুমি আমাকে দেখা মাত্র জড়িয়ে ধরার জন্য উদ্যত হতে। কিন্তু আজ আমাকে জড়িয়ে ধরার জন্য তোমার মাঝে কোনো উচ্ছ্বাস কেন দেখতে পাচ্ছি না? কেন তোমার দু চোখে ভয়?”

মিরান্ডা নিজেকে সাহসী করে তুললো। জোর গলায় বললো,
“আমি তোমার মতো ছেলেকে ভয় পাই না।”

বলে সে দরজা বন্ধ করতে চাইলো। কিন্তু ক্যানিয়ল চেপে ধরলো দরজা। মিরান্ডা রেগে বললো,
“তুমি আমার বাসায় মাস্তানি করতে এসেছো? আমার বাসায়? দাঁড়াও পুলিশে ইনফর্ম করি।”

মিরান্ডা দরজা ছেড়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে টেবিলের দিকে গেল। টেবিল থেকে মোবাইল তুলে নিয়ে পুলিশের নাম্বারে কল করা দিলো। কিন্তু ক্যানিয়ল এসে মোবাইলটা ছোঁ মেরে নিয়ে গেল মিরান্ডার হাত থেকে। মোবাইলটা ছুঁড়ে মারলো দূরে। মিরান্ডার দু চোখে ভয় চমকিত হলো। ফ্লোরে পড়া মোবাইলটার থেকে চোখ এনে তাকালো ক্যানিয়লের দিকে। ক্যানিয়লের ক্ষুব্ধ চোখে চোখ পড়তে ভিতরটা যেমন ভয়ে চুপসে গেল তেমনি আবার ক্রোধে ফুলে ফেঁপে উঠলো।
ক্যানিয়ল থমথমে কণ্ঠে বললো,
“তুমি ইজার মুখে টেপ লাগিয়ে দিয়েছিলে, কিন্তু আমি তোমার মুখে কোনো টেপ লাগিয়ে দেবো না। তোমার ইচ্ছা খুশি মতো চিৎকার করতে পারবে তুমি। তোমার চিৎকারগুলো নিশ্চয়ই মন ভালো করা গানের চেয়ে কোনো অংশে কম হবে না।”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here