#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৬১
_________________
মিরান্ডার চিৎকারগুলো তার এপার্টমেন্টের চার দেয়ালের মাঝেই বদ্ধ পড়ে রইল। সাউন্ড প্রুফ রুম বলে শব্দ বাইরে বেরোনোর সুযোগ পায়নি। মিরান্ডার শরীর ব্যথায়, যন্ত্রণায় নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। মাথা বেয়ে গড়িয়ে পড়েছে র’ক্ত। মুখেও র’ক্ত। গাল দুটো থা’প্প’ড়ের আঘাতে বেজায় লাল এবং ফোলা।
ভীষণ অসহায়, ভীষণ দুর্বল ঠেকছে নিজেকে। চোখ বারবার বুজছে, মেলছে। সে এখন চেয়ারের সাথে বাঁধা অবস্থায় আছে। হঠাৎ একটা পাশবিক কণ্ঠস্বর তার কর্ণ ছুঁয়ে গেল,
“কেমন অনুভব করছো মিরান্ডা?”
মিরান্ডা চোখ তুলে সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখার চেষ্টা করলো। ঘরের আবছায়া আলোতে ঝাপসা চোখে ক্যানিয়লের অবয়ব তার দৃষ্টি কোণে ফুঁটে উঠলো। দুর্বল কণ্ঠটাকে তেজি করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করে সে বললো,
“তোমাকে আমি খু’ন করবো ক্যানি! শে’ষ করে ফেলবো তোমায়। তোমার ড্যাড প্রতিবার তোমাকে পুলিশ স্টেশন থেকে ছাড়িয়ে আনে। আমি নিজেও একবার সুপারিশ করেছি তোমাকে ছড়ানোর জন্য। কিন্তু এবার এমন ব্যবস্থা করবো যাতে সারাজীবন জেলে পচে মরতে হয় তোমার। ব’র’বা’দ করে দেবো তোমার লাইফ। জাস্ট ওয়েট।”
কথাগুলো বললো খুব কষ্ট করে। কারণ কণ্ঠ থেকে স্বর বের হতে চাচ্ছে না।
ক্যানিয়ল ওষ্ঠ কোণে তুচ্ছ হাসি পুষলো। হাতের বেতটা ফেলে দিলো ফ্লোরে। বেতটা হাতুড়ির কাছে গিয়ে পড়লো। না, ক্যানিয়ল মিরান্ডাকে হাতুড়ি দিয়ে মারেনি। মিরান্ডার শরীরে বেশিরভাগই হকি স্টিক এবং বেতের আঘাতের চিহ্ন। থাপ্পড়ের সাক্ষী হয়ে আছে গাল, মুখের র’ক্ত।
ক্যানিয়ল মিরান্ডার দিকে খানিক ঝুঁকে বললো,
“তোমার সুন্দর ক্যারিয়ারে একটা অসুন্দর ঝড় আসতে চলেছে মিরান্ডা। এই ঝড় তোমাকে রাজপ্রাসাদ থেকে টেনে-হিঁচড়ে নিচে না নামিয়ে দেয়!”
“কোন ঝড়ের কথা বলছো?”
ক্যানিয়ল নরম ঠোঁটের প্রাঞ্জল হাসিতে রহস্য মিশিয়ে হেসে বললো,
“একটু অপেক্ষা করো, বুঝতে পারবে কোন ঝড়ের কথা বলছি। এই ঝড়ের জন্য তোমার সুন্দর মুখের আড়ালে কুৎসিত মনটাই দায়ী।”
সোজা হয়ে দাঁড়ালো ক্যানিয়ল।
মিরান্ডা রাগান্বিত কণ্ঠে বললো,
“আমার সাথে আর কিছু করার চেষ্টা করলে সেটা ভালো হবে না ক্যানি।”
“হবে না ভালো? ঠিক আছে, দেখি কতটা খারাপ করতে পারো তুমি। আমার কঠিন সময়টাকে তুমি আরও বেশি কঠিন করে তুলে বিষাক্ত বানিয়ে দিয়েছো! তবে এখন তোমাকে দেখে কিছুটা ভালো লাগা অনুভব করছি। আর হ্যাঁ, জরুরি সেবায় কল দিয়ে দিচ্ছি। এটা তোমার প্রতি শেষ সদয় আচরণ আমার।”
ক্যানিয়ল বেরিয়ে এলো মিরান্ডার এপার্টমেন্ট থেকে। রাস্তায় এসে সে মুক্ত বাতাসে প্রাণ ভরে একবার নিঃশ্বাস নিলো। কিছুটা হালকা লাগছে এখন তার। তবে পৃথিবীটা বিষণ্ন ঠেকছে। গাড়িতে উঠে বসে রক্তমাখা গ্লাভস দুটো খুলে রেখে চোখ বুজলো। এ কদিনে তার শান্ত সুলভ জীবনটাতে একটার পর একটা দুর্যোগ বয়ে গেছে। হৃদয়ে কষ্ট জমে পাথর হয়েছে। জমাট বাঁধা ক্ষোভ আগের চেয়ে কিছুটা মলিন হয়েছে। সে চেষ্টা করবে কষ্টের পাথরটাকেও নরম করার জন্য। সবকিছু মিটে গেলে সে সুখী থাকার চেষ্টা করবে নিজের সুখকে নিয়ে।
__________________
সকাল সকাল মুহাম্মদ ইসহাকের বাড়িতে পুলিশ এলো। এরেস্ট ওয়ারেন্ট নিয়ে এসেছে তারা। নাইলা সালেম পুলিশ দেখে ভড়কে গিয়েছিলেন। তার ভয়টাই সত্যি রূপ ধারণ করলো শেষ পর্যন্ত। পুলিশ তার জন্যই এরেস্ট ওয়ারেন্ট নিয়ে এসেছে। ক্যানিয়লের সেই কেসের তদন্তে তার নাম উঠে এসেছে। পুলিশ ক্যানিয়লের উপর সেই হামলাকারী গ্যাংটাকে ধরার পর গুরুতর কিছু তথ্য সামনে এসেছে। নাইলা সালেম ক্যানিয়লকে মেরে ফেলার প্ল্যান করেছিলেন! গ্যাংয়ের লিডার এগুলোর সঠিক প্রমাণও দিয়েছে।
নাইলা সালেমের আর অস্বীকার করার, এড়িয়ে যাওয়ার পথ নেই। সে মুহাম্মদ ইসহাকের হাতে-পায়ে ধরে কান্নাকাটি করলেন। উপায়ান্তর না পেয়ে শেষমেশ ক্ষমা চাইলেন। কিন্তু মুহাম্মদ ইসহাক সদয় হলেন না তার প্রতি।
সামুরা দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল সব অবরুদ্ধ চোখে। চাপা কষ্টে তার হৃদয় পিষে যাচ্ছিল। তার মম এমন কাজ করেছে যা ভাবতে তার কষ্ট হচ্ছিল, লজ্জা লাগছিল, মাথা নিচু হয়ে আসছিল। সে জলপূর্ণ দৃষ্টিতে মমকে চলে যেতে দেখলো পুলিশদের সাথে। রাম্মিকা কাঁদছিল। এরদোয়ান গতকাল সবটা ভালোভাবে শোনার পর আর মমের পক্ষে দাঁড়ানো সঠিক মনে করলো না। যত যাই হোক, মম কীভাবে পারলো ক্যানিয়লকে মারার চেষ্টা করতে? মায়া, ভালোবাসা নাই থাকুক ক্যানিয়লের প্রতি, কিন্তু দিন শেষে ক্যানিয়ল তো এই পরিবারেরই একটা অংশ। এটা তো অস্বীকার করার পথ নেই।
আরও একটা ঘটনা ঘটেছে। ইরতিজাকে মারার সেই ভিডিয়োটা পাবলিশড করা হয়েছে। ভিডিয়োতে মুখ ঢেকে দেওয়া হয়েছে ইরতিজার। রাতারাতি ভাইরাল হয়ে গেছে ভিডিয়োটা। মিরান্ডার এজেন্সির লোকেরা পেরেশান হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। সাংবাদিকরা মিরান্ডার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। যারা ভিডিয়োটা দেখছে তারাই মিরান্ডাকে ধিক্কার জানাচ্ছে, সমালোচনা করছে। পুরো লন্ডভন্ড এক অবস্থা চলছে এখন। এসব ব্যাপার দেখে মিরান্ডা পাগলের মতো হয়ে গেল। সে বুঝতে পারলো ক্যানিয়ল গতরাতে যে ঝড়ের কথা বলে গিয়েছিল সেটা এই ঝড়। শেষমেশ ক্যানিয়ল তার ক্যারিয়ার বরবাদ করার জন্য উঠে পড়ে লাগলো? আর ওই লোভী ব’দ’মা’ই’শ গুলো তাকে ব্ল্যাকমেইল করার জন্য এমন ফাঁদ পেতেছিল ভাবতেই পারছে না সে!
এজেন্সি থেকে একের পর এক কল আসতে শুরু করেছে। সবাই ক্ষুব্ধ। তারাও জানতো না মিরান্ডার সুন্দর চেহারার পিছনে একটা হিংস্র রূপ আছে!
________________
ইরতিজার অসুস্থতা সম্পর্কে জানতে পেরে আন্দ্রেজ সকাল বেলা ইরতিজাকে দেখতে হাসপাতালে এসেছে। রিশনের কাছ থেকে জেনেছে ইরতিজার ব্যাপারে। জুহির সাথে তার আর সেই ঝগড়ার পর থেকে কথা হয়নি। দেখা হয় জুহির সাথে, পিটারের সাথে প্রায়ই ঘুরতে দেখে ওকে, তবে ওই দিনের পর দুজন আর একে অন্যের সাথে এক দণ্ডও কথা বলেনি।
জুহিও সকাল বেলা হাসপাতালে চলে এলো। ইরতিজার রুমে ঢোকার আগেই দেখলো ভিতরে আন্দ্রেজ বসে আছে ইরতিজার সাথে। আর সামনে এগোলো না সে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। কেমন এক হাহাকার জেগে উঠলো মনে। সে উপরে যতই কঠিন থাকুক আন্দ্রেজের উপর, আসলে তার মনটা কাদার মতো নরম। ইচ্ছা হয় হুট করেই একদিন আন্দ্রেজের সাথে কথা বলা শুরু করে। কিন্তু সে আন্দ্রেজকে নিজের দুর্বলতা তো দেখাতে পারবে না। রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে জুহি অনেক কিছু ভাবলো। টুক করে খুলে গেল পাশের দরজাটি। বেরিয়ে এলো আন্দ্রেজ। আন্দ্রেজের মুখোমুখি হয়ে দিগভ্রান্ত হয়ে পড়লো জুহি। দ্রুত অন্যদিকে ঘুরলো চলে যাওয়ার জন্য। আর তখনই আন্দ্রেজ বললো,
“তোমার সাথে কথা আছে জুহি। লেট’স টক।”
জুহি দাঁড়ালো। পিছন ফিরে তাকালে আন্দ্রেজ দূরে খালি আসন গুলো দেখিয়ে বললো,
“ওখানটায় বসা যাক।”
জুহি বিনা বাক্যে আন্দ্রেজকে অনুসরণ করে এসে বসলো আন্দ্রেজের পাশে।
জুহির বুক এতদিন হাহাকার করছিল আন্দ্রেজের সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু এখন এই হাহাকার বন্ধ করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সে সেটা কাজে লাগাতে পারছে না। বিব্রত বোধ হচ্ছে। এতদিনের দূরত্বটা ক্ষুণ্ন করেছে তাদের আগের স্বাভাবিক সম্পর্ককে।
“কেমন আছো?”
আন্দ্রেজের জিজ্ঞেস করা প্রশ্নে জুহির ভিতরের কিছু একটা সামান্য দুলে উঠলো। বললো,
“ভালো।”
আন্দ্রেজ ঠোঁটে ম্লান হেসে বললো,
“কিছুদিন ধরে দেখছি পিটারের সাথে ডেট করছো। আমি জানি এটা তোমাদের ফেইক রিলেশনশিপ। কারণ পিটারের গার্লফ্রেন্ড আছে। যদিও আমি জানি এটা মিথ্যা, তবুও কী জানো তো, পিটারের সাথে তোমার ঘোরাঘুরি, আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ডের মতো আচরণ আমার ভীষণ খারাপ লাগে। এটা খারাপ অনুভূতির জন্ম দেয় আমার মাঝে। আমি জানি এই অনুভূতিটা কেন হয় আমার। তুমি কি জানো কেন হয়?”
জুহি হকচকিয়ে গেল। আন্দ্রেজের কথাগুলো তার মনে অগোছালো পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। কী বলছে আন্দ্রেজ? কী মানে ওর কথার?
আন্দ্রেজ কিছু সময় নীরব থেকে বললো,
“আমি জানি জুহি, আমি বুঝি। তোমার জানানো বোঝানোর চেষ্টারও আগে থেকে আমি সব জানি এবং বুঝি। কিন্তু…”
আন্দ্রেজ একটু চুপসে যাওয়ার পর আবার বললো,
“আমরা দরিদ্র জুহি! একটু বেশিই দরিদ্র! তোমাদের সাথে আমাদের তুলনা চলবে না। মা ব্যতীত আমার আর কেউ নেই। আমি শারীরিক দিক দিয়ে অস্বাভাবিক! এছাড়া আমি ভিন্ন ধর্মের মানুষ। সবকিছু মিলিয়ে কৈশরের ওই বুক ধুকপুকে অনুভূতিটা চাপা দিয়ে দিলাম। চাপাই দিলাম, শেষ করতে পারলাম না।”
ক্ষণকাল বাদে আবার বললো,
“মার্টার প্রতি আমার অনুভূতিটা শুধু ভালো লাগার। আমি ওকে পছন্দ করি। কিন্তু কৈশরের সেই বুক ধুকপুকে অনুভূতিটা ভিন্ন কিছু ছিল। যেটা এখনও আছে। চাপা পড়ে আছে!”
আন্দ্রেজের কথাগুলোর মাঝে মিশে আছে অনেক কিছু। অনেক না বলা কথার বহিঃপ্রকাশ। জুহি খুব সন্তর্পণে কথাগুলো অনুধাবন করলো। অনুভব করলো সূক্ষ্ম ভালো লাগার সাথে ঝাপসা কষ্টের আলিঙ্গন। সে অপলক চোখে চেয়ে রইল। দুই ঠোঁটের মধ্যিখান দিয়ে বেরিয়ে এলো না কোনো শব্দ, বাক্য।
“আগামী পরশু আমি ফিলাডেলফিয়া যাচ্ছি।”
জুহি এতক্ষণে কথা বললো,
“ফিলাডেলফিয়া যাচ্ছ মানে?”
কিছুটা বিস্ময়যুক্ত শোনালো তার কথা।
“মমের চাকরিটা চলে গেছে! এমতাবস্থায় আমাদের এখানে জীবনযাপন করা কঠিন। ফিলাডেলফিয়া আমার গ্র্যান্ড প্যারেন্টস থাকে। তারা আমাদের এই দুঃসময়ে তাদের সাথে থাকার জন্য আহ্বান করেছে আমাদের। মম সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওখানে চলে যাবে আমাকে নিয়ে।”
জুহির মুখখানি কালো হয়ে গেল। আন্দ্রেজ ফিলাডেলফিয়া চলে যাবে মানে?
আন্দ্রেজ বললো,
“ওখানে গেলে হয়তো আর আসা হবে না। আসলেও কিছুদিনের জন্য বেড়াতে আসা হবে। যদি আমি আসি নিশ্চয়ই তোমাকে স্মরণ করবো।”
আন্দ্রেজ উঠে দাঁড়ালো। জুহিও ওর দেখাদেখি দাঁড়ালো। আন্দ্রেজ পকেট থেকে একটা বক্স বের করে দিলো জুহির হাতে। বললো,
“সুন্দর কেউ আসুক তোমার জীবনে। যে তোমার পরিবারের সাথে মানানসই, শারীরিক দিক দিয়ে স্বাভাবিক। তোমার পাশে আমি বড্ড বেমানান!”
আন্দ্রেজ জুহির মাথায় এক হাত রেখে একটু হাসার চেষ্টা করলো।
জুহির বুকের মাঝে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে শুরু করলো কষ্টরা। কী অসহ্য লাগছে এই মুহূর্ত। কী যে বিষাক্ত অনুভূতি। ভিতরটা শেষ হয়ে যাচ্ছে, তবুও তার বাইরেটা সাবলীল দেখাচ্ছে।
“ভালো থেকো।”
আন্দ্রেজের এই দুই শব্দের কথাটা বিষের তীরের ন্যায় জুহির হৃৎপিণ্ড আক্রমণ করলো। আকুল কণ্ঠে বললো,
“যেতেই হবে ওখানে?”
আন্দ্রেজ মাথা দুলিয়ে বললো,
“হ্যাঁ, যেতে হবে।”
আন্দ্রেজ আর দাঁড়িয়ে থাকা উচিত মনে করলো না। জুহি তাকিয়ে রইল আন্দ্রেজের যাওয়ার পানে। দু চোখের দৃষ্টি ছলছল করে উঠলো জলে। ক্ষণিকেই সে জল টুপটাপ করে ঝরে পড়তে লাগলো। আন্দ্রেজ চলে যাচ্ছে? না কি হারিয়ে যাচ্ছে? হারিয়ে যাচ্ছে আন্দ্রেজ! কেন সে এই মুহূর্তে কিছু বলতে পারলো না আন্দ্রেজকে? তার কাছে আসলে সবকিছু একটা ঘোরের মতো মনে হচ্ছে। হোক সব ঘোর। তবে সে আজ একটা বিষয় স্পষ্ট বুঝলো, আন্দ্রেজ তাকে ভালো বাসতো এবং ভালোবাসে!
_________________
আবহাওয়ার অবস্থা আজ ভালো। রোদ চড়েছে আকাশে। রাস্তার রোদ্রোজ্জ্বলকর পরিবেশ এবং মৃদু হাওয়ায় চলিত গাড়িটা পার্কিং লটে এসে ঢুকলো। ইরতিজার অসুস্থতা সম্পর্কে আজ সকালে জেনেছে সাজিদ। জুহির মা জানিয়েছে। অফিসে অনেক কাজ ছিল, একবার ভেবেছিল আসবে না। কিন্তু মন মানলো না সে সিদ্ধান্ত। অগত্যা কাজ ফেলে রেখে ছুটে এলো। ইরতিজার কাছে আজাদ চৌধুরী আর শারমিন আহমেদ আছেন। জুহির মা-বাবাও এসেছিল, চলে গেছে একটু আগে।
সাজিদকে দেখে ইরতিজা কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করলো। সাজিদ প্রশ্ন করলো,
“কেমন আছেন?”
“ভালো।”
“সত্যিই ভালো? দেখে মনে হচ্ছে না আপনি ভালো আছেন।”
“দেখে মনে না হলেও আমি সত্যিই ভালো আছি।”
“তাই? আমি কিন্তু আপনার এই অবস্থা দেখে ভালো থাকতে পারছি না। খারাপ আছি আমি।”
সাজিদ এটুকু বলেই বাইরে বেরিয়ে এলো। জানে আজাদ চৌধুরী এখন কথা বলবে তার সাথে, তাই ওয়েটিং গ্রাউন্ডে বসলো। বুকের বাম পাশে ব্যথা করছে। খারাপ আশঙ্কায় বুক কাঁপছে।
আজাদ চৌধুরী ইরতিজাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি যে মার খেয়েছো এজন্য তোমার রাগ হচ্ছে না? ইচ্ছে হচ্ছে না ওই ছেলের সাথে সম্পর্ক শেষ করে দিতে?”
ইরতিজা বললো,
“না আব্বু, রাগ হচ্ছে না আমার। আর ওর সাথে সম্পর্ক শেষ করে দেওয়ার কথা তো আমি ভাবতেও পারবো না। তাহলে আমি নিজেও নিঃশেষ হয়ে যাব।”
“কিন্তু আমি যদি ওর সাথে তোমার সম্পর্ক মেনে না নিই?”
“তুমি নিজের কথার মাঝে ‘যদি’ শব্দটা উচ্চারণ করেছো, এর মানে তুমি নিশ্চিতভাবে বলছো না। আমি বিশ্বাস রাখতে পারি তুমি মেনে নেবে। সুতরাং যদি মেনে না নাও তখন আমি কী করবো তা নিয়ে ভাবার প্রয়োজন বোধ করছি না।”
আজাদ চৌধুরীর ইরতিজার অকপটে বলার ধরন ভালো লাগলো। সে কণ্ঠ অন্যরকম করে বললো,
“সাজিদ কষ্ট পাবে!”
ইরতিজা বাবার থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে অন্য দিকে তাকালো। বললো,
“জানি। প্রথমে বুঝতে পারিনি, কিন্তু আমার প্রতি যে তার অনুভূতি আছে সেটা বুঝতে পারছি এখন। আমি তাকে কষ্ট দিতে চাইনি। শুরু থেকেই তাকে বলে এসেছি আমি তাকে বিয়ে করবো না। এরপর তার উচিত হয়নি নিজের মনে আমাকে ঠাঁই দেওয়া। কিন্তু সে দিয়েছে! সবকিছু মজা ভেবে নিয়ে তার মনে ঠাঁই দিয়েছে আমাকে! ভুলটা তার ছিল। নিজের ভুলের কারণে নিজে কষ্ট পাচ্ছে, পাবে! এর দায়ভার আমি নেবো না।”
আজাদ চৌধুরী বড়ো করে নিঃশ্বাস ফেললেন। অতঃপর বললেন,
“ক্যানিয়লের কাছে তুমি সুখী থাকবে এ ব্যাপারে কতটুকু নিশ্চিত তুমি?”
“সম্পূর্ণ। তুমি নিজেও ভবিষ্যতে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হবে। সেজন্য শুধু নিশ্চিত হওয়ার পথ খুলে দিতে হবে।”
আজাদ চৌধুরী উঠে দাঁড়ালেন। কিছু না বলেই বেরিয়ে গেলেন বাইরে।
ইরতিজা মায়ের দিকে তাকালো। শারমিন আহমেদ বললেন,
“তোমার জন্য যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে সুস্থ হয়ে ওঠা। তোমার সুখী থাকার বিষয় নিয়ে এখন তোমার আব্বুকে ভাবতে দাও।”
“আমার জন্ম থেকেই আমি ভাগ্যবান। সকল দুঃখের মাঝেও আমার জন্য সুখ ছিল। আমি সুখী ছিলাম, কারণ আমার আব্বু ছিল।”
“তুমি এমন ভাগ্য পেয়েছো বলে আমি ভাগ্যবান।” বললেন শারমিন আহমেদ।
__________________
“দুজন মানুষ সাজিদ, যাদের দেখে আমি নিশ্চিত হয়েছি এই দুই জনের কাছে আমার মেয়ে ভালো থাকবে, সুখী থাকবে। প্রথম যার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছিলাম সে আমার অধিক পছন্দের পাত্র ছিল। আর দ্বিতীয় যাকে দেখে নিশ্চিত হয়েছি সে আমার মেয়ের পছন্দ। আমার কী করা উচিত বলো তো? কাকে বেছে নেওয়া উচিত আমার? আমার মেয়ে যাকে চাইছে তাকে? না কি অন্য জনকে?”
সাজিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“অবশ্যই তাকে, যার সাথে আপনার মেয়ে থাকতে চায়!”
আজাদ চৌধুরীও দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বললেন,
“তোমার কষ্ট লাগছে সাজিদ?”
“কষ্ট তখন থেকেই লাগতে আরম্ভ করেছে যখন থেকে আপনার মেয়েকে হারানোর ভয় ঢুকেছে মনে। এখন তো সে আমার হারিয়ে ফেলা মানুষই! কষ্ট লাগছে না আমার, ভীষণ কষ্ট লাগছে!”
আজাদ চৌধুরী কিছু বলার পেলেন না। কেটে গেল কিছু সময় পিনপতন নীরবতায়।
একসময় সাজিদ বললো,
“ইরতিজার সাথে আমার বিয়ে হয়নি বলে কিন্তু আমাদের সম্পর্ক শেষ কিংবা অন্য রকম হয়ে যাবে না আঙ্কল। আমাদের সম্পর্ক ঠিক তেমনই থাকবে, যেমন ছিল।”
আজাদ চৌধুরী হাসার চেষ্টা করলেন,
“হুম।”
সাজিদ যাওয়ার আগে ইরতিজার সাথে আর একবার দেখা করতে এলো। তখন ইরতিজার কাছে আর কেউ ছিল না। সাজিদ বললো,
“আমি সংশয়ে ছিলাম নিজের এগিয়ে আসার ব্যাপারে, আপনাকে কষ্ট দিতে পারবো কি না সে ব্যাপারে। পারলাম না। আপনাকে কষ্ট দেওয়ার সাধ্য আমার হলো না। মন মানাতেই পারলাম না আপনাকে কষ্ট দিতে।”
কথা গুলো বলেই সাজিদ হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল। হয়তো ইরতিজার অনুমান থেকে গোপন রাখতে চাইলো নিজের কষ্টের পরিমাণ।
যেতে যেতে হুট করে ক্যানিয়লের সাথে দেখা হয়ে গেল পথে। দুজনেই দাঁড়ালো দুজনকে দেখে। ক্ষণকালের জন্য দুই জোড়া দৃষ্টি একে অপরের সাথে মিলিত হলো। সাজিদই চোখ সরিয়ে নিলো প্রথমে। তারপর ক্যানিয়লকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত যেতে উদ্যত হলো। কিন্তু সাজিদের একটা হাত ধরে থামালো ক্যানিয়ল।
সাজিদ বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে গেল। তাকালো পিছনে ক্যানিয়লের দিকে।
ক্যানিয়ল সাজিদের চোখ জোড়ায় তাকিয়ে বললো,
“তোমার চোখে ইজার জন্য সত্যিকারের ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছি ব্রাদার!”
সাজিদ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। ক্যানিয়ল কখনও তাকে এই কথা বলতে পারে এ ধারণা সে কোনো ক্রমেই কখনও মস্তিষ্কে আনেনি।
সাজিদের বিস্ময় ঘেরা চক্ষু দ্বয়ের সামনে ক্যানিয়ল সরল হাসলো। সে আজাদ চৌধুরী আর সাজিদের মাঝে চলমান কথা শুনেছিল দূর থেকে অগোচরে। আর তখনই সে বুঝলো এই মানুষটার মাঝে ইরতিজার জন্য যে অনুভূতি আছে তা প্রকৃত।
সাজিদ একটু হাসলো। বললো,
“চিন্তা করবে না, তোমাদের বিয়ে হয়ে গেলে আমি ভুলে যাব আমি ইরতিজাকে ভালোবাসি!”
“কীভাবে করবে সেটা? তোমার মন যদি ইজাকে না ভোলে তুমি কীভাবে ভুলবে?”
“হয়তো পারবো ভুলতে। মানুষ অনেক কিছুই পারে। মানুষের মন এক বিষয় আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকে না। আর যদি একান্তই ভুলতে না পারি সেজন্য আমি দুঃখিত থাকবো তখন।”
“হ্যাঁ, ভুলতেই চেষ্টা করো। অন্যের হৃদয়ে আমার ওয়াইফের জন্য ভালোবাসা দেখতে খারাপ লাগবে আমার। আমার সমস্ত হৃদয় ইজার জন্য ভালোবাসায় ভরতি। ইজা যেমন একান্ত আমার মানুষ, তেমনি ওকে ভালোবাসারও অধিকার শুধুই আমার।”
“ভুলতে তো হবেই। আমার হৃদয়ও তো আমার ওয়াইফের জন্য ভালোবাসায় পূর্ণ করতে হবে।”
ক্যানিয়ল হাসলো। তারপর হঠাৎ জড়িয়ে ধরলো সাজিদকে। ভীষণভাবে চমকে উঠলো সাজিদ।
ক্যানিয়ল বললো,
“একজন ভালো মানুষ হওয়ার জন্য ধন্যবাদ তোমাকে। তুমি চাইলেই বিষয়টা কঠিন করে তুলতে পারতে, কিন্তু তুমি বিষয়টা সহজ হতে সাহায্য করলে।”
ক্যানিয়ল ছেড়ে দিলো সাজিদকে। সাজিদ যাওয়ার আগে বলে গেল,
“তুমি ইরতিজার জীবনে না এলে এখন ইরতিজার হৃদয়ে আমার জন্য ভালোবাসা থাকতো। এটা নিশ্চিত, কোনো দ্বিধা নেই এ ব্যাপারে। ওর জীবনে তোমার আগমন মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। তবে আল্লাহ তায়ালা চেয়েছেন বলেই এমন হয়েছে। এটা মানি আমি। তাই ইরতিজার জীবনে তোমার আগমনও মেনে নিতে হবে কষ্ট হলেও।”
সাজিদ চলে যাওয়ার পর ইরতিজার রুমে এলো ক্যানিয়ল। রুমে আজাদ চৌধুরী ছিলেন। ক্যানিয়ল সোজা ইরতিজার কাছে এসে হাসি মুখে বললো,
“কনগ্রাচুলেশন পাকিস্টানি গার্ল।”
ইরতিজা কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে বললো,
“কীসের জন্য?”
“তোমার বিয়ের জন্য।”
ইরতিজা চমকালো। বাবার দিকে চাইলো একবার। তারপর আবার ক্যানিয়লের দিকে তাকিয়ে বললো,
“বিয়ে মানে?”
ক্যানিয়ল আজাদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“তোমার ড্যাড তো খুব শীঘ্রই তোমার সাথে আমার বিয়ে দেবে।”
ইরতিজার পাশাপাশি এবার আজাদ চৌধুরীও ভারি চমকালেন। এমন কিছুই তিনি ক্যানিয়ল অথবা অন্য কারো কাছেই বলেননি। তাহলে ক্যানিয়ল এই কথা বলছে কীভাবে? তিনি বললেন,
“কী আজেবাজে কথা বলছো ছেলে?”
________________
নাইলা সালেমের প্রিজনে থাকার সাত দিন হয়ে গেছে। তার ধারণা ছিল এরদোয়ান তাকে খুব শীঘ্রই এখান থেকে মুক্ত করে নিয়ে যাবে। কিন্তু এরদোয়ান তা করেনি। সাতটা দিন হয়ে গেছে অথচ তার জামিনের কোনো প্রসঙ্গই ওঠেনি এখনও পর্যন্ত। ক্যানিয়ল তার সাথে দেখা করতে এসেছে। নাইলা সালেম আর ক্যানিয়ল এখন সামনাসামনি বসে আছে। একটা কাচের দেয়াল শুধু তাদের মাঝে। কথা বলার সময় খুব বেশি নয়। ক্যানিয়ল বললো,
“কেমন আছো মাদার সালেম?”
নাইলা সালেম বললো,
“ভুল করেছিলাম। উচিত ছিলো তোর মমের সাথে সাথে তোকেও বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া, নয়তো তোর গ্র্যান্ডপায়ের সাথেই তোকে মে’রে ফেলা। কিন্তু আমি তোকে ওই বাড়িতে থাকতে দিয়ে চরম ভুল করেছিলাম।”
“মানুষ মাত্রই ভুল হয়, কিন্তু তুমি তো অমানুষ। তারপরও এরকম ভুল কীভাবে করলে?”
“জেলে তো সেই আসতেই হলো আমার। কিন্তু তোকে খু’ন করে আসতে পারলে মনটাতে শান্তি পেতাম। তুই আর বেলা আমার সুন্দর জীবনটাকে তছনছ করে দিয়েছিস। বেলাকে আমি এক সেকেন্ডের জন্যও সহ্য করতে পারিনি কখনও। ও আমার জীবনের অভিশাপ। ওকে আমি চরম হিংসা করি, ঘৃণা করি। সবথেকে বেশি ভালো হতো শুরুতেই বেলাকে মে’রে ফেললে। বাড়ি থেকে তাড়িয়ে না দিয়ে খু’ন করা উচিত ছিল।”
ক্যানিয়ল চোয়াল শক্ত করে বললো,
“শুকরিয়া আদায় করো যে তুমি জেলের ভিতর আছো, নইলে এখন আমার হাতে বাজে ভাবে নি’হ’ত হতে!”
নাইলা সালেমের রাগ আসমান ছুঁলো। রাগে চিৎকার করে উঠলো সে,
“ব্লাডি হে…”
পুরো কথা শেষ করার আগেই ক্যানিয়ল চট করে উঠে পড়লো। এখান থেকে বেরোতে বেরোতে শুনতে পেল পিছনে নাইলা সালেমের রাগে লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে সব। ওসব ক্যানিয়লের গায়েও লাগলো না। সে প্রিজন থেকে বেরিয়ে এলো। গাড়িতে ওঠার পর মি. হেনরি ফোনে জানালো, মিরান্ডা আজ সকালের ফ্লাইটে দেশ ত্যাগ করেছে। ইংল্যান্ড চলে গেছে সে। এত মানুষের নিন্দা নিয়ে দেশে টেকা মুশকিল ছিল বেচারির জন্য। শেষমেশ দেশ ত্যাগেরই সিদ্ধান্ত নিতে হলো। যেখানে এক সময় সবাই তার রূপের, নাচের প্রশংসা করতো, সেখানে ওই ভিডিয়ো ভাইরাল হয়ে যাওয়ার পর শুধু মানুষের গালি, কটূক্তি হজম করে যেতে হচ্ছিল।
যারা খারাপ কর্ম করে তাদের অবশ্যই একদিন তাদের কর্মের জন্য শাস্তি পেতে হবে। প্রকৃতি কারো ঋণ রাখে না।
(চলবে)
__________
বি. দ্র. জুনের ২ তারিখ থেকে আমার প্রাক নির্বাচনী পরীক্ষা শুরু। লেখাপড়ায় আগের চেয়ে বেশি সময় দিতে হচ্ছে। ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করছি স্টাডি নিয়ে। গল্প লেখার জন্য সময়ের অভাব দেখা দিয়েছে। এত ব্যস্ততার মাঝে লেখালেখিতে মনোযোগও বিনষ্ট হচ্ছে।
তাড়াহুড়ো করে আজকের পর্বটা লিখেছি। পরবর্তী পর্ব পোস্ট করতে কিছুটা দেরি হতে পারে। সাথে থাকবেন। আর জানিয়ে রাখি, গল্পটা খুব শীঘ্রই শেষ হবে। গল্পটা শেষ হলেই হাফ ছেড়ে বাঁচি আমি। তারপর পুরোদমে স্টাডিতে সময় দেবো।