#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৬২ (শেষ পর্ব–শেষাংশ)
________________
স্থানীয় একটা রেস্তোরাঁয় দেখা করলো আন্দ্রেজ, জুহি। জুহি যে আনন্দের সহিত এসেছিল সেই আনন্দ আর সে ধরে রাখতে পারলো না আন্দ্রেজের সাথে দেখা হওয়ার পর।
আন্দ্রেজ জানালার পাশে একটা টেবিলে বসে অপেক্ষা করছিল। এই জানলা থেকে দূরের সবুজ পাহাড়ের চূড়াগুলো দেখা যায়। দেখা যায় দীর্ঘ একটা জল থলথলে লেক। আন্দ্রেজের পাশে সুন্দরী কালো চোখের একটা মেয়ে বসে আছে। মেয়েটাকে দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হয়েছে জুহি। আর এই অবাক হওয়ার নিচে ঢাকা পড়ে গেল ওর আনন্দের রেশ। জুহিকে দেখে আন্দ্রেজ উঠে দাঁড়ালো।
“তুমি এসে গেছো?”
জুহি এসে বসলো আন্দ্রেজের সম্মুখের চেয়ারে। আন্দ্রেজ ঠিক আগের মতোই আছে। চেহারা ঠিক আগের মতো। আগের মতোই শুকনো গড়নের।
“দীর্ঘ সময় পর তোমাকে দেখে সত্যিই ভীষণ ভালো লাগছে।” বললো আন্দ্রেজ।
জুহির কৌতুহল এখন আন্দ্রেজের পাশে বসে থাকা মেয়েটাকে নিয়ে। কেন যেন ভালো লাগছে না বিষয়টা তার। মেয়েটা তার চেয়ে বয়সে ছোটো সেটা অনুমান করতে পারছে। মেয়েটাকে কোমল প্রকৃতির মনে হলো। জুহি ডিরেক্ট জানতে চেয়ে প্রশ্ন করলো,
“ও কে?”
আন্দ্রেজ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। মেয়েটাও হাসলো আন্দ্রেজের দিকে তাকিয়ে। আন্দ্রেজ অতঃপর দৃষ্টি দিলো জুহির উপর। বললো,
“ওর নাম ফ্লোরি। আমার ওয়াইফ!”
খাঁখাঁ করে উঠলো জুহির বুক। মুখ শুকিয়ে রুক্ষ রূপ ধারণ করলো। আন্দ্রেজ কী বললো? ওয়াইফ? এটাই বলেছে? না কি তার শুনতে ভুল হয়েছে? জুহি মজা ভেবে উড়িয়ে দিতে চাইলো কথাটা। যদিও তা করা সম্ভব হলো না। হাসার চেষ্টা করে বললো,
“মজা করছো? এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করেছো তুমি? এরকম মজা কেন করছো? কে হয় ও? তোমার ফিলাডেলফিয়ার ফ্রেন্ড?”
আন্দ্রেজ লক্ষ করছে জুহির মুখের নিচে থমথমে একটা ভাব চাপা পড়ে আছে।
জুহির মাঝে এখন উদ্বেগ। সে চাইছে আন্দ্রেজের বলা কথাটা মিথ্যা হোক। আন্দ্রেজের বলা কথাটা সত্যি হলে সে মরে যাবে! আন্দ্রেজ ওকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে বললো,
“মজা করছি না। ও সত্যিই আমার ওয়াইফ। আমরা রিসেন্টলি বিয়ে করেছি।”
______________
যে মেয়েটা এত উৎফুল্ল মনে বাসা থেকে বের হয়েছিল সেই মেয়েটার কান্নার আওয়াজে পুরো বাসা এখন করুণ রূপ ধারণ করেছে। জুহির কান্না দেখে ইরতিজার চোখেও জল টলমল করছে। জুহি কান্নারত বিরহ কণ্ঠে বললো,
“আন্দ্রেজ কীভাবে বিয়ে করতে পারে টিজা? ওর গ্র্যান্ডপা চাইলো আর ও অমনি বিয়ে করে নিলো? আমার কথা একবারও মনে পড়লো না ওর? নিজের ওয়াইফকে দেখাবে বলে ও আমাকে ডেকেছিল? না, ও আসলে মানসিক টর্চার করবে বলে আমাকে ডেকেছিল। আমার ভীষণ কষ্ট লাগছে টিজা। আমাকে রেখে আন্দ্রেজ কীভাবে বিয়ে করতে পারলো? ও আমাকে ভালোবাসেনি টিজা। ও আমাকে ভালোবাসেনি! সেই সময়কার ধারণা মিথ্যা ছিল আমার।”
ইরতিজারও ভীষণ খারাপ লাগছে। সে জুহির পিঠে সান্ত্বনার হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
“কষ্ট পেয়ো না জুহি। এমনটা হওয়ার ছিল বলে হয়েছে! প্লিজ এমনভাবে কেঁদো না তুমি।”
জুহি কান্না থামালো না। মা-বাবা বাসায় না থাকাতে আরও মনের খায়েশ মিটিয়ে কাঁদলো। ওর মা-বাবা এক বাঙালি বন্ধুর বাসায় ডিনারের দাওয়াতে গেছে।
সন্ধ্যায় জুহি বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। ইরতিজা ওর জন্য কোল্ড ড্রিংকস প্রস্তুত করার জন্য কিচেনে গিয়েছিল, ফিরে এসে দেখলো জুহি নেই। সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে দেখলো জুহি কোথাও চলে যাচ্ছে। ইরতিজা ডাকলো। কিন্তু জুহি শুনতে পেয়েও কিছু বললো না। পিছনও ফিরলো না।
ক্লাবে এসে রাগ-কষ্টে দুই বোতল বিয়ার পান করলো জুহি। এতেই নেশায় বুদ হয়ে গেল সে। জীবনে এই প্রথম বিয়ার পান করেছে। এর আগে কখনও কোনো মদ্য পান করেনি। কাউন্টারের সামনে বসে আছে সে। কিছুক্ষণ কাউন্টার টেবিলে মাথা নুইয়ে ছিল। আস্তে আস্তে মাথা তুললো। একটা বোতলের তলানিতে একটুখানি বিয়ারের অংশ ছিল সেটুকুও মুখে ঢেলে নিলো। তারপর পুরো ক্লাবটায় তাকালো একবার। উচ্চৈঃ শব্দে গান বাজছে। ডান্স গ্রাউন্ডে প্রায় অনেক গুলো ছেলে মেয়ে নাচানাচি করছে। জুহির বিরক্ত লাগছে এসব। অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করলো,
“ওগুলো সব জম্বির মতো করছে কেন?”
বলে সে নতুন একটা বোতল থেকে আরও কিছু তরল পদার্থ পান করলো। হঠাৎ তার চোখ পড়লো ক্লাবের এক কোণে থাকা শান্ত স্থানটার দিকে। ওখানে বসে কথা বলছে দুজন যুবক। জুহির চোখ একজন যুবকের উপর গাঢ়ভাবে আটকে গেল। যুবকটি পরিচিত হওয়ার পরেও নেশাগ্রস্ত জুহি তাকে চিনতে পারল না। তার চোখে এই মুহূর্তে ওই যুবক একজন রাজপুত্র। সে প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে গেছে ওই রাজপুত্রের। সে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“হাউ কিউট! এত সুন্দর কেন ছেলেটা? ইশ কত মুগ্ধকর! আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি তার রূপে। এই রাজপুত্র কি আমার সাথে ডেট করবে?”
জুহি টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালো।
সাজিদ যেখানে বসে আছে এই জায়গাটি শান্ত স্থান ক্লাবের ভিতর। অফিস থেকে ম্যাক প্রায় জোর করে ধরে এনেছে তাকে। ক্লাব সে খুব একটা পছন্দ করে না। পাগলের কারখানা মনে হয় জায়গাটাকে। এখানে থাকা আর সম্ভব নয়। ম্যাক গা দোলাতে দোলাতে ডান্স গ্রাউন্ডের দিকে চলে গেছে। সাজিদকে এখন যেতে হবে। আর থাকার ধৈর্য নেই এখানে। উঠে দাঁড়ালো সে। যাওয়ার জন্য পাশ ফিরতেই এক নেশাগ্রস্ত মেয়ে তার দুই হাতে হাত স্পর্শ করে দাঁড়ালো।
সাজিদ প্রচণ্ড অবাক হলো। জুহিকে সে এখানে দেখতে পাবে একদম আশা করেনি। জুহি ড্রিংকস করেছে?
জুহি এখন নিজের রাজপুত্রের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার মনে হাজারো প্রজাপতির ডানা ঝাপটাঝাপটি এখন। খুবই মিষ্টি গলায় বলার চেষ্টা করলো,
“হেই হ্যান্ডসাম প্রিন্স, তুমি কি আমার সাথে ডেটে যাবে? তুমি কি আমায় ভালোবাসবে? আমি তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। তুমি কি আমার প্রেমে পড়বে? প্রেমে পড়ো আমার। আমি খুব মিষ্টি একটা মেয়ে। আমার সাথে ডেটে চলো।”
সাজিদ হতাশ। এই মেয়ে তো মাতাল হয়ে গেছে! হঠাৎ এত পান করেছে কেন? শখে? সাজিদ জুহির হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,
“জুহি, তুমি কি আমাকে চিনতে পারছো না? এটা আমি, সাজিদ। চিনতে পারছো এখন?”
জুহির কানে ঢুকলো না ওসব। সে তার ধ্যানেই আছে। সে এবার দুই হাতে চেপে ধরলো সাজিদের গাল। চোখের পাতা বন্ধ করে বললো,
“প্লিজ গিভ মি অ্যা লাভলি কিস। প্লিজ মাই প্রিন্স, গিভ অ্যা লাভলি কিস।”
বলে জুহি চুমুর ন্যায় সুচালো করলো ঠোঁট।
সাজিদ নেত্র বন্ধ মাতাল জুহির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বললো,
“সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেছে!”
সাজিদ জুহিকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে এলো ক্লাব থেকে। জুহি নিজে নিজে হাঁটতে পারছে না। আলুথালু হাঁটার চলন তার। একদিকে হাঁটা দিলে ঘুরে-ফিরে এদিক-ওদিক চলে যাচ্ছে। চোখে কেমন যেন সব অস্বাভাবিক দেখছে। সাজিদ এই অবস্থা দেখে জুহিকে ধরে এনে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। এই মেয়েকে একলা ছেড়ে দেওয়া মানে বিপদ। সাজিদও ড্রাইভিং সিটে বসলো। সিট বেল্ট বাঁধার সময় লক্ষ করলো জুহি কেমন যেন করছে। সাজিদ বুঝতে পারলো এখন কী ঘটবে। সে সিটবেল্ট খুলে নামবে তার আগেই যা ঘটার তা ঘটে গেল! জুহি বমি করে দিয়েছে। দিয়েছে তো দিয়েছে তাও আবার সাজিদের গায়ে! ঘৃণায় সাজিদের শরীর কেমন করে উঠলো। দৃশ্যটা দেখার পর তারও বমি বমি পাচ্ছে। সে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে।
______________
রিশন কাঁদছে। ওর পাশে বসে আছে ইরতিজা। রাতের আঁধারে প্রকৃতি ঢেকে যাওয়ায় জ্বলে উঠেছে কৃত্রিম সব আলোর উৎস। রিশনের মা-বাবা এখনও ফেরেনি। ইরতিজার বাসার সবাইও বাসার অভ্যন্তরে অবস্থান করছে, শুধু রিশন আর ইরতিজা বাইরে লনে বসে আছে। রিশন কিছুক্ষণ পর পর একেকটা টিসু দিয়ে নাক মুছে সেটা ফেলে দিচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু টিসু জমা হয়েছে তার পায়ের কাছে।
ইরতিজা বুঝতে পারছে না কিছু। আজ একই দিনে দুই ভাই-বোনের কান্নার জলে ভেসে যাচ্ছে সবকিছু। রিশন আজই আমেরিকা ফিরে আসবে এ সম্পর্কে কাউকে কিছু বলেনি। হঠাৎ তাই রিশনকে দেখে চমকে গিয়েছিল সে। খুব চমকে গিয়েছিল। সে রিশনের কাছে হঠাৎ এমনভাবে ফিরে আসার কারণ জানতে চাইলে তখনই কিছু জানায়নি রিশন।
গোসল সেরে ইরতিজাকে ডেকে লনে বসেছে। তারপর সব ঘটনা খুলে বলেছে। বলতে বলতে কান্নার বাধ ভেঙে পড়লো। সেই থেকে কাঁদছে। সব শুনে ইরতিজার মনও চরম খারাপ করেছে। মেয়েটা এরকম করলো কেন? নিষ্পাপ রিশনের সাথে এটা করা মেয়েটার মোটেই উচিত হয়নি!
বাড়ির সামনে রাস্তায় একটা গাড়ি থামতেই ইরতিজা, রিশন দুজনেই সেদিকে তাকালো। ইরতিজা গাড়িটা দেখা মাত্রই চিনলো। এটা সাজিদের গাড়ি।
গাড়ি থেকে প্রথমে নামলো সাজিদ। জুহি বমি করে দেওয়ায় ওর গায়ের কোট খুলে রাখতে হয়েছে। ওর গায়ে এখন স্কাই ব্লু রঙের শার্ট। জুহিকে দরজা খুলে বাইরে বের করলো। জুহি এখন চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। ঘুমঘুম দুটি চোখ। সাজিদ ওকে ধরে নিয়ে আসতে লাগলো। জুহিকে এমন দেখে দাঁড়িয়ে গেল ইরতিজা। আতঙ্কিত কণ্ঠে বললো,
“কী হয়েছে ওর?”
ইরতিজার কণ্ঠ কানে এলে জুহি চোখ তুলে তাকালো। চোখ-মুখ কুঁচকে কেমন এক ভঙ্গিতে ইরতিজাকে দেখলো কিছুক্ষণ। তারপর মুখে এক চিলতে হাসি ফুঁটিয়ে বললো,
“ভালো আছো টিজা?”
ইরতিজা বুঝতে পারলো জুহি মদ পান করেছে। জুহির দৃষ্টি হঠাৎ আটকে গেল ইরতিজার পাশে বসে থাকা তার ভাইয়ের উপর। দু চোখ বুজে মাথা ঝাঁকিয়ে দৃষ্টি কিছুটা স্পষ্ট করে দেখার চেষ্টা করলো। হঠাৎ কেঁদে উঠলো জুহি। কাতর কণ্ঠে বললো,
“আমার লক্ষ্মী ভাইটা কাঁদছে কেন টিজা?”
জুহি সাজিদকে ছাড়িয়ে আলুথালু পা ফেলে রিশনের কাছে এসে বসলো। রিশনের চিবুক স্পর্শ করে কাঁদতে কাঁদতে কাতর কণ্ঠে বললো,
“কাঁদছো কেন তুমি?”
বোনকে কাঁদতে দেখে রিশনের কান্না আরও ভারি হলো। সে মনের দুঃখ খুলে বললো জুহির কাছে,
“উম্মেহানি আমার সাথে ছলনা করেছে সিস্টার। ও আমাকে ধোঁকা দিয়েছে। আমি ওকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়েছিলাম, কিন্তু আমি নিজে কতটা সারপ্রাইজড হয়ে ফিরে এসেছি তুমি ধারণা করতে পারবে না। উম্মেহানি একজন বিবাহিত মেয়ে। এমনকি ওর একটা পাঁচ মাস বয়সী ছেলে বেবিও আছে। ও ছলনা করেছে আমার সাথে।”
সব শুনতে শুনতে জুহির কান্না একদম বন্ধ হয়ে গেল। সে কিছুক্ষণ নীরব বসে থেকে মস্তিষ্কে ধারণ করালো কথাগুলো। তারপর ফেঁটে পড়লো অট্টহাসিতে।
“আমি আগেই বলেছিলাম…আমি আগেই বলেছিলাম ওই মেয়ের সাথে রিলেশনশিপে না যেতে। দেখলে তো এখন। মেয়েটা আমার মনের মতো একটা কাজ করেছে।”
জুহি হাসতে হাসতে চেয়ারের সাথে হেলান দিয়েছিল, আর সাথে সাথে চেয়ারটা পড়ে গেল। চেয়ারের সাথে সাথে জুহিও পড়লো। পড়ে গিয়ে একটু আর্তনাদ করলো জুহি। ইরতিজা দৌড়ে এসে জুহিকে তুললো। জুহিকে আর থাকতে দিলো না এখানে। ভিতরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলো বিছানায়। তারপর বেরিয়ে এলো। দরজার কাছে আসতেই দেখতে পেল রিশন সাজিদকে প্রায় জড়িয়ে ধরে সাজিদের বুকে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদছে। কীসব বলছে সে শুনতে পাচ্ছে না।
রিশন কান্না ভেজা কণ্ঠে বলছে,
“খুব কষ্ট হচ্ছে ব্রো। মেয়ে জাতি এমন কেন? দুইজন মেয়ে আমার মন নিয়ে ছিনিমিনি খেললো। আমার মন নিয়ে খেলা করা কি তাদের নেশা হয়ে গেছে? প্রথম জন যা করেছিল তাও তো তা মানার মতো ছিল, কিন্তু উম্মেহানি যা করলো তা আমার হৃদয়কে টু’করো টু’করো করে দিয়েছে। মেয়ে জাতি এত নির্দয় কেন?”
সাজিদের চোখ দরজায় গিয়ে পড়লো একবার। ইরতিজাকে দেখতে পেয়ে সে এখান থেকে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো। রিশনকে ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত গাড়ির দিকে এগোতে লাগলো সে। ইরতিজাও নেমে এলো লনে। বললো,
“আমাকে দেখে পালিয়ে যাচ্ছেন কেন?”
সাজিদ থামলো এবং পিছন ফিরে তাকালো। ইরতিজা বললো,
“ধন্যবাদ। আমি ভেবেছিলাম ও হয়তো বাইরে হাঁটাহাঁটি করতে বেরিয়েছে। কিন্তু ও যে মদ পান করবে এ আমি কল্পনা করিনি। ও তো এসব খায় না। জুহিকে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।”
“ধন্যবাদের প্রয়োজন নেই।”
বলে সাজিদ আবারও যেতে উদ্যত হলে ইরতিজা বললো,
“আমি আপনার জন্য মেয়ে দেখেছি।”
সাজিদ থামলো। প্রথমে বুঝতে পারলো না কোন মেয়ে দেখার কথা বলছে ইরতিজা, যখন বুঝতে পারলো তখন পিছন ফিরে বললো,
“আপনাকে আমি ঘটকের চাকরি দিইনি।”
“এটা আমার দায়িত্ব ছিল। যেই দায়িত্ব এখন আরও গুরুতর হয়েছে।”
“ভুলে যান ওসব দায়িত্বের কথা। আমি নিজ দায়িত্বে একজন খারাপ মেয়ে খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করবো। যে মেয়ে আপনার চেয়েও বেশি খারাপ। আপনি এনগেজমেন্টের পর এসে নিজেকে খারাপ বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, আর আমি এমন একজনকে খুঁজে বের করবো যে মেয়ে বিয়ের পর আমার গলা কে’টে দিয়ে বলবে, আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিন। আমি কিন্তু তখন ডিভোর্স দেবো না। তাকে শেখাবো, আমাকে ভালোবাসতে। আপনার সাথেও যদি আমার বিয়ে হয়ে যেত, যদি আপনিও অমনভাবে আমার গলা কে’টে দিতেন, তাহলে আপনাকেও শেখাতাম। আপনাকে আরও বেশি ভালো করে শেখাতাম। এই শেখানো বিদ্যা ভুলে যাওয়ার কোনো উপায় থাকতো না।”
সাজিদ লম্বা পা ফেলে চলে গেল। গাড়ি নিয়ে চোখের অদৃশ্য হয়ে যেতেই ইরতিজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“আমি ক্যানিয়লকে নিয়ে ভালো আছি সাজিদ, ভীষণ ভালো আছি। আপনিও কাউকে নিয়ে এমনভাবে ভালো থাকুন। খুব খারাপ একটা মেয়ের আগমন ঘটুক আপনার জীবনে। যেই মেয়েটাকে আপনি ভালো করে তুলবেন নিজের ভালোবাসায়।”
__________________
শরতে ঘুরতে আসা হলো নিউ ইয়র্ক। ইরতিজার পরিচিত নিউ ইয়র্ক। সে আমেরিকা আসার পর এই শহরটাতেই প্রথমে পা রেখেছিল। নিউ ইয়র্ক এসেছে অনেকদিন পর। সেই যে রেডমন্ড গিয়েছিল তারপর আর আসেনি। রিশন আর জুহির মন খারাপ বলে ইরতিজা গত কয়েকদিন ধরে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করেছিল। যদিও সে মনে মনে ভারমন্ট ঘুরতে যাওয়ার কথা চিন্তা করছিল, কিন্তু ক্যানিয়ল নিউ ইয়র্ক আসার বন্দোবস্ত করে ফেলায় নিউ ইয়র্কই আসা পড়লো। ইরতিজা প্রথমে নিউ ইয়র্ক আসতে চায়নি। কারণ, এই শহরের এক প্রান্তে জোনাসের বসবাস।
নিউ ইয়র্কের গাছে গাছে এখন নানান রং বেরংয়ের তুলির আঁচড়। গাছের পাতায় পাতায় শুধুই লাল, কমলা আর হলুদের ছড়াছড়ি। এখানে এসেছে দুই দিনের সময় নিয়ে। প্রথম দিন গাড়িতে করে ঘুরে বেরিয়েছে আর আপেল পিকিং করেছে শুধু। সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করে অক্টোবরের মাঝামাঝি অব্দি চলতে থাকে ‘এপল পিকিং’। নির্দিষ্ট একটা ফি দিয়ে বিশেষ সাইজের ব্যাগ সংগ্রহ করে সবাই ঢুকে পড়ে তাদের পছন্দসই কোনো এক আপেল বাগানে। তারপর ইচ্ছা-পছন্দমতো আপেল নিয়ে ব্যাগ পূর্ণ করতে পারে।
আপেল পিকিং এর পাশাপাশি চলতে থাকে মিষ্টি কুমড়া দিয়ে বিভিন্ন রকমের ভূত তৈরি করা। কারণ অক্টোবরের ৩১ তারিখ যে আমেরিকানদের জনপ্রিয় এক উৎসব মুখর দিন। যাকে বলা হয় ‘হ্যালোইন’। এই হ্যালোইনে মিষ্টি কুমড়া দিয়ে ভূত বানানো খুবই জনপ্রিয়। মিষ্টিকুমড়া দিয়ে তৈরি করা বিভিন্ন রকম ভূতুড়ে মুখের ভিতর বাতি জ্বালিয়ে বাড়িতে বাড়িতে ঝুলিয়ে রাখা হয়। কেউ কেউ আবার উঠোনে মাকড়সার জাল বানিয়ে তাতে টাঙিয়ে দেয় কঙ্কাল। পুরো বাড়িই হয়ে ওঠে ভূতুড়েময়। ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েরা ভূতের পোশাক পরে ভূত সেজে দল বেঁধে বের হয়ে পড়ে চকলেট-ক্যান্ডি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। ইরতিজাদের নিউ ইয়র্কের হ্যালোইন উৎসব দেখা হবে না। কারণ ওরা ৩১ তারিখের আগেই চলে যাবে। ওরা দেখবে রেডমন্ডের হ্যালোইন উৎসব।
আজ নিউ ইয়র্কের দ্বিতীয় দিন ওদের।
আজ বেশিরভাগ সময়ই থাকবে শরতের রঙিন প্রকৃতির সাথে। ঘুরতে যাবে পাহাড়ের বুকে থাকা আঁকাবাঁকা পথে। যে পথের দুই ধারে দাঁড়িয়ে আছে রঙিন গাছ। গাড়িটা এখন সেই পথেই চলছে। ধীরে গতিতে। হলুদ প্রজাপতির দল তাদের রঙিন পাখা নাচিয়ে উড়ছে। নাকে ভেসে আসছে বিভিন্ন বুনো ফুলের ঘ্রাণ। ম্যাপল বনের দিকে অপলক মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে ইরতিজা। চোখ এই ম্যাপল গাছের বাইরে কী আছে তা দেখতে পাচ্ছে না। পুরো বন ম্যাপল গাছেই ঠাসা। পাতা ঝরে পড়ছে দুলে দুলে। কালো পিচের রাস্তার উপর অসংখ্য রঙিন পাতা শুয়ে আছে। কানে আসছে পাখির কিচিরমিচির শব্দ।
গাড়ি থামলো এসে বনের এক প্রান্তে। বনের মাটি ঢেকে দিয়েছে পাতার আস্তরণ। পায়ের নিচে শুধু পাতা আর পাতা। রিশন নিজের ক্যামেরা নিয়ে সর্বদা প্রস্তুত। ইরতিজা, জুহি বনের ওদিকটায় গিয়ে নানা রকম ফটো তুলছে। রিশন ভিডিয়ো করতে করতে যথারীতি বকবক করে চলেছে। ক্যানিয়ল সব মিলিয়ে খুব বিরক্ত হয়ে বসে রইল গাড়ির উপরে। সে যে একটা মানুষ এদের সঙ্গে এসেছে তা কেউ পাত্তাতেই ধরছে না। একটু-আধটু অপমান বোধ হচ্ছে ক্যানিয়লের।
রিশনের ভিডিয়ো করা শেষ হলে সে ক্যানিয়লের কাছে এলো। ক্যানিয়লের সামনে মোবাইল ধরে বললো,
“এটা আমার ইউটিউব চ্যানেল, অবশ্যই সাবস্ক্রাইব করবে। আর ভিডিয়ো গুলোও অবশ্যই দেখবে এবং লাইক করবে। সাথে কমেন্টও দেখতে চাই। ঠিক আছে?
আরও দুটো চ্যানেল আছে। ওগুলোও চিনিয়ে দেবো তোমায়। ওই চ্যানেল গুলোর ভিডিয়ো গুলোও দেখবে। ও কে?”
বিরক্তিতে মুখ বিকৃত হলো ক্যানিয়লের। বললো,
“আমার উচিত ছিল সাথে করে একটা হকি স্টিক নিয়ে আসা। তোমাকে দেখলেই মনে হয় তোমার মাথায় একেকটা করে হকি স্টিক ভাঙি। এই মুহূর্তে হকি স্টিক ভাঙার ইচ্ছাটা আরও বেশি হচ্ছে।”
“তোমার এত বড়ো সাহস? তুমি আমার কাজিনের উডবি হাসব্যান্ড সেটা ভুলে যাবে না। আমার সাথে এমন ব্যবহার করলে কিছুতেই আমি আমার কাজিনের বিয়ে তোমার সাথে হতে দেবো না।”
ক্যানিয়ল ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে রিশনের কথাকে তুচ্ছজ্ঞান করলো। তারপর বললো,
“তুমি তো দুবাইই গিয়ে ছ্যাঁকা-ট্যাকা খেয়ে এসেছো, কেঁদে কেটে ভাসিয়ে দিচ্ছিলে রেডমন্ড শহর। তাহলে এখনও কীভাবে তুমি তোমার ইউটিউব চ্যানেলের যত্ন নিচ্ছ? তোমার তো উচিত সব ইউটিউব চ্যানেল ভ্যানিশ করে দিয়ে দেবদাস হয়ে যাওয়া।”
“তোমার মতো গর্দভ হলে তো সেটাই করতাম। কিন্তু আমার মতো বুদ্ধিমানরা এটা করার কথা চিন্তাও করবে না। জানো এই ইউটিউব চ্যানেল দিয়ে আমি মাসে কত ডলার আয় করি? প্রচুর। প্রচুর আয় করি আমি। আমি তো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, জুহি এবং টিজা, দুজনকে দুটো ইউটিউব চ্যানেল খুলে দেবো। পারলে নওরিনকে দিয়েও একটা ইউটিউব চ্যানেল চালাবো। আর আমার মনে হয় তোমারও একটা ইউটিউব চ্যানেল খোলা উচিত। বেশি না শুধু প্রথম এক বছর একটু কঠোর পরিশ্রম করে দেখো। দেখবে তুমি এক বছরেই লাখপতি হয়ে গেছো। তারপর আস্তে আস্তে দেখবে ফ্যান ফলোয়ারের সাথে সাথে ডলারের পরিমাণটাও তরতর করে বেড়েই চলবে। এক সময় তুমি লাখপতি থেকে কোটিপতিও হয়ে যাবে।”
“আমি এখনই কোটিপতি ইডিয়ট, এক বছর অপেক্ষা করে লাখপতি হওয়ার কোনো আগ্রহ ইচ্ছা আমার নেই। আর তুমি গর্দভ কাকে বলছো? তোমার সাহস দেখে শিহরিত আমি। মানে তোমার কাজিনকে বিয়ে করবো বলে আমার সাথে যা নয় তাই ব্যবহার করতে পারবে ভেবেছো? ফারদার আমার সাথে এমন ব্যবহার করলে হাত, পা, মাথা, ঘাড়, পাঁজর সব ভে’ঙে দেবো।”
রিশন এমন হুমকিতে যদিও কিছুটা ভয় পেয়েছে, তবুও তা ধরা দিলো না। বললো,
“বড়োলোক বলে আগেই অহংকারে মাটিতে পা পড়তো না তোমার। আর এখন তো বিনা পরিশ্রমে বাবার বিশাল একটা কোম্পানি পেয়ে গেছো। এখন তুমি আকাশে উড়বে সেটাই স্বাভাবিক। তবে আমি টিজাকে একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলে দেবোই। ও ওর সুবিধা মতো, পছন্দ মতো ভিডিয়ো বানাবে। আমাদের ফ্যামিলির প্রত্যেকে সফল ইউটিউবার বয়-গার্ল হিসাবে খ্যাতি অর্জন করবে।”
রিশন কেমন অহংকার ভঙ্গিতে হেঁটে চলে গেল। ক্যানিয়লের খুব ইচ্ছা হচ্ছিল পিছন থেকে একটা লা’থি মেরে ফেলে দেয়, কিন্তু অযথাই ঝামেলা বাঁধবে বলে চুপ রইল।
ইরতিজার সবে খেয়াল হলো ক্যানিয়ল তাদের সাথে বনের ভিতরে আসেনি। রাস্তায় গাড়ির উপর উঠে বসে আছে। ইরতিজা ক্যানিয়লের কাছে এসে বললো,
“তুমি রোবটের মতো কেন বসে রয়েছো এখানে? বন ঘুরে দেখবে না?”
“এখানে বসে রয়েছি সেই তো বেশি। তোমাদের তিন পঙ্গপালকে রেখে গাড়ি নিয়ে চলে যাচ্ছি না এটাই তো পরম সৌভাগ্য তোমাদের।”
ইরতিজা বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“প…পঙ্গপাল?”
ক্যানিয়ল আর ও বিষয়ে কোনো কথা বললো না। বললো,
“চলো, পালিয়ে যাওয়া যাক।”
“মানে?”
“মানে হচ্ছে দুই পঙ্গপালকে রেখে আমি এক পঙ্গপালকে নিয়ে পালিয়ে যাব।”
“আমি বুঝতে পারছি না তোমার কথা।”
ক্যানিয়ল নামলো গাড়ি থেকে। ইরতিজাকে গাড়ির ভিতরে ঢুকিয়ে বসালো। তারপর নিজেও গাড়িতে উঠে বসে ভোঁ করে চলে গেল গাড়ি নিয়ে।
গাড়ি যাওয়ার শব্দ হতে জুহি, রিশন দুজনই তাকালো। জুহির মুখ ফসকে বিস্ময় ধ্বনি বেরিয়ে এলো,
“এটা কী হলো?”
পাহাড়ি রাস্তার এক জায়গায় এসে ক্যানিয়ল গাড়ি থামালো আবার। বেশি দূর আসেনি। এখানেও রাস্তার দুই পাশে ম্যাপল গাছ দাঁড়িয়ে আছে মাথায় রঙিন পত্র নিয়ে। ইরতিজা নামতে নামতে বললো,
“এটা কী করলে তুমি? ওদেরকে এমনভাবে ওখানে ফেলে রেখে আসা কি উচিত হয়েছে?”
“এমন তো না যে ওদেরকে পুরো দিন ওখানে ফেলে রাখবো। কিছুক্ষণ পরই আবার ওদের কাছে যাব।”
“আসার কী দরকার ছিল এখানে?”
“কোনো দরকারই ছিল না। তবুও বিনা দরকারে আমি সব করতে পারি।”
“আজব মানুষ তুমি!”
ক্যানিয়ল হাসলো।
এতক্ষণ শান্ত ছিল পরিবেশ। বাতাস হতেই ঝরে পড়তে লাগলো ম্যাপল পাতা। ইরতিজার চোখ ক্যানিয়লের থেকে সরে গিয়ে প্রকৃতিতে গিয়ে আটকালো। দৌড়ে ম্যাপল বনে ঢুকলো সে। উড়ে পড়া পাতাগুলো হাত ছুঁইয়ে দেখলো।
ইরতিজা উড়ে পড়া একটা পাতাকে মুঠো বন্দি করতে চাইলো। যে সময় পাতাটা মুঠো বন্দি হওয়ার পথে ছিল ঠিক তখনই সেই পাতাটা ইরতিজার হাতে পড়ার আগে ক্যানিয়ল ধরে ফেললো। ইরতিজা চকিতে তাকালো ক্যানিয়লের দিকে। ক্যানিয়ল বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
“বাচ্চাদের মতো উল্লাস করা বন্ধ করো।”
ইরতিজার মন ক্ষুণ্ন হলো। বললো,
“তুমি এমন কেন?”
“কেমন?”
“ভীষণ বেরসিক মানুষ!”
“উহুঁ, আমি তা নই।”
“তাহলে কী তুমি? সন্ত্রাসী?”
ক্যানিয়ল হেসে বললো,
“তেমনই কিছু।”
ইরতিজা আর কিছু বললো না, গম্ভীর হয়ে গেল। ক্যানিয়ল ইরতিজাকে এমন লক্ষ করে ডাকলো,
“পাকিস্টানি গার্ল!”
“আমি পাকিস্তানি গার্ল নই এটা কতবার বলতে হবে তোমাকে? আমি বাংলাদেশি। আমি বেঙ্গলি গার্ল। আর ডাকবে না আমাকে পাকিস্তানি গার্ল বলে।”
“অবশ্যই ডাকবো। বাংলাডেশি না হয়ে যদি ব্রিটেনেরও হও তবুও আমি তোমাকে পাকিস্টানি গার্ল বলে ডাকবো। কারণ এটা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।”
“বাংলাদেশ নিয়ে গিয়ে তোমাকে গরম ভাতের সাথে কাঁচা মরিচের ভর্তা খাওয়ালেই তোমার অভ্যাস পরিবর্তন হবে।”
ক্যানিয়ল বুঝতে পারলো না ইরতিজার কথা। মেয়েটা এই মাত্র বাংলা বলেছে তো সেজন্য। তবে সে ইরতিজার চেহারা দেখে বুঝতে পারলো তাকে উদ্দেশ্য করে ভালো কিছু বলা হয়নি। সে বললো,
“আর কখনও আমার সামনে বাংলা উচ্চারণ করো না, আমিও তাহলে বাংলা শিখতে বাধ্য হবো।”
“দেখো, দু-চারটা দাঁত যেন পড়ে না যায়।”
বলে খিলখিল করে হাসতে লাগলো।
পাতা ঝরে পড়া থেমেছে। ইরতিজা একটা নিচু ডাল থেকে একটা লাল রঙের পাতা পাড়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু তার যেটুকু উচ্চতা তাতে ডালের নাগাল পেল না। অগত্যা ক্যানিয়লকে বললো,
“আমাকে সহযোগিতা করো।”
“কেন আমি তোমার জন্য পাতা পাড়তে যাব? নিজে করে নাও।”
ক্যানিয়ল রাস্তার দিকে মুখ করলো। ধূসর থেকে কালো হয়ে গেল ইরতিজার মুখ। ক্যানিয়লের অবহেলায় কষ্ট পেয়েছে সে। যাক চলে, লাগবে না ক্যানিয়লকে। ইরতিজা পায়ের পাতায় ভর করে আরেকটু উঁচু হয়ে হাত বাড়িয়ে পাতাটা ছেড়ার চেষ্টা করতে লাগলো। পাতা ছিঁড়ে ক্যানিয়লকে দেখিয়ে দিতে হবে। ইরতিজা যখন চেষ্টা করেও পাতার নাগাল পাচ্ছিল না সে সময় কেউ একজন তাকে উঁচু করে উপরে তুলে ধরলো। বিস্ময়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল ইরতিজা। তাকিয়ে দেখতে পেল ক্যানিয়ল তাকে উঁচুতে তুলে ধরেছে।
ক্যানিয়ল শুধালো,
“পাতা ছিঁড়বে না? ফেলে দেবো?”
বিস্ময় জড়িত ইরতিজা বলতে পারলো না কিছু। শুধু তাকিয়ে রইল। এইমাত্রই ক্যানিয়ল তাকে সাহায্য না করে চলে যাচ্ছিল। আবার ফিরে এমন করলো। ক্যানিয়ল ইরতিজাকে এমনভাবে নির্বাক চেয়ে থাকতে দেখে বললো,
“ফেলেই দিই।”
ক্যানিয়ল সত্যিই ছেড়ে দিলো ইরতিজাকে। ইরতিজা পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মাটিতে পড়ার আগেই ক্যানিয়ল ওর এক হাত ধরে নিজের দিকে টেনে বললো,
“পড়বেই যখন, এভাবে পড়ো পাকিস্টানি গার্ল।”
ম্যাপল পাতার উপর দুজন মানুষের পতনের জন্য কেমন এক শব্দের সৃষ্টি হলো। ইরতিজা আতঙ্কে খিঁচে ধরেছিল দুই চোখ। তার মনে হয়েছিল সে মাটিতে পড়ে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পাবে। কিন্তু সে কোনো রকম ব্যথা অনুভব করলো না। পিটপিট করে চোখ খুললো। একটা প্রশস্ত বুকে মাথা রেখে আছে সে। একটু মুখ তুলে ক্যানিয়লের দিকে তাকালো। ক্যানিয়ল নিশ্চিন্ত চিত্তে নিজের মাথার নিচে ডানহাত রেখে বড়ো করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমার বুকে মাথা রাখা অনেক শান্তির তাই না?”
ইরতিজা হতবিহ্বল হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ক্যানিয়লের দিকে। এরপর তড়িঘড়ি করে উঠে যেতে চাইলো ক্যানিয়লের উপর থেকে। কিন্তু উঠে যেতে চাইলেই ক্যানিয়ল ইরতিজার মাথা নিজের বুকে চেপে ধরলো। থমকে গেল ইরতিজা।
ক্যানিয়ল বললো,
“আরও কিছুক্ষণ থাকো এরকম।”
এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড এরকম করে সময় পার হতে লাগলো। ইরতিজার বক্ষস্থল ঢিপঢিপ করছে। বিব্রত বোধ খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে তার ভিতরকে। তার সাথে সাথে লজ্জা মিশ্রিত এক নিঝুম প্রগাঢ় অনুভূতি ছেয়ে ফেললো তার হৃদয়।
ক্যানিয়ল বললো,
“কেমন হতো পাকিস্টানি গার্ল, যদি এই নির্জন ম্যাপল বনে একটা ট্রি হাউজ তৈরি করা হতো? শরৎ এলেই ম্যাপল বন রঙিন হয়ে উঠতো, ঠিক আমাদের অনুভূতি যেমন সবসময় রঙিন এবং সতেজ। অলিন্দ থাকতো, আমরা দুজন অলিন্দে দাঁড়িয়ে উড়ো পাতার ঢেউ দেখতাম। সাথে বৃষ্টি হলেও মন্দ হতো না। বৃষ্টিতে ভিজতাম। তোমার মুগ্ধতাও আমাকে খুব করে ভিজিয়ে দিয়ে যেতো। আমি কিছু ভেজা ভায়োবিন দিতাম তোমায়। আর কানে কানে বলতাম, ‘ভায়োলেট কুইন, আমার জীবনে আসার জন্য ধন্যবাদ তোমাকে। এই যে তুমি আমার জীবনে আছো, আমি ধন্য। সারাজীবন যে আমার সাথে থাকার সংকল্প করেছো, আমি কৃতজ্ঞ। তুমি আমার ভালো থাকার অন্যতম কারণ।’ ”
ইরতিজার হৃদয় এক পশলা ভালোবাসার বৃষ্টিতে ভিজে গেল। কোমল হৃদয় আরও কোমল হয়ে উঠলো তার। চোখের কোণ বেয়ে সংগোপনে আনন্দ অশ্রু ঝরে পড়লো। ক্যানিয়ল যে তাকে ভীষণ ভালোবাসে এটা সে অনুভব করতে পারে। কীভাবে যেন টের পায় এই ভালোবাসার গভীরত্ব। এই গভীরত্ব ঠিক কতখানি? না, এই গভীরত্ব কোনো কিছু দ্বারা পরিমাপ করা যাবে না। এটা অপরিসীম। এর কোনো পরিমাপ হয় না।
(সমাপ্ত)
______________
কেউ হয়তো ভাবেননি আজকের পর্বেই গল্পটা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু গল্পটা টুপ করে আজ নিজের সমাপ্তি টেনে নিলো। আমি এখন রিল্যাক্স অনুভব করছি। ব্যস্ততা মাথায় নিয়ে গল্প লেখা খুব কষ্টকর।
ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। যারা এতদিন গল্পটার সাথে ছিলেন তাদের প্রতি আমার ভালোবাসা রইল❤️
প্রথমাংশের লিংক– https://www.facebook.com/104288734976575/posts/388702489868530/?app=fbl
গ্রুপ লিংক―
https://facebook.com/groups/3087162301558677/