ব্রোকেন হার্ট পর্ব-১

0
3393

#ব্রোকেন_হার্ট
লেখাঃ মান্নাত মিম

|১|
আমাদের নতুন বাড়িতে উঠেছি আজ। গাড়ি থেকে জিনিসপত্র সব নামিয়ে বাড়িতে নেওয়া হচ্ছে। ডুপ্লেক্স বাড়িটা আমি পছন্দ করেছি। আমার বাবা নেই। আমি আমার মাম্মা আর ছোটো ভাই থাকব বাড়িটাতে। আমার রুম ওপরে। অতটা উচ্চতাও নয় বাড়িটা। নিচ থেকে অনায়াসে আমার রুমে আসা যায় জানালা টপকে, গ্রিল বিহীন জানালা বলে। অবশ্য সেটা ছেলেদের ক্ষেত্রে। কারণ মেয়েদের নরমাল উচ্চতায় জানালা দিয়ে রুমে যাওয়া সম্ভব না। আমার রুমের একটা জিনিসের জন্য কষ্ট হচ্ছে, সেটা হলো বারান্দা। নিস্তব্ধতার আঁধারে ঢাকা রাতে এক হাতে কফি নিয়ে রাতের শহরটা দেখতে আমার খুবই ভালো লাগে। আপাতত শখটা পূরণ হলো না কারণ বারান্দা নেই রুমটাতে। যাইহোক গ্রিল বিহীন জানালা যা আছে তাতে মন খারাপের সময়ে কিছুটা হলেও কাজে দেবে। আমার রুমের জানালা বরাবর নিচে বেশকিছু জায়গা নিয়ে খালি আঙিনা। সেখানে কাপড়চোপড় শুকানোর জন্য কাল দড়ির ব্যবস্থা করতে হবে। এরইমধ্যে ছোটো ভাই টমাস ফুটবল নিয়ে সেখানে খেলা শুরু করে দিয়েছে। জানালা দিয়ে বাইরে মাথা গলিয়ে চিৎকার করে বললাম,

“টমাস, কী করছ? মাম্মাকে কাজে হেল্প করো।”

“আমি পারব না। তোমরা করো গিয়ে।”

এই ছেলেটা এমনই। আমার সম্পূর্ণ বিপরীত, একরোখা, জেদি, ঘাড়ত্যাড়া টাইপ। তবুও মাম্মা কিংবা আমি তাকে কিছু বলি না। বলা যায় একপ্রকার প্রশ্রয় দেই কারণ বাবা নেই যে, তাকে আদর দেবে, বকবে, শাসনে রাখবে। সেই দিকগুলো ভেবে তাকে শাসন করাটা আর হয়ে ওঠে না আমাদের কারোরই। নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আবারো নিচে গিয়ে মালপত্র নিয়ে ঘর সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

রাতে সারা শরীর কাঁপিয়ে ব্যথাসহ জ্বরের আগমন ঘটল৷ সারাদিনের অতি খাটুনির ফল এটা বুঝে গিয়েছিলাম। আপাতত ওষুধের বাক্স কোথায় রেখেছি, সেই খোঁজে ক্লান্তি আর বাড়াতে চাই না। তাই ঘুমটাকে প্রাধান্য দিলাম। নতুন ভোরে নতুন জীবনের শুভকামনা কালই করি নাহয়।

“গুড নাইট মাই ডিয়ার পাস্ট।”

______

মায়ামি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের সবচেয়ে বড় শহর। এটি আটলান্টিক সাগরের তীরে অবস্থিত। বর্তমানে সেখানে ভালো এবং আমার যাতায়াতের সুবিধা মতো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি, অবশ্য সেটা অনলাইনের মাধ্যমে। আপাতত এখনো সেখানে যাওয়া হয়নি। তবে এবার সশরীরে যেতে হবে, কেননা ডাক পড়েছে বাকি থাকা প্রয়োজনীয় কাজগুলো শেষ করার জন্য। বাড়ির আঙিনায় রাখা আমার সাইকেলে চড়ে রওনা হলাম। ভার্সিটিতে প্রথমদিন অনুযায়ী মানুষের যেই সাজগোজের বিষয় থাকে আমার মধ্যে সেটা দেখা যাচ্ছে না। সোনালি রঙের কাঁধ সমান এলোমেলো চুলে কোনমতে ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়েছি। সকালের নাস্তা করা হয়নি৷ কারণ গতকালই বাড়িতে ওঠা, গোছগাছ করা। এতসবে ব্রেকফাস্ট তৈরি ঝামেলাপূর্ণ। রাতে অনলাইনে হালকা-পাতলা ডিনার সেরেছিলাম।

ভার্সিটির প্রাঙ্গণে সাইকেল রেখে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে অফিসকক্ষ যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। তখন খেয়াল হলো, আমি তো অফিসকক্ষ কোথায় সেটাই তো জানি না। কারো থেকে এবিষয়ে জেনে নেওয়া প্রয়োজন। ভার্সিটিতে ঢুকতে নেওয়ার সিঁড়ি বেয়ে ওঠে ভেতরে যেতে লাগলাম। এক এক করে বিভিন্ন শ্রেণির স্টুডেন্ট দেখতে পেলাম, গ্রাউন্ডফ্লোরে, সকলেই পরিপাটি হয়ে চলাফেরা, কথাবার্তা করছে। আমি-ই কেবল অগোছালো, সাজসজ্জা বিহীন। এমন সময় বাস্কেট বল খেলার জোনে চলে গেলাম। তবে পাশে করিডোর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার রাস্তা আছে। সেখান থেকেই ছেলেদের বাস্কেট বল প্র্যাকটিস করার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। এমন সময় চোখ পড়ল একজনের ওপর। সুঠাম দেহাবয়বের ছোটো-ছোটো করে কাটা চুল, চোখগুলোও ছোটো-ছোটো। ‘ডার্ক হ্যান্ডসাম টল গাই’ যাকে বলে। মাত্রই বাস্কেটে বল ফেলল। তাকে দেখতে দেখতে কখন যেন পিলারের সাথে ধাক্কা খেয়ে উপুড় হয়ে নিচে পড়ে গেলাম খেয়াল হলো না। স্মরণ হলো ব্যথা পেয়ে। আমার ধাম করে পড়ে যাওয়ার শব্দে সম্ভবত এগিয়ে এলো সেই ছেলেটা। যাকে দেখতে গিয়ে কি না আমার এই অবস্থা। এগিয়ে এসে সে আমাকে ধরে তুলল। তার পিছনেও আরো কয়েকজন।

“ইট’স অকে, অকে রিল্যাক্স। ডোন্ট গেইট হাইপার।”

আমি নিজেকেই নিজে স্বান্তনা দিচ্ছি। আমার এহেন কাণ্ডে অবাক ছেলেটা সাথে তার দল-বল। এমন সময় জিহ্বায় চিটচিটে ভাব পেলাম। আঙুল দিয়ে দেখলাম রক্ত। সামনের সবকিছু অন্ধকার দেখে মুহুর্তেই জ্ঞান হারালাম। ব্লাডফোবিয়া বলে কথা। উপরন্তু জ্বর।
_______

“হেই লিটল গার্ল ওয়েক আপ।”

ঘুমে বিভোর আমার গালে কে যেন চাপড় মারছে। মনে মনে বিরক্ত হলাম, যার কারণে মুখ কুঁচকে এলো আমার। আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলাম কোন এক বেঞ্চিতে শুয়ে আছি অচেনা ছেলের উরুতে মাথা রেখে। সময় লাগল বিষয়টা বুঝতে। সেই ছেলেটাই তো এটা। যাকে দেখে আঘাতে বক্রঘাতে কাত হয়ে পড়ে গেছি। এখন সেই পড়াটা পা পিছলে প্রেমে পড়াও হতে পারে, পারে না, না কি? আমার তো মন উত্তর দেয় ইতিবাচক।

“হেই লিটল গার্ল। কেমন ফিল করছ?”

ওঠে বসতে নিয়ে মাথা চক্কর দিতে শুরু করল। ছেলেটা বুঝতে পেরে ধরে বসালো তার পাশেই। চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম উৎসুক মুখ তাকিয়ে দুজন মেয়ে-ছেলে। সম্ভবত ছেলেটর ফ্রেন্ড হবে। সেদিকে খেয়াল দিলাম না অতোটা। আমার সম্পূর্ণ খেয়াল যে পাশে বসা সদ্যজাত প্রেমিক পুরুষের দিকে। তবে কথা হলো, প্রেমিক পুরুষ আমার একতরফা থেকেই দেওয়া, সে তো অজ্ঞাত আমার সম্পর্কে।

“ব..ব্যাটার।”

বলতে বলতেও ঠোঁট কেঁপে উঠল। দেখলাম ঠোঁটের চিকিৎসা দেওয়া। নিচের ঠোঁটের মাঝে সম্ভবত দাঁত লেগে কেটে গেছে। কপাল-ও ফোলে-টোলে ঢোল অবস্থা। ভার্সিটির প্রথম দিন-ই এমনটা হতে হলো! কষ্টে-দুঃখে কাঁদো কাঁদো মুখ হয়ে গেল আমার। তবে পরক্ষণেই সকল প্রকার কষ্ট বাষ্পীভূত হলো পাশে থাকা ছেলেটার কথায়।

“হেই আমার নাম এন্ডারসন পিয়োরে।”

“ওহ্! আমি ইমোজিন, সবাই ইমি বলে ডাকে।”

এন্ডারসন নাম শুনে আকাশে-পাতালে ওড়তে শুরু করলাম মনে হয়। সাধারণ একটা নামও আমার কাছে কেন জানি ভালো লাগছে। হৃদয়ে আনন্দের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। যদিও বিষয়টা অহেতুকী, তবুও প্রিয় মানুষটার প্রতিটি জিনিসই প্রেমিকাদের কাছে মহামূল্যবান। এদিকে আমি নিশ্চিতরূপে তার প্রেমিকা নই। তবে হতে কতক্ষণ, কতকাল?
_______

আজকের দিনটা আমার যে এত সুখকর দিন বলে সাব্যস্ত হবে ভাবিনি কখনো। মনকাননে ফুলেল সমাহার মলয়ে দোল খাচ্ছে। আমি-ও হেলে-দুলে চলছি। না, না ভেতরে ভেতরেই। সামনে শান্তশিষ্ট, সময়-শৃঙ্খলা মেনে চলা মেয়ের মতো চুপ করে বসে আছি এন্ডারসনের বলা লিটল গার্ল হয়ে। কারণও আছে, আমার মাথা গিয়ে ঠেকে তার বুক সমানে, তাই এ নামে ডাকে। যখন শুনেছে তার বয়স ও ক্লাসের দিক দিয়ে আমি ছোটো তো আরো ডাকে এই নামে। কথা হলো, ভার্সিটির ক্যান্টিনে এসেছি। এসেছি বলতে নিয়ে আসা হয়েছে। সেটা করেছে এন্ডারসন নিজেই। ছেলেটার এত মহৎগুণ আমাকে আরো দুর্বল করে দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। ভার্সিটির ভর্তি কাজে হেল্প তো করেছেই, সকাল থেকে না খাওয়া জেনে নিয়ে এসেছে ক্যান্টিনে খাওয়াতে। ইস! এতো ভালো হতে কে বলেছে তাকে? এই যে মুহূর্তেই আমি যে তার এতসব গুণের সাগরে ডুবে মরছি। সে খেয়াল আছে তার? হয়েছে তো যতসব জ্বালা আমার। নিজের অনুভূতি চাপিয়ে যে রাখা বড্ড দায়। যখন-তখন তাকে দেখতে মন চাইবে। সঙ্গ পেতে মন চাইবে। তখন কী হবে আমার?

“ইমি, কোথায় হারিয়ে গেলে?”

মুখের সামনে হাত নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করছিল এন্ডারসন। যার ভাবনাতে এতোই মজে ছিলাম, সে যে সামনেই সেই খেয়ালও মাথা থেকে ব্যানিশ।

“না, না এই তো আছি। বলুন?”

“প্রথম আমাকে ‘তুমি’ সম্মোধন করলে ভালো লাগত। অবশ্য সিনিয়র আছি এখানে দেখে যে ‘আপনি’ করে বলছ, বুঝতে পেরেছি। তবে বেশিদিনের জন্য নয়। এটাই লাস্ট ইয়ার।”

কথাটা না শুনলেই বোধহয় ভালো হতো। মনের মধ্যে থাকা ফুলের বাগানে দমকা সমীরণে সব মূহুর্তেই লন্ডভন্ড হয়ে গেলো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here