ব্রোকেন হার্ট পর্ব-১৯ শেষ পর্ব

0
2784

#ব্রোকেন_হার্ট
লেখা : মান্নাত মিম

|১৯|
“লেখা শেষ হয়েছে?”

“এই তো শেষাংশে আছি।”

“এন্ডিং কি পরিবর্তন করতে চাও?”

“নাহ, কেন?”

“না মানে স্যাড এন্ডিং দিয়ে পাঠকদের ইমোশন করতে পারো। নামটার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করো। কী সুন্দর নাম ব্রোকেন হার্ট! নামটাই তো বলে দিচ্ছে এন্ডিং স্যাড।”

“উহুম, এমনটা করব না। আমাদের এন্ডিংয়ের মতোই হবে। হ্যাপি, হ্যাপি।”

এন্ডারসনের কথার পরিপ্রেক্ষিতে বললাম।

“সত্যি মম? হ্যাপি এন্ডিং দিবে?”

“ইয়েস মাই সন।”

ছেলের নাক টিপ দিয়ে ফের মনোযোগী হলাম কাহিনির ফিনিসিং দিতে।
_____

সেদিন কেঁদে কেঁদে নিজ বাসগৃহে পৌঁছানোর পরেও মাম্মাম আসেননি। সারাদিনে তাঁর দেখা পেলাম না। এলেন তাও আবার সন্ধ্যার বেশখানিক পরে। সাথে একটা মেয়ে যাকে এন্ডারসনের মেজো ভাইয়ের সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থাতে দেখেছিলাম। তাকে মাম্মামের সাথে বেয়ারা পোশাকেও দেখেছিলাম। মনে মনে তাচ্ছিল্য হাসলাম। মেজো ছেলে কাজের লোকের সাথে লুকিয়ে-চুরিয়ে প্রেম করে। তা চোখে পড়ে না, সমস্যা না। আমার স্ট্যাটাসে আঙুল ঠিকই উঠায়। ভেতরে ভেতরে তীব্র ঘৃণা জন্মায় আমার এন্ডারসনের পরিবারের প্রতি।

“বেশ ভারি মিষ্টি দেখতে তুমি!”

তীব্র রাগে গা রি রি করছে যেখানে, সেখানে মেয়েটার মধু মিশ্রিত কথাও আমার ন্যাকামি লাগছে। বিরক্তে মুখ কুঁচকে আসছে। অপরদিকে ভয়ে ভয়ে ভেতর নাড়া দিচ্ছে বারবার। মাম্মামের এমন নির্জীব, নিরুত্তাপ উদাসীনতা আমাকে ভাবাচ্ছে বেশ। ঠিক যেমন ঝড়ের পূর্বাভাস। মাম্মাম ওপর তলা থেকে নিচে আসলেন ফ্রেশ হয়ে। এসে আমার পাশে বসা মেয়েটার উদ্দেশ্যে বললেন,

“মার্গারিতা , তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো। ওপর তলায় ইমির রুমে চলে যাও।”

থেমে ফের আমাকে বললেন,

“যাও তুমি গিয়ে দেখিয়ে দিয়ে এসো।”

ওপরে গিয়ে আমার রুম দেখিয়ে ফের নিচে এসে দেখলাম, মাম্মাম সোফায় বসে আছেন এখনো। পিছনে ফিরে আমাকে ইশারায় ডেকে তাঁর পাশে বসতে বললেন। আমি এগিয়ে গেলাম সেখানে ফাঁকা রাখা জায়গায় বসলাম। কিছুক্ষণ থম ধরে চুপ করে রইলেন। বোধহয় কথা গুছিয়ে নিচ্ছেন।

“তুমি আমাকে কখনো আপন ভেবেছ?”

কথাটা শুনে মাম্মামকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলাম। তিনি এমনটা কীভাবে ভাবতে পারলেন? জন্মের পর থেকেই মাম্মামের সান্নিধ্যে খুব কম ছিলাম। ড্যাডের সাহচার্যে ছিলাম বেশি বিধায় মাম্মামের সাথে সখ্যতাপূর্ণ রূপ না হয়ে উলটো ভীতি ও দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে। যার জন্য ড্যাড মারা যাবার পর সেই দূরত্ব আরো বৃদ্ধি পেয়েছে, যখন দু’জনেই কাজের সন্ধানে সংসার চালানোর কার্যে নেমে পড়েছিলাম। তাই বলে আমি কখনোই তাঁকে নিয়ে এমনটা ভাবিনি। যতই ভয় পাই কিংব দূরত্ব থাকুক না কেন, আমাদের আপন বলতে দুনিয়াতে কেবল মাম্মাম-ই তো।

“এমন করে কেন বলছ, মাম্মাম?”

আমাকে আগলে ধরলেনও না আবার জোরে ছাড়িয়েও নিলেন না। এক অনুভূতি শূন্যতা অনুভব করালেন যেন। কষ্ট ছাপিয়ে তীক্ষ্ণতা নিয়ে বললেন,

“বলার কারণ কী তুমি জানো না? নিজের না মনে করলে এভাবে এন্ডারসনের কথা গোপন করতে না? আমার নিজেরই তো খারাপ লাগছে এই ভেবে, তোমাদের সাথে সাধারণ বন্ধুপূর্ণ সম্পর্ক পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। যার ফলস্বরূপ…”

কথাগুলো পুরোপুরিভাবে সমাপ্ত করলেন না। তবুও আমার হৃদয় নাড়িয়ে দিচ্ছে তাঁর প্রতিটি শব্দবাক্য, তীব্রতার সহিত ধিক্কার দিচ্ছে তাঁকে কিছু জানালাম না। উপরন্তু তিনি অনেক আগে সাবধানও করেছিলেন, কোনো সম্পর্কে না জড়াতে। অথচ আমি কী করলাম! না জানি তাঁকে কতখানি অপমান, অপদস্ত হতে হয়েছে এন্ডারসনের বাড়িতে। তা সত্ত্বেও তিনি কী সুন্দরভাবে কথা বলছেন আমার সাথে! রাগ করার কথা যেখানে! সবই আমার জন্য। সেটা ভেবেই আমার অনুশোচনা বোধে মরে যেতে মন চাইছে। মাম্মামকে ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালাম। গন্তব্য আমার রুমের দিকে।

“ইমোজিন! দ্রুত ওঠো।”

কাল সারারাত আমার জীবনের জঘন্যতম রাত ছিল। একে তো কান্নায়, দুঃখ-কষ্ট জর্জরিত ছিলাম উপরন্তু জ্বালাতে মার্গারিতা আমার রুমেই অবস্থান করেছিল। আর সারাটাক্ষন কানের কাছে বকবক করে তার প্রেম কাহিনির গুনগান ছুঁড়ছিল। তার পরিচয় মাম্মামের সাথে কাজের সুত্রে। আর আজ আমাদের বাড়িতে আসার কারণ আমাকে দেখতে চাওয়া। এন্ডারসনের বাড়িতে দেখেছে ঘটনা তাও না কি আমার কাছে জানতে চায় প্রেম কীভাবে হলো এন্ডারসনের সাথে৷ ত্যক্ত-বিরক্ত আমি শুধু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুঁড়েছিলাম। তারপর থেকেই সে নিজের প্রেম কাহিনি জানায় আমাকে। একসময় তার বকবকানির কাছে পরাস্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।

“ইমিই, কতক্ষণ ধরে ডাকছি ওঠো।”

এবার প্রচণ্ড ধাক্কার জোরে ঘুম ছুটে পালালো চোখ থেকে আমার। ওঠেই স্থিরতা নিয়ে বললাম,

“কী হয়েছে? কী হয়েছে? মাম্মাম ঠিকাছে?”

“আমি তোমার সামনেই দাঁড়িয়ে। দ্রুত তৈরি হয়ে নাও।”

মানে এমন গভীর ঘুম থেকে তুলে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে দ্রুত তৈরি হতে, আজব! পাশে তাকিয়ে মার্গারিতাকে পেলাম না। মাম্মামকে এবিষয়ে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনবোধও করলাম না। এখন কারো প্রতি ভালো মন-মানসিকতা আমার মধ্যে নেই। হয়তো লোপ পাওয়া ধরেছে। সেটাই ভালো এবং উচিতও।

হসপিটালে পা রাখা মাত্রই মুখ কুঁচকে এলো। সবাই তো সুস্থসবল আছি। হসপিটালে তাহলে কে? টমাস বাড়িতে নেই। স্কুল থেকে কদিনের ট্যুরে গিয়েছে। তার আবার কিছু হলো না কি? বুকটা ধক করে উঠল। তবে মাম্মামের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, টমাসের কিছু হলে মাম্মাম তো এভানে স্বাভাবিক থাকত না। কেমন যেন পাজেলের মতো লাগছে সবকিছু! সারারাস্তা ভর তো কোন কথাও বললেন না তিনি। নিচের সিঁড়ি দিয়ে দ্বিতীয় তলাতে ওঠে করিডোর পেরিয়ে একদম শেষের মাথাতে অবস্থান করা রুমের দরজাতে কড়া নাড়লেন মাম্মাম। এদিকে আমি উদ্বিগ্ন ও উৎসুখ হয়ে উন্মুখ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে অধীর আগ্রহে। দরজার ওপাশে কে হতে পারে?

“এন্ডারসন!”

হসপিটালের কেবিনের সফেদ বেডটাতে এন্ডারসনের জ্ঞানহীন শায়িত মলিন মুখ দেখে হৃদয় অভ্যন্তর পর্যন্ত কেঁপে উঠছিল। পাশে মাম্মাম দেখে খুব করে চোখের জল আটকে রাখার প্রচেষ্টারত হয়ে লাভ হচ্ছি না। শেষে হাউমাউ শব্দে কেঁদে ফেলি। পরে নিজের কাছেই বিষয়টা লজ্জার ও বিশ্রী লাগে। বিশ্রী লাগার কারণও রয়েছে, অনুভূতি এই অনুভূতিটাই আমার জন্য হয়েছে যত জ্বালা। তাকে ভুলে থাকতে দিবে না। এদিকে আমার কান্নার শব্দে এন্ডারসন জেগে গিয়েছে। কাছে ডাকলে, মাম্মাম উঠে বাইরে চলে যান আমাদের স্পেস দিয়ে। আমি এগিয়ে গিয়ে তার পাশে বসলেই সে বলা শুরু করে,

“তুমি চলে আসার পর, গতকাল রাতে বাড়িতে ভাঙচুর করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি, গন্তব্য তোমাদের বাড়ি। তবে রাস্তায় অ্যাকসিডেন্ট হয়। যার জন্য আজ এখানে। তবে এত ক্ষয়-ক্ষতির মাঝে একটা ভালো হয়েছে। শুনবে? ড্যাড তোমার সাথে আমার বিয়েতে রাজি হয়েছেন। আজ সকালে আমাকে সেটা জানিয়ে, তোমাদের বাড়িতে ফোন দিয়েছেন। আর তোমরা এখানে আমাকে দেখতে এসেছ।”

একসাথে এতগুলো কথা বলে হাঁপিয়ে উঠেছে এন্ডারসন। খুশিতে আত্মহারা হয়ে হাসব না কি তার ব্যথিত মুখ ও ভাঙা হাত-পা দেখে দুঃখপ্রকাশের মাধ্য হিসেবে কান্না করব বুঝে উঠতে পারছি না। এই প্রথম দু-ধরনের অনুভূতিতে কেমন যেন অনুভূতি শূন্য অসাড় লাগছে নিজেকে।

তারপর আরকী আমাদের গ্র্যান্ড পার্টির মাধ্যমে বিয়ের আয়োজন হয়। ভেরোনিকা ও ক্রিশ্চান সেই পার্টিতে আমন্ত্রিত হয়েছিল। আমার প্রতি ক্রিশ্চানের যে ভালোবাসা তখনো বিদ্যমান ছিল তাকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম। তবুও বন্ধুত্ব বজায় রাখতে দু’জনই ফরমালিটি মেইনটেইন করে চলি। মাম্মামকে কাজের থেকে নিষ্পত্তি দেওয়া হয়েছে। তবে আমার চাকরি হয়েছে, এন্ডাসনের অফিসে। সেই বেতন পুরোটা মাম্মামের কাছে পাঠাই।
_______

“পাঠিয়েছ?”

“হুম, এডিটিং করেই মেইল পাঠিয়ে দিয়েছি।”

“আচ্ছা, চলো ডিনার করবে।”

ডাইনিং টেবিলে বসে সকলে খাওয়াদাওয়া করছি। এন্ডারসনের ড্যাড-মাম্মা, দু-ভাই সাথে তাদের সপত্নীকসহ উপস্থিত। এন্ডারসন আমার পাশে বসেই। ড্যাড-মাম্মা দু’জনই খাওয়া শেষে উঠে চলে গেলেন। কথা হলো, তাঁরা আমাকে মেনে নিলেও এখানে যে যার জীবন লিড করে। একে-অন্যের জীবনে হস্তক্ষেপ করে না। কথাবার্তা হয় খুবই সামান্য। তবে, এখানে সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক আমার এন্ডারসনের মেজো ভাই ও তার ওয়াইফ মার্গারিতার সাথে। হুম, একবার এন্ডারসন নিজ পছন্দানুযায়ী বিয়ে করাতে তার ড্যাডের ভালোবাসা বিদ্বেষের দেয়াল ভঙ্গ হয়, ফলে মেজো ভাই-ও সাহস করে মার্গারিতাকে বিয়ে করে ফেলে।

সুইমিংপুলের সামনে বসে আছি। এন্ডারসন ও পাঁচ বছর বয়সী আমাদের ছেলে এট্রিক পানিতে সাঁতরে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে থেমে একে-অপরের গায়ে পানিও ছিটাচ্ছে। এমন সময় মার্গারিতা তার মেয়ে চার বছরের পামিলাকে নিয়ে এলো। তাকে দেখে তুরতুরিয়ে এট্রিক পানি থেকে উঠে পড়ল। তাদের আবার গলাতে গলাতে সেই ভাব। মার্গারিতা বা আমাদের কিছু না বলেই পামিলার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেল। এদিকে আমরা তিনজন হা করে দেখেই গেলাম। অবশ্য নতুন না দৃশ্য কিংবা পামিলার ওপর অনাধিকার চর্চা করা এট্রিকের আচরণ। তবুও এত অল্প বয়সের বাচ্চাদের এমন ব্যবহারে আমাদের অবাক ও হতাশ করে। হতাশের কারণ এট্রিকের ভবিষ্যৎ প্রেমিকার সন্ধান এখনই সে নিজ দায়িত্বে ও পছন্দনুযায়ী নিয়ে নিয়েছে। হঠাৎ করে ঠান্ডা স্পর্শে সুইমিংপুলের পানিতে পড়ে গেলাম। এতক্ষণ যাবৎ বাচ্চাদের যাবার পথে তাকিয়ে কথাগুলো ভাবছিলাম বলে, সুযোগে আমাকে পানিতে টেনে নিলো এন্ডারসন। সাথে নিয়ে কয়েক ডুবও দিলো। আকস্মিকতায় কয়েক দফা পানি নাকে-মুখে ঢুকেও গেল। ওপরে উঠতেই দম নিলাম শ্বাস ভরে। মার্গারিতা নেই চলে গেছে বাচ্চাদের পিছন পিছন। অতঃপর রাগে দিশা হারিয়ে ক্ষিপ্র গতিতে এন্ডারসনের গলায় কামড় বসিয়ে দিলাম।

“উহহ! ইমোজিন, কী করছ? তুমি কি বাচ্চা না কি?”

“তাহলে তুমি কী করলে?”

“আমি তো একটু রোমাঞ্চকর রোমান্টিকতা করলাম।”

“আমি-ও রোমান্টিকতা শেষে লাভ-বাইট দিলাম।”

“তোমার সাথে কথায় পারা মুশকিল।”

“তোমার সাথে দুষ্টুমিতে।”

হি হি করে হেসে ফেললাম। এতে মহারাজ বেজায় নারাজ হলেন বোধহয়। তাই মুখবন্ধ করলেন অন্যপন্থায়, ফের তলিয়ে নিয়ে গেলেন ডুব সাঁতারে।

সমাপ্ত।

অ্যাটলাস্ট গল্প শেষে আপনাদের প্রতিক্রিয়া জানার অপেক্ষা রইলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here