একগুচ্ছ রক্তজবা পর্বঃ১২

একগুচ্ছ রক্তজবা পর্বঃ১২
#লেখিকাঃ সাদিয়া সিদ্দিক মিম

ছাঁদে দাঁড়িয়ে সাদাফ একের পর একে সিগারেট খেয়ে চলেছে।চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঘেরা,সাদাফের দৃষ্টি হাতে থাকা লাইটারের দিকে।একবার সেটা জ্বালাচ্ছে আবার নিভাচ্ছে,সাদাফের চোখে পানি স্পষ্ট।চোখের পলক ফেললেই তা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়বে।
বেশ অনেকক্ষণ পর সাদাফ হাতের সিগারেট ফেলে দেয়।আর পকেট থেকে ফোন বের করে টাইম দেখে নেয়।ঘড়িতে রাত ১২ টা ছুঁইছুঁই,সাদাফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিছন ফিরে পা বাড়ায় ঘরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।একটু সামনে এগোতেই সাদাফের সামনে সুজন পথ আগলে দাঁড়ায়।সাদাফ চোখ তুলে দেখে সুজন দাঁড়িয়ে,সাদাফ তাকানোর সাথে সাথেই সুজন বলে উঠে।

“এত রাতে এখানে কী করছিলি!”

“কিছু না।”

কথাটা বলে সাদাফ পাশ কেটে চলে আসতে নিলে সুজন বলে উঠে।

“তোর মধ্যে কী বিন্দুমাত্র অপরাধ বোধ কাজ করছে না!”

সাদাফ পকেটে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে ফেলে।সুজন এবার ফিরে সাদাফের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায় আর বলে উঠে।

“ভাইয়া তুই যখন বউমনিকে মেনে নিতে পারিস নি তখন যা করার সামনা সামনি করতি।তখন কী তকে একবারও কেউ জোড় করেছে বউমনিকে মেনে নেয়ার জন্য!করে নি কেউ জোড়,কারন আমরা সবাই জানি জোর করে আর যাই হোক ভালবাসা হয় না।কিন্তু আমরা সবাই জানতাম একদিন না একদিন তুই বউমনিকে ঠিক মেনে নিবি।কারন বউমনি তেমনই একজন মেয়ে যাকে ভাল না বেসে থাকাই যায় না।কথা বলতে না পারলেও বউমনি ভালো মনের একজন মানুষ।
আর একজন পারফেক্ট মানুষ হওয়ার জন্য ভালো মনের অধিকারী হওয়াটাই বড় বলে আমি মনে করি।
তাই কেউ তকে জোর করে নি বউমনিকে মেনে নেয়ার জন্য।
কিন্তু তুই আজ যা করলি তাতে করে সবাই বড্ড বেশি কষ্ট পেয়েছে রে ভাইয়া।তুই এমনটা না করলেও পারতি,তুই এমনি একবার বউমনিকে বলতি কাব্য ভাইয়াকে এসব না বলতে তবে বউমনি বলত না।আর আমি যতটুকু চিনি বউমনিকে উনি এমনিও কাউকে কিছু বলত না যে তুই বউমনির সাথে কেমন আচরন করেছিস।কিন্তু তুই বউমনির ইমোশন নিয়ে খেলায় নেমেছিলি আর দেখ তুই এতকিছু করেও কিছু করতে পারলি না।তোর রাগের কারনে তুই নিজের মান সম্মান হারানোর পথে,নিজের পরিবারের কাছে থেকেও বহু দূরে।আজ যা হয়েছে সব কিছুর জন্য তুই দায়ী,তোর জন্য বউমনি কষ্ট পেয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে।আর আমাদের দিকে আঙুল উঠেছে যে বিয়ের দুইদিন পর নতুন বউ তার বাবার বাড়িতে চলে গেছে কেন?নিশ্চয়ই শ্বশুর বাড়ির লোক ভালো না,তাই মেয়েটা টিকতে পারে নি চলে এসেছে।তোর জন্য আমাদের পরিবারের মানসম্মান নিয়ে টানাটানি করছে লোকে।বাবা অফিস থেকে এসে এখনও নিজের ঘরে বসে আছে।এক মিনিটের জন্য বের হয় নি,বাবার লজ্জার মাথা কাটা যাচ্ছে।কত শখ করে বউমনিকে ছেলের বউ করে নিয়ে মেয়ের আসনে বসিয়েছিল।আর তুই কী করলি ভাইয়া,শেষ করে দিলি সব।
ভালোই হয়েছে বউমনি চলে গেছে নয়ত তুই নিজের স্বার্থের জন্য আরো অনেক কিছুই করতে পারতি।কারন তুই হলি একটা নিকৃষ্ট মনের মানুষ,যে নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু বুঝে না।”

কথাগুলো সুজন এক নাগাড়ে বলে চোখের পানি মুছে নেয় আর বলে উঠে।

“শেষে একটা কথাই বলব এখনও সময় আছে ভাইয়া নিজের ভুল শুধরে নে।বউমনির কাছে ক্ষমা চেয়ে ফিরিয়ে আন এই বাড়িতে।নয়ত একদিন পস্তাবি তুই,আর সেই দিনের বেশি দেরি নয়।”

কথাটা বলেই সুজন স্থান ত্যাগ করে,আর সাদাফ হাঁটু গেড়ে ফ্লোরে বসে পড়ে।চুলগুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে টেনে ধরে,আর কান্না জড়িত কন্ঠে বলে উঠে।

“হ্যাঁ নিকৃষ্ট মনের মানুষ আমি,অপরাধী আমি,জানোয়ার আমি।সব সব সব আমি,তাই ত আজ নিজের পরিবারের কাছে এত কটু কথা শুনতে হচ্ছে।খুব কষ্ট হচ্ছে আমার এসব শুনতে,নিজের সাথে এমন না হলে হয়ত আমি কখনও বুঝতে পারতাম না যে সাবিহার সাথে আমি কত অন্যায় করেছি।সাবিহার সাথে করা প্রতিটা খারাপ আচরন আমার চোখের সামনে ভেষে উঠছে।কত কটু কথা বলে কষ্ট দিয়েছি সাবিহাকে।আমি এতটাই খারাপ মানুষ যে কী না একটা বোবা মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিব না বলে পশুর মত আচরন করেছি তার সাথে দিনের পর দিন।কিন্তু আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে সাবিহাও রক্তে মাংসে গড়া একজন মানুষ।তারও মন বলে কিছু আছে,তারও কষ্ট হয়,সেও কাঁদে।
আল্লাহ আমি খুব বড় ভুল করে ফেলেছি।বোবা বলে অনেক কটু কথা বলেছি সেই বিয়ের রাত থেকে মেয়েটার সাথে।নিজের স্বার্থের জন্য সাবিহার ইমোশন নিয়ে খেলেছি আমি।সবটা না জেনে না শুনে আজও আমি পশুর মত আচরন করেছি তার সাথে।তার গায়ে হাত তুলেছি অকারণে,তাকে মারার জন্য হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলাম।
আমি খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছি,এর জন্য ত আমাকে শাস্তি পেতেই হবে।হ্যাঁ আমাকে শাস্তি পেতে হবে,কী করব এখন!কীভাবে শাস্তি দিব নিজেকে?”

সাদাফ পাগলের মত এসব বলছে আর আশেপাশে কিছু খুজে চলেছে।একটু পর সাদাফের চোখ যায় ছাদে থাকা ক্যাকটাস গাছের দিকে।সাদাফ তেড়ে যায় সেদিকে আর গাছের মধ্যে নিজের হাত চেপে ধরে।শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে হাত চেপে ধরেছে,চোখ বন্ধ করে ঠোঁট কামড়ে আছে।সাদাফের রক্তে সবুজ রঙের গাছের অনেকটা জায়গা লাল হয়ে আছে।সাদাফের সেদিকে খেয়াল নেই সে তার মতই চেপে ধরে আছে।এভাবে অনেকক্ষণ পর সাদাফ জ্ঞান হারিয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে।

______________________________________

মায়ের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছি আমি,অঝোর দাঁড়ায় জল গড়িয়ে পড়ছে চোখ দিয়ে।মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের চোখের জল মুছে চলেছে।মায়ের কোলে মাথা রেখেই ভেবে চলেছি সন্ধ্যা বেলার কথা।যখন সুজন ভাইয়া আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসে।

🍁ফ্লাসব্যাক,,,

সুজন ভাইয়া আমাকে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলে দেখতে পাই ছোট চাচি,চাচাত ভাই নীরব ক্লাস থ্রিতে পড়ে,আর আমার বড় ভাই তুষার ড্রয়িং রুমে বসে ফোন টিপছে।আমাকে আসতে দেখে চাচি মুখ ভেংচি কেটে চলে যায় সেখান থেকে।আর নীরব সে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে আমাকে।আর ভাইয়া মাকে আর আব্বুকে ডাকতে থাকে।নীরব আমাকে জড়িয়ে ধরেই বলে উঠে,,,

“আপুমনি তুমি এসেছো,আমি খুব খুশি হয়েছি আপুমনি।”

আমি হাটুঁ গেড়ে নিরবের সামনে বসে কপালে চুমু একে নিরবের কাঁধে হাত দিয়ে সামনে এগিয়ে যাই।ভাইয়া আমার কাছে এগিয়ে এসে গালে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করে।

“আমার ছোট পরীটা কেমন আছে?”

আমি হাতের ইশারায় বলি।

“ভালো।”

ভাইয়ার চোখ যায় এবার আমার পিছনে দাঁড়ানো সুজন ভাইয়ার দিকে।ভাইয়া এবার সুজন ভাইয়ার কাছে গিয়ে উনাকে জড়িয়ে ধরে রসিকতা করে বলে উঠেন।

“আরে বিয়াই সাহেব যে,কেমন আছেন?”

সুজন ভাইয়া মলিন হেঁসে বলে উঠে।

“ভালো আছি।আপনি কেমন আছেন ভাইয়া!”

“আমিও ভালো আছি,তা সাদাফ কই!নিশ্চয়ই গাড়ি পার্ক করতে গেছে!তোমরা দাঁড়াও আমি ওকে নিয়ে আসছি।”

ভাইয়া কথাটা বলে যেতে নিলে সুজন ভাইয়া আটকে দেয় আর বলে উঠে।

“ভাইয়া আসে নি আমিই এসেছি বউমনির সাথে।”

তখন ভাইয়া কিছু বলবে তার আগেই মা আর আব্বু এসে পড়ে।মা এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে।আমারও চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে,আর আব্বু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠে।

“কেমন আছে আমার প্রিন্সেস?”

আমি মাকে ছেড়ে সোজা হয়ে বাবাকে ইশারায় বলি।

“ভালো।তুমি কেমন আছো!”

“আমার প্রিন্সেস কে ছাড়া আর কেমন থাকব?কিন্তু এখন তুই এসে গেছিস আমি এখন অনেক ভালো আছি।”

কথাটা বলেই আব্বু হেঁসে ফেলে,আমিও একটু মুচকি হাসি।সুজন ভাইয়া এবার একটু সামনে এগিয়ে এসে হাতের ব্যাগটা রেখে বলে।

“আমি আসি আজ,আর বউমনিকে একটু দেখে রাখবেন।”

সুজন ভাইয়ার এমন কথায় সবাই অবাক,ভাইয়া অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করে।

“দেখে রাখব মানে?কী হয়েছে সুজন?কোন সমস্যা?”

সুজন ভাইয়া কিছু বলতে নিলে আমি উনার সামনে এসে ভাইয়াকে হাতের ইশারায় বলি।

“কিছু না ভাইয়া,উনি এমনি বলেছেন।”

তখন সুজন ভাইয়া বলে উঠে,,,

“আমি আসি তবে।”

মা এগিয়ে এসে বলেন,,,

“এখনি চলে যাবে মানে কী!কোন যাওয়া যাওয়ি নাই আজ এখানে থাকবে।রাত হয়ে যাচ্ছে ত যাওয়া যাবে না,তুষার সুজনকে নিয়ে ঘরে যা।আর সাদাফ কোথায় সে আসে নি!”

“না আন্টি আমি আজ আসি,অন্য কোন দিন এসে থাকব।আর ভাইয়া আসে নি।”

“কেন সাদাফ কেন আসে নি!জানি সে ব্যাস্ত মানুষ তাই বলে কী শ্বশুর বাড়িতে আসবে না ছেলেটা!বিয়ের পর একদিনও এলো না ছেলেটা।আমার কী জামাইকে সামনে বসিয়ে খাওয়াতে ইচ্ছে করে না!একটাই ত মেয়ে জামাই আমাদের।সাবিহার আব্বু তুমি কালই যাবে ঐ বাড়িতে আর গিয়ে ধরে নিয়ে আসবে মেয়ের জামাইকে।”

কথাটা বলেই আম্মু হেঁসে ফেলে তখন সুজন ভাইয়া মাথা নিচু করে বলে উঠে।

“ভাইয়া আসবে না।”

“আসবে না মানে!কেন আসবে না?সাদাফ কী কোন কারনে রেগে আছে আমাদের উপর?”

“না ভাইয়া তেমন কিছু না।”

“তবে কেন আসবে না?”

ভাইয়ার কথায় সুজন ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বলে।

“আমাকে ক্ষমা করো বউমনি আমি তোমার কথা রাখতে পারলাম না।”

তারপর সুজন ভাইয়া একে একে সবটা বলে দেয়।সবটা বলার পর সুজন ভাইয়া চলে যেতে নিলে আবারও ফিরে এসে বলে।

“বউমনির মনের অবস্থা একদমই ভালো না,বউমনিকে দেখে রাখবেন প্লিজ।”

কথাটা বলেই সুজন ভাইয়া চোখে পানি নিয়ে চলে যায়।আর আমার মা,আব্বু,ভাইয়া যেন পাথর হয়ে আছে সবটা শুনে।

“ঐ সাদাফকে আমি ছাড়ব না,আমার বোনের সাথে এত বড় অন্যায় করার শাস্তি আমি ওকে দিবই দিব।খুন করে ফেলব ঐ নরপশুটাকে,যার গায়ে একটা ফুলের টোকা আমি দেই নি গত ১৮ বছরে।আর তাকে মেরে ফেলার জন্য ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো তুলে নিয়েছে,থাপ্পড় মেরেছে।ছাড়ব না আমি ওকে,জানে মেরে ফেলব।”

কথাগুলো বলে ভাইয়া বের হতে নিলে আব্বু পিছন থেকে ডেকে বলে উঠে।

“কোথাও যাবে না তুমি।”

“আব্বু তুমি আর একটা কথাও বলবে না,তোমার জন্য আজ এসব হয়েছে।বলেছিলাম এত বড় ঘরে বোনের বিয়ে দিও না,কিন্তু তুমি শোন নি।রাগ দেখিয়ে আমাকে চুপ করিয়ে বিয়ে দিয়েছিলে বোনকে,আর তার ফল এখন আমার ছোট বোনটাকে পেতে হচ্ছে।তুমি আজ আমাকে কোন বাঁধা দিবে না,আমি কোন বাঁধা মানব না আজ।শেষ করে ফেলব ওকে।”

“তুমি যদি এক পা বাইরে ফেলো তবে আমাকে আর আব্বু বলে ডাকবে না।”

ভাইয়া থেমে যায় আব্বুর কথায়,পাশে থাকা টি টেবিলে একটা লাথি মেরে সেটা ফেলে দিয়ে চলে যায় নিজের রুমে।আর আমি চোখের জল ফেলে চলেছি সেখানে দাঁড়িয়ে।জানতাম এমন কিছুই হবে তাই সুজন ভাইয়াকে মানা করেছি এখন এসব বলতে।আমি পরে সবটা বুঝিয়ে বললে হয়ত এখন এই পরিস্থিতিটা হত না।এখন আমার সাথে সাথে আমার পুরো পরিবার কষ্ট পাচ্ছে।
মা আমার কাঁধে হাত দিলে আমি তখন মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলি।আর মাও কেঁদে ফেলে।

🍁ফ্লাসব্যাক এন্ড

#চলবে,,,

(বিরাট বড় পর্ব দিছি আজকে ১৫০০+ শব্দ😪)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here