#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
লেখনীতে : আনিশা সাবিহা (ছদ্মবেশী)
পর্ব : ১৯
সকাল সকাল ফার্মহাউজ থেকে বাইরে ঠান্ডা শীতল বাতাস উপভোগ করছি আমি। বাতাসগুলো আমার সারা শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। তবে মন ছুঁইতে পারছে না কিছু তেই। নিজেকে এই ঠান্ডা বাতাসে হালকা করতে ইচ্ছে করছে বেশ। তবে পারছি না। কারণ মনটা ভার। ঠান্ডা বাতাস যে শুধু শরীর ছুঁইয়ে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে হালকা কেঁপে কেঁপে উঠছি আমি। জানুয়ারি মাস। ঠান্ডার প্রকোপ টা একটু বেশি। ফাঁকা জায়গা গুলোতে কচি কচি ঘাসের ডগায় শিশিরবিন্দু চিকচিক করছে। সেখানে মাঝে মাঝে পা দিয়ে হাঁটছি। খালি পায়ে বেশ ভালোই লাগছে। যদিও ডান পায়ের কাটা জায়গাটা পুরোপুরি ভাবে ঠিক হয়নি। তবুও ভালোই লাগছে। আজকের সকালটা একটু বেশিই কুয়াশা জড়ানো! পায়ের নূপুরধ্বনি আলতো সুরে বাজছে। কারো উপস্থিতি অনুভব করলাম। কারো গায়ের গন্ধ আমার সারা শরীরে ঝাঁকুনি দিয়ে তুলল। পিছন ঘুরে তাকানোর আগেই একটা কালো রঙের চাদরে মুড়িয়ে দিল কেউ। পিছন ফিরে তাকালাম। অনুরাগ কে দেখে খুব একটা অবাক হলাম না। কারণ আমি জানি উনিই এসেছেন।
উনি খানিকটা সরু গলায় বললেন….
–“এই ঠান্ডার সকালে উঠে খোলা জায়গায় ঘুরছ তাও কোনো রকম সোয়েটার বা চাদর না পড়ে? তার ওপর তো হাফ হাতার ব্লাউজ আর পাতলা শাড়ি। ঠান্ডা লাগবে তো! সেই খেয়াল তোমার আছে?”
আমি দায়সারাভাবে বললাম….
–“ঠান্ডা লাগলে কি হতে পারে? জ্বর আসবে? কাশি হবে? সর্দি হবে! এর থেকে বেশি ইনফ্লুয়েঞ্জা হতে পারে আর তার থেকে বে…..”
–“হুঁশশ! আর বলো না। চাদরটা জড়িয়ে নাও গায়ে।”
আমি কাঁধের দিকে তাকিয়ে চাদর জড়িয়ে নিলাম। তারপর আবারও সামনের দিকে ফিরে হাঁটতে থাকলাম আলতোভাবে। অনুরাগ এক প্রকার দৌড়ে এসে আমার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলেন। আস্তে আস্তে বাইরে চলে এলাম আমরা। নারায়ণগঞ্জের এই জায়গাটা বেশ শান্ত। ঢাকা বা তার আশেপাশের খুব কম জায়গা গুলোয় এমন শান্ত আর নিরিবিলি হয়ে থাকে। আশেপাশে সবুজ ও শ্যামলতার কমতি নেই। পিঁচ ঢালা রাস্তা তে হাঁটছি। মাঝামাঝি রাস্তা তেই হাঁটছি অবশ্য। কারণ এই সময় গাড়ি যানবাহন কমই থাকে। শুধু এই সময় নয় অন্য সময় গুলোতেও এই জায়গা গুলোতে গাড়ি কমই চলাচল করে।
আনমনে হাঁটছি। অনুরাগ এদিক ওদিক তাকিয়ে হাঁটছেন আমার পাশাপাশি। পকেটে তার হাত। কি যেন একটা ভেবে উনাকে বলে বসলাম…
–“একটা প্রশ্ন করি আপনাকে?”
উনি কোনোকিছু না ভেবেই বলে উঠলেন….
–“হ্যাঁ করো!”
–“অনামিকা কি ভাবে মারা গিয়েছিল?”
আমার এই আচমকা প্রশ্নে থেমে গেলেন উনি। উনার চোখে ভাসতে লাগল রাজ্যের কষ্ট।
–“ওইতো (গলায় খাঁকারি দিয়ে) এক্সিডেন্ট করে।”
উনার গলায় কথাগুলো আটকে যাচ্ছে। বুঝতে পারছি উনি দুর্বল হয়ে পড়ছেন। উনার কাছে গিয়ে আমার হাত দিয়ে উনার হাত আবদ্ধ করলাম। আমার দিকে দুর্বলভাবে তাকালেন উনি। অল্প হাসলেন। তারপর নিচের দিকে তাকালেন।
–“আপনাদের লাভ ম্যারেজ হয়েছিল না? আমাকে একটু গল্প শুনাবেন?”
বেশ বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালেন। যেন আমি কোনো অদ্ভুত কথা বলে ফেলেছি। আমার কাছে এই প্রশ্ন আশাই করেন নি যেন উনি। উনাকে কোনোরকম প্রশ্ন করতে না দিয়ে আমি বলে উঠলাম….
–“আসলে অনেক দিন থেকে আপনাদের লাভ স্টোরি শোনার আগ্রহ ছিল কিন্তু সময়ের অভাবে আপনাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি শোনাও হয়নি। আজকে শোনাবেন প্লিজ।”
আমার বায়নায় সামনের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ চলতে শুরু করলেন উনি। আমিও তার সঙ্গে চলছি। দুর্বল গলায় বলে উঠলেন….
–“গ্রীষ্মের দিন। বেশ গরম পরেছিল। তারওপর এক ঘেয়ামি ক্লাস, এক্সামস আর কোচিংয়ে প্রচন্ড এক ঘেয়ামি লাগত। আমি আর আমার বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম এই ঘেয়ামি দূর করতেই। এটা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছিল। এক বন্ধুর গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করল সবাই। গ্রামটা রাঙামাটির আশেপাশের এলাকায়। সব কিছু বাদ দিয়ে ট্রেন জার্নি করে পৌঁছালাম সেখানে। বন্ধুরা মিলে বেশ ইনজয় করলাম। তবে হঠাৎ এক মেয়েকে দেখে আমার জীবনটা একদিনেই পাল্টে গেল। আমি আর আমার বন্ধুরা সবাই মিলে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম বিকেল বেলা। দুর্ভাগ্য কিনা সৌভাগ্য বলবো জানি না তবে একটা বল এসে আমার মাথায় লেগেছিল বেশ জোরেশোরে। নিজের মাথায় হাত দিয়ে বেশ রেগে গিয়েছিলাম। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলের মালিক খুজতে লাগলাম। মিনিট দুয়েক পরেই আমার সামনে এসে কয়েকটা পুচকে ছেলে হাজির হল। তাদের ঠেলে ঠুলে এসে দাঁড়ালো একটা মেয়ে। চুল দুদিকে ঝুঁটি করা, লং স্কার্ট পরিহিত মেয়েটা। তাকে দেখে ব্যাথা জিনিসটা যেন এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম। মেহেটি অপরাধীর মত চেয়েছিল আমার দিকে। মেয়েটা আর কেউ নয় অনামিকায় ছিল। আমাকে চুপচাপ দেখে ধীরে ধীরে আমার হাত থেকে ছোঁ মেরে বলটা কেঁড়ে নিয়ে দৌড় দিল ও। মূহুর্তের মাঝেই আমি আর আমার বন্ধুরা অবাক হয়ে গেলাম। মেয়েটাকে প্রথমে শান্তশিষ্ট মনে হলেও ও যে দুষ্টুপরি সেটা তখনই বুঝেছিলাম। সে ছিল একদম তোমার মতই। দেখে শান্তশিষ্ট মনে হলেও মটেও শান্তশিষ্ট ছিল না।”
উনাকে কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে বেশ রাগি সুরে বললাম….
–“ওয়েট ওয়েট। আপনি কি বললেন? আমি দেখতো শান্তশিষ্ট কিন্তু মটেও তা নই? মানে টা কি হ্যাঁ? নিজের লাভ স্টোরির মাঝে আমাকে টানেন কেন?”
–“কারণ ওকে তো তোমার মাঝেই দেখতে পাই!”
উনার অদ্ভুত কথাতে আমি থতমত খেয়ে চেহারার রঙটা পাল্টে গেল। উনিও কথাটা বলার পর থতমত খেয়ে গেলেন। হালকা কেশে পেছনে হাত রেখে চলতে শুরু করলেন। আবারও বলে উঠলেন…
–“পরেরদিন ঠিক সেই সময় আমি এক অজানা টানে ঠিক ওইখানে যাই। ইচ্ছেটা ছিল বড়ই অদ্ভুত! মেয়েটাকে এক পলক দেখার ইচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে একটা বড় খোলামেলা মাঠ দেখে আশেপাশে মেয়েটাকে খুঁজতে থাকলাম। চোখটা যেন দ্বিতীয়বারের মতো জুড়ালো। মেয়েটা ব্যাটিং করছে। ৪ রান করে বেশ জোরেশোরে লাফিয়ে উঠল মেয়েটা। লাফাতে লাফাতে আমার দিকে নজর আসতেই ও লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে পড়ল। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে অন্য একটা মেয়েটাকে কি জানি একটা বলে আমার দিকে এগিয়ে এলো ওরা। দ্বিতীয় মেয়েটা আর কেউ নয়। সুনয়না ছিল। অনামিকা এগিয়ে এসে মিনমিনে কন্ঠে বলেছিল,, ‘আপনার লাগেনি তো? সরি আসলে কালকে ভয়ের চোটে তাড়াতাড়ি চলে এসেছি।’ আমি তার কথার কোনো জবাবই দিতে পারিনি। শুধু শুনেছি তার মিষ্টি মধুর সুর। দিনে দিনে অজানা টানে সেখানেই ছুটে যেতাম। আস্তে আস্তে দুজনে যেন বন্ধুতে পরিণত হলাম। হাসি ঠাট্টা এভাবে চলছিল আমাদের দুজনের সম্পর্ক। ৫ দিন পর আমাদের ঢাকা যাওয়ার ডেট এসে গেল। সেদিন ওর চোখে দেখেছিলাম অন্যরকম কষ্ট। ফোন নম্বর টা ওকে দিয়ে এসেছিলাম। এরপর থেকে মাঝে মাঝেই ওর সাথে কথা হত। আস্তে আস্তে দুজনের মনেই ভালোবাসা নামক এই মূল্যবান অনুভূতি জন্ম নিল। ঠিক করলাম কথাটা জানানো প্রয়োজন। ভ্যালেন্টাইনস ডে তে একা একা চলে গেলাম। তাকে নিজের মনের অনুভূতি জানান দিতে। তবে জানতে পারলাম ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। তখন আমার পড়াশোনা প্রায় শেষ। সবে সবে বাবার কোম্পানির হাল ধরেছিলাম। পায়ের জমিনটা বেশ শক্ত না হলেও হয়েছিল কিছুটা নড়বড়ে। মানতে পারিনি ওর বিয়ে হবে। ও সেদিন আমায় জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল। সিদ্ধান্ত নিলাম ওর বাড়িতে প্রস্তাব দেব। যেই ভাবা সেই কাজ। তবে ওর বাড়িতে কেউ মানল না। সেদিনই আমি ওকে নিয়ে কাজি অফিসে এসেছিলাম লুকিয়ে। অতঃপর বিয়ে। তবে ওর বাড়ি থেকে আমাদের কেউ মেনে নেয়নি। মেনে নেয়নি বললে ভুল হবে। সবাই মেনেছিল শুধু অনামিকার বাবা ছাড়া। তাই ওই বাড়িতে আসাযাওয়া বন্ধ ছিল আমাদের। কয়েক মাস পর উনিও মেনে নিলেন। কাটল প্রায় ২ বছর। অনামিকা বাচ্চা নিবে বাচ্চা নিবে বলে প্রচন্ড জেদ করছিল। তবে বাচ্চা না হওয়ায় প্রচন্ড কষ্টের মাঝে থাকত। ডক্টর বলল কোনো সমস্যা নেই। ৬ মাসের মাথায় জানতে পারলাম আমি বাবা হতে চলেছি। সেদিন অনামিকার খুশির সীমা ছিল না। প্রথম থেকেই নিজে নিজেকে বেশ যত্নে রাখত। আমিও ওকে সবসময় সময় দেওয়ার চেষ্টা করতাম। ১০ মাস পার হয়ে যায়। অনামিকার তখন হাঁটতে চলতে খানিকটা কষ্ট হত। ঠিক সময়ে পৃথিবীর আলো দেখল অদ্রিজা। ছোট্ট একটা পরিবার হয়ে গিয়েছিলাম।”
কথাটাগুলো শেষ হতেই দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন উনি। উনার নিস্তব্ধতায় আমার বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। উনি কষ্ট পাচ্ছেন। উনার কষ্টগুলো যে এতদিন ধরে মনের মাঝে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিলেন। আজ উনার কষ্টগুলো ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করছে। ভারাক্রান্ত গলায় বলে উঠলাম….
–“তারপর?”
উনি নিজের মুখমন্ডল হাত দিয়ে বুলালেন। দুর্বল গলায় বললেন….
–“অদ্রিজার তখন ১ মাস বয়স। অনামিকার প্রথম বড় অপারেশন হয়েছিল তাই রেগুলার চেক আপ করাতে নিয়ে যেতাম নিয়ম করে। সেদিনও ঠিক তেমনই দিন ছিল। অদ্রিজাকে রেখে গিয়েছিলাম মায়ের কাছে। ছোট বাচ্চা তাই ওকে নিয়ে বাইরে চলাফেরা না করাটাই ভালো। তাই মা ওকে নিয়ে যেতে বারণ করেছিল। অনামিকার চেকআপ করিয়ে ফিরছিলাম। সন্ধ্যে পেরিয়েছে তখন। আমি আর অনামিকা বেশ হাসিখুশি ছিলাম। টুকটাক কথাতে দুজনেই মগ্ন। গাড়ি ড্রাইভিং আর কথা দুটোই চলছিল। তবে ড্রাইভিংয়ে একটু অন্য মস্তিষ্ক হয়ে গিয়েছিলাম। আর মেইন রোডে বড় বড় ট্রাক ড্রাইভার রা তো রাতে অনেকেই ড্রিংকস ড্রাইভ করে। এমনই কোনো ড্রাইভার হঠাৎ করেই আমার গাড়ির সামনে আসে। সেটা সবার আগে খেয়াল করে অনামিকা। বড় বড় চোখ করে কি করবে ভেবে না পেয়ে আমাকে নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে ধাক্কা দেয় সে। গাড়ি থেকে ছিটকে পড়ে যায় আমি রাস্তার এক পাশে। তবে অনামিকা আর গাড়ি থেকে বের হতে পারেনি। সামনাসামনি ট্রাকটা আর গাড়ি এক্সিডেন্ট করে। আমার চোখের সামনে আগুন জ্বলে উঠে গাড়িতে। হাত পায়ে লাগায় বেশ সেদিকে পারছিলাম না আমি। সবাই আমাকে ঘিরে রেখেছিল। কোনোমতে উঠে দৌড়ে গাড়ির দিকে যেতে লাগলাম। লোকজনেরা আমাকে ধরে রাখল জানো তো? আমাকে না ওরা আর আমার অনামিকার কাছে যেতে দিল না। আমি আমার সামনে ওকে হারিয়ে বসলাম। সারাজীবনের মতো হারিয়ে বসলাম।”
শেষ কথাগুলো বলতে বলতে বড় বড় নিশ্বাস ছাড়ছিলেন অনুরাগ। কথা শেষ হতেই আমার কাঁধে শক্তভাবে হাত রাখলেন উনি। এতবড় একটা কষ্টদায়ক সত্যিটা মানতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে আমার। নিজের গায়ে থাকা চাদর খামচে ধরে চোখ বন্ধ করলাম। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল পিঁচ ঢালা রাস্তায়। বুঝতে পারিনি পাহাড়ের কষ্ট বুকে চেপে সারাটা দিন হেসেখেলে পার করতেন অনুরাগ। ভালোবাসা হারিয়ে কতটা পরিমাণে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছেন সেটা আজ উনার প্রত্যেকটা কথায় প্রমাণ পাচ্ছি। অনুরাগ আলতো ভাবে আমার কাঁধ জড়িয়ে ধরলেন। দমবন্ধ করা কন্ঠে বললেন….
–“চলো ফার্মহাউজে ফেরার সময় হয়েছে।”
আমি চোখ খুলে সম্মতি জানাতেই উনি ডান হাতের বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে আমার চোখে লেগে থাকা পানি মুছে দিয়ে মলিন হাসলেন।
আমার বিস্ময় যেন সপ্তম আকাশে উঠল। এতোটা কষ্ট নিয়ে এই লোকটা হাসছেন? কি করে পারছেন? হাউ? আমি উনার গাল ছুঁলাম। উনি ফার্মহাউজের দিকে হাঁটতে লাগলেন আমাকে ধরে। আমার পক্ষে আর কিছু বলা সম্ভব হলো না। বলতে চাই না আমি কিছু। মিথ্যে শান্তনায় শান্ত করতে না উনাকে।
দুপুর দুটো বাজতে চলেছে। দুপুরের খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। বর্ণদাকে ডাকতে পাঠিয়েছেন মা। আমিও বাধ্য মেয়ের মতো বর্ণদাকে ডাকতে তার রুমের দিকে ছুটছি। তার রুমে বরাবরের মতোই কড়া না নাড়িয়ে না বলে কয়ে ঢুকে পড়লাম। এটা আমার অভ্যেস।
বর্ণদা জানালার সোজাসুজি দাঁড়িয়ে হাতজোড়া বুকে রেখে এক ধ্যানে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি চুপি চুপি হাঁটতে হাঁটতেই বর্ণদা কিভাবে যেন বুঝে গেল আমার আগমন হয়েছে। আমার দিকে না ঘুরেই বলে উঠল…
–“নুড়ি এসেছিস?”
আমি মুখ ফুলিয়ে নাক ঘষে তার সামনে গিয়ে বললাম…
–“বর্ণদা এটা কি ঠিক? আমি তোমাকে চমকে দিতে চাইছিলাম আর তুমি আগেই বুঝে গেলে?”
বর্ণদা আমার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট প্রসারিত করে নিঃশব্দে হাসলো। আমি চোখ ছোট ছোট করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম….
–“আচ্ছা, জানালার সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক বলো তো? সারাক্ষণই তো জানালার আশেপাশে ঘুরঘুর করো।”
–“আছে হয়ত কোনো সম্পর্ক। হয়ত কেন বলছি সত্যিই আছে এক গভীর সম্পর্ক। জানালা আর আকাশের সাথে।” (ভাবুক হয়ে)
আমি তার হাত ধরে টেনে বললাম….
–“এখন তাদের সাথে ব্রেকআপ করে খেতে এসো। তাড়াতাড়ি খেয়ে বিকেলের মধ্যে ঢাকার উদ্দেশ্যে বের হবে সবাই। বাড়ি থেকে গাড়িও চলে এসেছে।”
–“আমি আসছি তুই যা।”
একধ্যানে আকাশের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল বর্ণদা। আমি মাথা হেলিয়ে দুলিয়ে এলাম তার পাশ কাটিয়ে আসতেই আবারও তার দিকে ঘুরে বেশ উৎসাহ নিয়ে বললাম,,
–“বর্ণদা, কিছু জানার ছিল!”
সে আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল…
–“কি জানতে চাস?”
–“আমরা তো সেদিন শীতলক্ষ্যা নদীর পারে হাঁটতে গিয়েছিলাম। সেদিন সন্ধ্যার পর অনেক গুলো পিচ্চিকে দিয়ে প্রপোজ কি তুমি করেছিলে?”
বর্ণদা সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ ভাবুক হয়ে ভেবে ভ্রু উঁচিয়ে বলল….
–“আমি? তোকে কেন প্রপোজ করব? তুই না বিবাহিতা? তোকে প্রপোজ জেলে যাব নাকি?”
–“আরে তোমাকে কিন্তু বেশ সিরিয়াস প্রশ্ন করেছি। তুমি মজা করছো? অসহ্য ছেলে জানি কোথাকার!” (দাঁতে দাঁত চেপে)
বর্ণদা বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল…
–“আরে বাবা আমি তোকে প্রপোজ করিনি।”
–“তাহলে কে করল?” (বড় বড় চোখ করে)
বর্ণদা কোনোকিছু না ভেবেই বলল…
–“কে আবার অনুরাগ!”
প্রথমে তার কথা কানে না নিলেও কয়েক সেকেন্ড পর চমকে উঠলাম। কি বলছে এই ছেলে? অনুরাগ আমাকে এভাবে? মাথা ঝাঁকালাম। তার দিকে তাকাতেই তীব্র গলায় বলল…
–“তুই যা তো ঘর থেকে। এতো ভাবাভাবি না করে বাইরে গিয়ে ভাব। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
আমি এদিক-ওদিক তাকিয়ে ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে এলাম। অনুরাগই কি তবে আমাকে ভালোবাসা প্রকাশ করেছিলেন? না না তা কি করে হয়। ভাবনার শেষ হলো না। ভাবতে ভাবতে নিচে নামলাম আমি। ভাবনার অন্ত নেই। ভাবনার সমুদ্রে ভাসিয়ে দিচ্ছি নিজেকে।
বিকেল বেলা সবাই তাড়াহুড়ো করে রেডি হতে ব্যস্ত। এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করে নিজের লাগেজগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে সবাই। আমি অদ্রিজাকে রেডি করিয়ে দিচ্ছি। মেয়েটা তিড়িংবিড়িং করছে। ওর কপালে কাজলের টিপ দিতে যেতেই ও মাথা নাড়াতেই টিপ ঘেঁটে গেল। কাজল গালে মাখামাখি হয়ে গেল। আমি অসহায় ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে হু হা করে হেসে দিলাম। ওর গালে কালো দাগগুলো ওকে আরো মিষ্টি বানিয়েছে। আমার হাসি দেখে চোখ বড় বড় করে তাকালো অদ্রিজা। আমি আরো হাসতেই অনুরাগের কথায় হাসিটা বন্ধ হয়ে গেল।
–“বাহ। মেয়েকে ভূত বানিয়ে বেশ হাসছো। ওকে রেডি করিয়ে তাড়াতাড়ি নিজেও রেডি হয়ে নাও।”
শার্টের হাতা ঠিক করতে করতে কথাটা বললেন উনি। আমি ভেংচি কেটে অদ্রিজার গালের কালি মুছে দিলাম।
নিজেও রেডি হতে শুরু করলাম। মাথার বাঁধতে গিয়েও ছেড়ে দিলাম। কারণটা হলো এটা অনুরাগের পছন্দ! চুল ছেড়ে মাথা ঘুরাতেই অনুরাগের সাথে ধাক্কা লাগল। মাথা উঠিয়ে তাকালাম উনার দিকে। লোকটার মুখ ভার। ইচ্ছে করছে উনাকে স্পষ্ট জিজ্ঞেস করতে। উনিই সেদিন নিজের মতো করে ভালোবাসা প্রকাশ করেছিলেন কি না। জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে গেলাম আমি। মনে এক জড়তা কাজ করায় আর জিজ্ঞেস করলাম না।
গাড়িতে বসে আছি। আমার পাশে অনুরাগ। সামনে বর্ণদা গাড়ি ড্রাইভ করছেন। বর্ণদার মাথায় যে কি চলছে তা আমাদের ভাবনার বাইরে। সে জোর করে আমাকে অনুরাগের কাছে বসিয়ে রেখেছে। অথচ অনুরাগও জোর করেছিলেন আমাকে বর্ণদার পাশে বসতে। দুজনের জোড়াজুড়ি তে আমি ছিলাম নিরব দর্শক। আমার কোলে অদ্রিজা ঘুমোচ্ছে। অন্য বড় গাড়িতে আসছে পরিবারের বাকি সবাই। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। বর্ণদা না জানি কোন রাস্তা দিয়ে গাড়িটা নিয়ে যাচ্ছে। গা টা বেশ ছমছম করছে। অন্য কোনো যানবাহনের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি না। মাঝে মাঝে দু একটা গাড়ির যাতায়াত। রাস্তার দুই পাশে ঘন জঙ্গল! এক অজানা ভয় গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে। অনুরাগের পাশে আরো খানিকটা সেঁটে বসে বর্ণদার উদ্দেশ্যে বললাম….
–“বর্ণদা! এটা কোন রাস্তা বলো তো? এমন ভয়ানক রাস্তা দিয়ে না এলে চলছিল না?”
বর্ণদা গাড়ি মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভ করতে করতে ব্যস্ত গলায় বলল…
–“অনুরাগ ভাইকে বল নুড়ি। উনিই এই রাস্তা দিয়ে যেতে বলেছেন।”
আমি অনুরাগের দিকে তাকাতেই উনি গম্ভীর গলায় সামনের দিকে তাকিয়ে বললেন….
–“এইদিক দিয়ে শর্টকাট রাস্তা। তাড়াতাড়ি ঢাকায় যেতে পারব। আসলে অফিসে একটা মিটিং পড়েছে আমি থাকলে হচ্ছিল না। তাই এই রাস্তা দিয়ে যেতে বলেছি।”
আমি আর কিছু বললাম না। অদ্রিজাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকলাম। বার বার অন্যরকম বাজে অনুভূতি মনে মাঝে সঞ্চার ঘটছে। আশেপাশে তাকাচ্ছি বার বার।
মিনিট বিশেক পর হঠাৎ বর্ণদা জোরে গাড়ির ব্রেক কষলো। আমরা সবাই হুমড়ি খেলাম। অনুরাগ ঘুমে খানিকটা ঢুলছেন। তাই ঘুম ঘুম গলায় বললেন….
–“কি হলো বর্ণ? গাড়ি থামালে কেন?”
–“সামনে তো কেউ যেন ফাইজলামি করে রাস্তায় ইট দিয়ে রেখেছে। ওসব সরাতে হবে!”
অনুরাগ রাগান্বিত হয়ে বললেন….
–“হোয়াট? এসব রাস্তায় ইট রাখার সাহস কি করে কেউ পায় কে জানে! চলো নিচে নামি।”
বর্ণদা মাথা নাড়িয়ে নিচে নামতে লাগলেই আমি আতঙ্কিত গলায় বললাম….
–“কি দরকার এমন ভয়ানক রাস্তায় নিচে নামার? আমরা ব্যাক করি?”
বর্ণদা আমার দিকে তাকিয়ে ফিচেল গলায় বলল…
–“নুড়ি এতো ভয় পাচ্ছিস কেন বল তো? সামান্য রাস্তায় তো। কোনো ভূতের বাড়ি নয়।”
কথাটা বলে নিচে নেমে গেল সে। তার সাথে অনুরাগও নেমে গেলেন। আমি গাড়ির এক কোনায় কাঁচুমাচু হয়ে বসলাম। বুকটা ঢিপঢিপ করছে। ওদের দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে আছি। হুট করে গাছের আড়াল থেকে কয়েকটা লোক বেরিয়ে এলো। তাদের পোশাকআশাক অন্যরকম। ভাড়া করা গুন্ডাদের মতো বা ডাকাত। মুখটা ঢাকা। চোখজোড়া ভয়ে ভয়ে ওদের দিকে তাকালো। বর্ণদা আর অনুরাগ কে ওরা কয়েকজন মিলে ধরল। অনুরাগকে বেশ কয়েকটা চড় ঘুষি মারল। আমি চোখ খিঁচে বন্ধ করে অদ্রিজাকে ধরে রাখলাম। এসব কি হচ্ছে আমাদের সাথে? অদ্রিজা না থাকলে এতোক্ষণে গাড়ি থেকে নেমে কিছু একটা করতাম। কিন্তু অদ্রিজাকে নিয়ে আমি কোনো রিস্ক নিতে চাই না। একদমই না। তবে ওদের কি হবে?
একজন লোক গাড়ির দিকেই এগিয়ে আসছে। আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। বার বার একটা কথায় মনে হচ্ছে যদি আমার অদ্রিজার কিছু হয়ে যায়? এটা আমি আমার জীবন থাকতে হতে দিতে পারি না। দ্রুত গাড়ির দরজা লক করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু অসফল হলাম। গাড়িটা এক হেঁচকায় খুলে ফেলল লোকটা। আমার হাত ধরে টানতে টানতে বের করল। আমাকে ওদের কাছে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিল। আমি অদ্রিজাকে নিজের বুকের সাথে আগলে নিলাম। ওর কোনো আঘাত লাগতে দিলাম না। বর্ণদা চিৎকার দিয়ে বলে উঠল…
–“নুড়ি, পালা। অদ্রিজাকে নিয়ে পালা।”
আমি মাথা নাড়ালাম। ওদের বিপদে ছেড়ে স্বার্থপরের মতো কি করে পালাব আমি? অনুরাগও দুর্বল গলায় বললেন…
–“আমার অ….অদ্রিজাকে নিয়ে পালাও অনুশ্রী!”
আমি কোনোমতে উঠে দাঁড়ালাম। অনুরাগের ঠোঁট বেয়ে রক্ত পড়ছে। আমি কোনোমতে উঠে দাঁড়ালাম। সামনের দিকে দৌড়াতে লাগলেই দুটো লোক এসে বাঁধ সাধলো। পিছাতে থাকলাম আমি। দুই ধাপ পিছাতেই আমার কাঁধে কেউ হাত দিয়ে ঘুরিয়ে নিল। আঁতকে উঠলাম। এই গুন্ডা লোকের হাতে ধারাল ছুরি। লোকটা ভয়ানক হাসছে। আমার পেট বরাবর ছুড়ি ধরে চালিয়ে দিল। আমি চোখ বন্ধ করে চিৎকার দিয়ে উঠলাম।
চলবে…..🍀🍀
বি.দ্র. কালকে গল্পের লাস্ট পার্ট দেওয়া হবে। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।