একজন রূপকথা পর্ব-৪

0
2204

#একজন_রূপকথা
#পর্ব_৪
#নুশরাত_জেরিন

কথার ঘুম ভাঙলো খুব সকালে, ফজরেরও আগে। আলো ফোটেনি এখনও, চারিদিকে অন্ধকার। কাল সে ঘুমিয়েছিল শেষ রাতে, সেই হিসেবে আজ দেরিতে ঘুম ভাঙার কথা ছিল। অথচ ঘটলো তার উল্টো। কথার সাথে প্রায়ই এমন উলোটপালোট ঘটনা ঘটে। খুব সাধারণ ঘটনাও তার জন্য আলাদা। এই যেমন জেএসসি পরিক্ষার সময় সে প্লাস পেলো, খুশির খবর। অথচ ঠিক সেই দিনই তার জিবন থেকে মা নামক মহিলাটি বিদায় নিলেন। যদিও ইদানীং তিনি খোঁজ খবর নেবার চেষ্টা করছেন, কথা নিজেই এ বিষয়ে এগোচ্ছে না। কাল রাতে ছাঁদে পাশাপাশি বসে শোভনের সাথে অনেক গল্প করেছে সে, যদিও গল্প করেছে বলতে শুধু বসে বসে শুনেছে। শোভন নিজেই বকবক করেছে। সচারাচর কথা অতিরিক্ত বকবক করা মানুষ পছন্দ করে না, বিনা কারনে কথা বলাও তার পছন্দ না। অথচ কাল তার একটুও বিরক্ত লাগেনি। বরং মনের ভেতর একধরনের খুশি অনুভব করেছে।

শোভন পাশ ফিরে ঘুমোচ্ছে, এলোমেলো চুলে তাকে দেখতে বাচ্চা বাচ্চা লাগছে। কথা অপলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে বেলকনিতে গিয়ে দাড়ালো। রুমের সাথে লাগোয়া ছোট্ট বেলকনি। এখান থেকে নিচের রাস্তা স্পষ্ট দেখা যায়। কথা ফোন সাথে নিয়ে এসেছে। কবিতার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। মামি তার সাথে কেমন ব্যবহার করছে কে জানে! ভালো ব্যবহার আশাও করা যায় না। আগে তো বোনের কোলে মাথা রেখে কেঁদে মন হালকা করতো, আজ কী করছে? পিঠাপিঠি বোন হলেও কবিতা যে বড্ড ছেলেমানুষ।


সকালে রান্নাঘরে ঢুকে চা বানালো কথা। তার শাশুড়ী নামাজ পড়ে এখনও ঘরেই আছেন, এখনও বের হননি। শোভনও ঘুমোচ্ছে। এ বাড়িতে কোনো কাজের লোক নেই, মা ছেলের ছোট্ট সংসারে কাজ ই বা কী! রোজিনা বেগম নিজে হাতে কাজ সামলাতেন। এসব কথা শোভন কাল রাতে বলেছে। তাদের নিজেদের সম্পর্কে প্রায় সব কথাই সে নির্দ্বিধায় বলেছে, আপন মানুষ ছাড়া কাউকে নিজের ব্যক্তিগত কথা বলা যায়? কথা মনে মনে পুলকিত হলো, শোভন তাকে নিজের মানুষ ভাবে? এর আগে কবিতা ছাড়া কেউ এমন ভাবেনি বোধহয়। আরিফ তো কখনই ভাবেনি।
ভাবলে নিজের বন্ধুর কাছে বলতে পারতো না, কথার মত মেয়েকে সে বিয়ে করার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। কেমন নির্লিপ্ত, ঠান্ডা মেয়ে! কখনও হাতটা অব্দি ধরতে দেয় না। বিছানায় না জানি….
কথা চোখ বন্ধ করে জোড়ে নিশ্বাস নিলো৷ এসব কথা আর কখনও সে মনেও করবে না। ছেলেটার সাথে সে সংসার করার স্বপ্ন দেখেছিলো, আর সে কী করলো? এমন বিশ্রী ভাবে উপস্থাপন? অথচ তারপরও বিয়ের দিন কী ভালো অভিনয়টাই না করলো।

রোজিনা বেগমের দরজায় টোকা পড়লো।
তিনি বললেন,
“দরজা খোলা আছে।”

কথা সাবধানে ভেতরে ঢুকলো। তার হাতে চায়ের কাপ দেখে ততক্ষণে রোজিনা বেগমের কপাল কুঁচকে গেছে।
কথা বলল,
“আপনার চা এনেছি মা?”

রোজিনা বেগম ক্ষিপ্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। তার ছেলেকে হাত করার পর মেয়েটা রান্নাঘরও দখল নিতে চাইছে? এতদিনে যত্নে গড়া সংসার তার!

“আমি তোমার মা নই।”

শক্ত তেজদীপ্ত কন্ঠ শুনে কথা দমে গেলো। নতুন সংসারে সবার মন জয় করে সুখী হবার নতুন আশা নিয়ে আজ ঘুম থেকে উঠেছিলো সে৷ সে আশায়,সামান্য ভাটা পড়লো বোধহয়। তবুও দমলো না। বলল,
“কিন্তু আমি তো আপনারই মেয়ে মা!”

রোজিনা বেগমের চোখের তেজ ভাবটা কমে এলো। চা হাতে তুলে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে একবার কথার মুখপানে তাকালেন। আহামরি সুন্দরী না হলেও মায়া আছে চেহারায়। এই মায়া দিয়েই কী ছেলেটাকে বশ করেছে? আবারও মুখ শক্ত হয়ে এলো তার।
চায়ের কাপ শব্দ করে টেবিলে রাখলেন। কিছুটা চা ছিটকে আশেপাশে পড়লো।
বললেন,
“চায়ে এত বেশি চিনি কেনো দিয়েছো তুমি? সামান্য এই কাজটুকু পর্যন্ত শিখে আসোনি? সংসার করে খাবে কিকরে?”

কথার মন খারাপ হলেও সে মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখলো। সে জানে চায়ে চিনির পরিমাণ সঠিক আছে৷ শোভনের কাছ থেকে মায়ের পছন্দ অপছন্দ সব জেনেছে সে।

নরম গলায় বলল,
” শিখে আসিনি তো কী হয়েছে মা? আপনি নাহয় শিখিয়ে পড়িয়ে নেবেন।”

শোভন বিয়ে উপলক্ষে কোনো ছুটি পায়নি৷ নিকটাত্মীয় অসুস্থ বলে দুটো দিন ম্যানেজ করেছিল। সে দুটো দিন চোখের পলকেই পেরিয়ে গেলো। কথার সামনে থাকলে সময় যেন দৌড়ে পার হয়। মেয়েটাকে এত কাছে দেখেও তৃপ্তি মেটে না। বিকেলে অফিস সেরে বাসায় ফিরতেই কথা শরবত হাতে সামনে এলো।
বিয়ের পর থেকে সে শাড়ি পরতে শুরু করেছে, এতক্ষণ নিশ্চয়ই রান্নাঘরে ছিল। ঘেমে নেয়ে একাকার, তবুও কী মিষ্টি লাগছে।
কথা বলল,
“আজ ফিরতে এত দেরি হলো যে?”

শোভন সে কথার উত্তর না দিয়ে দুষ্টু হেসে বলল,
“তোমাকে একদম বউ বউ লাগছে কথা।”

কথা হেসে ফেললো। লোকটাও যে কী বলে! বউকে বউয়ের মত লাগবে না তো কিসের মত লাগবে? শোভন একটু মনোক্ষুণ্ণ হলো। সে ভেবেছিল কথা লজ্জা পাবে। তার লজ্জায় রাঙা মুখ এ’কদিনেও দেখার সৌভাগ্য হয়নি। শোভনের লজ্জাবতী মেয়ে পছন্দ। কথায় কথায় লজ্জায় যে নুইয়ে পড়বে, শোভন দুষ্টুমির ছলে লজ্জা কমাবার পরিবর্তে আরও বাড়িয়ে দেবে।

কথা বলল,
“বসে না থেকে যান তো ফ্রেশ হয়ে আসুন, এভাবে কতক্ষণ বসে থাকবেন?”

শোভন মন খারাপের ভাবটা এক নিমিষে উড়িয়ে দিলো। মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলল,
“তুমি যতক্ষণ বলো।”

কথা এবার হাসলো। তার সাথে তাল মিলিয়ে শোভনও হাসলো।

রাত বারোটা নাগাদ কবিতার ফোন এলো। এ বাড়িতে আসার পরের দিন কথা হয়েছিল তার সাথে। মন খারাপ থাকলেও স্বাভাবিক কথা হয়েছিল। মামিও জালায়নি। বিয়েতে খরচের জন্য শোভনের থেকে বেশ কিছু টাকা গছিয়েছিল সে। সেই নিয়ে খুশি আছে।
কথা হ্যালো বলতেই কবিতার কান্নার শব্দ ভেসে এলো। কথা ব্যতিব্যাস্ত হয়ে উঠলো,
“কাঁদছিস কেনো কবিতা? কী হয়েছে? মামি কিছু বলেছে?”

কবিতা কান্না থামানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। কাদতে কাদতে বলল,
“আমাদের মা কী অন্য পুরুষের হাত ধরে চলে গিয়েছিল আপা?”

“কে বলেছে এ কথা?”

“মামি বলল! মা নাকি আমাদের ফেলে চলে গিয়েছিল? সে বেঁচে আছে আপা?”

কথা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এসব সে কখনও কবিতাকে জানাতে চায়নি। মায়ের প্রতি যে শ্রদ্ধা সে মনে পুষে রেখেছিল সেটা এক নিমিষেই ভেঙে যাবার ভয়ে। কিন্তু শেষ পরিনতি কী হলো! শ্রদ্ধা দুমড়ে মুচড়ে ভাঙলো তো!
সে বলল,
“সে বেঁচে থাকুক বা না থাকুক এতে আমাদের কী এসে যায় বল? আমাদের পাশে তো নেই? আমাদের সুখে দুঃখে কখনই তো ছিল না। একপ্রকার মৃতই তো সে।”

কবিতা আবারও ফুপিয়ে উঠলো।
কথা কিছু বলতে পারলো না। চুপচাপ ফোন কানে ধরে রাখলো।

,

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here