একজন রূপকথা পর্ব-৭

0
1957

#একজন_রূপকথা
#পর্ব_৭
#নুশরাত_জেরিন

শোভনের চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, মুখটা গম্ভীর। সচারাচর সে চশমা পরে না, বই পড়ার সময় পরতে হয়। ছুটির দিনে সে বেশিরভাগ সময় ঘরে বসে বই পড়ে, রোমান্টিক উপন্যাস। অথচ মুখটা এমন গম্ভীর করে রাখে যেনো কোনো সিরিয়াস বই পড়ছে।
কথা পেছনে দাড়িয়ে নিঃশব্দে হাসলো। এদিক দিয়ে লোকটার সাথে তার মিল আছে। তার নিজেরও বই পড়াটা পছন্দের। তবে রোমান্টিক উপন্যাস না, গোয়েন্দা সিরিজ। স্কুল কলেজে থাকতে লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে রাত জেগে জেগে পড়তো। কাকাবাবু সিরিজ তার কী যে পছন্দের। তাছাড়া ছোটবেলায় বাবা দোকান থেকে ফেরার পথে রূপকথার গল্পের বই নিয়ে ফিরতো। কথার পাশে বসে পড়ে শোনাতো। রাজা, রানী, রাজকন্যা, রাক্ষসের গল্প। বলতো সাত সাগর তেরো নদী পার হয়ে কথার জন্যও রাজকুমার আসবে, সকল দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দেবে। ছোট মস্তিস্কে কথাটা গেথে ছিলো এতকাল, আজ বুঝি সে কথা সত্য হলো। কথার জীবনের সেই রাজকুমার বুঝি শোভন! কথার হাসি বিস্তৃত হলো।
লোকটার আশেপাশে থাকতে আজকাল বেশ ভালো লাগে৷ কেমন সুখ সুখ লাগে বুকের ভেতর। কথা বোঝে এ অনুভূতি! নিজের স্বামীর প্রেমে পড়ার এই অনুভূতি এই জীবনে প্রথম অনুভব করতে পারে কথা! শেষে কিনা বিয়ের মাস চারেক পরে এসে সে প্রেমে পড়লো, বসন্ত তার জীবনে দোলা দিল তবে! এই যে লোকটা যখন চশমা খুলে রুমাল দিয়ে মুছে আবার চোখে পড়ছে, মাঝে মাঝে চুলে হাত গুজছে, একা একাই বিরবির করছে, কী ভালো দেখাচ্ছে তাকে!
কথা বারকয়েক আশেপাশে ঘুরঘুর করলো, একবার তো শোভন বলেই ফেললো,
“কী ব্যাপার? বিরক্ত কেনো করছো?”

“বিরক্ত কোথায় করলাম? আমি তো কাচার জন্য জামা কাপড় নিতে এলাম।”

শোভন উত্তর না দিয়ে আবার বইয়ে মুখ গুজলো। কথা হেসে ফেললো৷ প্রেমে পড়ে অবশেষে তাকে মিথ্যাও বলতে হচ্ছে। লোকটা মাঝে মাঝে এত গম্ভীর রূপ ধরে, আর মাঝে মধ্যে দুষ্টু। প্রায় রাতে একেবারে জ্বালিয়ে মারে।
শোভনের আজ জন্মদিন। কথা ভাবলো তার জন্য পায়েস রান্না করবে। শোভন এসব আবার খুব পছন্দ করে৷ জন্মদিনে সারপ্রাইজ দিলে সে নিশ্চিয় খুব খুশি হবে। যদিও নিজের জন্মদিন নিয়ে কথার তেমন একটা আগ্রহ নেই, এসব তার ভালো লাগে না। কিন্তু শোভনকে খুশি করার জন্য একটু আধটু অপছন্দের কাজ করাই যায়।

রান্নাঘরে রোজিনা বেগম রান্না করছেন। ইদানীং তিনি রান্নায় খুব একটা হাত লাগান না। কথাই সব সামলায়। আজ হঠাৎ তাকে রান্নাঘরে দেখে কথা একপ্রকার দৌড়ে গেলো। বলল,
“আপনি রান্না ঘরে কেনো মা? কোনো দরকার? আমাকে বলুন।”

রোজিনা বেগম গ্যাসের চুলা বন্ধ করে গম্ভীর গলায় বললেন,
“কেনো, আমার রান্নাঘরে ঢোকা নিষেধ।”

“না না মা, আসলে…!”

কথা পুরো করতে পারলো না। তার চোখ গেলো ধোয়া ওঠা পায়েসের বাটিতে। এটা রান্না করতেই এসেছেন তাহলে। ছেলের জন্মদিনের জন্য? কথার মুখে হাসি ফুটলো। মা তার ছেলের জন্য পায়েস বানাবে এর চেয়ে আনন্দের আর কী হয়! তার মা ও যদি এমন করতো! কথা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
বলল,
“আজ বিরিয়ানি রান্না করবো মা?”

“তোমার ইচ্ছা, আমায় কেনো বলছো?”

“আসলে আপনার ছেলের পছন্দ তো, আজ তার জন্মদিন।”

রোজিনা বেগম তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন। কথা ইতস্তত করলো।
ঠিক তক্ষুনি কবিতা হুড়মুড় করে ঢুকলো। রান্নাঘরে ঢুকে লম্বা শ্বাস টেনে লাফিয়ে উঠলো। রোজিনা বেগমকে পেছন থেকে জাপ্টে ধরে চিৎকার করলো,
“পায়েস রান্না করেছো আন্টি, আমায় কেনো আগে বলোনি?”

রোজিনা বেগম হেসে অন্য একটা বাটিতে কিছুটা তুলে দিলেন। বললেন,
“তোকেও দেবো তো!

কবিতা খুশি মনে বাটি তুলে নিলো, পাশ থেকে ছোট চামচ নিলো। যেভাবে হুড়মুড় করে এসেছিল আবার সেভাবেই চলে গেলো।
কথার মনটা তৃপ্তিতে ভরে উঠলো। রোজিনা বেগম তাকে আপন করতে না পারলেও কবিতাকে আপন করে নিয়েছে। নেবে নাই বা কেনো, ভালবাসা আদায় করার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তার। কথার সে ক্ষমতা নেই, কারো সাথে মিশতে বা সহজ ভাবে কথা বলতে তার অনেকটা সময় লাগে। মাঝে মাঝে তার আফসোস হয়, সে কেনো কবিতার মত নয়?


“এই ঘড়িটা কেমন লাগবে? ”

কথার হাতের দিকে তাকিয়ে কবিতা নাক কুঁচকালো। তার আপার পছন্দ খুব বাজে। এই ঘড়ি শোভন ভাই কখনও পড়বে? কেমন মরা মরা রং।
সে বলল,
“এটা কী বাজে দেখতে রে আপা, এখনকার যুগে এসব চলে? শোভন ভাইয়ের জন্মদিনে যেহেতু গিফট দিবি, তাহলে তার পছন্দ মতো দিবি না?”

কথা বলল,
“তবে তুই পছন্দ কর না কবিতা, জানিসই তো আমি ভালো কিছু চুজ করতে পারি না, এজন্যই তো সাথে নিয়ে এলাম।”

“তুই এমন কেনো রে আপা, একটু যুগের সাথে চলনসই হ, ভাইয়া কত স্মার্ট, আর তুই? পরে যদি ভাইয়ার মন অন্যদিকে চলে যায়?”

কথা আঁতকে উঠলো,
“এসব কী বলছিস তুই?”

কবিতা খিলখিলিয়ে হাসলো। কেমন অদ্ভুত হাসি।
“আমি একটু দুষ্টুমি করছিলাম, মন থেকে বলেছি নাকি! পরিক্ষা করলাম তুই ভাইয়াকে কতটা ভালবাসিস?

” এরকম দুষ্টুমি আর করবি না।”

কবিতা কথা ঘুরানোর জন্য দোকান থেকে কালো বেল্টের ঘড়ি হাতে তুলে নিলো।
“দেখ এটা কী সুন্দর! ”

কথারও পছন্দ হলো খুব।
“সত্যি রে, খুব সুন্দর! তুই সবসময় সেরা জিনিসটাই কিভাবে যে বের করে ফেলিস!”

কবিতা হাসলো। দোকানিকে ঘড়িটা প্যাক করতে বলে কথার দিকে ঘুরলো।
বলল,
“আমাকে কিছু কিনে দিবি না?”

“তোকে কখন নিষেধ করলাম, নে না যা ইচ্ছা।”

“এত টাকা কোথায় পেলি রে আপা, আগে তো কিছু চাইলে টিউশনির টাকা পাবার অপেক্ষা করতি৷ এখন টিউশনি তো আর করিস না।”

“মাসে মাসে শোভন হাত খরচের জন্য টাকা দেয়, আমার খরচ বলতে তেমন কিছুই নেই। যা দরকার শোভন নিজেই এনে দেয় জানিসই তো। এজন্যই এত টাকা জমে গেছে। এত নিষেধ করি লোকটাকে, তবু কথা শোনে না। আস্ত পাগল! ”

কথা একগাল হাসলো।
কবিতা আনমনে বলল,
“আমারও মাঝে মধ্যে তোর মত সুখী হতে ইচ্ছে করে আপা, খুব ইচ্ছে করে।”

“হবি তো, অনার্সটা শেষ কর। ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দেবো, তখন দেখবি তুই কত সুখী হোস।”

কবিতা সামান্য হাসলো।
“তোর মত হয়তো হবো না।”
,

,
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here