একটুখানি
#লামিয়া_চৌঃ
পর্ব:২৭
“তোরা যে যা বলিস ভাই
আমার সোনার হরিণ চাই
মনোহরণ চপল চরণ
সোনার হরিণ চাই
আমার সোনার হরিণ চাই
আমার সোনার হরিণ চাই
তোরা যে যা বলিস ভাই
আমার সোনার হরিণ চাই
সে যে চমকে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায়
যায় না তারে বাঁধা
সে যে নাগাল পেলে
পালায় ঠেলে
লাগায় চোখে ধাঁধা
সে যে চমকে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায়
সে যে নাগাল পেলে
পালায় ঠেলে
লাগায় চোখে ধাঁধা।”
হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ আসতেই ইরিন বেতের মোড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। কূজন তখন চোখ বন্ধ করে গান গেয়েই চলছে। ইরিন বললো,
– ভাইয়া তুমি গান গাইতে থাকো আমি দেখে আসছি কে এসেছে।
কূজন চোখ খুলে মাথা নেড়ে ইরিনের কথায় সায় দিলো। আর একমনে গেয়ে চললো,
“আমি ছুটবো পিছে মিছে মিছে
পাই বা নাহি পাই
আমি আপন মনে মাঠে বনে
উধাও হয়ে ভাই
আমার সোনার হরিণ চাই
আমার সোনার হরিণ চাই
তোরা যে যা বলিস ভাই
আমার সোনার হরিণ চাই”
হাসনাদ সাহেবকে দেখে ইরিন আনন্দে আটখান হয়ে বললো,
– আঙ্কেল! আপনি?????
– কেমন আছো হরিণ?
ইরিন হাসনাদ সাহেবকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে উনাকে ভিতরে নিয়ে আসেন।
হাসনাদ সাহেবের হঠাৎ মনে হলো কেউ গান গাইছে আর সে কেউটা কূজন। ইরিন ধীরে ধীরে হাসনাদ সাহেবকে
নিজের রুমের বারান্দায় নিয়ে গেলো। হাসনাদ সাহেব দেখতে পেলেন একটা ছেলে বেতের মোড়ায় বসে গিটার হাতে একমনে গান গেয়েই চলছে। কূজন পিছন ফিরে থাকায় হাসনাদ সাহেব কূজনকে দেখেনি। কিন্তু ঠিকই বুঝে নিয়েছেন এই ছেলে আর কেউ নয় কূজন।
হাসনাদ সাহেব শিউর হওয়ার জন্যে কূজনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। কূজন চোখ বন্ধ করে আছে তাই বাবাকে দেখতে পায়নি।
হাসনাদ সাহেব এতোদিন পর ছেলেকে দেখে বেশ খুশি হলেন। কূজনের সামনের মোড়াটায় বসলেন। ইরিনকেও ইশারায় বসতে বললেন। ইরিন হাসনাদ সাহেবের পাশের মোড়াটায় বসলো। দুইজন একমনে কূজনের গান শুনতে লাগলো। কূজনের গান শেষ হতেই কূজন চোখ খুলতে খুলতে বললো,
– সোনার হরিণ কে এসে….
কূজন পুরো বাক্য আর বলতে পারলো না। হাসনাদ সাহেবকে দেখে কূজনের মনে হলো চোখে সরষে ফুল দেখছে। মুখ দিয়ে আর কোনো কথা বের হচ্ছে না তার। ইরিন হঠাৎ বলে উঠলো,
– আঙ্কেল আপনি আমার গান শুনে বলেছিলেন না অনেক সুন্দর তাহলে এখন কি বলবেন?
হাসনাদ সাহেব হেসে বললেন,
– হরিণ! নাহ্ সোনার হরিণ! আমার তো মন অন্য কিছু চাইছে। তোমাদের যুগলবন্দী শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে।
– তাহলে তাই হবে। কি বলো কূজন ভাইয়া???
কূজনের সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ওর মাথায় এখন অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। বাবা এখানে কি করে? বাবা জানলো কি করে যে সে এখানেই আছে? আর ইরিন আর বাবা এমনভাবে কথা বলছে কেনো? ইরিন তো বাবাকে চেনার কথা না এমনকি কলরব ভাইও তো বাবাকে চেনে না আর বাবাও তো ওদের চিনে না। বাবা এখন কি করবে? অনেক রেগে যাবে নিশ্চয় কিন্তু রাগার কোনো লক্ষণ তো দেখছি না।
ইরিনের কথায় কূজনের ভাবনায় ছেদ পড়লো।
– না আঙ্কেল তা হবে না আগে আপনাকে খাওয়া দাওয়া করতে হবে তারপর যা বলবেন তাই হবে।
– হুম করবোই তো দেখোনা এই ভর দুপুরে এসেছি তোমার কাছে।
– হা হা হা। আচ্ছা সেদিনের মতো আবার ভেগে যাবেন না তো?
– নাহ্ যাবো না হরিণ। সোনার হরিণ!
– আচ্ছা আমি এখনই টেবিলে খাবার সাজাচ্ছি।
ইরিনের পা এখন প্রায় পুরোপুরি সেরে গেছে তাই আগের চটপটে ভাব আবার চলে এসেছে তার মাঝে। ইরিন চলে যেতেই হাসনাদ সাহেব কূজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
– কি ব্যাপার তোমার ট্যুর শুনেছিলাম বান্দরবন,রাঙামাটি,নাফাখুম। তা ফেণীতেই থমকে গেলো কি করে?
– বাবা আসলে..
– বন্ধুর বাসায় আছো বললেই তো হতো। ট্যুর বাদ দিয়ে এসে পড়েছো নাকি ট্যুর শেষ হয়ে গেছে?
– না মানে ট্যুর শেষে এসেছি।
– কোন বন্ধুর বাসা এটা? সোনার হরিণ তো আর তোমার বন্ধু হতে পারে না। না মানে হতে পারে তবে বয়সটা একটুখানি ম্যাটার করে আরকি। তোমার থেকে ছোটই মনে হলো তার উপর ভাইয়া বলছে।
– না ওহ্ আমার ফ্রেন্ড না।
– তাহলে কে তোমার ফ্রেন্ড?
কূজন কোনোরকম বললো,
– কলরব!
– কলরব আবার কোন বন্ধু? আগে তো নাম শুনিনি। তোমার ভার্সিটির ?
– না কলরব ভাই আমার সিনিয়র। ভাইয়া চিটাগাং ভার্সিটির। ফরেস্ট্রি তে পড়াশুনা শেষ করে জব করছে।
– সিনিয়র বন্ধু বেশ ভালো। কলরব কি সোনার হরিণের ভাই?
– জ্বি বাবা। বাবা তুমি এখানে যে?
– কয়েকদিন আগে নতুন প্রজেক্ট এর উপর কাজ করছিলাম তখন না একবার ফেণী এসেছিলাম?
– হুম।
– বলেছিলাম না একটা মেয়ে খুব হেল্প করেছিলো?সেই মেয়েই হলো তোমার সোনার হরিণ।
– ওহ্।
– আজ আবার ফেণী আসতে হলো। ভাবলাম ইরিনের সাথে দেখা করেই যাই তাই চলে এসেছি।
ইরিন বললো,
– ভালো করেছেন আঙ্কেল এখন তাড়াতাড়ি চলুন তো।
হাসনাদ সাহেব উঠতে উঠতে বললেন,
– চলো মা।
– কূজন ভাইয়া তুমিও চলে এসো তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।
ইরিন কিছু বলার আগেই কূজন তাড়াতাড়ি করে বললো,
– ইরিন তার প্রয়োজন নেই। উনি আমার বাবা।
ইরিন তার টানা টানা বড় চোখগুলো আরো বড় করে থমকে দাঁড়ালো।
হাসনাদ সাহেব হেসে বললেন,
– আমার ছেলের গানের কথা বলেছিলাম না শুনলে তো কেমন গায়?
ইরিন কূজনের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। কূজন ইশারায় নির্ভরতার আশ্বাস দিলো। কিন্তু ইরিন বুঝতে পারছে না আঙ্কেল কূজনকে দেখে কেনো রিএক্ট করছে না। ইরিন তাই চুপ থাকাটাই শ্রেয় মনে করলো। ডাইনিং টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে হাসনাদ সাহেব বললেন,
– তোমার মা, বাবা, ভাইকে দেখছি না যে?
– মা, বাবা স্কুলে আর ভাইয়া অফিসে।
– ওহ্ তোমার মা, বাবা টিচার?
– জ্বি আঙ্কেল।
– আচ্ছা তুমি নিজ হাতে কিছু রেঁধেছো?
– না আঙ্কেল তবে সালাদটা আমি বানিয়েছিলাম।
– আমি তো ভাবলাম তোমার হাতের রান্না খাবো।
– আসলে কয়েকদিন ধরে অসুস্হ তো তাই করা হচ্ছে না।
– সমস্যা নেই। একটুখানি মজা করলাম আরকি। তবে তোমার পায়েশটা অনেক ভালো লেগেছিলো। তোমার আন্টির মানে কূজনের মায়ের হাতের খিচুড়িটা যেমন আমার সবচেয়ে প্রিয়, তোমার পায়েশটাও আমার খুব পছন্দের।
– থেঙ্ক ইউ আঙ্কেল।
– তুমিও বসো আমাদের সাথে।
হাসনাদ সাহেব এর সাথে তাল মিলিয়ে কূজন বললো,
– ইরিন বসে যাও, বাবাই তো এতো ফর্মালিটিস দেখিয়ে সার্ভ করতে হবে না।
– ইরিন বলছিস যে? সোনার হরিণ বলবি। হা হা হা।
বসে পড়ো মা। তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি। আসলে সেদিন বলেছিলাম না তোমাকে, আবার আসবো তাই চলে এলাম।
ইরিন চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,
– আপনি অনেক ভালো আঙ্কেল।
– আচ্ছা তুমি যেন কিসে পড়ো?
– এইবার এসএসসি দিবো।
– তুমি তো তাহলে অনেক ছোট কিন্তু কতো গুছিয়ে কথা বলো।
ইরিনের অনেক কথাই বলতে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু সে যতোটুকু না বললেই নয় ঠিক ততোটুকু বলছে পাছে আবার কোনো ঝামেলা বাঁধে। খাওয়া দাওয়া শেষে হাসনাদ সাহেব ওদের দুজনের যুগলবন্দী শুনতে চাইলেন। ইরিনের তখন বুক ঢিপঢিপ করছে। কোনসময় কি ঝামেলা বাঁধে এই ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে তাই গান গাইতে না করে দিলো। কিন্তু হাসনাদ সাহেবের পিড়াপিড়িতে শেষ পর্যন্ত রাজি হতেই হলো। তবে বললো একটু পরে গাইবে। কূজন ইরিনের একথা শুনে ভাবলো,
ইশ্ বুঝে না কেনো মেয়েটা? যতো তাড়াডাড়ি বাবাকে বিদায় করা যায় ততো ভালো। কূজনও বেশ জোর করেই ইরিনকে গান গাইতে রাজি করালো। কিন্তু ইরিনকে আর গান গাইতে হলো না। হাসনাদ সাহেবের ব্যবসার কাজে ডাক পড়লো। তাই তিনি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। ইরিন আর কূজন হাসনাদ সাহেবকে বিদায় জানাতে নিচে গেলো। গাড়িতে বসেই হাসনাদ সাহেব বললেন,
– ভালো থেকো মা! আর কূজন তোমার বেড়ানো শেষ হলেই বাসায় এসো।
– বাবা আমি কাল সকালেই বাসায় আসছি।
– আহা তাড়াহুড়ার দরকার নেই। আরো কয়েকদিন থাকো,আনন্দ করো।
হাসনাদ সাহেব কথা শেষ করেই ইরিনের হাতে একটা প্যাকেট দিলেন।
– এটাতে কি আঙ্কেল?
– একটা শোপিস! আর কিছু চকোলেট। তোমার জন্য উপহার।
ইরিন নিতে চাইলো না খুব জোর করে হাসনাদ সাহেব এটা ইরিনকে দিয়ে গেলেন তাও আবার কূজনের হাতে গছিয়েই বললেন,
– তুই রাখ পরে দিয়ে দিস, এই ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দাও তো নয়তো সোনার হরিণ আবার আবার প্যাকেট ফেরত দেওয়ার সুযোগ পেয়ে যাবে।
গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পর হাসনাদ সাহেব গাড়ির জানালা দিয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানালো দুইজনকে। কূজন আর ইরিন সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। গাড়ি যতোদূর দেখা গেলো তাকিয়ে রইলো। গাড়ি পাশের মোড়ে বাঁক নিতেই গাড়ি কোথায় যেন মিলিয়ে গেলো। তারপর কূজন বললো,
– বাবাকে জীবনেও আমি এতোগুলো মিথ্যে বলিনি।
– সব আমার জন্যে হলো। তোমাকে জোর না করলে এখানে আসতেও না আর আঙ্কেলকে মিথ্যেও বলতে হতো না।
– আরে সোনার হরিণ তুমি মন খারাপ করো না। তুমি আমার বড় উপকার করেছো।
– চলো বাসায় যাই।
কূজন হেসে বললো,
– আমার সোনার হরিণকে মনমরা হয়ে থাকলে একদমই ভালো লাগে না।
– ঠিকাছে ভাইয়া মন খারাপ করবো না।
– গুড গার্ল।
চলবে…