একটুখানি
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৪৯
– ভালোবাসো?
কুহু হাতের টিস্যু একবার ভাঁজ করছে একবার
খুলছে।
– কি হল বললে না যে ভালোবাসো?
কুহু কলরবের দিকে মুখ তুলে তাকাচ্ছে না।
দৃষ্টি মেঝের দিকে রেখে একমনে সে হাতের
টিস্যুটা নিয়ে মেতে আছে।
– বিয়েটা কি তোমার ইচ্ছেতে হচ্ছে?
কুহু তার নিরবতা পালন করেই যাচ্ছে। কলরবের
কোনো কথারই জবাব দিবে না ঠিক করে
ফেলেছে সে।
কলরব বিরক্ত হয়ে বলল,
– কি ব্যাপার একটা কথারও জবাব দিচ্ছো না
কেনো?
– আমি বাসায় যাব। আজ আসি পিহু নীচে
অপেক্ষা করছে।
কুহু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই কলরব থমথমে
গলায় বলল,
– আমার কথা কি শেষ হয়েছে কুহু?
কলরবের কণ্ঠ এই প্রথম কুহু নিজের নাম শুনেছে।
কোকিলের কুহু ডাক আজ যেন কলরব ছিনিয়ে
এনেছে। কলরব শান্ত স্বরে বলল,
– বসো কুহু আগে আমার কথা শেষ হোক। পিহু
আর ইরিন কূজনের সাথে আছে।
সমস্যা নেই কূজন অনেক ভালো ছেলে।
কলরব এতটুকু বলেই কুহুর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি
নিক্ষেপ করলো। কলরবের শান্ত কণ্ঠস্বর কুহু এর
আগে শুনেনি। খুব গম্ভীর আর ভয়ঙ্কর মনে হলো
কুহুর কাছে। তাই চুপচাপ চেয়ারে বসে পড়লো
সে।
– কাল রাতে তোমাকে কল দিয়েছিলাম। পিহু
কিছু বলেছে?
– হুম।
– তাহলে পরে কল দাওনি কেনো? চুপ করে
থাকবে না প্লিজ।
– এমনিতে।
– তাহলে আজ আমার সাথে ঘুরতে আসতে
চাওনি কেনো?
কুহু নিশ্চুপ।
কলরবের বেশ মেজাজ খারাপ হচ্ছে তাও কিছু
বলছে না। রাগটাকে গিলে ফেলে এবার সে
নরম স্বরে বলল,
– কুহু! অনেস্টলি বলো তোমার বিয়েতে মত
আছে কিনা?
কুহু এবারো চুপ করে রইলো। কলরবের কোনো
কথার জবাব সে দিবে না বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
কলরব প্রশ্নটা করে কিছুক্ষণ সময় দিল কুহুকে।
কুহুর জবাব না পেয়ে কলরব আহত স্বরে বলল,
– তুমি চিন্তা করো না আমি বিয়েটা ভেঙে
দিব। তোমাকে চাপ নিতে হবে না। কেউ
তোমাকে কিছু বলবে না। তোমার ফ্যামিলিও
না আমার ফ্যামিলিও না।
কলরবের কথা শুনে কুহু এত বেশি অবাক হয়েছে
যে সে হাতে থাকা পার্স হাত থেকে ছেড়ে
দিয়েছে। কলরব পার্সটা তুলে টেবিলে
রাখতেই কুহু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
তারপর টলমলে চোখে কলরবের দিকে তাকিয়ে
বলল,
– উদ্ধার করেছেন আমাকে ধন্যবাদ। আর
আপনিও আপনার অন্য ফুলটুশীদের মাঝে
কোনো একজনকে নিয়ে সুখে থাকুন দোয়া
রইলো।
কথাটা বলেই কুহুর দম আটকে গেল। চোখ উপচে
পানি বেরিয়ে আসতে লাগলো। কলরবের
সামনে সে কিছুতেই কাঁদবে না তাই
তাড়াতাড়ি পা চালালো। কলরব কুহুর কথা
শোনে বিস্ফোরিত চোখে কুহুর চলে যাওয়া
দেখছে। কি বলে গেল মেয়েটা? অন্য
ফুলটুশীরা মানে? ফুলটুশী কয়টা আছে?? কলরব
ব্যাপক অবাক হয়েছে। হা হয়ে আছে পুরা।
কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে থাকার পর ধাতস্হ হলো
কলরব। কুহুর কিছু একটা হয়েছে। তড়িঘড়ি করে
উঠে দাঁড়ালো সে। পা বাড়ালো চলে যাওয়ার
জন্য। পরমূহুর্তেই পিছন ফিরে টেবিল থেকে
কুহুর পার্সটা নিল সে। তাড়াতাড়ি করে নীচে
নামতেই কলরব দেখলো কুহু, পিহু রিকশায় করে
চলে যাচ্ছে। ইরিন প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দিবে এমন
চাহনী দিতেই কলরব কুহুর পার্সটা ইরিনের
হাতে দিয়ে বলল,
– এটা রাখ।
– ভাবী এভাবে হুড়মুড় করে চলে গেল কেনো?
আর পিহু আপুকেও সাথে নিয়ে গেল আর
কাঁদছেই বা কেনো?
কূজন বাইকের সাথে ধাক্কা দিয়ে দূরে
কোথাও তাকিয়েছিল। কে আসলো গেল
কিছুতেই তার মন নেই। কুহু কখন এলো আর কখন
গেল, কবেই বা কাঁদলো কূজন কিছুই টের
পায়নি। ইরিনের কথায় সম্বিত ফিরে পেল
কূজন। কানে বাজলো কুহ কেঁদে চলে গেছে।
সেদিনের কথা মনে পড়তেই চিৎকার করে
কুহুকে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হলো “কেনো
কাঁদলে কুহু? কেনো কাঁদাচ্ছো কুহু? ”
কলরব ইরিনের কথার জবাব দিল না শুধু বলল,
– বাসায় চল আর পার্সটা হাতে রাখ।
…
কুহু রিকশায় বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
ঠোঁট কাপঁছে, বুকের মধ্যে সূচ গাঁথা হয়েছে
এমন কষ্ট হচ্ছে। পিহু কিছুই বুঝতে পারছে না।
হঠাৎ কি হলো কুহুর? এভাবে চোখের পানি
ফেলতে ফেলতে বেরিয়ে এলো কেনো? আর
কেনোইবা এখন এভাবে কাঁদছে? বাসায় যেয়ে
জানতে হবে। কুহু সারা রাস্তায় কেঁদেকেটে
গলির ভিতর রিকশা ঢুকতেই চোখমুখ মুছে
ফেললো। বাসায় যেয়েও নরমাল বিহেভ
করলো। পিহুরও বান্ধবী এসেছে বাসায় তাই
কুহুর সাথে আর কথা বলা হলো না। সন্ধ্যা
সাতটার দিকে বান্ধবীকে বিদায় করে কুহুর
কাছে গেল সে। চুপচাপ গুটিসুটি মেরে বসে
আছে কুহু। পিহু বোনের মুখোমুখি বসে বলল,
– কলরব ভাই কি কোনো শালীন কাজ করেছে?
কুহু ভাঙ্গা কণ্ঠে বলল,
– বাক্যটা ভুল হয়েছে। অশালীন শব্দটা হলে
তোর মনের ভাব প্রকাশ পেতো।
পিহু কুহুর কথার রিপিড করে বলল,
– ঢং!!! মনের ভাব তুই বুঝেছিস তাতেই হলো
এখন বল এমন কিছু?
– না।
– তাহলে?
– বলেছে বিয়ে ভেঙে দিবে।
বোনের কথা শোনে পিহু আৎকে উঠলো।
– কি বলিস কি? এটার কোনো মানে হয়? যতসব
ফাজলামি…
পিহুর কথা শেষ না হতেই কুহু পিহুকে জড়িয়ে
কাঁদতে লাগলো। পিহু চুপ করে বসে রইলো। কুহুর
কান্নাকাটি শেষ হলে আরো কথা জানতে
হবে। কুহুর কান্না কমে এলে পিহু কুহুকে বলল,
– তুই কাল রাতে এতো রেগেছিলি কেনো?
– কারণ কাল রাতে আমি যখন ফোন করি তখন
কলরব…
– এই আল্লাহ আমার না কালকে কোচিং এ
পরীক্ষা। আল্লাহ পরে বলিস এখন পড়তে হবে।
কুহু হতাশ হয়ে বলল,
– তোর পরীক্ষা আর আমার জীবন…
পিহু বই বের করতে করতে বলল,
– পড়াশুনা আমার জীবন।
– তুই অনেক বড় হবিরে পিহু।
– বল ডাক্তার হবি।
– ইনশাআল্লাহ!
…
কলরব কিছুতেই বুঝতে পারছে না কি করবে।
কুহুর মোবাইলটা পার্সের ভিতর ছিল তাই
সেটাও এখন তার কাছে। পিহুর নাম্বার জানে
না কলরব। কুহুর মায়ের মোবাইলের ফোন
দেওয়াটা পছন্দসই মনে হচ্ছে না কলরবের তাই
তাও দিচ্ছে না। ইরিনকে এতো রাতে
পাঠানোও সম্ভব না। তাছাড়া পরশু থেকে
ইরিনের পরীক্ষা, এখন পড়া দরকার। কুহুর সাথে
যোগাযোগ করতেই হবে। বেশি দেরি হয়ে
গেলে সবকিছু কমপ্লিকেটেড হয়ে যাবে। বাধ্য
হয়ে মায়ের কাছে যেয়ে আবদার ধরলো কুহুর
সাথে দেখা করিয়ে দেবার।
– ঠিক আছে কাল সকালে কথা বলিস নয়তো ওর
মায়ের থেকে আমি পিহুর নাম্বার নিয়ে
নিচ্ছি। পিহুর মোবাইলে ফোন দিয়ে কথা বল।
– মা আমি সরাসরি কথা বলতে চাই।
– কাল সকালেই বলিস।
– মা আমি এখন কথা বলতে চাই।
– রাতের আটটা বাজে তুই ওর সাথে কি কথা
বলবি?
– ইম্পর্টেন্ট।
– তাহলে আমার সাথে ওর বাসায় চল..
– নাহ্ মা ওর বাসায় না..
– কুহুর মা এখন ওকে জীবনেও আসতে দিবে না।
– না মা কুহুকে আমাদের বাসায় আসতে হবে
না।
সাহরা বিস্ফোরিত চোখে ছেলের দিকে
তাকিয়ে বললেন,
– তাহলে?
– মা ওকে ওদের ছাদে আসতে বলো।
– তোর পা দুইটা ভেঙে হাতে ধরিয়ে দিব।
এতো রাতে কিসের কথা তোর?
– মা বুঝো না কেনো? আর্জেন্ট! আমি বললে
সে কখনো আসবে না প্লিজ কিছু একটা করো।
– কিছু একটা করবো মানে কি? সামনে থেকে
সর বলছি। যতসব ফাজলামি! এতোদিন বিয়েই
করতে চায়নি আর এখন পাগল হয়ে গেছে।
– মা বুঝো না কেনো?
– তোকে বললাম যা নিজের কাজ কর গিয়ে।
– ভালো হয়েছে বলা লাগবে না কুহুকে। কুহু
যেমন পাগল তুমিও একইরকম পাগল। দুই পাগলের
মাঝে আমি ফেঁসেছি। একটা নরমাল কথাকে
কি থেকে কি বানিয়েছো। লাগবে না কারো
বলা। কোনো কুহুটুহুর সাথে কথা বলানো
লাগবে না। আজ কেনো কালও কথা বলবো না।
মায়ের সাথে রাগ দেখিয়ে বাসা থেকে
বেরিয়ে এসেছে কলরব। প্রচন্ড রকমের
মেজাজ খারাপ তার। কূজনকে কেটে কুঁচি কুঁচি
করে পানিতে ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে
তার। সারা দুনিয়াতে আর একটা মেয়েও খুঁজে
পায়নি। আর কুহু গাধীটাও একটা! ক্লিয়ার করে
কিছুই বলে না। মায়ের উপর সবচেয়ে বেশি
বিরক্ত লাগছে। একটু কথাই তো বলবে নাহ্
সেটাও বলা যাবে না। আর খুঁজে টুঁজে কুহুকেই
ধরতে হলো। একে তো কি রাগ আবার
বোকাসোকা। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে রাস্তায়
দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি কুহুদের বারান্দার দিকে।
মেয়েটা কি একবার বারান্দায় ও আসতে
পারে না? হতাশ হয়ে কলরব দাঁড়িয়ে আছে।
পকেটে ফোন বাজতেই পকেট থেকে মোবাইল
বের করলো।
– হ্যালো রঞ্জু বল!
– কি খবর দোস্ত?
– কি আর খবর।
– কেনো দোস্ত কি হলো আবার? তুই না তোর
ফুলটুশীকে পেলি। আর কি চাই?
– শালার কচু পেয়েছি। মানুষ বিয়ের পরে
পস্তায়। আমার জ্বালা আগেই শুরু।
– ভাবী অনেক প্যারা দেয় নাকি?
– প্যারা দেয় মানে সে নিজেই তো একটা
প্যারা। তার উপর মা আরেক ড্রামাকুইন।
– বউ শ্বাশুড়ীর যুদ্ধ শুরু নাকি?
– আরে নাহ তেমন না। বলেছিলাম কুহুর সাথে
আর্জেন্ট কথা আছে ওকে একটু ছাদে দেখা
করতে বলো। নাহ্ উনি বলে দিয়েছেন সকালে
দেখা করিস।
রঞ্জু ফোনের ওপাশ থেকে হাসতে হাসতে
বলল,
– তা তো বলবেই। তুই এতো বলদ হলি কবে
দোস্ত? আন্টিকে যেয়ে বলেছিস দেখা করবি
হাহাহাহা। ভাবীকে বল তুই দেখা দেখা করতে
চাচ্ছিস..
– আরেহ্ আপনার ভাবীরে..আপনার ভাবী খালি
রাগ দেখাতে জানে আর কিছুই জানে না। আর
পারে শুধু শুধু আমাকে জমের মতন ভয় পেতে।
উনি কি এখন জীবনেও আসবেন? উনাকে তো
আমি খেয়ে ফেলবো।
– আরে বল বল বললেই আসবে। প্রথম একটুখানি
পার্ট নিবে আরকি।
– আরে নাহ্ তোর ভাবী হলো অন্য চিজ। এখন
রাখ তো সেই মেজাজ খারাপ হচ্ছে।
চলবে…