একটুখানি
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫৭
কুহুর আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেল।
গতকাল দুপুর থেকেই প্রচন্ড রকমের মাথা
ব্যাথা ছিল তাই সারা দুপুর ঘুমিয়ে
কাটিয়েছে। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে নামাজ
পড়ে আবার একচোট ঘুমিয়েছে সে। সন্ধ্যার পর
যাও একটু পড়তে বসেছিল কূজনের বলা
কথাগুলো মনে হতেই নিমিষেই মন বিষিয়ে
উঠেছিল। তাই মন ভালো করার জন্য ছাদে
গিয়েছিল।পিহুকেও বলেছিল সাথে যেতে,
পিহুর পড়া আছে তাই যায়নি। ভেবেছিল পিহু
সাথে থাকলে কিছু গল্পগুজব করবে। একা একা
ছাদে যেতে গতকাল কেনো যেন একটুও ভালো
লাগছিল না কুহুর কিন্তু ঘরে থাকতেও ইচ্ছে
করছিল না। পিহুর না শোনে নিরুপায় হয়ে
একাই ছাদে গেল সে। ছাদে পা রাখতেই মন
আরো খারাপ হয়ে গেল। কলরবকে দেখার
ইচ্ছাটা কুহুর মনে তীব্র আকার ধারণ করলো।
কুহুর হঠাৎ মনে হলো ভিডিও কল দিলেই তো হয়।
কুহু নিজেই নিজের সাথে বলল,
– ফুলটুশী মেডাম আপনি তো দেখি দিন দিন
বুদ্ধিমতী হয়ে যাচ্ছেন। বাহ্ সব আপনার
কলরবের কেলমা।
তারপর একা একাই অট্টহাসি হাসতে লাগলো।
হাসতে হাসতে বলল,
– এতো রাক্ষসী হাসি তুই হাসিস কীভাবে
কুহু??
– আমি ভালোবাসি তাই।
কুহু অবাক হয়ে পিছন ফিরতেই দেখলো কূজন
দাঁড়িয়ে আছে। কূজনকে দেখে কুহুর এবার খুব
বেশি রাগ হলো। কুহু কূজনকে কিছু বলল না
কিন্তু চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কূজন
নরম সুরে বলল,
– কুহু লাভ হবে না। সিঁড়িঘরের গেইটে তালা
দেওয়া আর..
কূজনের কথা শেষ না হতেই কুহু আতঙ্কে কূজন
থেকে অনেকখানি দূরে সরে দাঁড়ালো। তারপর
কাঁপা স্বরে বলল,
– আর??
কূজন পকেট থেকে চাবি বের করে কুহুর সামনে
তুলে ধরলো। কূজনের হাতি চাবি দেখেই কুহুর
হাত পা ভয়ে জমে গেল। এই শীতের মাঝেও
কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করলো। এই
প্রথম কূজনকে কুহুর কাছে ভয়ংকর মনে হচ্ছে।
কুহু ভয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
– প্লিজ তালাটা খুলে দিন।
কূজন কিছু বললো না। চুপচাপ চাবিটা
প্যান্টের পকেটে রেখে দিল। কূজনকে পকেটে
চাবি রেখে দিতে দেখে কুহু আর এক মিনিটও
দাঁড়ালো না। দৌড়ে গিয়ে সিঁড়িঘরের দরজা
ধাক্কাতে লাগলো। ভয়ের চোটে মুখ দিয়ে
একটা শব্দও বের করতে পারছে না। শুধু
নিরলসভাবে একটানা দরজা ধাক্কাতে
লাগলো। কূজন ধীর পায়ে এসে কুহুর পিছনে
দাঁড়িয়ে বলল,
– ভয় পাচ্ছো কেনো কুহু?
কূজন এই প্রথম কুহুকে তুমি করে বলল। কুহুর তাতে
ভয় আরো দ্বিগুণ হলো। কুহু পুরোপুরি কান্নায়
ভেঙ্গে পড়লো। কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
– প্লিজ কূজন আমাকে যেতে দিন। আপনার
পায়ে পড়ি কূজন তারপরো আমাকে যেতে দিন।
কুহু চোখের পলকেই দরজা ছেড়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে
কূজনের পা ধরার জন্য বসে পড়লো। কূজন দুপা
পিছিয়ে বলল,
– কুহু তোমাকে তো পায়ে পড়তে বলিনি। তুমি
কি জানো তোমাকে কাঁদলে কতোটা সুন্দর
লাগে? তোমার কান্না দেখেই তোমার প্রেমে
পড়েছিলাম আর তাই চেয়েছিলাম জীবনে
যখনি তুমি কাঁদবে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে
কাঁদবে আর তুমি কিনা আমার পায়ে পড়ছো।
কুহু দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে কাঁদছে আর
বলছে,
– প্লিজ কূজন আমাকে যেতে দিন।
কূজন কুহুর মুখোমুখি বসে বলল,
– যেতে দিব তো শুধু…
কুহু সাথে সাথে দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর কঠিন
গলায় জিজ্ঞাসা করলো,
– শুধু কি?
কূজন কুহুর দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বলল,
– আমি একটা গান শুনাবো তোমায়। তুমি
আমার পাশে বসে গানটা শুনবে আর আমি
একসাথে দুইটা চাঁদ দেখবো।
কুহুর কূজনকে কেমন যেন বদ্ধ পাগল মনে হচ্ছে।
কুহু আরো বেশি ভয় পেল। কুহু আবার দরজা
ধাক্কাতে শুরু করলো। সাথে চিৎকার করে
বলছে,
– কেউ আছেন প্লিজ সাহায্য করুন। হেল্প মি!
কেউ আছেন?? আব্বু! আছো? আব্বু!
কূজন নরম স্বরে বলল,
– আঙ্কেল নেই। মাত্র দেখলাম মসজিদে
গেলেন নামাজ পড়তে।
কূজনের কথা শোনে কুহু কূজনের প্রতি ঘৃণা ভরা
দৃষ্টি নিয়ে এক পলক তাকালো তারপর পুরো
দমে চিৎকার করে মা আর পিহুকে ডাকতে
লাগলো। বাড়িওয়ালা আঙ্কেলকেও ডাকতে
লাগলো। কূজন ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে
উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
– কুহু বোকার মতন কাজ করছো কেনো? নিজের
বদনামি নিজেই করতে চাচ্ছো? সবাইকে
ডেকে জড়ো করলে তোমার নামেই মানুষ
কুৎসা রটাবে। এর চেয়ে বরং আমার পাশে
বসে গানটা শুনে ফেলো। প্রমিজ করছি
তোমাকে যেতে দিব আর আটকে রাখবো না।
আমি এতোটাও খারাপ গাই না যে তোমাকে
পালিয়ে যেতে হবে।
কুহু একটু সময় নিল ভাবার জন্য। তারপর ভেবে
দেখলো কূজন ঠিক বলছে। এভাবে মানুষ জড়ো
করে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার
কোনো মানেই হয় না। বহু কষ্টে সাহস সঞ্চয়
করে বলল,
– প্লিজ তাড়াতাড়ি শুরু করুন।
কূজন কুহুর কথা শোনে মিষ্টি করে হাসলো।
তারপর বলল,
– চলো পিছন দিকটায় যাই। আমি ঐখানে
গিটার রেখে এসেছি।
কুহু ডানে বায়ে মাথা নেড়ে বলল,
– এখানে নিয়ে আসুন গিটার।
কূজন কুহুর অশ্রুসজল চোখজোড়ার দিকে
তাকিয়ে আহাজারি করে বলল,
– কলরব ভাইয়ের সাথে তো দিব্যি সেখানে
বসে থাকতে পারো কিন্তু আমাকে এক
ফোঁটাও বিশ্বাস করতে পারো না, তাইনা কুহু?
কুহু কিছু বলল না। চুপ থেকে নিজ সিদ্ধান্তে
অটল রইলো। কূজনও কুহুকে জোর করলো না।
চলে গেল গিটার আনতে। কুহু মনে মনে
আল্লাহকে ডাকতে লাগলো। কোনোরকম
এখানে থেকে যেতে পারলেই বাঁচে সে। কূজন
খুব দ্রুত গিটার নিয়ে চলে এলো। কুহুকে
উদ্দেশ্য করে বলল,
– বসো।
কুহু কথা বাড়ালো না, কূজনের কথামতো
চুপচাপ দরজা ঘেঁষে বসে পড়লো। কূজন কুহুর
মুখোমুখি বসে গান ধরলো,
“আমি নামের বসন্তে তুমি কুহু,
তুমি নামের সাগরিকায় আমি ঢেউ,
বুঝলো না বুঝলো না বুঝলো না কেউ,
তুমিও বুঝলে না কুহু,
বুঝলো নারে কেউ।
আমি নামের আকাশে তুমি পূর্ণিমা।
তুমি নামের অমানিষায় আমি অন্ধকার।
এই মন এই গিটার ঐ চাঁদটাও তোমার।
কুহু তুমি শুধুই আমার, শুধুই যে আমার।
আমি নামের শরতে তুমি কাশবন।
তোমায় ভালোবাসে এই কূজন।
কুহু কভু চেয়েছো কি এই নয়নে?
ভালোবাসা লুকিয়ে অশ্রুর গহীনে?
জানালার কাঁচ ছোঁয়া বৃষ্টি তুমি এই হৃদয়ের
খিল,
এই আকাশ সাক্ষী, সাক্ষী এই নিখিল।
আমি নামক বারান্দায় তুমি সাজানো ফুল,
ভালোবাসাটাই কি ছিল এই অভাগার ভুল?
বুঝলো না বুঝলো নারে বুঝলো নারে কেউ,
সাগরিকা তুমি, আমি সেই সাগরের ঢেউ।”
কূজনের গান শেষ হতেই কুহু চট করে উঠে
দাঁড়িয়ে মিনতির সুরে বলল,
– প্লিজ এখন তো যেতে দিন।
কূজনও আকুতির স্বরে বলল,
– আরেকটু বসো না প্লিজ।
কুহু অসহায় চোখে কূজনের দিকে তাকিয়ে
রইলো। কূজন কুহুর চোখের ভাষা বুঝলো। পকেট
থেকে চাবি বের করে কুহুর দিকে বাড়িয়ে
দিল। কুহু অতি দ্রুত চাবিটা হাতে নিয়ে তালা
খুলে তালা চাবি দুটোই ছাদে ছুঁড়ে ফেলে
দিয়ে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে নেমে
এলো। এসে কাউকে কিছুই বললো না। এমনকি
পিহুকেও না। আসলে কুহু কিছু খুলে বলার মতন
অবস্হায় ছিল না। জীবনেও সে এতো ভয়
পাইনি যা সে গতকাল রাতে পেয়েছে। বাসায়
এসে থরথর করে কাঁপছিল। এখনো কম্বল গায়ে
দেয়ার মতন শীত পড়েনি তাই কম্বল নামানো
ছিল না। কিন্তু গতকাল কুহু এতোটাই কাঁপছিল
যে আলমারি থেকে কম্বল নামিয়ে গায়ে
দিয়ে শুয়ে পড়েছিল সে। মাথা ব্যাথায় কুহুর
ইচ্ছে করছিল হাতুড়ি দিয়ে মাথাটা দু টুকরো
করে ফেলতে। বহু কষ্টে ঘুমিয়েছিল সে। অথচ
মাঝরাতে কলরব ফোন করায় ঘুম ভেভে
গিয়েছিল কুহুর। মাথা ব্যাথার চোটে কলরবকে
ফোন রাখতে বলে আবার ঘুমিয়ে পড়ে কুহু আর
সেই ঘুম ভাঙলো এতো দেরি করে। কোনোরকম
ফ্রেশ হয়েই কুহু স্কুলে যাওয়ার জন্য বাসা
থেকে বেরিয়ে পড়লো। ভাগ্য ভালো ছিল
তাই তাড়াতাড়ি রিকশাও পেয়ে গেল।
রিকশায় উঠেই কলরবকে ফোন করলো। কলরব
প্রায় সাথে সাথেই ফোন ধরলো যেন কুহুর
ফোনের অপেক্ষাতেই মোবাইল হাতে নিয়ে
বসেছিল।
– হ্যালো! ফুলটুশী মাথা ব্যাথা কমেছে?
– কমেছে। আসলে সরি! কাল দুপুরেও আপনার
কল রিসিভ করিনি আবার রাতেও কথা বলতে
নিষেধ করে দিয়েছি। প্রচন্ড মাথা ব্যাথা
ছিল। কাল সারাদিন ঘুমিয়ে কাটিয়েছি।
– হুম একবার বলেছিলে অসুস্হ হলে তুমি ঘুমিয়ে
থাকতে পছন্দ করো যাতে যন্ত্রনা টের পাওয়া
না যায়।
কুহু অবাক হয়ে বলল,
– ঠিক বলেছেন কিন্তু আপানকে কখন বললাম?
– মনে করে দেখো বলেছিলে।
কুহু মনে করতে পারলো না।
কলরব আবার বলল,
– ফুলটুশী তোমার ব্রেন খুব ডাল।
কুহু হেসে বলল,
– কলরব ইবনাত মশাইয়েরটা যে খুব বেশি শার্প
তাই হয়তো। আল্লাহ আসলে ব্যালেন্স করে
দিয়েছে।
কলরব কুহুর কথায় গগনবিহারী হাসি হাসতে
লাগলো। কুহু ফোনের অপর প্রান্ত থেকে
বিভোর হয়ে কলরবের হাসির শব্দ শুনতে
লাগলো। রাঁধা যেমন শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির সুরে
পাগল হয়ে যেতো, কুহুও তেমনি কলরবের
হাসিতে মাতোয়ারা। দুটো ভালোবাসার
মানুষ যখন একে অন্যকে জুড়ে থাকে তখন
পৃথিবীর অধরা সুখগুলোও যেন নিজে এসে ধরা
দেয়, হাতছানি দিয়ে ডাকে। কুহুকেও যেন
কলরব নামের সুখপাখি হাতছানি দিয়ে
ডাকছে। কলরবের হাসির শব্দ কুহুর সব চিন্তা,
গ্লানি চোখের পলকে মুছে দিল।
চলবে…