এক্কা দোক্কা পর্ব-১৮

0
705

#এক্কা_দোক্কা – ১৮
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

সম্পূর্ণ দেশে এই মুহূর্তে হট্টগোল লেগে আছে। নেতাদের মধ্যে হচ্ছে চরম বিশৃঙ্খলা! রিয়াদ তালুকদারের মত জনপ্রিয় এক নেতার হত্যাকান্ড রাজনৈতিক দুনিয়ায় তোলপাড় করে দিচ্ছে। লাশ মর্গে পাঠানো হয়েছে। রিয়াদ তালুকদারের লাশ তন্নতন্ন করে আঘাতের কোনো চিন্হ পাওয়া যায়নি। কিন্তু ফরেনসিক ডাক্তারের ভাষ্যমতে,
‘ রিয়াদ তালুকদারের খুন বিষক্রিয়ার মাধ্যমে হয়েছে। সেই বিষক্রিয়ায় তার দেহের হৃদপিণ্ড গলে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে কোনো ইনজেকশন কিংবা পুশিং এর মাধ্যমে উনার দেহে বিষ সঞ্চালন করা হয়েছে। কিন্তু তার দেহে সেরকম কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। শরীরের কোথাও আঘাতের কোনো চিন্হ পাওয়া যায়নি। রিয়াদ তালুকদার একজন মারাত্মক ড্রাগ এডিকটেড মানুষ। হতে পারে তিনি সেদিন রাতে মাতাল অবস্থায় ড্রাগে বিষ ঢুকিয়ে ইনজেকশনের মাধ্যমে তা নিজের শরীরে প্রবেশ করিয়েছেন। ‘

পুলিশের এই বয়ানে আমজাদ হোসেন রেগে অস্থির হয়ে উঠলেন। তার নাকের ডগা তরতর করে কাপছে। তিনি লাথি দিয়ে পুলিশ স্টেশনের চেয়ার নিচে ফেলে দিলেন। অতঃপর পুলিশ ইন্সপেক্টরের কলার চেপে ধরে রগরগিয়ে বললেন,
-” এই পুলিশের বাচ্চা, তোর বা/লে/র মুখ বন্ধ রাখ। কুত্তার মত ভ্যা ভ্যা না করে ভালো করে ভেবে দেখ। এটা একটা প্রি প্ল্যানড মার্ডার। রিয়াদ এমনি এমনি মরে নাই। বুঝলি? তদন্ত আরো জোরদার কর শালার বাচ্চারা। ”
আমজাদ হোসেনের কিরমির করে বলা কথাটা শুনে ইন্সপেক্টর ভয়ে রীতিমত গা কাপতে লাগলো। সে অস্থির হয়ে বলল,
-” জি, আমি দেখছি স্যার। আপনি কোনো চিন্তা নেবেন না। আমি দেখছি বিষয়টা। ”

আমজাদ হোসেন ইন্সপেক্টরের কলার ছেড়ে ধাক্কা দিয়ে তাকে নিচে ফেলে দিলেন। ইন্সপেক্টর মাটিতে পড়ে ভয়ার্ত চোখে আমজাদ হোসেনের দিকে তাকালো। আমজাদ হোসেন ঘাড় দুইদিকে ঘুরিয়ে মটমট শব্দ তুললেন। অতঃপর সকল পুলিশকে তর্জনী তুলে শাসিয়ে পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে গেলেন।

আমজাদ হোসেন বেরিয়ে যেতেই ইন্সপেক্টর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মাটি থেকে উঠে দাঁড়ালেন। সবার দিকে চেয়ে আঙ্গুল উচুঁ করে জানালেন,
-” আমি এই তদন্তের শেষ দেখতে চাই। ছোট থেকে ছোট ক্লু আমাদের খুনি অব্দি পৌঁছে দিতে পারে। রিয়াদ তালুকদারের কাপড, চুল থেকে মাথা সবকিছু সার্চ করো। আমি এর শেষ দেখবো! বুঝেছ সবাই! ”
ইন্সপেক্টরের গর্জন শুনে পুলিশ স্টেশন কেপে উঠলো। সবাই তটস্ত চোখে পরখ করলো চারপাশ। সবার কপালে ঘামের সূক্ষ চিন্হ!
____________________________
জুভান মাত্রই বাড়ি ফিরেছে। তার মাথা আপাতত ফাঁকা। রিয়াদ তালুকদারের এমন হুট করে মৃত্যু সে বিশ্বাস করতে পারছে না। এই মুহূর্তে একটা হট শাওয়ার নেওয়া দরকার। জুভান নিজের রুমে ঢুকে চটপট বাথরুমে চলে গেল।

জুভানের ফোনে রিং হচ্ছে। জুভান উদোম গায়ে, শুধু টাওয়াল পেচিয়ে বাথরুম থেকে বের হলো। বিছানার উপর থেকে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো, হিয়া কল দিয়েছে। জুভান ফোন রিসিভ করলো,
-” হু, বল। ”
-” জুভান, কোথায় তুই? সাতদিন আগে ঐশীকে টেস্ট করালি। এখনো রিপোর্ট আনতে এলি না? ”

জুভানের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। সে বেমালুম রিপোর্টের কথা ভুলে গেছে। এ কদিন কম চাপ তো যায়নি তার উপর দিয়ে। শুটিং, গানের রেকর্ডিং আর রিয়াদের এই রহস্যময় খুন। সব নিয়ে জুভান বেশ ব্যস্ত ছিল এ সপ্তাহ! জুভান গায়ে টিশার্ট গলিয়ে বললো,
-” ড্রাইভার পাঠিয়ে দিচ্ছে। রিপোর্ট নিয়ে আসবে। আপাতত তুই মুখে বল, কি এসেছে রিপোর্টে? ”
-” সারোগেট প্রসেসের জন্যে ঐশী প্রিপায়ার্ড না, জুভান। ”
জুভান কিছুটা থমকালো। চোখ ছোট ছোট করে বললো,
-” কেন? ”
-” স্যারোগেসি উপায়ে ওর জরায়ুতে বেবী স্থাপন করলে, সেই বেবী তার জরায়ু ক্যাপচার করতে পারবে না। তার কারণ ঐশীর হরমোনাল প্রবলেম আছে। বেবী পেটে এলে, তার জরায়ু সেই বেবি ক্যারি করতে পারবে না। শি ক্যান গেট অ্যা ম্যাজর মিসক্যারাজ। ”

জুভান বিস্মিত হলো। দাত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে ভাবনায় ডুব দিল। ঐশীকে নিজের কাছে আটকে রাখার একটাই উপায় ছিল, সেটা হলো একটা ফুটফুটে বাচ্চা! কিন্তু এবার সব আশায় ঝরঝর করে পানি গড়ালো। জুভান ক্ষুদ্রশ্বাস ফেলে বললো,
-” ওহ! এর কোনো ট্রিটমেন্ট আছে? ”
-” হ্যাঁ। আমি রিপোর্ট দেখে একটা প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়েছি। ওটা ফলো কর ছ মাস। তারপর দেখ কি হয়! আশা করি, ভালো রেজাল্ট আসবে। ”
-” ওকে, রাখছি তাহলে। ”
-” ওয়েট, জুভান। ”

জুভান ফোন আবার কানে ধরলো।
-” হু, বল। ”
-” জুভান আমি আবারও বলছি, তোরা কেনো ন্যাচারাল পদ্ধতিতে বেবি নিচ্ছিস না? আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, তুই ঐশীকে পছন্দ করিস। তাহলে হোয়াটস দ্য প্রবলেম, ম্যান? ”

জুভান দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ফোনের অপর পাশ থেকে হিয়ার স্পষ্ট মনে হলো, জুভানের কষ্টের পাল্লা। জুভান ভালো নেই, কথাটা মনে হতেই হিয়ার বুক ভার হলো। সে নিম্ন কণ্ঠে বলল
-” তুই ভালো আছিস তো, জুভান? ”

জুভান বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। বারান্দায় রাখা ইজি চেয়ারে গা হেলান দিল। মাথার উপর ধবধবে আকাশ। তার উপর গাঢ় মেঘের প্রলেপ। মেঘেরা একে অপরের সাথে লুকোচুরি খেলছে। আকাশ মেঘেদের এই দুষ্টুমিতে মিটমিটিয়ে হাসছে। জুভান মুচকি হাসলো। বললো
-” জানিস হিয়া, এই জুভান একবার যা চাইতো চোখের পলকে তাই পেয়ে যেত। যদি না পেত তবে আকাশ বাতাস দূষিত করে তা হাসিল করে নিত। কিন্তু জীবনের ছাব্বিশ বসন্ত পেরিয়ে যাওয়ার পর আমার মনে হলো, আমি বোধহয় এবার হেরেই গেলাম। মনেপ্রাণে যাকে আপন করে চাইলাম, তাকে আমি পেয়েও পেলাম না। কেনো পেলাম না, বলতে পারিস হিয়া? আমার ভালোবাসায় কি কোনো খুঁত ছিল? ”

হিয়ার মুখ মলিন হলো। সে বুঝতে পারলো জুভান কার কথা বলছে। সে বলল
-” কখনো বলেছিস তাকে, তোর মনের কথা? ”
-” নাহ, লাভ নেই বলে। সে মানবে না। আর আমি তাকে এক মিনিটের জন্যেই হারাতে পারব না। মরে যাবো রে আমি। ”
-” চেষ্টা না করে ই হার মেনে নিচ্ছিস জুভান? তুই তো এমন ছিলি না। ছোট থেকে বড় হওয়া অব্দি জয়টা সবসময় তুই-ই ছিনিয়ে নিতিস। তাহলে, এখন কি হলো? কেন এত সহজে হার মেনে নিচ্ছিস? ”

জুভান উঠে বসলো। একহাতে মাথার চুলগুলো খামচে ধরে মাথা নিচু করে বসে রইল। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকার পর বলে উঠলো,
-” আমি জানিনা! কিছু জানিনা আমি। সে যদি আমায় ফিরিয়ে দেয়, আমি শেষ হয়ে যাবো রে। এই হার আমি জীবনভর বয়ে বেড়াতে পারবো না। সম্ভব না আমার পক্ষে।”

-” জুভান, একবার চেষ্টা তো করে দেখ। তাকে এক ভীষন সুন্দর মুহূর্তে জানিয়ে দে, এই পৃথিবীতে কেউ একজন তাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। তার ভালোবাসার অভাবে সেই নির্দিষ্ট মানুষ ক্রমাগত ছটফটিয়ে মরছে। বলে ফেল, বুঝলি গাধা?”

জুভান ঠোঁট কামড়ে ভাবলো। কাজটা কি করা ঠিক হবে? ঐশী কি বিষয়টা ভালোভাবে নেবে?

-” আপনার কফি! ”
বারান্দার দরজা থেকে ঐশীর গলা পেয়ে জুভানের ধ্যানে পানি পড়লো। সে চমকে উঠে ঐশীর দিকে তাকালো। ঐশী ভ্রু কুঁচকে জুভানের দিকে চেয়ে আছে। সে কি কিছু শুনে ফেললো? জুভান গলা খ্যাকারি দিয়ে ফোন কেটে সোজা হয়ে বসলো। বললো,
-” ভেতরে আসো, ঐশী। ”

ঐশী ভেতরে প্রবেশ করে জুভানের পাশে বসলো। ঐশী চোখ মুখ উজ্জ্বল করে বললো,
-” কবিদের ভাষায় আজ নাকি মন খারাপের দিন। আজকের দিনে মন ভালো থাকা হলো পাপ, ঘোর পাপ। দিনমাফিক আমারও তাই ভীষন মন খারাপ! তাই ভাবলাম, একটু গল্প করি। বাসায় কেউ নেই, তাই আপনাকেই বেছে নিলাম গল্প করার জন্যে। এই নিন আপনার কফি। ”

ঐশী হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে চেয়ে জুভানের চোখটা যেন জুড়িয়েই গেল। আজ মন খারাপের দিন না হয়ে চোখ জোড়ানোর দিন হলে কেমন হতো? জুভান যদি কখনো কবি হয়, তাহলে সে আকাশ পাতাল মিথ্যে করে আজকের দিনকে মন খারাপের দিন বদলে চোখ জোড়ানোর দিন বানাবে।
জুভান নিজের ভাবনায় নিজে হেসে ফেলল। ঐশী কফির কাপ বাড়িয়ে চেয়ে আছে। জুভান মুচকি হেসে ঐশীর থেকে কফির কাপ হাতে নিল। কাপে চুমুক দিয়ে বললো,
-” ভালো করেছ। গল্প শুরু করো,আমি শুনছি। ”
-” ফোনে কাকে ভালোবাসার গল্প শুনাচ্ছিলেন? ”

ঐশীর সরু চোখে ঠোঁট টিপে বলা কথায় জুভানের বিষম লেগে গেল। কফির কাপটা পড়ে যেতে গেলে খপ করে ধরে ফেলল সে। মাথার উপর মস্ত আকাশ ভেঙে পড়ার মত বোধ হলো। দুবার খ্যাক খ্যাক করে কাশি দিতেই গলাটা বোধহয় জ্বলে উঠলো। ঐশী জুভানের পিঠে হাত মালিশ করে দুর্বোধ্য চোখে চেয়ে রইলো তার দিকে। হঠাৎ করে জুভানের এমন অসুস্থতায় সে চিন্তিত। সে কি অসুখওয়ালা কোনো কথা বললো? তার কথাতে কি অসুখ নামক বীজ বপন হলো জুভানের গলদেশে? ঐশী উত্তর পেলো না। মন খারাপটা যেন হুরহুর করে বেড়ে গেল। অসহায় হলো দৃষ্টিশক্তি!
জুভান নিজেকে সামলালো। অসহায় এবং বিমূড় অনুভূতির সংমিশ্রণ নিয়ে ঐশীর দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো,
-” তুমি কি সব শুনে নিয়েছ,ঐশী? ”

ঐশী দৃষ্টিসীমা সংকুচিত করলো। ধাম করে জুভানের পাশে বসে পড়লো। অতঃপর ঠোঁট চেপে ভ্রুতে ভাজ ফেলে বললো,
-” হ্যাঁ, শুনে নিয়েছি। ”
সর্বনাশ! জুভানের জিহ্বায় কামড় পড়লো।

#চলবে
অনেক বড় পর্ব দিয়েছি। দেরি করার জন্যে দুঃখিত! এখন থেকে রেগুলার হবো, ইন শা আল্লাহ!
সাইলেন্ট পাঠক রিয়েক্ট এবং গঠনমূলক মন্তব্য করবেন, প্লিজ!

লেখিকার পাঠকমহল,
আভার পাঠকঘর📚-stories of Ava Islam Ratri

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here