এক প্রহরের খেলা
৪||
ঘুম ভাঙ্গতেই নিজেকে অচেনা একটা ঘরে আবিস্কার করে রীতিমত আঁতকে উঠলাম। শুয়ে থেকেই মার্বেলের মত করে চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, নাহ এটা অন্য কোন ঘর নয়। এটা আমার নিজেরই ঘর। কিন্তু ঘরটা এমন অচেনা লাগছে কেন ! যেন এটা অন্য কারো ঘর। আমার দীর্ঘদিনের ব্যাচেলর ভাবটা একেবারেই উধাও হয়ে গেছে । কেসটা কী ! চোখ ঘুরিয়ে পায়ের দিকে স্থির করলাম। খাট বরাবর দেয়ালে মেরিলিন মনরোর একটা প্রমাণ সাইজের ছবি ছিল যেটা এখন নেই। মনরোর সেই বিখ্যাত লাস্যময়ী পোজের ছবিটা আমাকে নায়লা গিফট করেছিল। তার স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে আমি সেটাকে বাঁধিয়ে আমার রুমে লাগিয়ে ছিলাম। সেই পোস্টারটার জায়গায় এই মুহূর্তে শোভা পাচ্ছে পানতুমাই ঝরনার মনোরম একটা দৃশ্য । তার নিচেই ছোট্ট চৌপায়ার ওপর সুদৃশ্য ভাসে একঝাড় রজনীগন্ধা।
আস্তে করে উঠে বসলাম আমি। ঘাড় ফিরিয়ে পুরো ঘরটা দেখলাম। চারপাশ পুরোপুরি বদলে গেছে। কেমন অন্যরকম ঠেকছে ঘরটা। একটা সুখী সুখী ছবি বিরাজ করছে ঘরটার মধ্যে। জানালার গ্রামীন চেকের পর্দাগুলোর বদলে ক্রিম কালারের সাটিনের পর্দা ঝুলছে। টু সিটের সোফাটা খাটের পাশ থেকে সরে গিয়ে জানালার নিচে চলে গেছে। নতুন একটা ড্রেসিং টেবিল চলে এসেছে আমার রুমে যেটা আগে ছিল না। মাত্র একদিনেই ঘরটা কেমন মেয়েলি হয়ে গেছে। ঘরের মাঝখানে আমার এলোমেলো কাপড়ে জাবরা হয়ে থাকা হ্যাঙ্গারটা ঘরের এককোণে সেপাই এর মত অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছে। একপাশের দেয়ালটা লাইট অরেঞ্জ কালারের প্লাস্টিক পেইন্ট করানো হয়েছে। বাকি ঘরের রং আগেরটাই, লাইট রয়েল ব্লু। চমৎকার কনট্রাস্ট। নিজেকে হঠাৎ পথ হারিয়ে যাওয়া রাজপুত্র মনে হল আমার। যাকে আলাদীনের চেরাগের জিনি এনে এক অজানা জগতে রেখে গেছে । স্বীকার করতে বাধ্য হলাম যে চমৎকার ভাবে রি-ডেকোরেট করা হয়েছে ঘরটা। সত্যি বলতে, গতকাল সকালের ফেলে যাওয়া রুমটাকে খুঁজে পেতে কষ্টই হচ্ছে আমার।
এবার নতুন ভাবনা জুড়ল। একদিনের মধ্যেই আমার ঘরের এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কোনদিন যে আমাকে বদলে ফেলে তার আশঙ্কাই তো এখন জাগ্রত হয়ে উঠছে। গতকাল সকালে কোনমতে নাস্তা গুঁজে সেই যে বেরিয়েছি। ফিরেছি একেবারে গভীর রাতে। এই একদিনেই এত পরিবর্তন কিভাবে সম্ভব। আর কেনইবা এত আয়োজন। আস্তে ধীরেও তো করা যেত। আনমনেই মধু পাগলা স্টাইলে চুলে হাত বুলাতে গিয়ে কলিজাটা ছ্যাঁৎ করে উঠল আমার। পুরো মাথাটা হাতিয়ে দেখলাম আবার। নাহ্, চুলের কোন অস্তিত্বই নেই। ধড়ফড় করে হাঁচড়ে পাঁচড়ে বিছানা থেকে নেমে পড়িমড়ি করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আর নিজেকে আবিস্কার করলাম রাকেশ রোশন রূপে। আরেক দফা ভিরমি খেতে গিয়েও সামলে নিলাম এবার। কারণ কপালের কাছে টেকো উইগ আর আমার গৌরবর্ণ ত্বকের বৈসাদৃশ্য রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বুঝতে পেরে রেখা ধরেই টান মেরে উইগ খুলে ফেলতেই আমার সযত্নে লালিত কোঁকড়া চুলগুলো ঝাঁপিয়ে বেরিয়ে পড়ে আনন্দে হিল্লোলে উড়তে শুরু করে দিল ফুলস্পিড ফ্যানের বাতাসে। উইগটা আছড়ে মাটিতে ফেললাম। কাজটা কার বুঝতে সমস্যা হলো না। এটা নিশ্চয়ই ঐ বকবকের রানীর কাজ। হাসব না রাগ করব বুঝতে পারছিলাম না। তার সাথে আমার সম্পর্ক এতটাও সহজ হয়নি যে আমাকে ভয় দেখানোর জন্য সে আমার মাথায় উইগ পরিয়ে দিতে পারে । কোমড়ে দু ‘ হাত রেখেই চেঁচিয়ে ঘর ফাটাবার যোগাড় করলাম।
-” প্রীতিইই….? প্রীত…..! ” রুমকি কে ঘরে ঢুকতে দেখেই মাঝপথে থেমে গেলাম। যতটা না রাগ লাগছে তারচে বেশী বহিঃপ্রকাশ দেখানোর নিমিত্তে আলগা ঝাড়ি দিয়ে প্রশ্ন করলাম, ” ঘরের মধ্যে এসব কী ? আমার পোস্টার খুলেছ কেন ? আর আমার মাথায় উইগ পরিয়েছে কে? হ্যাঁ…? ”
-” উইগ মানে ? এটার ব্যপারে তো আমি কিছু জানি না। তবে ঘরের ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন যেটা দেখছেন এটা আমার করা। গতকাল সারাদিন প্রীতিকে সাথে নিয়ে সব আমি করেছি। পোস্টার খুলেছি দুটো কারণে। প্রথমত আপনি এখন ব্যাচেলর নন। রীতিমত বিবাহিত একজন পুরুষ। শিশুর ঘরে দোলনা মানালেও বালকের ঘরে যে মানায় না এটা বোঝার বুদ্ধি নিশ্চয়ই আপনার আছে। দ্বিতীয় কারণ হলো ঘরে ছবি পুতুল বা প্রাণীর প্রতিকৃতি থাকলে রহমতের ফেরেস্তা প্রবেশ করেন না। এজন্য ওটা সরিয়েছি। কিন্তু এজন্য চেঁচাতে হবে কেন ? ” রুমকি শান্ত ভঙ্গিতে কথাগুলো বললেও তাতে যথেষ্ট দৃঢ়তা ছিল। শুনে আমি প্রায় মিইয়েই যাচ্ছিলাম। তার উপর রুমকিকে অমন ঘরোয়া রূপে হজম করতে কষ্ট হচ্ছিল। কখনো সখনো আম্মু বা প্রীতিকে এই রূপে দেখলেও সেটা সাময়িক। কারণ আম্মু সচরাচর এমন রূপে আমার বাবা ছাড়া আমাদের সামনে তেমন আসতেন না। পরিপাটি হয়েই আসতেন আর প্রীতি এলেও বিসদৃশ কিছু চোখে পড়েনি। কিন্তু এই মেয়েটাকে গোসলের পরপর একেবারেই অন্যরকম ঠেকছে। তার ভেজা চুলের কারনে পিঠ ভিজে যাচ্ছে সে খেয়াল কী ওর আছে ? সে আমার সাথে কথা বলতে বলতেই চুল থেকে তোয়ালে টেনে হাতে নিয়ে নিয়েছে। তাতেই আংশিক শরীর ভয়াবহ ভাবে ভিজে গিয়ে চড়াই উৎরাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আচ্ছা, নায়লাকেও কী গোসলের পর এমনই স্নিগ্ধ দেখায় ? নায়লার কথা মনে আসতেই চট করে রাগের পারদ দুই ডিগ্রী চড়ে গেল আমার। রাগ না চড়িয়েও উপায় নেই। খাদের কিনারায় চলে যাচ্ছি বারবার। পা স্লিপ করে পস্তাতে চাই না। নায়লা জানলে আমাকে খুনই করে ফেলবে। রেগে বললাম,
-” শোনো, এটা আমার ঘর। এই ঘরের কোনো কিছু ডান বাম করতে হলে আমাকে না জিজ্ঞেস করে করবে না। কারণ এটা আমার রুম, আমার রুচি পছন্দমতই সাজবে। আজই সোফা ঐ দেয়াল থেকে সরিয়ে এই দেয়ালে আনবে। যেটা যেখানে ছিল সেটা সেখানে দিয়ে দেবে। আমার রুম আগের মত চাই। মাত্র দু’দিন হয় এসেছ আর এসেই ছড়ি ঘোরানো শুরু করেছে। এসব চলবে না।” বেশ রূঢ়ভাবে কথাগুলো বললাম।
মেয়েটা আহত চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ” আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন ? আমার কী অধিকার নেই এই রুমের সাজসজ্জা করার ? তাছাড়া আমি তো এমনি এমনি এগুলো করিনি। কারণ ছিল এসব করার।”
-” কারণ যাই হোক, সেটা আমার দেখার বিষয় না। আমার জীবনে অযাচিত দখল দেবার চেষ্টা করবে না প্লিজ। আমি তোমাকে অত্যন্ত ভদ্রভাবে বলছি, এভাবে আমাকে বদলে চেষ্টা করে কোন লাভই হবে না। অযথাই পন্ডশ্রম হবে !”
-” আমি আপনাকে বদলে দেবার কোন চেষ্টাই করিনি আর করবও না। কিন্তু এটা তো মানবেন যে সময়েরও নিজস্ব একটা দাবী থাকে। বিশেষ প্রয়োজনেই আজ এসব করতে বাধ্য হয়েছি। আমার কী এতটুকুও অধিকার নেই ?” বলতে গিয়ে হয়ত মেয়েটার গলা সামান্য ভারী হয়ে থাকবে। নাকি আমার কান ভারী হয়েছে কে জানে। তাৎক্ষণিকভাবে কোন জবাব দিতে পারলাম না। হঠাৎই মনে হতে লাগল নায়লা আমাকে পেছন থেকে ঠেলছে আর বলছে, বল না ঋভূ বল। এই মেয়ের নরম কথায় পরম হয়ে যাইস না। বি রুড।
গম্ভীর মুখে বললাম, ” অধিকার অনধিকারের প্রশ্ন না। তোমার ঘর সাজানো আমার মোটেও পছন্দ হয়নি। মেরিলিন মনরোর পোস্টারটা আমার এক বন্ধু আমাকে গিফট করেছিল। বন্ধু মানে বেস্ট ফ্রেন্ড এবং সে আমার গার্লফ্রেন্ড। তোমার যেমন বয়ফ্রেন্ড ছিল , আমারও তেমন গার্লফ্রেন্ড ছিল মানে আ…আছে ! আর আমি তাকে এখনও ত্যাগ করিনি। কাজেই তুমি চাইলেই তাকে আমার রুম থেকে তাড়িয়ে দিতে পারনা।” কিছুটা ইতস্তত করে অবশেষে বলেই ফেললাম। ভেবেছিলাম মেয়েটা আঁতকে উঠবে। কিন্তু সেরকম কিছু হলো না। বরং সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেজা চুলগুলো তোয়ালের জোরে একপাশে টেনে এনে সেগুলো মুছতে মুছতে শান্ত স্বরে বলল, ” আমি জানি।”
-” জানো মানে ? কিভাবে ? ”
-” আমাকে যতটা বোকা ভেবেছেন আমি ততটা বোকা নই। হয়ত আপনার আর আপনার গার্লফ্রেন্ডের মত অত বিদুষী নই কিন্তু এটুকু বোঝার বুদ্ধি আছে যে, অপ্রাসঙ্গিকভাবে কোন বন্ধুর সমাধান চাইতে আপনি বিয়ের রাতেই ওসব বলেন নি। সে রাতে আপনি আপনার যে বন্ধুটার কথা আমাকে বলেছিলেন, সেটা যে আপনার কোন বন্ধু নয় আপনি নিজে আর অপছন্দের পাত্রীটা যে আমি এটা বুঝতে আমাকে খুব বেশী বেগ পেতে হয়নি। তার উপর আপনার আম্মু গতকাল সারাদিনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জানতে চাইছিলেন আপনি আমার সাথে ঠিকমত কথা বলেছিলেন কি না, মিস বিহেভ করেছেন কিনা, এসব। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে আমি ধরে নিয়েছি হয়ত আপনাকে একরকম বিপাকে ফেলেই স্বাক্ষর করানো হয়েছে। আপনি আসলে অন্য কোথাও এনগেজড। ” বলে মেয়েটা থেমে গেল।
আমি ক্ষীণ আশার আলো দেখতে পেয়ে বললাম, ” যাক্, নায়লার ভাষ্যমতে তুমি তাহলে গবেট নও। সে তো ভেবেছে তুমি ধরতে পারো নি। যাই হোক, তোমার ধারণা সম্পূর্ণ সত্যি। আমি নায়লা নামের একটা মেয়েকে ভালোবাসি। গত চার বছর ধরে আমাদের সম্পর্ক । আমি ওকেই বিয়ে করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু মাঝখানে আপান সব এলোমেলো করে দিল।” কিছুটা অসাঢ় ভঙ্গিতে চেয়ে রইল রুমকি। কী বলবে হয়ত ভেবে পাচ্ছে না। আমি কিছু বলতে যাবার আগেই সে মুখ খুলল।
-” আপান এলোমেলো করে দেয়নি বরং আপনাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। ” বলে ম্লান হাসল মেয়েটা। ওর চেহারায় বেদনার ছায়া স্পষ্ট। হাসিতেও বিষন্নতা। যার ফলে কর্তন দাঁতটা দেখা হল না।” চার বছর ধরে একজনকে ভালবাসেন অথচ বিয়ে করার সময় পান নি। তখন বিয়ে করে নিলে তো আজ আপনাকে আমার গলায় মালা ঝুলাতে হত না। আমিও নিজের মত করে বাঁচতে পারতাম।”
আমি দমে না গিয়ে সমান রূঢ়ভাবে বলে চললাম, ” নিজেকে এতটা ইমপরটেন্ট ভাবার কোন কারণ নেই। আমাকে বিয়ে করে তুমি মরে গেছ আর আমি কী খুব বেঁচে গেছি ? তুমি কী জানো, গত চারটা দিন ধরে কত অশান্তিতে দিন কাটছে আমার ? একদিকে নায়লার রাগ জেদ কান্না আর অন্যদিকে তোমার নীতিবাক্য আমাকে পাগল করে ফেলছে। আমি বুঝতেই পারছিনা আমি কী করব। কিন্তু আমি তোমাকে ঠকাতে চাইনা বলেই প্রথম রাতেই কথাটা বারবার বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তুমি এত বকবক করছিলে যে বাধ্য হয়ে আমাকে অন্য ভাবে বলতে হয়েছে।” বিরক্তির সুরে কথাগুলো বলে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।
মেয়েটার ব্যথিত মুখ দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এমনিতেও আমি কাউকে আঘাত করে কথা বলায় অভ্যস্ত নই। রিক্সাওয়ালারা মলিন মুখ করে পাঁচটাকা বাড়িয়ে দিতে বললে কখনও না করতে পারিনা। এখন রুমকির ঐ ছলছল চোখ দেখলে যে মনটা নির্ঘাত মিউমিউ করবে এটা জানি বলেই আমাকে চেষ্টাকৃত গাম্ভীর্য বজায় রাখতে হচ্ছে। আর এটা যে প্রেম না সেটা এই বোকা মেয়ে হয়ত বুঝবেই না। সে আমার নরম স্বভাবকে প্রেম ধরে নিয়েই সামনে এগোবে আর ভাববে আমাকে বাগে এনে ফেলেছে। সেসব ভেবেই কথাগুলো এভাবে বলা। এছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই ওকে সচেতন করার। তবে এতটা রুঢ় বোধহয় না হলেও পারতাম। একদিনে একটু বেশীই হয়ে গেল হয়ত। কিভাবে ব্যপারটাকে সহজ করা যায় ভাবতে ভাবতে ঘাড় ফেরাতেই দেখলাম রুমকি নেই। বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে। পুরোনো আশঙ্কা জেগে উঠল মনে। নিচে গিয়ে কিছু বলে দেবে না তো। দ্রুত বাথরুমে ঢুকে পড়লাম। আগে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামি। তারপর সুযোগ বুঝে কিছু কথা বলে মেয়েটাকে হাত করতে হবে। নায়লার কথামত ওর সাথে মিসবিহেভ করলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
নিচে নামতেই দ্বিতীয় দফার বিস্ময় ধাক্কা মারল আমাকে। পুরো বাড়ীতেই সাজ সাজ রব। ড্রইংরুমের সোফার কভার থেকে শুরু করে দরজা জানালার পর্দা সবই বদলানো হয়েছে। এবার সত্যিই ভাবনায় পড়লাম। হচ্ছে কী এ বাড়ীতে।
নাস্তার টেবিলে আম্মু নিজেই জানালেন যে, আজ প্রীতিকে দেখতে বরপক্ষ আসবে। শুনে রীতিমত হতভম্ব বনে গেলাম আমি। আচ্ছা, তাহলে এই ব্যপার। ইস, অযথাই না বুঝে মেয়েটাকে…!
-” হঠাৎ ? কবে এল এই সমন্ধ ? এত হুট করেই বা মেয়ে দেখতে আসছে কেন ? ” বুকের ভেতর জাগতে চাওয়া আফসোসটাকে গলা টিপে হত্যা করে নিরুদ্বেগে প্রশ্ন করলাম। বলেছি বলেছিই সই। এত আফসোসের কী আছে। বি এ ম্যান ঋভূ। নিজেকে সান্তনা দিয়ে নাস্তার প্লেট টেনে নিলাম।
-” আরে, ছেলেটা আমাদের আবির। তোর মজনু মামার মেজ ছেলে। মজনু মামাকে মনে আছে না, আমার বড় খালার ছেলে? ”
আমি মাথা নাড়লাম।
আম্মু বলে চললেন, ” আবির মজনু মামার মেজ ছেলে। ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়াশোনা করছে। তোর মজনু মামা যে বাহরাইন থাকে তা তো জানিসই। উনি সামনের সপ্তাহেই ছুটি শেষে বাহরাইন ফিরে যাচ্ছেন। তো গতকাল দুপুর বারোটার দিকে হঠাৎ উনি ফোন দিয়ে বললেন, যাবার আগে আমার সাথে একটা নাাকি কী একটা জরুরী বিষয়ে কথা বলতে চান। আমি সরাসরিই জানতে চাইলাম, কী বিষয়ে ! উনিও বলে দিলেন তোমার প্রীতির ব্যপারে কথা বলব। আমি তো তখনই বুঝে ফেলেছি। তাই আসতে বলে দিলাম।”
-” এত তাড়াহুড়ার কী ছিল? ” খেতে খেতেই বললাম।
-” তাড়াহুড়া কোথায়? ভাল প্রস্তাব আসলে ফিরিয়ে দেব নাকি?”
আমি আর জবাব দিলাম না। আম্মু তার স্বপ্নজাল বুনেই চলেছেন।
-” আমার কী ধারণা জানিস ? আমার মনে হয় উনি হয়ত আজ এসে বিয়ের প্রস্তাবই দিয়ে বসবেন। আমরা রাজী হলে হয়ত বিয়ের ব্যপারে সব রকমের কথা বলবেন। আমি তোর বাবাকে বললাম, মামা যদি আবিরকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেয় তাহলে মানা করার দরকার নেই। ছেলে আমাদের জানাশোনার মধ্যে আছে। তাছাড়া মজনু মামা মানুষ খুব ভাল। মামীও তো চমৎকার। কাজেই না করব কেন। ওনার ফোন রাখার পরই তো আমরা হুলুস্থুল করে বাড়ীঘর গোছালাম। তবে তোর বউটা বেশ কাজের রে..! একদিনেই ও পুরো বাড়ীর ভোলই পাল্টে দিয়েছে। প্লাস্টিক পেইন্ট এনে নিজের হাতে তোর রুমের একপাশের দেয়ালটা ব্রাশ পেইন্ট করেছে। ও বলে, যদি মামীরা আমাদের রুম দেখতে চায়, তাহলে ওদের কী দেখাব। এরকম আস্তাবল দেখলে ওরা কী ভাববে বলেন তো মা ! ”
-” আমার রুম তার কাছে আস্তাবল মনে হয়েছে ? ” খাওয়া থামিয়ে জানতে চাইলাম। শুনে মা হেসে দিলেন।
আমিও আর কথা না বাড়িয়ে নিঃশব্দে নাস্তা শেষ করে উঠে এলাম। আসার পথে দেখলাম রুমকি প্রীতির সাথে কথা বলছে। তবে আমাকে পাশ দিয়ে যেতে দেখেও সে ফিরে তাকায়নি। তার মানে সকালের কথাগুলো মহাশয়ার গায়ে লেগেছে । যাক্, এখন বাসায় বলে না দিলেই ভাল। তবে বলবে বলে মনে হয় না। আজ প্রীতির একটা অনুষ্ঠান। সে নিশ্চয়ই এসব বলে অনুষ্ঠানটা পন্ড করতে চাইবে না। দেখি সুযোগ পেলে ভুজুং ভাজুং কিছু একটা বুঝিয়ে আপাতত কাউকে বলতে মানা করে দিব।
====
যথাসময়ে মজনু মামারা চলে এলেন। বাবা সাত সকালেই গুরু গম্ভীর চালে আমাকেও বাইরে যেতে নিষেধ করে দিয়েছেন। শুধু নিষেধ করেই ক্ষান্ত হন নি। আমি যে একটা চলমান অপদার্থ আর আমার রুমকির কাছ থেকে কিছু শেখা উচিত সেই নসীহতও ঝেড়ে দিয়েছেন। রুমকি সামনেই ছিল। কিন্তু সে ছিল যথারীতি গম্ভীর। ভাব করেছে যেন শোনেইনি।
ফলে আমাকে নিজ দায়িত্বেই বাড়ীতে থাকতে হয়েছে আর সারাদিন রুমকীর গম্ভীর মুখ দেখতে হয়েছে। সে সবার সাথে হাসিখুশি। আমার সামনে এলেই মুখটা গম্ভীর করে ফেলছে। আমিও পাত্তা দিলাম না। মনে মনে বললাম, অফ যাও। এসব ভাব অন্যখানে দেখাও গিয়ে।
মজনু মামা আজ তার পুরো পরিবার নিয়ে এসেছেন, কেবল আবির বাদে। মামার সাথে তার শ্যালক রিয়াজ আঙ্কেল আর তার ওয়াইফ রুনা আন্টিও এসেছেন। প্রাথমিক আলাপের পরেই আম্মা আমার হাত ধরে টেনে রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে বললেন, ” তোর মজনু মামা তো আজই আংটি পড়িয়ে যেতে চাচ্ছে। কী করব ? ”
-” বাবার সাথে কথা বল। আমি আর কী বলব? ”
-” তুই হলি ঘরের বড় ছেলে। সময় মত পরামর্শ দিতে পারিস না তো বড় হইছিস কোন কাজে? ” আম্মু এটা বলার পরপরই রুমকি পাশ থেকে বলে উঠল, ” মা, আপনাদের যদি আবিরের ব্যপারে মনে কোন দ্বিধা না থাকে তাহলে মামা যেভাবে চায় সেভাবেই রাজী হয়ে যান। তবে আংটি পড়িয়ে রাখাটা রিস্কি। এতে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে। খুব ভাল হয় আকদ করে ফেললে। ওনারা চাইলে সামনের সপ্তাহের আগেই এটা হতে পারে। পরে প্রীতির পরীক্ষার পর নাহয় তুলে নিলেন।”
-” ভালোই বলেছ মা। আমার ছেলেটার মাথায় যদি এতটুকু বুদ্ধি থাকত। এখন থেকে তোমার মাথার কিছু কিছু বুদ্ধি ওর মাথায় ভরে দিও তো মা। ” বলে মা হেসে ড্রইংরুমে চলে গেলেন। আমি নিজের চাপা রাগটা প্রকাশ করলাম রুমকির উপর তীর্যক দৃষ্টি ফেলে।
একটু পরেই মজনু মামার শ্যালিকা রুনা আন্টি সহ আরেকজন মহিলাকে নিয়ে আম্মা দোতলায় উঠলেন। আমি তখন নিজের রুমেই ছিলাম। তাদের দেখে সরে আসার মুহূর্তেই শুনলাম রুনা আন্টি রুমকির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছেন। তাদের কথা শুনে চলে আসতে গিয়েও পায়ের গতি স্লথ হয়ে এল আমার। রুনা আন্টি বলছেন, ” ইস, কী ভাল একটা মেয়ে পেয়েছেন বেলা আপা। আমি তো প্রথমে ওকে প্রীতির বান্ধবী ভেবে আমার ছেলেটার জন্য মনে মনে ভেবে বসেছিলাম। পরে জানলাম ও আপনার ঋভূর বউ। কী সৌভাগ্য ঋভূর। অমন চৌকস মেয়ে এই বাজারে পাওয়া সত্যিই কঠিন। আচ্ছা, ওর কোন বোন টোন নেই…?”
এ পর্যন্ত শুনেই সরে এলাম। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়েই মুখোমুখি হয়ে গেলাম রুমকির। আমাকে দেখেই চোখ নামিয়ে মুখের হাসি মুছে ফেলল মেয়েটা । নাহ্, মেয়েটাকে বোধহয় বেশীই দুঃখ দিয়ে ফেলেছি। আমি আসলেই বোকা। নিরেট বুদ্ধু। নইলে যে কাজ আপোসে রফা করা যেত সেটা নায়লার মেয়েলী বুদ্ধিতে এভাবে বিগড়ানো মোটেই উচিত হয়নি আমার । তারচে রুমকির সাথে সহজ ভাবেই জিনিসটা সর্ট আউট করা যেত। খামোকাই বাগাড়ম্বর হয়ে গেল। আমি আসলেই গাধা। ছোটখাট না, বড় ধরণের গাধা।
চলবে….