এক_প্রহরের_খেলা মোর্শেদা হোসেন রুবি ৩||

এক_প্রহরের_খেলা
মোর্শেদা হোসেন রুবি

৩||
-” আপনার প্রতি আমার একটা অনুরোধ থাকবে ।”
গলায় এক অন্য ধরণের আকুলতা। বিচিত্র চাউনি। চোখে চোখ রাখব না, শর্তটা মনের ভেতরেই আছড়ে ভাঙ্গলাম। কোন প্রশ্ন করলাম না। কেন বলতে পারব না, তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগছে আমার। চিরাচরিত নারী সত্ত্বারই পরাজয় হল। রুমকি চোখ নামিয়ে নিল সংকোচে নতুবা লজ্জায়। ঠিক জানি না। তবে এটা তার পরাজয় না জয় তা সময়ই বলে দেবে। আপাতত আমি চিরন্তন পুরুষসত্ত্বার একচেটিয়া সম্পত্তি থেকে কিছু নির্লজ্জতা খরচ করলাম। চোখকে মুক্ত করে দিলাম স্বাধীন বিচরণের জন্য। রুমকি অস্বস্তি মাখা সুরে বলল,
-” বলতে চাই যে, আপনি যেন কখনও এমন কোন কথা বলবেন না যে কথায় আমাদের বিয়ে ভেঙ্গে যায়।”
জবাব দিলাম না। কারণ জবাব দেবার মত কিছু খুঁজে পেলাম না। বিয়ে ভাঙ্গার চিন্তা এই মেয়ের মাথায় এল কেন হঠাৎ সেটাই ভাবছি। রুমকি বলে চলল,
-” যদি কখনও এমন হয় আমার কোন আচরণে আপনি রেগে গেছেন তাহলে সেটার কারণ আমাকে অবশ্যই জানাবেন, আমার দোষ হলে আমি শুধরে নেব। আর আমার কিছু বলার থাকলে সেটা ব্যখ্যা করার সুযোগও আমাকে দেবেন। কিন্তু কোনদিন ঠাট্টা করেও বলবেন না যে, আমি তোমার সাথে থাকব না বা তোমার সাথে সংসার করব না কিংবা এই জাতীয় কোন বাক্য। এগুলো বৈবাহিক সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেয়।”

-” শুধু মুখের কথাতেই বিচ্ছেদ ? সেদিন কাগজে সই করলাম যে! এর কী মূল্য তাহলে ?” ঠিক প্রশ্ন নয় তবে সতর্কতার সঙ্গে বললাম। মনে মনে খানিক বিস্মিত হলাম। কিছুটা হয়ত আশাবাদীও। ভাবছি, আমি “গেট আউট” বললেই সম্পর্কচ্ছেদ ঘটবে ? রিয়েলি ? ঔৎসুক্য নিয়ে চেয়ে রইলাম ইমাম সাহেবের মেয়ের মুখ থেকে নতুন কোন ফতোয়া শুনব এই আশায়। রুমকি মৃদু স্বরে বলল-

-” মুখের কথাতেই সব হয়। ধর্মান্তরিত হওয়া বলুন চায় কাউকে বিয়ে করা। ব্যাক্তির মৌখিক স্বীকারোক্তিটাই আসল। ধরুন আপনার মনে মনে ইচ্ছে নেই বিয়ে করার বা বিচ্ছেদ ঘটানোর। সেক্ষেত্রে আপনার মুখ দিয়ে কবুল কিংবা এর বিপরীতটা বলানো কঠিন হবে। কারণ মুখ তো মনের কথাই বলে। মৌখিক স্বীকারোক্তির মূল্য সর্বত্র। কাগজটা তো সেটাকে প্রমাণ করে যেন সে পরে কথা বদলাতে না পারে কিন্তু স্বীকারোক্তি তো সবসময় মুখেরই। তাই…!” থেমে গেল রুমকি।
আমি নিরব বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম। ভাবতে চেষ্টা করছি। কত বয়স হবে মেয়েটার ? জীবন সম্পর্কে এত গভীর জ্ঞান এরই মধ্যে সে রপ্ত করে নিয়েছে কিভাবে । মেয়েটা আবার বলল।

-” দোষ দুজনের যারই হোক সেটা নিয়ে আমরা আলোচনা করব তবু ঐ ধরনের বাজে কথায় আমরা যাব না। ঠিক আছে ? আমি চাই আমার দাম্পত্যটা একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে যাক। প্রতিযোগীতার মধ্য দিয়ে না। কারণ প্রতিযোগীতা হয় সমান দুজনের মধ্যে। অসম দুজনের মধ্যে কখনও প্রতিযোগীতা হয়না। কারণ খুঁজলে দেখা যাবে কিছু জিনিসে আপনারা সেরা, কিছু জিনিসে আমরা। আমি মনে করি, প্রতিযোগীতার কনসেপ্টটা এখানে অচল। ”

-” ঠিক এই কথাগুলোই তোমার মনে কেন আসছে জানতে পারি ? ” মেয়েটার মনোভাব বুঝতে চাইলাম। সে কী ভাবছে তা আমার জানা প্রয়োজন।

-” না, মানে। আমাদের বিয়েটা যেভাবে হয়েছে তাতে আপনি বা আমি নিজেদের স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ পাইনি। তবে আমি কিন্তু স্বেচ্ছায় কবুল বলেছি। ”

-” আর আমি অনিচ্ছায়। ” মনে মনে বললাম কথাটা। মুখে কিছু বললাম না।
ভেবে রাখা সমস্ত কথা দমকা হাওয়ার সাথে মাথার উপর ঘুর্ণি পাকাচ্ছে। এক মন বলছে, বলে ফেলি নিজের সমস্ত কথা। যা হয় হোক। আরেক মন বলছে, এত অস্থির হবার কী আছে। মন চায় বা না চায় বিয়ে তো হয়েই গেছে। আর বিচ্ছেদ , সেটাতো যে কোন সময় ঘটানো সম্ভব। তাড়াহুড়া করে পরিস্থিতি বিগড়ে লাভ কী। অযথা ঝামেলা বাড়বে। সযত্নে চেপে গেলাম যা বলতে চেয়েছিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম আপাতত দু একদিন অপেক্ষা করব। তারপর মেয়েটার সাথেই পরামর্শ করব কী করা যায়। যতদুর বোঝা যাচ্ছে মেয়েটার মাথায় ঘিলু আছে কাজেই সে আমার জন্য ভাল পরামর্শদাতা হলেও হতে পারে। দেখাই যাক না। অন্তত সম্পর্কটা যেন সুন্দরভাবেই শেষ হয় সেই চেষ্টাই থাকবে আমার। খামোকা এটা সেটা বলে ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কী।

===

অনেকদিন লেকের পাড়ে বসা হয়না। আগে নিয়মিত বসতাম এখানে। ঝিলের শান্ত পানি আর তাতে কৃষ্ণচূড়ার ঝুঁকে পড়া ডালে ডাহুকের ছায়া দেখে পার করে দিতাম এক বেলা। বাদামের খোসার সাথে উড়ে যেত আমাদের ভেতরকার অযাচিত উদ্বেগ আর নিত্য জমে থাকা অভিমানগুলো।
আজ সব আছে। সেই নিটোল দীঘি, তার বুকে জমে থাকা শান্ত পীতাভ জল, ঝুঁকে থাকা কৃষ্ণচূড়া আর তার ডালে বিরামহীন ডেকে চলা ঘুঘু। দীঘির জলে আমার ছায়া। আধখাওয়া বাদাম আর তার উড়ন্ত খোসা। কিন্তু সেগুলো একাই আজ বাতাসে উড়ে যাচ্ছে। আমাদের অভিমান গুলোকে সাথে নিয়ে যাচ্ছে না। দুজনে পাশাপাশি বসে আছি অথচ নিরুত্তাপ একটা সময় কাটছে।
নায়লা আজও একচোট কেঁদেছে এখানে বসে। আমাকে ইচ্ছেমত কথা শুনিয়েছে। ভেড়া গরু ছাগল থেকে শুরু করে নার্সারী ক্লাসে শেখা দশটা গৃহপালিত পশুর নামের সবগুলো আউড়েছে। সাথে ভুলে একটা হিংস্র ক্যাটাগরির পশুর নামও ঢুকিয়ে দিয়েছিল । তবু আমি কোন প্রতিবাদ করিনি। কেবল বসে বসে গুনেছি কয়টা গৃহপালিত পশুর গুনাগুন আমার মাঝে আছে। তবে অজগর সাপ বলায় প্রতিবাদ করেছি। অজগরের কী বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে আমার বুঝিনি বলে।
আমার প্রতিবাদ শুনে নায়লা তখনই এ্যানাকন্ডার দীর্ঘশ্বাস রূপী ফোঁস শব্দে বলেছে, আমি নাকি অজগরের মত হরিণ গিলে সাতদিন মড়ার মত পড়ে থাকতে পারি। নামকরণে স্বার্থকতা পেয়ে যাবার পর আর কিছু বলিনি। সত্যিই তো, কী বলব আমি। নায়লার ভালবাসা গিলে খেয়ে গত চারদিন ধরে আমি কুন্ডুলী পাকিয়ে শুয়ে আছি কথাটা তো একেবারে মিথ্যে নয়। কিন্তু কী করার আছে আমার। গতরাতে যদি রুমকিকে সব বলে দিতাম তাহলে রুমকি সকাল হলেই বাসা ছাড়ত। কারণ তার মতে এতে নাকি বিবাহিত সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়। কী আজব কথা। জীবনে কত ঝগড়া দেখেছি যেখানে স্বামীরা তাদের স্ত্রী’কে অন্তত একশ বার বলছে, তোমার ভাত খাব না, তোমারে আর রাখব না, বের হ বাড়ী থেকে, যা তোরে ছাইড়া দিলাম… এসব কথা তো অহরহ। আমার বাপই তো রাগ উঠলে একশ বার আমার মা’কে দরজা দেখিয়ে বলে, দরজা খোলা আছে কোন চুলোয় যাবে যাও। কই তাদের তো বিয়ে ভাঙ্গেনি। আর আমি যদি রুমকি কে বলি, ” শোনো রুমকি, আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসি তাই তোমার সাথে আমার সংসার করা সম্ভব না। তোমাকে কিছুদিন পর এখান থেকে চলে যেতে হবে। আপাতত পরিস্থিতিটা সামলে নেই তারপর আমরা একটা সিদ্ধান্তে আসব। ততদিন তুমি সামাজিক ভাবে এ বাড়ীর বউ হয়ে থাকলেও, আমার আসল বউ হলো নায়লা। তুমি নও। তোমাকে আমি ভালবাসি না তাই তোমার সাথে সংসার করব না।” এই কথাটা যদি আমি বলি, তাহলেই কী আমার সংসার ভেঙ্গে যাবে ? কী অদ্ভুত কথা।

বিরক্তির সাথে আনমনেই ঝিলের শান্ত পানিতে একটা ঢিল ছুঁড়ে মারলাম। আর মুগ্ধ নয়নে দেখলাম তার বুকে জেগে ওঠা তরঙ্গ নিঃশব্দে মিলিয়ে যেতে । আহ্, জীবনের সমস্যা গুলো যদি ঐ ছোট ছোট তরঙ্গের মত এমন করেই মিলিয়ে যেত। কতই না ভাল হত।

-” কী ব্যপার ? মুখে তালা মেরে রেখেছ কেন ? আমরা কী এখানে মৌণব্রত পালন করতে এসেছি না কি কথা বলতে এসেছি ? ” রাগত স্বরে বলে উঠল নায়লা।

সামান্য নড়েচড়ে উঠে বললাম, ” মুখে তালা মেরে রাখলাম কই। তুমিই তো রিপ্লাই দিচ্ছো না।”

-” কী রিপ্লাই দেব আমি ? এটা কী রিপ্লাই দেবার মত কোন প্রশ্ন ? ”

-” মানে ? ‘আমি এখন কী করব’ , এই প্রশ্নটা কী তোমার কাছে অবান্তর মনে হচ্ছে ? তোমার কাছে এটা বলার মানে কী ? তুমি আমাকে সময়োপযোগী একটা পরামর্শ দেবে, এজন্যেই তো। নাকি? ” রাগ হয়ে গেল আমার। এমনিতেই তো নিজের জ্বালায় বাঁচিনা এর মধ্য নায়লার রাগারাগি। বেশ বিরক্তই লাগছে। কিন্তু বিরক্তিটা ঠিক কী কারণে বা কার উপর সেটা ধরতে পারছি না।

-” জানি না। আমার মাথায় কোন পরামর্শ আসছে না। আমি কিচ্ছু জানি না এ ব্যপারে। তুমি বিয়ে করসো, তুমি জানো। আমি কী জানি ? ” চরম বিরক্তি নিয়ে কথাগুলো বলে সানগ্লাস ঠেলে মাথায় তুলে দিল নায়লা। তার মুখ আসলেই বিরক্তিতে কুঁচকে গেছে। এটা দেখে আমার বিরক্তি আরো বাড়ল এবার। এমনিতে আমি নিজেও কম বিরক্ত না। চারিদিকে কোন কূল কিনারাই দেখতে পাচ্ছি না। তার উপর গতকাল রাতে একফোঁটা ঘুমাই নি।
মেয়েটার সাথে গল্প করতে গিয়েই রাত পার। মেয়েটা আমার সাথে এত কথা বলেছে যে আমি ওকে বাঁধা দিতে পারিনি। নিজের এ যাবৎ কালের যাবতীয় হিস্ট্রির অর্ধেক সে শুনিয়ে ফেলেছে আমাকে। ওর কথা বলার ভঙ্গিতে মনে হচ্ছিল যেন আমরা কত কালের চেনা জানা বন্ধু।
দুজনের আলোচনা পাল্টা আলোচনা কথোপকথনের পর্ব পেরিয়ে কখন যে আড্ডায় রূপ নিয়েছে টেরই পাইনি। ওকে বাঁধা দেব কী, উল্টো সোফা ছেড়ে বিছানায় এসে মাথার বালিশ কোলে নিয়ে আয়েশ করে বসেছি। আর মেয়েটাও দাড়ি কমা ছাড়া ননস্টপ বকবক করে যাচ্ছিল। একটার লেজ দিয়ে আরেকটার গল্প বানাচ্ছিল সে। শুনতে গিয়ে আমারও মনে হচ্ছিল মন্দ কী, আড্ডা চলুক না। মজাই তো লাগছে। এমনিতেও ঘুম আসছে না। তার উপর খাটে আজ আমার সাথে মেয়েটাও দখল নেবে, এই ব্যপারটাই অস্বস্তি লাগছিল বেশী । কেবলি মনে হচ্ছিল নায়লাকে ঠকাচ্ছি। তারচে বসে বসে আড্ডা মারছি এটাই তো ভাল। যার ফলে আর বাধা দেই নি ওকে।
আমাদের দুজনের আড্ডা আলাপ হয়ত আরো অনেকক্ষণ চলত কারণ মেয়েটা কথা বলতে পারে চমৎকার । অন্তত শ্রোতাকে মাতিয়ে রাখার মত যোগ্যতা তার আছে। কিন্তু তারপরেও মেয়েটা আচমকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ” ইহ্” বলে লাফ দিয়ে ওঠায় আমাকে বলতে হয়েছিল, ” কী হয়েছে ? ”
তখনই মেয়েটা আমাকে রীতিমত তাড়া দিয়ে বলেছে, ” তাড়াতাড়ি ওঠেন। এটা তো তাহাজ্জুদের সময়। আর আমরা কী না এখনও বিয়ের নামাজই পড়লাম না।”

-” বিয়ের নামাজ মানে..? ” এটা ছিল আমার বিস্মিত প্রশ্ন। শুনে মেয়েটা স্ট্যাচু হয়ে তাকিয়ে ছিল সেকেন্ড পাঁচেক। সম্ভবত আমার নির্বুদ্ধিতা ওকে ভাবিয়ে তুলেছে।

সে কপালে আলতো হাত ঠেকিয়ে বলেছে।
-” হায় আল্লাহ। বিয়ের নামাজ জানেন না?”

-” না জানা নিশ্চয়ই অপরাধ নয় ? ” বিরক্ত হয়েই জবাবটা দিয়েছিলাম। মেয়েটার সামনে এভাবে নাকাল হতে হবে ভাবিনি। কিন্তু মেয়েটা সত্যিই স্পষ্টভাষিনী।

বিনা দ্বিধায় বলে উঠল,
-” একজন মুসলিম হিসেবে অবশ্যই অপরাধ। একজন ভদ্রলোক হিসেবে যদি আপনি ওঠা বসা খাওয়া দাওয়া সমাজে চলাফেরার ম্যানার্স জানতে পারেন তাহলে জীবনের এত গুরুত্বপূর্ণ একটা নিয়ম জানবেন না, এটা তো ভাই হজম হবার মত কথা না। মুসলিম কাস্টম এটা। ” কথাটা শুনে চট করে রাগ উঠে গিয়েছিল আমার। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিলাম, ” নিজের চরকায় তেল দাও। আমার জানা না জানা নিয়ে মাতব্বরী ফলানোর জন্য তোমাকে আনা হয়নি। ‘ কথাটা বলেই বুঝতে পারছিলাম যে, একটু বেশী রুড হয়ে গেল কথাটা।

কিন্তু মেয়েটা রাগ করার বদলে উল্টো স্যরি হয়ে বলেছিল, ” দুঃখিত, আমি একটু বেশী কথা বলি তো , তাই ভুল হয় বেশী। আর বলব না। নিন, এবার অযু করে আসুন। আজ আপনি ইমামতি করবেন।’ বলে হেসে পরিবেশটা সহজ করে দিয়েছিল মেয়েটা।
আমিও কথা না বাড়িয়ে অযু করে নামাযে দাঁড়িয়ে গেছি। মেয়েটাকে দ্বিতীয় কথা বলার সুযোগ দেইনি। নইলে আরো কী বলে বসবে তার ঠিক কী। মুখ তো না, যেন মেশিনগান। বুলি ফুটছে তো ফুটছেই।

আমার নামাজ শেষ হলে মেয়েটা আক্ষেপ করে বলল, ” কী পড়লেন, কিছুই তো শুনলাম না। এরকম মনে মনে নামাজ পড়ে মানুষ ? নামাজ পড়তে হয় মধ্যম আওয়াজে।”
ওকে থামিয়ে রুডলি বলতে শুরু করলাম, ” তোমাকে যেটা বলতে চাচ্ছি সেটাই তো এখনও বলতে পারলাম না। সারারাত একাই বকবক করলে। এবার আমার কথা চুপ করে শোনো।”

আমার এই কথার জবাবে মেয়েটা কোমল স্বরে বলল, ” আপনি কী রাগ করলেন ?আমি খুবই স্যরি। আপনি রাগ করবেন জানলে এত কথা বলতাম না। এমনিতে আমি মানুষের মুড বুঝেই কথা বলি। বেহায়া বা বেয়াদব টাইপের মেয়েও নই। একটু দুষ্ট ছিলাম বলে আমার নানু বলত, হাজীর ঘরে পাজী হইসে। ছোটখাট দস্যিপনা ছাড়া আমার মধ্যে কোন দুই নম্বরি পাবেন না আপনি।”

-” আমি কী এবার আমার কথাটা বলতে পারি? ” বিরক্তি চেপে বলেছিলাম।

-” ওহ্, স্যরি বলেন। আসলে প্রতিমুহূর্তেই কিছু না কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে তো ! বলুন, কী বলবেন।” তারপরেই আমি নায়লার কথাটা ওকে বলেছিলাম। তবে আমার মত করে।

====

নায়লাকে দেখলাম হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়েছে। চমকে তাকালাম, ” কী হলো, উঠছ যে ? ”

-” তো কী করব ? তোমার সাথে বসে ঝিলের ঢেউ গুনব? ”

-” তুমি রাগ করছ কেন তাই তো বুঝলাম না। আমি তো তোমার কথা রুমকিকে বলেছি।”

-” কচু বলসো। এটা কী বলা হলো ?”

-” তো কী বলতাম তুমিই বল ? আমি অনেক দিক ভেবেচিন্তেই এভাবে বলেছি। কারণ সরাসরি আমার নাম দিয়ে বললে সে বাড়ীর সবাইকে জানিয়ে দেবে তারপর সোজা নিজের বড় বোনের বাড়ী চলে যাবে। ওর একটা বোন ঢাকায় থাকে তোমাকে তো আগেই বলেছি। ওর বাড়ীতে থেকেই পড়াশোনা করেছে সে। ওরা যে’ই ঢাকায় আসে সবাই ঐ বোনের বাড়ীতেই ওঠে। রুমকিও দেখা যাবে সোজা ওখানে গিয়ে উঠবে। তখন জিনিসটা কী বিশ্রী দাঁড়াবে একবার ভেবেছ? ”

-” তাহলে আর কী। রুমকিকে নিয়েই সংসার কর। আমার ব্যপারে তোমাকে ভাবতে হবে না। তোমার মত চিটার গন্ডারদের আমার খুব চেনা আছে।”

-” গন্ডার তো গৃহপালিত না। গন্ডার বললা কেন? ”

-” তোরে একটা লাত্থি মাইরা এখন ঝিলের মধ্যে ফালামু। ফাইজলামি করস আমার সাথে ? ” নায়লার টোন আর ল্যাঙ্গুয়েজ দুটোই বদলে গেল হঠাৎ করে ।
অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে। চেহারা দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। একসাথে পড়ার এই এক জ্বালা। তুইও বলা যায়, লাত্থিও মারা যায়। অথচ এই নায়লার একদিনের বলা তুই ডাকটা কত মধুর লাগত। আর আজ আমার কানে ঐ শব্দটাই যে কতটা বিসদৃশ ঠেকছে কাউকে বলে বোঝাতে পারব না। নায়লার কথাটা শোনার পরপরই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। সত্যি সত্যি কিক মেরে বসলে খামোকা কাপড় ভিজবে, যদিও মানসম্মান যাবার চান্স কম। কারণ ঝিলের এ পাশটায় লোকজন একেবারেই নেই বললেই চলে। তবে আশপাশের ফ্ল্যাট বাড়ী থেকে দেখে ফেলার ভয়টা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।

নায়লা দেখলাম সে এবার রুদ্রমুর্তি ধারণ করেছে। ভাষণ দেবার ভঙ্গিতে তর্জনী উঁচিয়ে বলতে শুরু করল ” শোন, তুই আজকেই বাসায় যায়া ঐ মাইয়ারে সব বলবি। ঐ সব বন্ধু ফন্ধুর ছদ্মবেশে না। সরাসরি নিজের কথা বলবি। তুই তারে বলছোস, আমার এক বন্ধু বাবা মায়ের চাপে বিয়ে করে ফেলসে কিন্তু বউরে সেটা বলতে পারতেসে না। ইসলামে এটার সমাধান কী ! এইটা কোন প্রশ্নের ধরণ হইল? মেয়েটা তো বলবেই যে, বিবাহ পূর্ব প্রেম হারাম। তো তুই জিগাইছোস কিল্লিগা এইটা আমারে ক। তোর লগে আমার চার বছরের প্রেম আর তুই চারদিনে ঐ মেয়ের টোনে আমারে বুঝাইতে আসছোস। আরে ঐ মাইয়া গাধা, নইলে ওর তো ধইরা ফেলা উচিত ছিল যে এটা তুই আর ঐ মাইয়াটা সে নিজে। কিন্তু ঐ খ্যাত আর কী বুঝবে। পড়সে তো গ্রামের পাঠশালায় না মাদ্রাসায় । আমার মত শহরে পড়াশোনা করলে তবু কাম আছিল। শোন্, আজকেই ওরে গিয়া আমার টোনে বলবি যে, তুই ওরে ভালবাসিস না। ওরে নিয়া সংসার করতে পারবি না। সে যেন এইটারেই তার খোঁয়াড় মনে না করে। গট দ্যাট অর আই উইল কাম ? ”

-” না, না। তোমার আসতে হবে না। আমিই ওকে বলব। সব বলব। সরাসরি আমার কথাই বলব।” তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম।

নায়লাকে এই মুহূর্তে দেখাচ্ছে আলিফ লায়লার মহিলা ঐ দৈত্যটার মত । অথচ এই নায়লাকেই আমার সবসময় অপ্সরী মনে হয়েছে। আসলে আমি কী মানুষটাই খারাপ, যার মন আর দৃষ্টি বারবার বদলে যায় ? নাকি এখানে অন্য কোন ব্যপার আছে !! নিজেকেই তো বুঝতে পারছি না। উফ্, এত অশান্তিতে জীবনে পড়িনি আমি।

=====

নায়লাকে ওর বাড়ীতে নামিয়ে দিয়ে সোজা রোহেনের কাছে চলে এলাম। রোহেন আমার ভাল বন্ধু। যাকে বলে জানের জান দোস্তি। চমৎকার সব পরামর্শ সব সময় ওর পেটে গিজগিজ করে। ওর কাছেই আজ পরামর্শ চাইতে এসেছি। কারণ আমার ব্রেনটা আজকাল সত্যিই ঠিকমত সার্ভিস দিচ্ছে না।

রোহেন আমার সবটা শুনল। শুনে গম্ভীর হয়ে বসে রইল পাক্কা দশ মিনিট। গম্ভীর মুখেই উঠে নিজ হাতে কফি বানাল। তারপর আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে মৃদু কেশে বলল, ” দস্যু বনহুর পড়েছিলি দোস্ত ?”

কফির কাপে চুমুক দিতে গিয়েও রয়ে গেলাম, ” হঠাৎ দস্যু বনহুর এর কথা কেন ? আমি তো তোর সাথে সাহিত্য নিয়ে গল্প করতে আসিনি। সমাধান চাইতে এসেছি যে আমি কী করব এখন ? ”

-” সেটাই তো দিতে যাচ্ছি। বল্ না, বনহুর পড়েছিস? ”

-” হম, পড়েছিলাম ।”

-” গুড। সেখানে দস্যু বনহুর দুজনকে বিয়ে করে। নুরী আর মনিরা। মনিরা থাকে শহরের বাড়ীতে আর নূরী থাকে বনহুরের জঙ্গলের ডেরায়। কিন্তু কী চমৎকার ভাবে সে দুজনকেই…!”

-” তুই কী আমার ফাইজলামি করতেছিস?”
রোহেনকে থামিয়ে দিয়ে থমথমে মুখে জিজ্ঞেস করলাম। হাতের কাপটা সামনের টি টেবিলের উপর রেখে রাগ দেখিয়ে বললাম, ” সিদ্ধান্ত দিতে না পারিস, এটলিস্ট পরামর্শ তো দিতে পারিস ? এসব ঠাট্টার কোন মানে হয় না। আমার জায়গায় একবার আয় তারপর দেখ কেমন লাগে ! ”

-” রাগ করিস না দোস্তো। তুই খালি আমারে একটা কথা বল, তুই রুমকিকে কথাটা বলতে ভয় পাচ্ছিস কেন? ”

-” সিম্পল। এটা শুনলে সে চলে যাবে তাই।”

-” তো সে গেলে তোর সমস্যা কী ! তোর তো ময়দান খালি।”

-” আরে বাবা, সহজ জিনিসটা বুঝিস না কেন। ও গেলে আমার বাবা, মা, আপান সবাই আমাকে পিরানহা মাছের মত কামড়ে ধরবে। তুই কী মনে করিস, ওরা আমাকে ছেড়ে দেবে ?”

-” হম, এটাও বুঝলাম। আচ্ছা, এমনিতে ক্রাশ ট্রাশ খাস নাই তো ? ”

-” আরে ধুর, ক্রাশ…!” বিরস ভঙ্গিতে বলে ফের চায়ের কাপটা হাতে নিলাম। চুমুক দেবার আগেই দেখলাম কফির ফোমের ওপর কর্তন দাঁতের উঁচু অংশটা ভাসছে। হাসছে রুমকি। মেয়েটা হাসার সময় চোখটা সামান্য কুঁচকে আসে আর দু পাশে মাছের লেজের মত ভাঁজ পড়ে যায়। ”

-” কী ভাবছিস, কফি ঠান্ডা হচ্ছে তো।” রোহানের কথায় ধ্যান ভাঙ্গল আমার। মাথাটা সত্যিই গেছে। ইস, গাড়ী, বাইক এসবের মত মাথাটাও যদি কোন গ্যারেজে সার্ভিসিং এর জন্য পাঠাতে পারতাম। কতই না ভাল হতো।
মাথা ঝাঁকিয়ে ফের কফির কাপে তাকালাম। এখনও কর্তন দাঁত ভাসছে। ধুউর। চোখ বন্ধ করে কফির ফোমে ভেসে থাকা হাসিটুকু এক টানে গিলে ফেললাম।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here