এক_প্রহরের_খেলা ২

#এক_প্রহরের_খেলা ২
মোর্শেদা হোসেন রুবি
——————————
||

সৌজন্য সাক্ষাৎ পর্ব শেষ করেছি কিছুক্ষণ হয়। শ্বশুর মহাশয় যাবার আগে পুনরায় আমার হাত ধরে কেঁদে ফেলেছেন। বক্তব্য সেই একই। আমার মেয়েটা বড় অভিমানী বাবা। ওর অভিমান চট করে ভাঙানো যায় না। কিন্তু এটুকু ছাড়া আমার রুমকি অসাধারণ একটা মেয়ে। ওর মত মেয়ে তুমি সারা ঝিনেদাতে খুঁজে পাবে না…ইত্যাদী । আমাকেও দাঁত চেপে তার মেয়ের প্রশংসা গিলতে হয়েছে। তারপরেও ভদ্রতা করেই তাকে বিদায় দিয়েছি। এখন শুধু ঘর খালি হবার অপেক্ষা । মনে মনে ভাবছি কখন আমার মা’কে একটু একা পাব আর আমার মনের যত রাগ উগরে দিতে পারব। এমনিতেই গতপরশূ থেকেই আমার ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। এরকম ফলস পজিশনে পড়ব জানলে আমি ঝিনাইদহই যেতাম না। তাছাড়া আপানের অসুস্থতা আজকের নতুন নয়। প্রথমত তিনি বুড়ো মানুষ, তার উপর ক্রনিক এ্যাজমার রুগী। ওনার যখন বাড়াবাড়ি হয় তখন তাকে নিয়ে একরকম যমে মানুষে টানাটানি টাইপ অবস্থা হয়ে দাঁড়ায়। এর আগেও হয়েছিল। তবে এটা সত্যি সেদিনেরটা বাড়াবাড়ি ছিল। আমি নিজেই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আপানকে দেখে। কারণ আপানের শ্বাস যে উপরের দিকে আটকেছে আর নামার নামই নেই। কোনভাবেই তাকে স্বাভাবিক করা যাচ্ছিল না। সেই মুহূর্তটার কথা আমার এখনও মনে আছে। ঐ অবস্থার মধ্যেও আপান বারবার আমাকে হাতড়াচ্ছিলেন। কারণটা সবার জানা। আমি আপানের হৃদয়ের পুরোটাই বলতে গেলে। আমার শৈশব কৈশোর কেটেছে আপানের কোলে। পরে আমরা ঢাকা স্থায়ী হলেও আপান তার স্বামীর ভিটা ছাড়তে রাজী হননি। ফলে ঝিনাইদহ আসাযাওয়া ছিল সাপ্তাহিক রুটিন।
শেষ যেদিন আমি ঝিনাইদহে গিয়েছি সেদিনও যদি জানতাম আমাকে ঘিরে আপানের মনে রঙীন স্বপ্নের জাল বোনা চলছে। তাহলে অবশ্যই আপানকে জড়িয়ে ধরে বুঝিয়ে বলতাম নায়লার কথা আর তার সযত্নে তার জাল থেকে রুমকি নামের সুতোটা বের করে দিয়ে নায়লা নামের সুতাটা জড়িয়ে দিয়ে বলতাম, নাও এবার বোনো যতখুশি। কিন্তু তা হয়নি। বরং আমার বোঝাবুঝির আগেই আপানের স্বপ্ন জাল বোনা শেষ হয়ে গিয়েছিল । তিনি তখন ঐ জাল দিয়ে শুধু আমাকে বাঁধার অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু সিস্টেমেটিক ওয়েতে বাঁধতে যাবার আগেই তার হঠাৎ অসুস্থতা পুরো পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। নইলে আমার মতামত জানতে চাইবার সময়ও আমি কিছু একটা বলতে পারতাম হয়ত। কিন্তু এখন তো সেই সুযোগটাও পাওয়া হলো না আমার। এক ঘন্টার নোটিশে একটা অজানা অচেনা মেয়ের হাত আমার হাতে ধরিয়ে দেয়া হল। আর আমি আপানের স্বপ্নজাল ছিঁড়তে না পেরে নায়লার স্বপ্ন জাল ছিন্নভিন্ন করে দিলাম। কত পাষন্ড আমি। রাগে দুঃখে সব ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে হলো আমার।

একটু পরেই ঘর খালি হলো। বাকি অতিথিরা সরে যেতেই আম্মু হুট করে আমার হাত চেপে ধরলেন। আমাকে কিছু বলার বা করব করার কোন সুযোগ না দিয়ে আবেগাক্রান্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ” তুই যা করে দেখিয়েছিস। তা আমি কোনদিন ভুলতে পারব না ঋভূ। আসলে এতটাও ভাবতে পারিনি রে। এমনকি তোর আপান যখন আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলছিল, ” আমার ঋভূরে বলসিলা কথাটা ? ” তখনও আমি তাঁকে বলার চেষ্টা করেছিলাম যে, তুই এ যুগের ছেলে। তোর সাথে আগে কথা না বলে এভাবে বিয়েটা পড়িয়ে দেয়াটা হয়ত ঠিক হবে না। কিন্তু তোর আপানের ফুল কনফিডেন্ট। তিনি বললেন, ” আমার ঋভূরে আমি হাড়েমাংসে চিনি। তুমি আমার কথা বলো আর কাজিরে খবর দাও। আমাদের বংশের ছেলে সে। মুরুব্বী মানতে জানে। তার এ কথার পর আমি আর কোন কথা বলতে পারিনি রে। তারপর যা হলো তা তো নিজেই….!”

-” আমি নায়লাকে ভালবাসি মা।” রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠলাম এবার। এতক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে শুধু আম্মুর কথাগুলো শুনে গেছি। তার কথার পিঠে কোন কথা বলতে পারিনি। এই মুহূর্তে সুযোগ পেয়ে এক সেকেন্ডও দেরী না করে কথাটা বলে দিলাম। আর বলতে পেরে অপার তৃপ্তি অনুভব করছি। বুকের ভেতর চেপে রাখা দমটা যেটা কুন্ডুলী পাকিয়ে গলার কাছে আটকে ছিল সেটাও মুহূর্তেই উধাও। মনটা কিছুটা হলেও ভারমুক্ত লাগছে। আসল কথা বলা হয়ে গেছে। এবার চলবে উপকথা। মূল কথাকে স্ট্যাবলিশ করতে যেগুলো লাগে। মোটকথা, আমি নায়লাকে ভালবাসি এই কথার ভাবসম্প্রসারণের কাজ চলবে এখন। তবে মূলকথা হজমে সম্ভবত বেশীই সমস্যা হচ্ছে আম্মার। কারণ তাঁকে দেখাচ্ছে বাজপড়া মানুষের মত।

প্রাথমিক ধাক্কাটা সয়ে নিয়ে বিস্মিত আম্মু বললেন, ” নায়লা মানে ? নায়লা কে ? ”

-” নায়লা আমার ক্লাসমেট। আমরা একসাথে হায়দারে অডিট করেছি। বাইরে ট্যুরে গেছি। নায়লার সাথে আমি কমিটেড। তোমরা আমাকে জোর করে বিয়ে করিয়ে দিয়েছ এক হুজুরনীর সাথে। আমি এই বিয়ে মানি না।”

-” আস্তে কথা বলো ঋভূ। তোমার বাপি শুনলে ব্যপারটা খারাপ হয়ে যাবে। আব্দুল্লা ভাই তোমার বাবার জানের জান বন্ধু। শুধু বন্ধুই না, তিনি তোমার বাপির বিপদের সাথী। তাছাড়া তোমাকে তো পিস্তল ঠেকিয়ে সই করতে বলা হয়নি। তুমি স্বেচ্ছায় সই করেছ। ”

-” পিস্তলই ঠেকিয়েছ। ” এবার তেতে উঠলাম আমি।” আপানের দোহাই দেয়া আমার জন্যে পিস্তলের চেয়ে কম না। বাপি বলেছে , আমার মা তোর কাছে আজ কিছু চাইছে ঋভূ। তাকে ফিরিয়ে দিস না। সেকারণেই বাধ্য হয়ে আমাকে….!”

-” একটা নিরপরাধ মেয়ের জীবন নষ্ট করতে হয়েছে। তাই না…?” আমার কথা শেষ হবার আগেই আম্মু আমার কথা কেটে নিজের বাকী অংশ জুড়ে দিলেন। আমি এবার সামান্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। আম্মু যে এভাবে প্রশ্নটা করে বসবেন বুঝিনি। তাৎক্ষণিক ভাবে কোন কথা যোগাল না আমার মুখে।

আম্মু বলে উঠলেন, ” বিয়ে কোন ছেলেখেলা নয় বাবা। যে মন চাইলেই বিয়ে করে নিলাম তারপর মন চাইলেই ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। এটা বিয়ের উদ্দেশ্য নয়। তারচে তুমি তখনই সরাসরি মানা করে দিতে। সেটাই তো ভাল ছিল। এখন এসব কথার কোন অর্থ নেই। রুমকী তোমার ভাগ্য আর তুমি তোমার ভাগ্যের কাছে পৌঁছে গেছ, ব্যস।”

-” না, আম্মু। ব্যস না। ঐ মেয়েকে আমি কখনোই নায়লার জায়গা দিতে পারব না। নেভার এভার। ”

-” তাহলে কী করবে শুনি ? ”

-” আই উইল ডিভোর্স হার। ” মৃদু শব্দে কথাটা বলে একটু থামলাম। আম্মু নির্বাক হয়ে গেছেন।
আমি স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বললাম, ” এখন না হলেও যে কোন সময়। কিন্তু আমাকে দমাতে পারবে না তোমরা। যদি বাবাকে দিয়ে ভেজাল লাগানোর চেষ্টা কর তো শুনে রাখ। সোজা বাড়ী ছাড়ব আমি। থাকব না এখানে। ” বলেই হন হন করে দোতলায় চলে এলাম।

===

নিজের রুমে ঢুকতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালাম। একবার ভাবছি ভেতরে যাব না। পাশের রুমে চলে যাব। ঐ রুমটা প্রীতির। ওর রুমে গিয়ে ওকে অনায়াসেই এই রুমে পাঠিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু তাতে কোন লাভ হবে না। উল্টো আমারই দেরী হয়ে যাবে। মেয়েটাকে নায়লার কথাটা বলা হবেনা। জিনিসটা আরো পিছাবে। তারচেয়ে যত দ্রুত সম্ভব ওকে বলে ক্লিয়ার হয়ে যাওয়াই ভাল। নইলে মেয়েটা আমাকে পতি পরমেশ্বর বানিয়ে ভজন গাইতে শুরু করে দিলে আরেক বিপদ হবে। যা বলার এখনি বলতে হবে। মত বদলে ফেললাম। ঘরেই যাব।
হালকা খাকারী দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলাম। আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেখে রিয়া আর প্রীতি উঠে দাঁড়াল। ওরা এতক্ষণ সম্ভবত গল্প করছিল ঐ মেয়েটার সাথে। আমাকে দেখে বেরিয়ে যাবার উদ্যোগ নিল দুজনেই। প্রীতিকে দেখলাম পাশ কাটানোর সময় অর্থপূর্ণ একটা হাসি দিল আমাকে উদ্দেশ্য করে। দেখে গা টা জ্বলে গেল আমার। ইচ্ছে হচ্ছিল এক থাপ্পড়ে প্রীতির দাঁতগুলা ফেলে দেই আর রিয়াকেও কঠিন ভাবে ধমকে দেই। এত ফচকে হয়েছে আজকালকার মেয়েগুলো যে বলার নয়। কিন্তু নতুন মেয়েটার জন্য পারলাম না। হাজার হোক, আমার নিজেরও তো একটা ইমেজ আছে। সেটাকে আঁকড়ে ধরে রাখতেই হচ্ছে বাধ্য হয়ে। আপাতত আচরণে একটা গুরুগম্ভীর ভাব না আনলে হবে না। মেয়েটাকে বোঝানো দরকার যে আসলে আমি কতটা সিরিয়াস।

আবারও মৃদু কেশে ভেতরে গিয়ে বসলাম। তবে দরজা লাগালাম না। অবশ্য এমনিতেও দোতলায় আমি আর প্রীতি ছাড়া আর কেউ থাকে না। গেস্টরুম যেটা আছে সেটা বেশীরভাগ সময়ই খালি পড়ে থাকে। গ্রাম থেকে চাচু ফুপ্পীরা বেড়াতে এলে তখন কাজে ওটা। নইলে তালাবদ্ধ থাকে সারামাস । আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে মেয়েটা সচেতন হল। শাড়ী কাপড় গুছিয়ে বসছে। ওর দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছি সে আমাকে এখানে অনড় বসে থাকতে দেখে সামান্য উসখুস করছে। হয়ত সে আশা করছে আমি তার পাশে গিয়ে বসব আর বাংলা সিনেমার ডায়ালগ দিতে শুরু করব। ছ্যাহ্। মনে মনে এবার প্রস্তুত হলাম আমার কথাগুলো বলার জন্য। পরক্ষনেই মনে হল গেটটা লাগিয়ে কথাগুলো বলা উচিত। বলা তো যায় না, রিয়া আর প্রীতি যদি আড়িপাতার চেষ্টা করে তবে ব্যপারটা বিশ্রী হবে। সোজা বাপির কানেও চলে যেতে পারে কথাটা। আমি চাইনা, যে জটিলতা এড়াতে বিয়ের ঢেঁকিটা আমাকে সবার অনুরোধে গিলতে হয়েছে, সেই জটিলতা আমার কোন ভুলেই তৈরী হোক। তাহলে আর বিয়ে করা কেন ! তাছাড়া বাপি জানা মানেই আপানের কাছে খবর পৌঁছে যাওয়া। সেটা হতে দেয়া যাবেনা। বরং এমন সিস্টেম করতে হবে যেন মেয়েটা নিজেই এর গুরুত্ব বুঝতে পারে। আর নিজেকে সামলে চলে কারণ এটা নায়লার জায়গা। কিছু মানুষ গায়ের জোরে তাকে এখানে বসিয়ে দিয়েছে। এটা তার প্রাপ্য নয়। আর এটা মেনে নিয়েই তাকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়াতে হবে।

সালামের শব্দে চমকে তাকালাম। মেয়েটা কখন আমার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে টেরই পাইনি। আসলে নিজের ভাবনায় এতটাই বিভোর ছিলাম যে বাকি সব গুলে খেয়েছি। দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে সালামের জবাব দিয়ে বললাম, ” কী নাম তোমার ? স্যরি, তুমি করে বলছি।” দায়সারা গোছের করেই বললাম কথাটা। আলাপ তো শুরু করতে হবে। নইলে নাম তো জানিই। তাছাড়া তুমি বলার জন্য আবার স্যরির কী আছে। তবু একটা সাধারন ভদ্রতা থেকেই বলা।
মেয়েটা মিহি কণ্ঠে বলল, ” জি, আমার নাম রুমকি। আপনাকে একটা কথা বলতে চাই যদি অনুমতি দেন।” কিছুটা অনুনয়ের সুর মেয়েটার কণ্ঠে। মাথা নেড়ে অনুমতি দিলাম। যদিও আমারই অনেক কথা বলার আছে। তবু এরটাই আগে শুনি। মেয়েটার দিকে তাকালাম না। হাতের মোবাইলটাকেই খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করলাম। নায়লার মেসেজগুলো ভাসছে। তুমি একটা অমানুষ। হিপোক্রেট। তুমি যদি….!”

-” আসলে এভাবে বিয়ের জন্য আমি একদম প্রস্তুত ছিলাম না। ” পাশ থেকে বলা কথাটা শুনে ঘাড় ফেরাতে বাধ্য হলাম তবে জবাব দিলাম না। মেয়েটাকে বলার সুযোগ দেয়াটাই উদ্দেশ্য।
” গতকাল আমার সেকেন্ড ইয়ারের শেষ পরীক্ষা ছিল। ভেবেছিলাম পরীক্ষা দিয়ে এসে রেস্ট করব। দুদিন নানুর বাড়ীতে বেড়াব। কিন্তু আম্মু হঠাৎ করেই….!” বলেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল মেয়েটা। কিছুটা হতচকিত হয়ে গেলাম দুটো কারণে। প্রথমত মেয়েটাকেও একরকম হুট করেই কবুল বলিয়ে দেয়া হয়েছে। তার মানে দুজন একই রোগের রুগী। আর দ্বিতীয়ত মেয়েটা বলল তার সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষা ছিল। কিসের সেকেন্ড ইয়ার ? মাওলানা ? ভাবতে চেষ্টা করলাম। মেয়েটার ফোঁপানি দেখে সান্তনা দেবার ভঙ্গিতে বললাম,

-” আরে আরে, কাঁদছ কেন। আমার নিজের ব্যপারও তো এমনই। খুব আহ্লাদ করে যে বিয়ে করেছি এমন তো না। রীতিমত জোর করে….!” মেয়েটার বিস্ফোরিত চোখের দৃষ্টি দেখে দ্রুত নিজেকে সামলে নিলাম। নাহ্, এভাবে উইদাউট প্রিপারেশন সব কথা গড়গড় করে বলে দেয়া ঠিক হচ্ছে না। বোকার মত হয়ে যেত কাজটা। ওর কান্না করার আছে ও করুক। আমি সমর্থন যুগিয়ে যাব তারপর ধীরে ধীরে নিজেরটা বলব। আগেভাগে বলেই ফাঁসতে চাইনা। বলা তো যায়না, এমনও হতে পারে। আমার কিছু বলার দরকার পড়ল না। মেয়েটার সমস্যাকেই নিজের সমস্যা বানিয়ে ভেজাল মিটিয়ে ফেলতে পারলাম। নাহ্, কৌশলি আর মিতভাষী হতে হবে। শুনব পাঁচটা বলব একটা। হা হা হা হুু হু। মনের আনন্দে একচোট হেসে নিলাম আরকি।

-” আপনি তো ছেলে মানুষ, মানে পুরুষ মানুষ। আপনাকেও জোর করে বিয়ে দিল ওরা ? আহারে…! ” মেয়েটা যারপরনাই বিস্ময় নিয়ে কথাটা বলতেই সামান্য আঁতে লাগার মত অনুভূতি হল। খুক খুক করে কেশে নিয়ে বললাম।

-” ব্যপারটা এরকম না। আমার আপান খুব অসুস্থ। তাঁর কারণেই অমন হুট সিদ্ধান্ত। নিজের কথা বলার সময় বা সুযোগ পাইনি। সেটাই বলতে চেয়েছি। বাই দা ওয়ে, তোমার কী পরীক্ষা ছিল ? আসলে আমি মাদ্রাসার সাবজেক্টগুলো তেমন বুঝিনা। এদের ডিগ্রী ফিগ্রীগুলাও….!”

-” ডিগ্রী তো বুঝি। ফিগ্রী কোনটা ? ” মেয়েটার মুখ থমথমে দেখাচ্ছে। আর আপনাকে কে বলেছে যে আমি মাদ্রাসায় পড়ি ? ”

সন্তর্পনে ঢোক গিললাম। আরেকটা ধরা খেয়েছি। আসলে আমার ব্রেনটাই আজ ঠিকমত সার্ভিস দিচ্ছে না। বোকার মত প্রশ্ন না করে অপেক্ষা করা উচিত ছিল আমার। কেন যে বকবক করছি আল্লাহই মালুম। মেয়েটা তার বাম ভ্রূ সামান্য তুলে বলল,
-” আমি হোম ইকনমিক্স কলেজে পড়ি। সামনের বছর এইচ এস সি দেব। আমার টেস্ট পরীক্ষা ছিল গত পরশু।”
-” ওহ্, স্যরি। আসলে তোমাকে বোরকায় দেখে….মানে তোমাদের পুরো পরিবারকে বোরকায় দেখে।”
-” কেন, বোরকা কী শুধু মাদ্রাসার মেয়েরাই পড়ে ? কলেজ ভার্সিটির মেয়েরা পড়ে না ? বাকী মেয়েদের কী অধিকার নেই বোরকা পড়ার ? ”
-” অধিকারের প্রশ্ন আসছে কেন ? এটা তো কমন সিমটম যে যারা মাদ্রাসায় পড়ে তারা ভুতু…মানে বোরকা পড়ে। ”
-” আর যেসব ছেলেরা দাড়ী রাখে পাঞ্জাবী বা জুব্বা পড়ে তারা মাদ্রাসায় পড়ে, তাই তো ? এটাই জানতেন এতদিন? “মেয়েটার মুখে এখন হাসির সাথে কিছুটা কৌতুকও খেলা করছে। তারমানে সে আমাকে গবেট ধরে নিয়েই হাসছে। রাগে মুখটা গরম হয়ে উঠল। বুঝতে পারছি, মেয়েটাকে আলাভোলা ভেবে আরেকবার ভুল করে ফেলেছি। বেশ ভালোই চাল্লু দেখা যায়।

হালকা কেশে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললাম, ” ঠিক এরকম না। যাই হোক্, তোমাকে যেটা বলতে চাচ্ছি সেটা একটু মন দিয়ে শোনো…!”
-” জি, শুনব। অবশ্যই শুনব। তার আগে একটা অনুরোধ থাকবে আপনার প্রতি।”
-” কী ? ”
-” আমার বাবা হয়ত সকালে ফোন দেবে আপনাকে। আমার সম্পর্কে জানতে চাইবে। আমি কান্নাকাটি করেছি কি না, আপনার সাথে সব ঠিকঠাক আছে কিনা এসব জানতে চেয়ে বাবা ফোন দিতে পারে। আমি চাইনা আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি বাবার কানে যাক। উনি তাতে প্রচন্ড কষ্ট পাবেন।”

-” কষ্ট পাবেন কেন ? ” করব না ভেবেও প্রশ্নটা করে বসলাম। কারণ আমার কৌতুহল বাড়ছে। এই মেয়েও তো স্বেচ্ছায় বিয়েটা করেনি। সেকারণেই কী ? বললাম,
” বিয়েটা কি তাহলে তোমার অমতে হয়েছে ? ”

-” না, না। ঠিক অমতে না। মানে আমি একজন দ্বীন জানা শিক্ষিত ছেলে চেয়েছিলাম। কিন্তু মেজভাবি যখন বলল, পাত্র দাঁড়িওয়ালা হলে কী হবে দ্বীন জানে না। বাম হাতে পানি খায়। আবার স্বভাবও তেলতেলে ফুলবাবুদের মত। এটা শুনে মনটা এত খারাপ হয়েছিল যে বলার নয়। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছিল।”

“আমি তেলতেলে ফুলবাবু?” নিজেকেই প্রশ্ন করলাম। আপনা হতেই চোখ চলে গেল দেয়ালের সাঁটানো তিন ফুট বাই আট ফুট আয়নার দিকে। কোন দিক বিচারে ঐ মহিলা আমাকে তেলতেলে ফুলবাবু মিন করেছে জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। কৌশলে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলাম। গলায় গাম্ভীর্য এনে বললাম,” ওনার এরকমটা বলার কারণ ? ” আনমনেই গালে হাত বুলালাম। চমৎকার এক গাল দাঁড়ি থাকার পরেও আমাকে তেলতেলে ফুলবাবু বলার রহস্যটা জানতেই হবে।

-” না, আপনি আসলে খুব টিপটপ তো….!” বলতে বলতেই লজ্জায় নুয়ে পড়ল মেয়েটা। আমি কিছু বলতে যাবার আগেই বলল, “এটা আসলে দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যপার। ভাবি জানে, আমার পছন্দ আরাফাতের মত আউট এন্ড আউট একজন দ্বীনদার। যার আপাদমস্তক একজন আল্লাহভীরু পুরুষের কথা মনে করিয়ে দেয়। ”

-” আরাফাত কে ? ”

-” ওমা, আপনি বই পড়েন না ? আরাফাত হচ্ছে বৈরীপ্রিয়া উপন্যাসের নায়ক। টপ টু বটম একজন পাক্কা পুরুষমানুষ।”

-” কাঁচা পুরুষমানুষ কোনগুলা? ” কৌতুহল বাড়ছে আমার। এই মেয়ে গল্প উপন্যাসও পড়ে!

-” এই যে, পুরুষ হবার পরও মেয়েদের মত চিঁ চিঁ করা। আমার এটা একদম পছন্দ না। মেজভাবি বলছিল, ভাইয়ার হাতের ধাক্কায় আপনার হাতের গ্লাস ছলকে নাকি কিছুটা কোক আপনার প্যান্টে পড়ে গিয়েছিল আর আপনি লাফ দিয়ে উঠে প্যান্টে টিস্যু ঘসছিলেন বিরক্তি নিয়ে। পড়ে আপনাকে পানি দিয়ে ওয়াশ করতে বললে আপনি টিস্যু ভিজিয়ে মুছে নিয়েছেন কারণ ধুতে গেলে প্যান্টের আয়রন নষ্ট হয়ে যাবে। আবার রুমালে বার বার ঘাম আর নাক মুছছিলেন। গ্লাসটাও টিস্যু দিয়ে পেঁচিয়ে ধরেছিলেন। ”

-” তো ? এতে তেলতেলামির কী হল ? ”

-” আরাফাত হলে এটা করত না। সে তো শার্ট দিয়ে ঘাম মুছে। সে কাদামাটি গায়ে মেখে কাজ করে। সময় মত অযু করে নামাজ পড়ে। আরো কত কী করে। আসলে এসব গল্প উপন্যাসেই হয়। বাস্তবে কোন আরাফাত আসলে নেই। ” বলতে গিয়ে আবারও মনমরা হল মেয়েটা।

আমি এবার ওর সমস্যা কিছুটা ধরতে পারলাম। মেয়েটা সম্ভবত ফ্যান্টাসীতে ভোগে। এজন্যই উপন্যাসের নায়ককে বাস্তবে খোঁজে। নইলে এসব আজগুবি ধারণা জন্মাবে কেনা। আমি কিছু বলার আগেই সে মন খারাপ করে বলে বসল, ” আমার যে বয় ফ্রেন্ডটা ছিল। ও খুব রাফ এন টাফ ছিল। ম্যানলি হিরো টাইপ। কিন্তু আরাফাতের মত দ্বীন জানা ছিল না।”

-” কীহ্…?” চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এই মেয়েরও বয়ফ্রেন্ড ছিল? জায়গাতে বসেই আছাড় খেলাম একটা। শরীরটা বেশ হালকা মনে হল আমার। আহা, কী আনন্দ আকাশে বাতাসে। আমি এখন মহান সেজে ওকে ওর বয়ফ্রেন্ডের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারব। হাম দিল দে চুকে সানামের অজয় দেবগানের মত। বাবার কাছে যেয়ে অজয়ের মত ফ্যাঁসফেসে গলায় বলব , ” পিতাজী, ক্যায় অওরাতকো জাবারদাস্তী বান্ধ কারকে রাখনা হি মারদাঙ্গী হ্যায় ? তারপর মেয়েটাকে নিয়ে ওর বয়ফ্রেন্ডের হাতে তুলে দিয়ে আসব। আর আমার নায়লা পরীকে ঘরে নিয়ে আসব। আহা, কী দারুণ। সব একেবারে গোছানো। অযথাই এতক্ষণ ধরে ভেবে মরছি।

আমি যখন আকাশে ভাসছি তখনই মেয়েটার পরের কথাটা আমাকে আছড়ে টেনে মাটিতে ফেলল।
সে মৃদু স্বরে বলল, ” বিবাহ পূর্ব প্রেম হারাম। কঠিন গুনাহ। এটা এক ধরণের জেনা। আর আমি এটা জানতাম না। জানার পরই ব্রেকাপ করেছি। অনেক কষ্ট হয়েছে। তবু করেছি। ছেলেটার পিছু ছাড়াতে অনেক কষ্ট হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বোরকায় নিজেকে ঢেকেছি যেন কলেজে যাবার পথে সে আমাকে খুঁজে না পায়। সে প্রথম কয়েক মাস আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজেছে। আমার বান্ধবীদের কাছে জিজ্ঞেস করেছে আমার কথা। তারপর আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে রাগ করে চাকরী নিয়ে চট্টগ্রাম চলে গেছে।”
স্তব্ধ হয়ে শুনছিলাম কথাগুলো। মুখ দিয়ে কোন কথা সরছিল না। খানিক নিরব থেকে বললাম,
-” তোমার তখন বিয়ে ঠিক হয়েছিল? ”

-” ওমা, আপনার সাথেই তো। কেন, আপনি জানতেন না? আমি তো অনেক আগে থেকে জানি যে আপনার সাথে আমার বিয়ে হবে। কিন্তু গত পরশুই হবে এটা জানতাম না। ”

-” ওহ, তা এই কথাটা ছেলেটাকে জানিয়ে দিলে ? ”

-” জি। ”

” কেন ? ছেলেটাকে বিয়ে করলে কী সমস্যা ছিল ? ইসলাম কী পছন্দের মানুষকে বিয়ে করতে নিষেধ করে ? ”

-” একটু বসি ? পা’ টা ব্যথা করছে।” মেয়েটা কাতর স্বরে বললে আমি সচেতন হলাম। সত্যিই তো, এতক্ষণ ধরে মেয়েটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা বলছে। ওকে খাট ইশারা করে বললাম।

” হ্যা, বসো। বসে বলো।”

-” আসলে ওর মধ্যে কিছু বাজে ব্যপার ছিল যেটা আমার পছন্দ না। যেমন, প্রেম করত আমার সাথে কিন্তু আমার বান্ধবীদের সাথেও তার ভাব। ঠাট্টা মশকরা তার মজ্জাগত। ছেলেদের এই স্বভাবটা আমার রাগ লাগে। কেন তারা অনেষ্ট থাকতে পারেনা। তাদের সব সময়ই কেন দু তিনজন করে লাগে ! এদের এথিসক বলে কিছু নাই।”

আমাকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেয়েটা দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ” স্যরি, আপনাকে মিন করছিনা। সবাই এক রকম না। আপনার ব্যপারে এত ভাল ভাল কথা শুনেছি যে আর মানা করতে পারিনি।” হালকা লাজুক হেসে মুখ নামিয়ে নিল মেয়েটা।

-” কী কী ভাল শুনেছ শুনি ? মানে আমার তো তেমন ভাল গুণ আছে বলে জানি না।”

-” ওহ্, নিজের প্রশংসা শুনতে চাচ্ছেন ? “হাসল মেয়েটা। আর তখনই খেয়াল করলাম মেয়েটা হাসলে ওর কর্তন দাঁতের উপর আরেকটা দাঁত উঁচু হয়ে থাকায় দেখতে বেশ লাগে।

মেয়েটা মুখ নামিয়ে বলতে লাগল, ” আপনি মোটেও অহংকারী নন। প্রতিবছর নিজে এসে গ্রামের দরিদ্রদের ঘরে যাকাতের মাল পৌঁছে দিয়ে আসেন। সবার সাথে হেসে কথা বলেন। মানুষের উপকার করেন…এসব।” আমি এবার পুরোপুরি অফ হয়ে গেলাম।
মেয়েটা হঠাৎ একটা কথা বলে উঠলে আমার মুখে তালা পড়ে গেল।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here